ট্রেনে আসন সংখ্যা কম : ছাদে ও বগিতে গাদাগাদি ভ্রমণ, ভোগান্তি চরমে

আগের সংবাদ

জ্বালানি সাশ্রয়ে কৃচ্ছ্রতার কৌশল

পরের সংবাদ

ঈদযাত্রা, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট ও কৃচ্ছ্রসাধন

প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঈদুল আজহা উদযাপনের জন্য নেত্রকোনায় গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। মূল শহর থেকে বড়জোর তিন কিলোমিটার দূরে, পাঁচকাহনিয়া গ্রামে আমাদের বাড়ি। ঈদের আগে ঢাকা থেকে বেরিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছা সহজ হবে না, এটি পূর্ব থেকেই জানা। অনেক বছর ধরে এ পথে বিআরটি নামক মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান। কাজ যেন আর শেষ হওয়ার নয়। নির্মাণযজ্ঞের বাধা উৎরে স্বাভাবিক সময়েই যেখানে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়, সেখানে ঈদের সময় কী দশা হবে তা তো জানাই ছিল। ১০ ঘণ্টা সময় ময়মনসিংহ পৌঁছতেই লেগে যায়, তারপর অবশ্য নেত্রকোনা শহর পর্যন্ত যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। গোল বাধে নেত্রকোনা শহর থেকে অনতিদূরে বাড়িতে পৌঁছানো। মালনি রোডের মগরা নদীর পাড় ঘেঁষে নেত্রকোনা-আটপাড়া রোড ধরে বাড়ি যেতে হয়। পথে অবস্থান বর্তমান সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর বয়লার বা চালকল ও কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বকবিতার সংগ্রহশালা ‘কবিতাকুঞ্জ’। কবি ক্রমাগত তার প্রতিষ্ঠানটিকে সমৃদ্ধ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে চলেছেন, এবং আশা করছেন সারাদেশ, এমনকি সারা বিশ্বের কবিতাপ্রেমীরা এখানে আসা-যাওয়া করবেন, কবিতায় নিমগ্ন হবেন। কবিতা-পিপাসুদের সীমিত পরিসরে রাতযাপনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে কবিতাকুঞ্জে। কিন্তু রাস্তার যা হাল তাতে কবির আশা পূরণ হবে না, একবার গেলে দ্বিতীয়বার কেউ সেখানে যাবেন না। এমন খানা-খন্দপূর্ণ রাস্তা বাংলাদেশে আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। রাস্তার পৌরসভার অংশটিই বেহাল বেশি, বলা যায় চলাচলের অনুপযোগী। এর কোনো অভিভাবক আছে বলে বোধ হয় না। রাস্তাটি খুবই অপ্রশস্ত। প্রতি মুহূর্তে গাড়ি উল্টে যাওয়ার ভয় নিয়ে এই সামান্য তিন কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে বাড়ি পৌঁছে হাফ ছেড়ে বাঁচি। শুনেছি, নেত্রকোনা-কেন্দুয়া-কিশোরগঞ্জের রাস্তারও একই হাল, খানা-খন্দে পূর্ণ। ওই পথে যারা চলাচল করেন তাদের দুর্ভোগ চরমে। নেত্রকোনা শহরের পরিস্থিতিও ভালো নয়, পথঘাট সংকীর্ণ ও অপ্রতুল। মোটা দাগে জেলা সদরসহ গোটা জেলাই অনগ্রসর, উন্নয়নবঞ্চিত। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বৈতরণী পারে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এখানকার মানুষ, কিন্তু উন্নয়নের হিস্যায় তারা সবসময় পিছিয়ে।
তবে জেলার গৌরব কিছুটা বাড়তে চলেছে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জায়গা নেয়া হয়েছে ৫০০ একর। জমিটা নিচু প্রকৃতির হলেও এতে ধান হতো প্রচুর। কয়েক হাজার মণ ধানের আবাদ আর হবে না ভাবতে কিছুটা কষ্ট লাগে। মেডিকেল কলেজের জন্যও জায়গার সংস্থান করতে হবে, তাতেও হয়তো লয়প্রাপ্ত হবে আবাদি জমি, কিংবা জলাশয়। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখার জন্য আবাদি জমি যতটা সম্ভব কম ক্ষয় করা দরকার। যে কোনো প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে এই চিন্তাটি সর্বাগ্রে মাথায় রাখা প্রয়োজন।

দুই.
এই মুহূর্তে দেশের মানুষ দ্রব্যমূল্যজনিত সমস্যায় জর্জরিত। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক পর্যায়ে। কোভিডের পর রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ এই সংকটের উদ্গাতা। মানুষের আয় যেহেতু বাড়ছে না, সেহেতু সরকারের ওপর দায়িত্ব বর্তেছে মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার। সামর্থ্যরে অভাবে সরকারের পক্ষে পর্যাপ্ত সহায়তা দেয়া সম্ভব নয়, এ কথা মানুষ জানে। তবুও তারা আশা করে সরকার যতটা সম্ভব পাশে থাকবে, নতুন করে চাপ তৈরি হবে না তাদের ওপর। কিন্তু চাপ তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিয়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাসের মূল্যের উল্লম্ফন সামাল দিতে গিয়ে সরকার পাঁয়তারা করছে পণ্য দুটির মূল্য বৃদ্ধির। পণ্য দুটি হলো স্ট্র্যাটেজিক পণ্য। অর্থাৎ এদের মূল্য বৃদ্ধি ঘটলে সব পণ্য ও সেবার দাম বৃদ্ধি পাবে। তেমন হলে মানুষের আর উপায় থাকবে না। মানুষকে সুরক্ষা দিতে চাইলে সরকারকে গ্যাস-তেলের নতুন করে মূল্য বৃদ্ধি থেকে বিরত থাকতে হবে।
দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বিপুল, অথচ উৎপাদন করা যাচ্ছে না জ্বালানির অভাবে। ফলে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে দেশ। বিদ্যুতের প্লান্টগুলোর জ্বালানির উৎস হলো নিজস্ব গ্যাস, এলএনজি, ফার্নেস ওয়েল, কয়লা। বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদ ড. বদরুল ইমামের সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধের তথ্য অনুযায়ী ২০১০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশীয় গ্যাসের ওপর নির্ভরতা ছিল ৯০ শতাংশ, ২০২২ সালে এই নির্ভরতার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ দেশীয় গ্যাসের ওপর নির্ভরতা ক্রমাগত কমছে, বাড়ছে উচ্চমূল্যের এলএনজির ব্যবহার। প্রতি ইউনিট দেশীয় গ্যাসের মূল্য যেখানে ২ থেকে ৩ ডলার, সেখানে প্রতি ইউনিট আমদানি করা গ্যাসের (এলএনজি) ব্যয় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ক্ষেত্রে ১২ ডলার, স্পট মার্কেট থেকে কিনলে ৩৫ ডলার পর্যন্ত। বিভিন্ন জরিপ ও বিশেষজ্ঞদের মতানুযায়ী দেশে গ্যাসের যথেষ্ট মজুত আছে, কিন্তু অনুসন্ধান ও উত্তোলনের উদ্যোগ নেই। প্রকৃতপক্ষে গ্যাস সম্পদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বাপেক্ষা কম অনুসন্ধানকৃত দেশগুলোর একটি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যথেষ্ট অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভূগর্ভে লুক্কায়িত গ্যাস উত্তোলন করলে বাংলাদেশে গ্যাস সংকট থাকত না। দেশের গ্যাসসম্পদ শেষ হয়ে যাওয়ার পথে- এমন ধারণাকে অবৈজ্ঞানিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করেন তারা। বিশেষজ্ঞদের মতামতের প্রতি সরকার দ্বিমত পোষণ করে বলে মনে হয় না, তেমন হলে তারা নিশ্চয়ই এর প্রতিবাদ করত। কেন নিজেদের গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সরকার আমদানি নির্ভরতার দিকে গেল, এ প্রশ্ন গুরুতর। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের নিষ্পত্তি হয়েছে। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও প্রাপ্ত অতিরিক্ত সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধান করা হচ্ছে না, অথচ মিয়ানমার তাদের অংশে অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে বর্তমানে বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে। তার জন্য বিপুল পরিমাণ কয়লার প্রয়োজন হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গ্যাসের মতো কয়লারও যথেষ্ট মজুত আছে দেশে। সেগুলো উত্তোলনের ব্যবস্থা নিলে আমদানি নির্ভরতা কমবে। আমরা চাই সরকার স্বয়ম্ভরতার পথে হাঁটুক, যার সূচনা ঘটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে। তিনি বাংলাদেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি শেল অয়েল আবিষ্কৃত ও পরিচালিত পাঁচটি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র কিনে নিয়েছিলেন।

তিন.
সরকার ডলারসহ নানামুখী সংকটের মুখে কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করেছে। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাস দ্রব্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ডলারের ঘাটতি হ্রাস করতে চাইছে। সরকারি কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ, প্রশিক্ষণ, অপ্রয়োজনীয় গাড়ি ক্রয় ইত্যাদি খাতে ব্যয় কমিয়ে অর্থ সাশ্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছে। অপ্রয়োজনীয় বা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ ছাড় কমানোর নীতি নিয়েছে। আলোকসজ্জা ও রাত ৮টার পর দোকানপাট-মার্কেট বন্ধ রেখে লোডশেডিংয়ের মাত্রা কমাতে চাইছে। পরিত্রাণের অন্য উপায়ও খুঁজছে হয়তো সরকার, যা স্পষ্ট নয় এখনো। কৃচ্ছ্রসাধন খারাপ কিছু নয়, যদি সফলতা আসে। এ মুহূর্তে প্রধান হয়ে উঠেছে গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা। গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিভাগে দুর্নীতির কথা কে না জানে! সঠিক পরিসংখ্যান হাতে না থাকলেও নিশ্চিন্তে বলা যায়, অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগে সয়লাব হয়ে আছে গোটা দেশ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশেই এ কাণ্ড ঘটছে। এসব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও তার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হলে সংকট অনেকাংশে কমবে। পূর্বেই বলেছি, গ্যাস-বিদ্যুৎ হচ্ছে স্ট্র্যাটেজিক পণ্য যার দাম বাড়লে দেশের প্রতিটি মানুষকে এর অভিঘাত সইতে হবে। সুতরাং আর মূল্য বৃদ্ধি নয় এই দুই পণ্যের। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সরকার অন্য উপায় বের করুক, আর ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে নিজের গ্যাস-কয়লা উত্তোলনে মনোনিবেশ করুক অনতিবিলম্বে।

মজিবর রহমান : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়