শিনজো আবের প্রতি বিএনপির শ্রদ্ধা

আগের সংবাদ

ভোট ঘিরে তৎপর কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

থ্রি ইন ওয়ান চ্যালেঞ্জে গভর্নর রউফের অভিষেক

প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ ৩ চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নরের চেয়ারে বসেছেন সাবেক অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। বাকি চ্যালেঞ্জ দুটি হচ্ছে মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে আনা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে বাড়ানো। দেশের এ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১২তম গভর্নর তিনি। আর স্থলাভিষিক্ত হলেন ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের জায়গায়। সংখ্যা মানে ৩ বলা হলেও ডান-বামে, আগে-পিছে আরো অনেক ঝুঁকি চক্কর দিচ্ছে নয়া গভর্নরের ঘাড়ে-মাথায়। যার কিছু কিছু তার আগে থেকেই জানা। বেশ বুঝেশুনে, হিসাবনিকাশ করে এগোচ্ছেন তিনি। এর কিছুটা ছাপ দেখা গেছে তার যোগদানের ক্ষেত্রে ধীর কদমের ঘটনায়ও। তার আগের গভর্নর ফজলে কবিরের মেয়াদ ৩ জুলাই শেষ হওয়ার পর ৪ জুলাই দায়িত্ব নিতে পারতেন তিনি। তাতে কী সমস্যা ছিল? হ্যাঁ ছিল। কোনো ঝুটঝামেলা রাখেননি রউফ তালুকদার। তার চাকরি আছে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত। গভর্নর হতে তাকে সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিতে হয়। ১১ জুলাই থেকে তার স্বেচ্ছা অবসর আবেদন রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে অনুমোদন হয়েছে গত সপ্তায়।
সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর দ্বাদশ অধ্যায়ে অবসর, ইস্তফা ইত্যাদি বিষয়ে কিছু বিধিবিধান আছে। এতে উল্লেখ আছে, সরকারি চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যে কোনো সময় একজন সরকারি কর্মচারী অবসর নিতে পারেন। অবসর গ্রহণের ৩০ দিন আগে ওই কর্মচারীকে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার ইচ্ছা লিখিতভাবে জানাতে হবে। এই ইচ্ছা চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে এবং তা সংশোধন বা প্রত্যাহার করা যাবে না মর্মেও বিধান আছে। প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ থাকলেও আগামী ৪ জুলাই গভর্নর পদে যোগ দিতে গেলে আব্দুর রউফ তালুকদারের আইন লঙ্ঘন হতো। পেনশন সুবিধাও কমে যেত। সাধারণত ৩-৪ দিন বা বড়জোর এক সপ্তাহ সময় হাতে নিয়ে বড় ধরনের পদে নিয়োগ দিয়ে থাকে সরকার। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আব্দুর রউফ তালুকদারকে ৪ বছরের জন্য নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে তিন সপ্তাহ আগে। সেদিন ছিল ১১ জুন, অর্থাৎ সরকারি ছুটির দিন শনিবার।
তিনি গভর্নর হয়ে চলে আসায় শূন্য হয়ে যায় অর্থ সচিবের পদ। নতুন অর্থ সচিব পদে আগেভাগেই নিয়োগ দেয়া হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-ইআরডি সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনকে। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয় গত ১৬ জুন। আর ফাতিমা ইয়াসমিনকে যোগ দিতে বলা হয়েছে ১১ জুলাই। একইভাবে ১৬ জুন নতুন ইআরডি সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শরিফা খান। তাকেও যোগ দিতে বলা হয়েছে ১১ জুলাই। তারও অবসরে যাওয়ার বিষয় নেই। দুজনের ক্ষেত্রেই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় তাদের যোগ দেয়ার অন্তত ২৫ দিন আগে। একজনের জন্য কতজনের সন্নিবেশন আয়োজন করতে হয়েছে। সব ঠিকঠাক করে ঈদের ছুটির পর ১২ জুলাই প্রথম কর্মদিবসে ঘটা করে গভর্নর পদে অভিষেক হয় তার। এর ঠিক ক’দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কিছু রদবদল ও পদোন্নতি সম্পন্ন হয়েছে। পরিচালক (সাবেক জিএম) পদে পদোন্নতি পেয়েছেন আট কর্মকর্তা। পদোন্নতির আগে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের আলাদা দুই আদেশে তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়। আর অতিরিক্ত পরিচালকের পদ শূন্য হওয়ায় নিচের দিকেও একইভাবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। অনেকে বলে থাকেন, অর্থের দায়িত্ব অর্থনীতিবিদের ওপরেই ছেড়ে দেয়া উচিত। কারণ এটি আমলাদের কাজ নয়। উদাহরণ হিসেবে ফজলে কবিরের ব্যর্থতার কথা সামনে নিয়ে আসেন তারা। বলেন, তিনি ব্যাংকিং শৃঙ্খলা নষ্ট করেছেন। ঋণ খেলাপি বাড়িয়েছেন। দুয়েকটি শিল্প গোষ্ঠীর হাতে ব্যাংকিং খাত এমনভাবে ছেড়ে দিয়েছেন, যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাংকের মালিক হচ্ছে। অর্থ পাচার ও পাচার করা অর্থ উদ্ধারে তার কোনোই ভূমিকা নেই। ব্যাংকের সার্ভিস নিয়ে কোনো অভিযোগ করলে তিনি অভিযোগের নিষ্পত্তি করেননি। সেখানে এখন আরেক আমলার অভিষেক। বিসিএস ১৯৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তা আব্দুর রউফ তালুকদার সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন সচিবালয় ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে। এ ক্যাডার বিলুপ্ত হয়ে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত গেছে প্রায় ২০ বছর আগে। কর্মজীবনে তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ে সহকারী সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। সরকারি চাকরি থেকে তার স্বাভাবিকভাবে অবসরে যাওয়ার কথা ২০২৩ সালের আগস্টে। স্বাভাবিক অবসরে যাওয়ার আগে সরকার তাকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। ফজলে কবির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মেয়াদে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালনকারী গভর্নর। তার চেয়ে বেশি সময় গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এম নূরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৃতীয় গভর্নর ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত টানা ১১ বছর। এক সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়েও এ ধাঁচের কথা ছিল। দীর্ঘদিন পদটিতে সাবেক বিচারপতিদের নিয়োগ দেয়ার রেওয়াজ ছিল। পরে আবু হেনা, সাঈদ, শামসুল হুদা, নুরুল হুদাসহ বেশ ক’জন আমলার পর কাজী হাবিবুল আওয়াল মিলিয়ে সিইসি পদটি আমলারাই অলঙ্কিত করে আসছেন। অভ্যস্ততাও তৈরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও সেই ধারায় এগোচ্ছে। এ অভ্যস্ততার মাঝেও আছে কিছু ব্যতিক্রম। কাউকে ‘অখুশি’ না করে পার পেতে পেতে বিদায় নিয়েছেন ফজলে কবির। রিজার্ভ চুরির পর দায়িত্বপ্রাপ্ত গভর্নর ফজলে কবির ভালো কাজের জন্য প্রশংসিত হওয়ার পাশাপাশি কিছু কাজের জন্য সমালোচিতও হয়েছেন। যার অন্যতম ঘটনা ছিল কোনো আলোচনার ধার না ধরে তাৎক্ষণিক বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার কমানো, খেলাপি ঋণের মাত্র ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়েই ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া, ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়ার মতো হুটহাট সিদ্ধান্ত। তবে এগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব নয়, ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত বলে কথার প্রচলন আছে মতিঝিল ব্যাংকপাড়ায়। এসব সিদ্ধান্তের বড় উপকারভোগী ছিলেন ব্যবসায়ী ও ব্যাংক মালিকরা। আবার ব্যাংক খাতে ন্যূনতম বেতন-ভাতা নির্ধারণ, চাকরির নিশ্চয়তা বিধানসহ নানা পদক্ষেপের কারণে শেষ সময়ে এসে সাধারণ ব্যাংকারদের কাছেও প্রিয় গভর্নর হয়ে ওঠেন তিনি। সরকার আইন পরিবর্তন করে তাকে ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত গভর্নর পদে রাখে। কয়েকটি ব্যাংকের মালিকানা ও পরিচালনায় পরিবর্তন আসে ‘অস্বাভাবিক পন্থায়’। বিদেশে অর্থ পাচার ও ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ নেয়া বেড়েছে। যার জেরে শেষ সময়ে এসে সংকটময় পরিস্থিতি হয় মার্কিন ডলার নিয়ে।
আমদানি খরচ বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় দেশে মার্কিন ডলারের চরম সংকট চলছে বলে তত্ত্ব দেয়া হলেও ভেতরের খবর ভিন্ন। যার বাকি দায় ও জের এখন উত্তরাধিকারের মতো নিতে হবে নতুন গভর্নর রউফ তালুকদারকে। যার অন্যতম বিশেষ একটি হচ্ছে ডলার সংকট। দেশে ডলার পরিস্থিতি এখন লেজেগোবরে। তা লুকানো বা অস্বীকারের জো নেই। অর্থনীতিবিদের কেউ কেউ নানা ব্যাখ্যা দিয়ে একে সাময়িক বা বিশ্ব পরিস্থিতির জের বলার চেষ্টা করলেও গত দশ বছরে ডলার ডিভ্যালুয়েড হয়েছে ১৩.৭৩ শতাংশ। এর কারণ অনেকটাই রহস্যঘেরা। করুণ এই দুর্গতি কাটাতে রাশিয়ার জাতীয় মুদ্রা রুবলের সঙ্গে টাকার বিনিময় বিবেচনার একটি চেষ্টা চলছে। তাড়াহুড়া না করে আরো সময় নিয়ে সূ²ভাবে বাংলাদেশকে এ ট্র্যাকে ঢুকানোর প্রক্রিয়া চলমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথা ৪২২তম পর্ষদ সভায়ও গুরুত্ব পেয়েছে বিষয়টি। এতে ১৯টি এজেন্ডার মধ্যে অন্যতম ছিল রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ব্যাংক অব রাশিয়ার’ রুশ জাতীয় মুদ্রা রুবলের সঙ্গে টাকার বিনিময় ও আন্তঃব্যাংক লেনদেন সংক্রান্ত প্রস্তাব। হাল পেক্ষাপট বিবেচনায় সিদ্ধান্ত হয়নি। আবার প্রস্তাবটি নাকচও করা হয়নি। তা চূড়ান্ত করা না করার ঝুঁকি পুরোটাই রেখে দেয়া হয়েছে সদ্য গদিনশীন হওয়া গভর্নরের জন্য।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়