করোনা সনদ জালিয়াতি : হাইকোর্টে রিজেন্ট সাহেদের জামিন আবেদন খারিজ

আগের সংবাদ

‘নিষেধাজ্ঞায় মানবাধিকার লঙ্ঘন’ > মুন্সি ফয়েজ আহমেদ : আমাদের প্রধানমন্ত্রী উচিত কথা বলেছেন

পরের সংবাদ

নীতিবর্জিত সামাজিক প্রথা আর নয়

প্রকাশিত: জুলাই ৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রাচ্যের রানী, বীর প্রসবিনী সুজলা-সুফলা প্রাকৃতিক নৈসর্গিক পরিবেশের এক অন্য নাম চট্টগ্রাম। এখানকার ঐতিহ্য আতিথেয়তা সব মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে। তদ্রুপ চট্টগ্রামের কিছু অনৈতিক সামাজিক কার্যক্রম বেশ আলোচিত-সমালোচিত। আমরা প্রত্যেকেই জানি রাষ্ট্রের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ববোধ দ্বারা আমাদের জীবন চালিত হয়। একটি সুন্দর সুস্থ পরিবেশে থাকতে হলে সামাজিক নিয়ম নীতির মধ্যে চলতে হয়। সেই প্রত্যয়ে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় সমাজ কমিটি সমাজপতিদের নিয়ে গঠিত হয়। যাতে সামাজিক সব কার্যক্রম সুন্দর ও সুচারুরূপে গঠন করা যায়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আজকাল সমাজে যে সর্দার কমিটি সুন্দর সমাজ পরিচালনার জন্য করা হয় তারা অনৈতিক, কুসংস্কার-কুকর্মের ভরাডুবিতে কিছুদিন ধরে নতুন নতুন আইন ও অমানবিক সিদ্ধান্ত নেন। যা চট্টগ্রামের আগামী প্রজন্মের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বিয়ে :
একা জীবন পেরিয়ে যুগল জীবনে পদার্পণের মধ্য দিয়ে বিয়ে সম্পাদন করতে হয়। ইসলাম ধর্মে বিয়েকে সুন্নত বা ধর্মের অর্ধেক কাজ সম্পন্নও বলা হয়। বিয়ে মানবজীবনের অন্যতম অংশ। অন্যান্য বিভাগের বিয়ের অনুষ্ঠানের চাইতে চট্টগ্রামের মানুষদের বিয়ের খরচও ব্যয়বহুল এবং এ চট্টগ্রামের বিয়ে নিয়ে নানা কথা ও নানা অভিযোগ গণমাধ্যমেও প্রকাশিত, যা সবাই অবগত। বিয়ে একটি সামাজিক কাজ, তাই এ বিয়ে নিয়ে সমাজের সর্দারদেরও অনেক মাথাব্যথা ও নানা নিয়মের কবলে পড়তে হয় বর ও কনে পক্ষকে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে পাঁচজ্জইন্না কথা। উক্ত পাঁচজ্জইন্না আলোচনাই সামাজিক প্যাডে বা নির্দিষ্ট ফর্মে লিখিত হয় বর কনেকে কী কী উপঢৌকন হিসেবে দিবে যেমন ধরুন; স্বর্ণ, কনে সাজানো খরচ, বিয়ের বৈরাতী ক’জন ইত্যাদি। এসব নিয়ম তোয়াক্কার বাইরে হলেও উক্ত পাঁচজ্জইন্না কথায় ‘সামাজিক খরচ’ বাবদ একটা নীরব ভদ্রতার চাঁদাবাজি হয়। বাধ্যতামূলক এই সামাজিক খরচ বাবদ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। সামাজিক এই খরচ বাবদ টাকা না দিলে অনেক কথা-কাটাকাটিও হয়, পরিশেষে এই টাকা বর পক্ষ বা কনে পক্ষ দিতে বাধ্য হয়। বিশেষ করে চট্টগ্রামে একটি মেয়ের বিয়ে দিতে যে কাঠখড় পোহাতে হয় সেখানে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা স্বরূপ এই চাঁদা। সে গরিব হোক কিংবা বড়লোক। সকলের প্রশ্ন এই টাকা কোথায় যায়? সামাজিক খরচই বা কী করে? কিছুই করে না। সব টাকা কথিত কিছু সমাজপতিদের পেটেই যায়।
বিশেষ করে চট্টগ্রামের একটা মেয়েকে বিয়ে দিতে এসব কুপ্রথার কবলে পড়ে কত কষ্ট পেতে হয় তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। চিংড়ি মাছ ও গরুর মাংসের জন্য বিয়ে ভেঙে যাওয়ার ঘটনাও নতুন কিছু নয় চট্টগ্রামে, যা সকলে গণমাধ্যমেও দেখেছেন। বিয়ের পরে প্রথম কয়েক বছর ঈদুল ফিতরের সময় মেয়ের বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ির সবার জন্য কাপড় দেয়ার জন্য নানা চাপ, দিতে না পারলে নববধূকে নির্যাতনের শিকার হওয়ার চিত্রও দেখা যায়। ঈদুল আজহার সময় ঘনিয়ে এলেই শ্বশুরবাড়ির লোকেরা নববধূকে বাপের বাড়ি থেকে গরু আনার চাপ দেয়, গরু দিতে না পারলে ছাগল আনতে বলে, তাও অক্ষম হলে গৃহবধূকে শারীরিক নির্যাতন করে মেরে ফেলার ঘটনাও ঘটে। এই তো কিছুদিন আগে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ রাজনগর ইউনিয়নে নববধূ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। আরিফা মনি ওরফে রিয়ার বাবা একজন বাবুর্চি, অনেক কষ্টে এলাকাবাসী ও আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় ৩ লাখ টাকা ব্যয় করে বিয়ে দেন; কিন্তু বিয়ের তিন মাসের মাথায় আসন্ন কুরবানির জন্য ছাগল দাবি করে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। মেয়ের বাবার সামর্থ্য না থাকায় ছাগল দিতে পারবে না বললে এর জেরে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় নববধূ রিয়া মনিকে। বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই একটি তাজা জীবন সামাজিক নামে অসামাজিক এই নির্মম প্রথার জন্যই শেষ হলো। এভাবে প্রতি বছরই হীনম্মন্যতায় ভরা সামাজিক নীতির কারণে কত নববধূর মৃত্যু ঘটে তার কোনো হিসাব নেই। সমাজের এমন অসংহতির ঘটনা কি দেখার মত কেউ নেই?
কবর :
আমরা প্রত্যেকে যেভাবে মানুষ হয়ে জন্মেছি ঠিক বিধাতার নিয়মে মৃত্যুও আমাদের অবধারিত। একজন মুসলিম মানুষের মৃত্যুর পর তার শেষ ঠিকানা কবরেই হয়। তদ্রুপ সমাজে কোনো মানুষ মারা গেলেই তার পরিবারের কাছে কথিত কিছু মসজিদ কমিটি বা সমাজপতি প্যাড বা নির্দিষ্ট ফরম নিয়ে এসে হাজির ‘কবরের জায়গা খরচ’ বাবদ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয়ার জন্য। মৃত্যুর পরও শান্তি নেই এসবের জন্য। মৃত্যুর পরে যেখানে শোকে কাতর হয়ে সমবেদনা জানানো দরকার সেখানে তারা এমন জঘন্যতম কাজ করে, তা কতটুকু মানবিক ও আইনসম্মত- প্রশ্ন থেকেই যায়। এহেন অমানবিক, অনৈতিক কাজ দিনের পর দিন করেই যাচ্ছে এসব সমাজ (সর্দার) কমিটি। এদেরকে নিয়ে প্রতিবাদের সাহসও কারো জোগায় না। এদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতেও পারে না। দিনের পর পর দিন ভদ্রভাবে নীরব চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। যেন এদের দেখার কেউ নেই।
সালিশ :
অনেক সময় মানুষের মধ্যে পারিবারিক কলহ ঝগড়া বিবাদ লাগলে তা পরিত্রাণ বা সমাধানের জন্য সমাজের সর্দার বা সমাজ কমিটিকে বিচার দেয়। বিচার দিতে গেলে যে কোনো এক পক্ষকে সালিশি বৈঠকের আয়োজন করতে বলে। ওই সালিশি বৈঠক সম্পন্ন হওয়ার আগে-পরে সালিশি খরচ বা রায়ের কপি বাবদ বড় দাগের টাকা দাবি করে নামধারী সমাজপতিরা। পরক্ষণে সালিশি রায়ের কপির টাকা দিতে না পারলে রায় এক তরফে চলে যায়। সমাজের অসহায় মানুষটি নির্দোষ হয়েও টাকার কাছে এভাবে হেরে যায় হাজারো সালিশ-বিচার। যেখানে রক্ষক সুষ্ঠু সমাজ পরিচালনার লক্ষ্যে শপথ পাঠ করে সর্দার হন সেখানে তিনি নিজেই ভক্ষক হয়ে ওঠেন কী করে?
চট্টগ্রামে এভাবে দিনের পর দিন সর্দারি প্রথায় কত মানুষ তার প্রাপ্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে, উল্টো নীরবে চাঁদা ও হয়রানির শিকার হচ্ছে তার শেষ নেই। অন্যান্য বিভাগের তুলনায় উপরোক্ত ঘটনাবলি চট্টগ্রামে বেশি দেখা যায়। তাই সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সমাজকর্মী ও দায়িত্বশীল সচেতন মানুষের কাছে অনুরোধ- এই সর্দারি প্রথা বাদ দিয়ে বা সুষ্ঠুভাবে সমাজ পরিচালনা করে চট্টগ্রামের মানুষদের রেহাই দেন। আর সচেতন মহলের কাছে অনুরোধ, কেউ যদি আপনাদের থেকে এভাবে কুপ্রথার মাধ্যমে নীরব চাঁদাবাজি করে, নববধূ উপঢৌকনের কারণে খুন হয়, নারী নির্যাতন হয়, তাহলে প্রশাসনকে অবহিতকরণের পাশাপাশি সচেতন সমাজ সোচ্চার হোন। আপনারা-আমরা যদি এসব বিষয়ে সোচ্চার না হই, প্রতিবাদ না করি, তাহলে এভাবে যুগের পর যুগ সমাজে কিছু অনৈতিক সমাজপতিরা এহেন নীরব নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাতেই থাকবে। তাই আসুন নিজে বদলাই, সমাজকে বদলে দিই, এসব কুপ্রথা বন্ধ করি। তাহলেই আগামীর প্রজন্মকে একটি সুস্থ সুন্দর সমাজ উপহার দিতে পারব।

আলতাফ হোসেন হৃদয় খান : লেখক ও সমাজকর্মী, চট্টগ্রাম।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়