পদ্মা সেতু উদ্বোধন : বুয়েটে ক্লাস বন্ধ থাকবে ২৫ জুন

আগের সংবাদ

বর্ণিল উৎসবে খুলল দখিন দুয়ার

পরের সংবাদ

আত্মমর্যাদার পদ্মা সেতু অগ্রগমনের দৃঢ় প্রত্যয়

প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পদ্মা সেতু। এশিয়ার ১১তম এবং বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ সেতু। এ সেতু রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া একটা জাতির আবেগ, আকাক্সক্ষা, প্রত্যয় ও সক্ষমতার প্রতীক। আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধের বলিষ্ঠ প্রকাশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারের গণমুখী উন্নয়নের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের উপাদান। স্বাধীন বাংলাদেশের পাঁচ দশক সময়কালে নিজস্ব অর্থায়নে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং মেগাপ্রকল্প। এ সেতুর প্রতিটি কর্মপরিকল্পনায় জাতির অস্তিত্ব ও মর্যাদার বিষয়টি জড়িত। কেননা, এ সেতু নির্মাণকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশে পানি কম ঘোলা করা হয়নি। তথ্য উপাত্ত পরিসংখ্যানে লক্ষ্য করা যায়- ১৯৯৮-৯৯ সালে সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, ৪ জুলাই ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, ২৮ আগস্ট ২০০৭ তারিখে একনেকে অনুমোদন, ২০০৯-১১ সালে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন, ১১ নভেম্বর ২০১০ সালে সেতুর দরপত্র আহ্বান, ১১ নভেম্বর ২০১১ সালে রেলপথ যুক্ত করে প্রকল্প সংশোধন, ২৮ এপ্রিল ২০১১ তারিখে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে, ২৪ এপ্রিল ২০১১ তারিখে আইডিবির সঙ্গে, ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়। কিন্তু কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক ২৯ জুন ২০১২ তারিখে ঋণচুক্তি বাতিল করে এবং বিশ্বব্যাংকের পথ অনুসরণ করে অন্যান্য দাতাসংস্থাগুলো ঋণচুক্তি থেকে পর্যায়ক্রমে সরে আসলে ৯ জুলাই নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন।
আমাজনের পর পদ্মা নদীই বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রবাহমান নদী। যে নদীর অববাহিকায় প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। তাই নানাদিক বিশেষ করে পলি মাটির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পদ্মা নদী শাসনে নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন নদী শাসন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, এর মূল লক্ষ্য হলো নদীর গতিপথকে এমনভাবে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা, যাতে নদীর জলরাশির প্রবাহ সেতুর নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদী শাসনে যে কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে, তাকে বলা হয় গাইড ব্রান্ড উইথ ফলিং অ্যাপ্রোন। এ কৌশলে নদীর পাড় থেকে যত দূর খনন করা যায়, সেটিই করা হয়েছে। এতে আধুনিক ড্রেজার ব্যবহার করে পদ্মার পাড় থেকে ২০-২৫ মিটার খনন করে ঢাল তৈরি করা হয়েছে। এ ঢালে ফেলে রাখা হয়েছে ভারি পাথর বা বালুভর্তি জিও ব্যাগ। যাতে কোনো কারণে নরম মাটি ভেঙে গেলে ভারি পাথর বা ব্যাগ নিচে গিয়ে শক্ত স্তর সৃষ্টি করতে পারে। পদ্মা সেতুর প্রতিটি পিলারে খনন করা হয়েছে প্রায় ১২২ মিটার, যা ৪০ তলা ভবনের উচ্চতার সমান। এখানে ৩ মিটার ব্যাসের ইস্পাতের টিউবকে কিছুটা বাঁকাভাবে হ্যামার দিয়ে মাটিতে প্রবেশ করানো হয়েছে। পদ্মা সেতু ভূমিকম্প সহনীয় একটি শক্তিশালী কাঠামো। ভূমিকম্প প্রতিরোধ বিবেচনায় এখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ভূমিকম্পের সময় মাটিতে যে কম্পন সৃষ্টি হয়, তার সবটুকু যেন সেতুর উপরিকাঠামোতে যেতে না পারে, সে জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ১০ হাজার টন সক্ষমতার ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং বা এফপিবি প্রযুক্তি। এটি ব্যবহার করায় ভূমিকম্পের সময় সেতুর পাইলিং নড়াচড়া করলেও মূল সেতু কাঠামোতে প্রভাব পড়বে না। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এফপিবি প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রায় ১০ কোটি মার্কিন ডলার কমে গেছে। বজ্রপাতে যেন পদ্মা সেতুর কোনো ক্ষতি না হয়, সে জন্য সেতুতে ব্যবহার করা হয়েছে কপার ক্যাবলের আর্থিং। এই ক্যাবলটির একটি প্রান্ত স্ক্রুর সাহায্যে রোডওয়ে স্লাবের নিচে লাগানো হয়েছে। আর অন্য প্রান্তটি লাগানো হয়েছে স্প্যানে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যদি বজ্রপাত হয়, তবে তাতে উৎপন্ন হওয়া বিদ্যুৎ প্রথমে রোড স্লাবের সঙ্গে সংযুক্ত ক্যাবলের মাধ্যমে স্প্যানে আসবে। এরপর পিলারের সাহায্যে এই বিদ্যুৎ স্প্যান থেকে একদম মাটির গভীরে চলে যাবে। পদ্মা সেতুর ১৭-১৮টি স্লাব পরপর এই কপার ক্যাবল ব্যবহার করা হয়েছে। এ সেতুতে মোট ৬৫৯টি পাইলিং করা হয়েছে, যার প্রতিটির গভীরতা ১০১.১৩-১২৫.৪৬ মিটার বা ৩২৫.৪২-৪০৭.৫০ ফুট। এ সেতুর অন্যতম সংযোজন হলো ৭৬২ মিলিমিটার ব্যাসের গ্যাস সরবরাহ লাইন, ১৫০ মিলিমিটার ব্যাসের ফাইবার অপটিক্যাল ও টেলিফোন লাইন এবং মূল সেতুর ২ কিলোমিটার নিচের জলপ্রবাহে পাইল ফাউন্ডেশনের ওপর সাতটি উচ্চ বৈদ্যুতিক ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক লাইন পরিবহন সুবিধা রাখা হয়েছে।
সকল ষড়যন্ত্র চক্রান্ত ও প্রতিকূলতা জয় করে বাংলার মানুষকে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার মূল সেতুসহ সর্বমোট ৯.৮৩ কিলোমিটার এবং ২২ মিটার প্রস্থের পদ্মা সেতু উপহার দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এ সেতু নির্মাণ বাংলাদেশকে বিশ্বে নতুন উচ্চতায় স্থান করে দিয়েছে। এ সেতু মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে শরীয়তপুরের জাজিরা ও মাদারীপুরের শিবচরকে। যেটি আজ ২৫ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন সেতুর স্বপ্নের কারিগর জননেত্রী শেখ হাসিনা। বস্তুত নিজস্ব অর্থায়নে এ মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের আত্মগৌরবের জায়গাটিকে মজবুত ভিত্তি দিয়েছে। পদ্মা সেতু শুধু নিছক একটি সেতুই নয়, এটি আমাদের অনন্য গৌরব, মর্যাদা আর অহংকারের প্রতীক। যেখানে জাতির পিতার সুযোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনার প্রত্যয় আর দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। এ সেতু নির্মাণে অর্থ জোগানে নেপথ্য কারিগর ছিলেন দেশের প্রবাসী, তৈরি পোশাক ও কৃষিখাতের শ্রমিকের হাড়ভাঙা শ্রমলব্ধ বৈদেশিক মুদ্রার জোগান। যাদের আয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ব্যাস্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতি। তাই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এ মাহেন্দ্রক্ষণে দুঃসাহসী নেতৃত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থনীতির ভিত্তি গড়ার মূল কারিগর দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
প্রমত্তা পদ্মায় এ সেতু নির্মাণে অর্থের জোগানের পাশাপাশি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রেও ছিল নানাবিদ চ্যালেঞ্জ। সব চ্যালেঞ্জ ধাপে ধাপে মোকাবিলা করে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল সেতু ও দুই প্রান্তের উড়ালপথ ৩.৬৮ কিলোমিটার আজ দৃশ্যমান। ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান (প্রতিটি স্প্যানের ওজন ৩১৪০ টন) ও ৮১টি পিলারের ওপর নির্মিত সেতুটি চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এ সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা সরাসরি সারাদেশের সঙ্গে যুক্ত হবে। এতে মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ১ থেকে দেড় শতাংশ বাড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার কমবে দশমিক ৮৪ শতাংশ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে নতুন করে গড়ে উঠবে ভারি শিল্পকারখানা। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে প্রথমত, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। এতে ওই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করবে; বাড়বে বিনিয়োগ। দ্বিতীয়ত, কৃষক উৎপাদিত পচনশীল পণ্য সরাসরি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহজে পরিবহন করতে পারবেন এবং পণ্যের ভালো দাম পাবেন। তৃতীয়ত, সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার হবে। যা দেশের অভ্যন্তরে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস করতে সাহায্য করবে।
কার্যত, অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। এডিবির এক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে- পদ্মা সেতু দিয়ে ২০২২ সালে ২৪ হাজার যানবাহন চলবে, তার মধ্যে বাস চলবে ৮ হাজার ২৩৮টি, ট্রাক ১০ হাজার ২৪৪টি, মাইক্রোবাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলবে ৫ হাজারের বেশি। সমীক্ষায় আরো প্রাক্কলন করা হয়েছে, ২০২৫ সালে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে দিনে যানবাহন চলাচল বেড়ে দাঁড়াবে ২৭ হাজার ৮০০টি। ২০৩০ সালে হবে ৩৬ হাজার ৭৮৫। ২০৪০ সালে দিনে যানবাহন চলাচল বেড়ে দাঁড়াবে ৫১ হাজার ৮০৭টি। পাশাপাশি জাইকার সমীক্ষামতে, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের ১ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি পেয়ে আঞ্চলিক জিডিপি বৃদ্ধি দাঁড়াবে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে। দক্ষিণবঙ্গে শিল্পায়নের গতি ব্যাপক বেড়ে যাবে। যা ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণের পরিকল্পনায় বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের মোংলা সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের মতো যথাযথভাবে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে পদ্মা সেতু ও সংযোগ সড়ক এশিয়ান হাইওয়ে রুট এএইচ-১-এর অংশ হওয়ায় তা যথাযথ ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হবে এবং যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সুবিধা হবে। ঢাকা থেকে খুলনা, মোংলা, বরিশাল, কুয়াকাটা অর্থনৈতিক করিডোর খুলে যাবে। এ সেতুকে ঘিরে বিশদ অঞ্চলজুড়ে গড়ে উঠবে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক। ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে এবং দেশের শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত হবে। সেতু ঘিরে পদ্মার দুপাড়ে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। সুন্দরবন, কুয়াকাটা, ষাটগম্বুজ মসজিদের মতো অনেক পর্যটন কেন্দ্র ওই অঞ্চলের যাতায়াতের অনুপযোগিতায় পর্যটকদের অনাগ্রহের বিষয় থাকলেও পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সেটি দূর হবে। সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যায়- স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানুষের অনাগত স্বপ্ন পূরণে সারথি হিসেবে কাজ করবে।
পদ্মা সেতু নিছক একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু নয়। প্রমত্তা পদ্মায় সেরা প্রকৌশলবিদ্যা আর প্রযুক্তিতে নির্মিত এই দ্বিস্তরের দৃষ্টিনন্দিত সেতুটি দেশের ১৮ কোটি মানুষের আবেগের নাম। স্বপ্ন পূরণে বিশ্বাস ও আস্থার সার্থক রূপায়ণ। আজ সেতু উদ্বোধনের আলো প্রজ্বলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠবে এদেশের কোটি মানুষের প্রাণের উচ্ছ¡াস। এটি সহজেই অনুমেয়। সমগ্র জাতি প্রস্তুতি নিচ্ছে সেই ইতিহাসের কালের সাক্ষী হতে, অনন্য গৌরবের অংশীদার হতে। দেশের প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পকে বহুমুখী প্রকল্পে রূপায়ণের জন্য আইডিইবি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অব্যাহতভাবে সরকারের কাছে সুপারিশ/পরামর্শ প্রদান করে আসছে। যখন প্রমত্তা যমুনা নদীর এপার থেকে ওপারে বৈদ্যুতিক লাইন সঞ্চালনের জন্য ইস্ট ওয়েস্ট ইন্টারকানেক্টরের জন্য বৈদ্যুতিক পিলার নির্মাণ হচ্ছিল, তখন আইডিইবি বৈদ্যুতিক পিলারগুলোকে বহুমুখী ব্যবহারের উপযোগী করে নির্মাণের দাবি জানায়। অনুরূপভাবে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু নির্মাণকালেও একই দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকারগুলো বিষয়টি আমলে না নিলেও পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুতে রেললাইন সংযুক্ত করা হয়। আইডিইবির সুপারিশ বিবেচনা নিয়ে পদ্মা সেতু বহুমুখী প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়িত হওয়ায় এদেশের ডিপ্লোমা প্রকৌশলীগণ আনন্দিত। পদ্মা সেতুতে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে যখন বিশ্বব্যাংক ও অন্য দাতাসংস্থাগুলো অর্থায়ন থেকে সরে যাচ্ছিল, তখন আইডিইবির বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুবুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালিদ, আহছান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. এ এম এম শফিউল্লাহ, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান, গণপূর্ত সচিব ড. খন্দকার শওকত হোসেন, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এর উপাচার্য প্রফেসর ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ প্রমুখের অংশগ্রহণে ঢাকায় ২০১২ সালের ১২ জুলাই রাউন্ডটেবিলের আয়োজন করে এবং সেখানে জোরালোভাবে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। এই আলোচনা থেকে বিকল্প অর্থ সংস্থানে সরকারের কাছে একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। সেতু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় আইডিইবির সুপারিশ বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত হওয়ায় সরকারপ্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীগণ কৃতজ্ঞ। আইডিইবি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পুরো দেশবাসীর মধ্যে যে আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টি হয়েছে, আগামীদিনে সেই প্রত্যয়ে ভর করে দেশে আরো মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এই অর্থের মূল জোগানদাতা হিসেবে প্রবাসী ও তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের মূল্যায়ন করতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে আরো বেশি দক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার শক্তিশালী রিজার্ভ গড়ে উঠতে সহায়ক হবে।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু এবং এর সংযোগ সড়ক নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন আমাদের জন্য গৌরববোধ ও আভিজাত্যের অনন্য অহংকার। বিশ্ব বাংলাদেশকে যে চোখে দেখত, এখন সেই চোখে দেখার অবকাশ নেই। বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক সক্ষমতার দেশ। প্রতিটি অঙ্গনে অপ্রতিরোধ্য গতিতে উন্নতি ও অগ্রগতি সাধন করে চলেছে বাংলাদেশ। এখন উন্নয়ন টেকসই করার বিষয়ে আমাদের অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ সৃষ্টির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি যেন কোনোভাবেই পরিবেশ প্রতিবেশে বিরূপ প্রভাব না ফেলে সে দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কোনো উন্নয়ন যেন পরিবেশগত সমস্যার উদ্রেক না করে এবং দূষণের সমস্যাগুলো বৃদ্ধি না পায়, সেদিকে মনোযোগ রাখা বাঞ্ছনীয়। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়নের যে বিশাল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, সেটি যেন আমাদের মূল্যবান কৃষিজমি ও এর উর্বরাকে গ্রাস না করে সে বিষয়ে সরকারকে অত্যন্ত কঠোর হতে হবে।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে জাতিগতভাবে যে আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টি হয়েছে, সেই প্রত্যয়ে ভর করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের হাত ধরে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মমর্যাদায় টিকে থাকবে। মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক সক্ষমতা আমরা দেখাতে পারলেও প্রকৌশল ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশের ওপর। যে কারণে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। চলমান অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে আরো ব্যাপক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের প্রকৌশল ও প্রযুক্তি জ্ঞানে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আমাদের প্রকৌশলীদের বড় বড় মেগাপ্রকল্পের নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কারিগরি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন ও গবেষণায় মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি মেগাপ্রকল্প পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণেও জনসম্পদ তৈরির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নচেৎ, ধার করা প্রকৌশল ও কারিগরি জনবল আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের সময়সীমাকে প্রলম্বিত করবে। তাই, জাতির এই আনন্দঘন মুহূর্তটি যেন সমৃদ্ধ আগামীর নির্মাণের প্রত্যয়কে উৎসাহিত করে- সেটাই প্রত্যাশা।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা ও পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় যেমন ছিল বাঙালির জাতির সামনে জাতিগত অস্তিত্ব রক্ষার চ্যালেঞ্জ, তেমনি একবিংশ শতাব্দিতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত ডালপালা ছিন্ন করে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নও ছিল আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বে টিকে থাকার অনন্য চ্যালেঞ্জ। কালের ইতিহাসে জাতির এ দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ভার কাকতলীয়ভাবে মোকাবিলা করতে হয়েছে একই রক্তের প্রবাহমান পিতা ও কন্যাকে। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনয়নে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকেও বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জাতিগত সক্ষমতার পরিচয় দিতে গিয়ে শেখ হাসিনার দুঃসাহসিক নেতৃত্বে পদ্মা সেতু নির্মাণ আমাদের আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ করে বিশ্বব্যাংকের কল্পনাপ্রসূত অপবাদ তাকে সহ্য করতে হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল অকল্পনীয় ঘটনা। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে, সেই বিশ্বাসকে ধারণ করে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি জাতির পিতার সেই অমর বাণী ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’। বাংলা ও বাঙালির অগ্রগমনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তা চির প্রেরণা উৎস হয়ে থাকবে।

এ কে এম এ হামিদ : উন্নয়ন গবেষক ও সভাপতি, আইডিইবি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়