গ্রেপ্তার ৪ ডাকাত : বন্যার কারণে বেড়ে যেতে পারে ডাকাতি আশঙ্কা পুলিশের

আগের সংবাদ

আ.লীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

পরের সংবাদ

সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি : ৬ কমিটির কোনোটিই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি

প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রীতম দাশ, চট্টগ্রাম অফিস : চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোর ভয়াবহ আগুন-বিস্ফোরণে ব্যাপক হতাহতের ঘটনার ১৮ দিন পার হলেও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেনি কোনো সংস্থা। এ ঘটনায় ৪৯ জনের প্রাণহানি হলেও একটি মামলা করা ছাড়া দৃশ্যত কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বেসরকারি এই ডিপো পরিচালনায় পদে পদে গাফিলতি-অনিয়ম থাকলেও মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।
এদিকে ওই কন্টেইনার ডিপোতে অক্ষত থেকে যাওয়া পণ্যের রপ্তানি নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। আগুন থেকে রক্ষা পাওয়া এসব পণ্য দ্রুত রপ্তানির উদ্যোগ নেয়ার তাগিদ দেয়ার পরও কোনো পক্ষই এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি বলে জানিয়েছেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা। তাদের প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, ডিপোটিতে ১৫৮টি প্রতিষ্ঠানের পোশাক ছিল। এর মধ্যে কী পরিমাণ নষ্ট হয়েছে, আর কতটুকু রপ্তানি উপযোগী রয়েছে, তার সঠিক হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। তবে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ পণ্য আগুন থেকে রেহাই পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রপ্তানিকারকরা জানান, ঘটনার তদন্ত শেষ না হওয়ায় অক্ষত কন্টেইনারগুলো বের করা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্ষতিগ্রস্ত ডিপোর অক্ষত পণ্য রপ্তানিতে অনেক জটিলতা আছে। বিশেষ করে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো কন্টেইনার ডিপো থেকে বের না করার নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়া বিমার বিষয় জড়িত থাকায় বিদেশি বায়ার এবং দেশি বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোও ডিপো পরিদর্শন করতে চায়। ডিপোটির মালিক পক্ষও ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত হিসাব তৈরি করছে। এ অবস্থায় অক্ষত পণ্য রপ্তানি প্রক্রিয়া আরো দীর্ঘায়িত হতে পারে।
তদন্ত শেষ না হওয়ায় কোনো কমিটির প্রতিবেদন দাখিল হয়নি : আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়, জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এবং ফায়ার সার্ভিস পৃথক কমিটি গঠন করে। তবে ঘটনার ১৮ দিন পার হলেও কোনো কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি। দফায় দফায় সময় বাড়াচ্ছে কমিটিগুলো।
অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মো. মিজানুর রহমানকে প্রধান করে গঠিত ১২ সদস্যের কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবস সময় দেয়া হয়েছিল। পরে আরো পাঁচ কার্যদিবস সময় বাড়ানো হয়। বর্ধিত সময়েও শেষ হয়নি তদন্তের কাজ। গত মঙ্গলবার এই কমিটির সদস্যরা বিএম ডিপোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি আবারো ঘটনাটি নাশকতা দাবি করে বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব নাশকতার ঘটনা ঘটছে বিএম ডিপোর ঘটনার সঙ্গেও এর যোগসূত্র থাকতে পারে।
তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. মিজানুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, তদন্তের সুবিধার্থে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সভাপতি, সিআইডির প্রতিনিধি এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) পোস্ট ব্লাস্ট

ইভেস্টিগেশন টিম থেকে প্রতিনিধি যুক্ত করা হয় তদন্ত কমিটিতে। বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষের বক্তব্যও নেয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট কর্মদিবসে তদন্ত শেষ করতে না পারায় সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়। আগামী ৪-৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে পারব বলে আশা করি।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটিতে প্রধান করা হয় স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক বদিউল আলমকে। প্রথমে সাত কর্মদিবস সময় দেয়া হলেও পরে আরো সাত কর্মদিবস সময় বাড়িয়ে নেয় কমিটি। তদন্ত কমিটির প্রধান বদিউল আলম বলেন, কমিটির সদস্যরা দুর্ঘটনাস্থল, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড উৎপাদনকারী কারখানা পরির্দশন করেছে। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গেও কথা বলেছি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক শিপন চৌধুরীকে প্রধান করে গঠিত কমিটিকে তিন কার্যদিবস সময় দেয়া হয়েছিল। আরো পাঁচ কার্যদিবস সময় বাড়িয়ে নিলেও এখনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি সংস্থাটি।
কমিটির প্রধান শিপন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের চেক বিতরণের কারণে প্রথম দিকে আমরা কাজ করতে পারিনি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শ্রমিকদেরও বক্তব্য নেয়া হচ্ছে। প্রতিবেদন দাখিল করতে আরো সময় লাগবে। দ্বিতীয় দফায় সময়ের আবেদন করব।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ শফি উদ্দিন বাবুলকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটিকে পাঁচ দিনের সময় দেয়া হয়েছিল। পরে আরো ১৫ কার্যদিবস সময় বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান মোহাম্মদ শফি উদ্দিন বলেন, আমরা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলছি। তদন্তের কাজ চলছে। প্রতিবেদন জমা দিতে আরো কিছু সময় লাগতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ টার্মিনাল ম্যানেজারকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছিল। প্রতিবেদন জমা দিতে পাঁচ কর্মদিবস সময় দেয়া হয়। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. রেজাউল করিমকে প্রধান করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটিকে পাঁচদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও এখনো তা দেয়া হয়নি। তদন্তের কাজ এখনো শেষ না হওয়ায় এই কমিটিও সময় বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছে।
অক্ষত পণ্য রপ্তানি নিয়ে অনিশ্চয়তা, দ্রুত শিপমেন্টের দাবি : বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) নেতারা গত ২০ জুন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার এম ফখরুল আলমের সঙ্গে বৈঠকে যেসব পণ্য চালান ভালো আছে, সেগুলো দ্রুত শিপমেন্টের দাবি জানান। এর আগেও একই দাবি জানিয়েছিল বিজিএমইএ। বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোটস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) তথ্য অনুযায়ী, ডিপোটিতে ৪ হাজার ৩০০ কন্টেইনার ছিল। এর মধ্যে ৮০০টি ছিল রপ্তানি পণ্যবোঝাই আর ৪০০টি আমদানি পণ্যের। খালি কন্টেইনার ছিল ৩ হাজার। পণ্য ও অবকাঠামোগত মিলিয়ে মোট ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে বিকডা। অক্ষত কন্টেইনারগুলো যদি দ্রুত রপ্তানির উদ্যোগ নেয়া হয়, তাহলে ক্ষতি কিছুটা হলেও কমে আসবে। পণ্য দীর্ঘদিন ডিপোতে পড়ে থাকলে ক্রেতা গ্রহণ নাও করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আরো ভারী হবে লোকসানের পাল্লা।
বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বিএম ডিপোতে অক্ষত পোশাকের চালানগুলো রপ্তানির ব্যবস্থা করতে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কাস্টমস, ডিপো কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু এতে কোনো অগ্রগতি হয়নি। রপ্তানি চালানগুলো ডিপোতেই পড়ে আছে। ডিপোতে কী সংখ্যক কন্টেইনার অক্ষত আছে, সেই হিসাবও ডিপো কর্তৃপক্ষ বা অন্য কেউ দিতে পারেনি। কিছু কন্টেইনার পুড়ে গেলেও বেশির ভাগ পণ্য আগুন থেকে বেঁচে গেছে। এসব চালানের শিপমেন্ট মিস হয়েছে। তারপরও যত দ্রুত সম্ভব পাঠাতে পারলে দুর্ঘটনার কথা বিবেচনা করে হয়তো বায়াররা গ্রহণ করবেন। বেশি দেরি হয়ে গেলে সেই সুযোগ আর থাকবে না।
মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা : গত ৪ জুন রাতে বেসরকারি ডিপোটিতে ভয়াবহ আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ ৪৯ জন নিহত হন। এছাড়া আড়াই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। আশপাশের এলাকার স্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিয়ম না মেনে ডিপোতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রাখায় আগুন ভয়াবহ রূপ নেয় বলে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছে সংস্থাগুলো। বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে বিপজ্জনক পণ্য সংরক্ষণের জন্য দেশীয়-আন্তর্জাতিক নীতিমালা এবং পৃথক স্থানে কন্টেইনার সংরক্ষণের নিয়ম থাকলেও বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ তা মানেনি বলে প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন সংস্থা চিহ্নিত করে। এছাড়া বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষের কাছে পরিবেশ অধিদপ্তরের যথাযথ অনুমোদন ছিল না এবং ডিপোর ভেতরে ফায়ার হাইড্রেন্ট, স্মোক, হিট, মাল্টি ডিটেক্টর, সেফটি কমিটিসহ অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। বেসরকারি ডিপোটি পরিচালনায় এত অনিয়মের পরও মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আটজনের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে মামলা করেছে পুলিশ। এখনো কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। সীতাকুণ্ড মডেল থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, মামলার তদন্ত কাজ চলছে। তদন্ত শেষ হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়