বন্যায় উদ্ধার ও ত্রাণ : সরকারের উদাসীনতার তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ বাম জোটের

আগের সংবাদ

ত্রাণ পৌঁছেনি প্রত্যন্ত জনপদে : এখনো পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ, সিলেট বিভাগে বন্যায় ২২ জনের মৃত্যু

পরের সংবাদ

বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি : উত্তর-মধ্যাঞ্চলে তীব্র খাদ্য সংকট

প্রকাশিত: জুন ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২১, ২০২২ , ১:৫৯ পূর্বাহ্ণ

কাগজ ডেস্ক : ভারতের মেঘালয় ও আসামে টানা বৃষ্টি হওয়ায় পাহাড়ি ঢলে নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে। কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, লালমনিরহাটে তিস্তা, গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট এবং সিরাজগঞ্জ ও জামালপুরে যমুনার পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সিলেট-সুনামগঞ্জে পানি কমতে থাকায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এদিকে ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় নদী রক্ষা বাঁধের চার স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে ১৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য সংকট। ত্রাণ তৎপরতা অপ্রতুল বলে অভিযোগ বানভাসিদের। এ সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট-
কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অন্তত দেড় লাখ মানুষ। সোমবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫২ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্রের নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ও ধরলা নদীর কুড়িগ্রাম ব্রিজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে । তিস্তার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও তা বিপৎসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।
নদীবেষ্টিত দুর্গম চরাঞ্চলের বন্যাকবলিত মানুষজন অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছেন। চুলা জ্বালাতে না পারায় এবং টিউবওয়েল তলিয়ে থাকায় শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে ।
অন্যদিকে টানা বৃষ্টি ও উজানের পানিতে গো-খাদ্য নষ্ট হয়ে হয়ে যাওয়ায় একমাত্র আয়ের উৎস গবাদিপশুর খাদ্য সংকট নিয়েও চরম বিপাকে পড়েছেন চরাঞ্চলের মানুষ।
বন্যাকবলিত এলাকার কাঁচা-পাকা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ার চরের শাহাজালাল জানান, এই চরের সব বাড়িঘরের অর্ধেকেরও বেশি তলিয়ে আছে। কিছু পরিবার অন্যত্র চলে গেলেও কিছু পরিবার নৌকায়, ঘরের ভেতর উঁচু করা মাচায় দিন-রাত পার করছেন। তারা জানান, তাদের নৌকা না থাকায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে উঁচু জায়গায় যেতে পারেননি। ঘরের ভেতর কষ্ট করে আছে। সরকারিভাবে ত্রাণ সহায়তা পেলেও তা রান্না করার মতো উপায় নেই বলে জানান তিনি। একই ইউনিয়নের খেয়ার আলগা চরের সদরুল ইসলাম জানান, আমরা কষ্ট করে দিন পার করলেও গরু, ছাগল, ভেড়ার খাদ্য সংকট নিয়ে বিপদে আছি। একদিকে বন্যার পানিতে চারণভূমি পানির নিচে অন্যদিকে টানা বৃষ্টিতে পচে গেছে খড়ও। এই গবাদিপশুই আমাদের মূল আয়ের উৎস।
এদিকে সরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতার পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও কিছু এলাকায় সামান্য ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নে ৪০০ শুকনা খাবারের প্যাকেট বিতরণ করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমান উদ্দিন আহমেদ মন্?জু। মানবিক বাংলাদেশ সোসাইটি কুড়িগ্রাম শাখার পক্ষ থেকে সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের চর ভগবতীপুর এলাকায় ৩০০ পরিবারের মঝে ১ কার্টন করে বিস্কুট বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাধ্যমতো বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর জানান, আমার ইউনিয়নে যে পরিমাণ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন তাতে বরাদ্দের বাইরে আরো সহযোগিতার প্রয়োজন হবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, ৯ উপজেলার বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ৩৩৮ টন চাল, নগদ ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ১৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকার শিশুখাদ্য ও ১৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকার গো-খাদ্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লা আল মামুন জানান, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পানি কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
নেত্রকোনা : জেলার সব কয়টি নদনদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছে। এতে জেলার দশ উপজেলায়ই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। পানিবন্দি হয়ে আছেন প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি ও গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বানভাসি মানুষের মাঝে নগদ টাকা, শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করা হলেও প্রশাসনের এই সহায়তা অনেকের কাছেই পৌঁছেনি। এদিকে জেলার হাওর উপজেলা

খালিয়াজুরীতে বন্যায় আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার, ত্রাণ বিতরণ ও চিকিৎসাসেবা দিতে স্থানীয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে কাজ করছে সেনাবাহিনী। এরই মধ্যে বন্যার পানিতে নেত্রকোনা-কলমাকান্দা, নেত্রকোনা-মোহনগঞ্জের রেলপথসহ জেলার অভ্যন্তরীণ সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। পানিবন্দি মানুষ যাতায়াত করছেন নৌকা ও ভেলায় চেপে।
প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলার ১০টি উপজেলার ৬২টি ইউনিয়ন পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে বন্যাকবলিত হয়েছে। ঢলের পানিতে অসংখ্য রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে। অসংখ্য পুকুর পানিতে তলিয়ে ভেসে গেছে মাছ। এ পর্যন্ত বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য ৩২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তাতে প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার ৯৩৫ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জামালপুর : জামালপুরে বিভিন্ন নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। সোমবার দুপুর ২টায় জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ ও বকশীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা বন্যাকবলিত হয়।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন জানান, জেলার ৩ উপজেলার ৩২টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ৮৭টি গ্রামের বাসিন্দা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েন। ৫০৩ উপজেলার ৫০ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত হলেও জেলার ২টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ১ হাজার ২৮৯ জন। বাকিরা নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছেন। জেলার ১ হাজার ১৪৭ হেক্টর জমির ফসল ও ১৫ মিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সোমবার জেলার ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলি ইউনিয়নের ড্যবরাইপ্যাঁচ এলাকায় সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ড্যাবরাইপ্যাঁচ এলাকার গ্রামের বাড়িগুলো প্লাবিত হয়েছে। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন উঁচু স্থানে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৪৯০.১৬০ টন জিআর চাল, নগদ ৫ লাখ ৫৩ হাজার টাকা এবং ৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ আছে। এর মধ্যে দেওয়ানগঞ্জে ২ টন জিআর চাল ও ইসলামপুরে ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে চাহিদা অনুযায়ী আরো ত্রাণ বিতরণ করা হবে।
এদিকে জেলার ইসলামপুরে বন্যার পানিতে ডুবে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার সকাল ১০টায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলার সময় আমগাছ থেকে ঝাঁপ দিয়ে বন্যার পানিতে ডুবে আরিফা (৯) নামে এক শিশু নিখোঁজ হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা পর আরিফার মরদেহ স্থানীয়রা উদ্ধার করেন। আরিফা আক্তার ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলি ইউনিয়নের পশ্চিম বামনা গ্রামের আলম মিয়ার মেয়ে।
সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। জেলার দুটি পয়েন্টেই পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিনিয়তই প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চলের একের পর এক এলাকা। জেলার বেলকুচি, কাজিপুর, চৌহালী, এনায়েতপুর ও শাহজাদপুরের চরাঞ্চলে শুরু হয়েছে নদীভাঙন। জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জের কাজিপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার এবং শহর রক্ষা বাঁধ হার্ডপয়েন্টে ৩৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এতে নিম্নাঞ্চলের মানুষের ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে গেছে। অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ভিটেমাটি ছেড়েছেন। কেউ ঠাঁই নিয়েছেন উঁচু বাঁধ বা নির্মাণাধীন ভবনে আবার কেউ রাস্তার ধারে ছাপরা ঘর করে থাকছেন।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, যমুনার পানি দ্রুত বাড়ছে। তিনি আরো জানান, ভাঙনরোধে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ইতোমধ্যেই ভাঙন এলাকায় ৪০ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। এছাড়া আরো ৩০ হাজার জিও ব্যাগ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা আকতারুজ্জামান জানান, বন্যার্তদের জন্য ইতোমধ্যেই ৯১১ টন চাল, নগদ ২০ লাখ টাকা এবং ৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এগুলো বিতরণের জন্য স্ব-স্ব এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছ ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা চাওয়া হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী বিতরণ করা হবে বলে তিনি জানান।
গাইবান্ধা : গাইবান্ধার সব নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সোমবার বিকাল পর্যন্ত বালাসীর তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ৪ সেমি এবং ঘাঘট নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৪ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে তিস্তা ও করতোয়া নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার নিচে রয়েছে।
পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার ২০টি ইউনিয়নের ৫৯টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। ফলে ওই সব উপজেলার চরাঞ্চলসহ নিচু এলাকার নতুন নতুন জায়গায় পানি উঠতে শুরু করেছে।
এদিকে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ৮০ টন চাল ও নগদ ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা বিতরণের কাজ শুরু হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়