সোহেল চৌধুরী হত্যা : শেষ দিনেও দাখিল হয়নি কেস ডকেট

আগের সংবাদ

ভয়াবহ বন্যায় দিশাহারা মানুষ

পরের সংবাদ

সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ এত কম

প্রকাশিত: জুন ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এ মুহূর্তে দেশের পত্রপত্রিকার অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় জাতীয় বাজেট। অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছেন তার ভালোমন্দ বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। এবারের বাজেট নিয়ে মানুষের ঔৎসুক্য একটু বেশিই ছিল। করোনাকালের বিরূপ প্রভাব কাটতে না কাটতেই ভয়াল রূপ নিয়ে সামনে আসে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ। এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় চাপ বাড়ে অত্যধিক। মূল্যস্তর এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছে যার ভার বহন করা সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে দুরূহ। করোনার অভিঘাতে অনেক মানুষ নতুন করে গরিব হওয়ায় দুর্ভোগের সীমা আরো বেড়েছে। প্রকৃতপক্ষে এমন কোনো শ্রেণি নেই যাদের মূল্যস্ফীতির চাপে পড়তে হচ্ছে না। বিত্তবান মানুষের এই চাপ সয়ে নেয়ার ক্ষমতা হয়তো আছে, কিন্তু নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনের সে ক্ষমতা নেই। মধ্যবিত্তরাও ভালো নেই এমন পরিস্থিতিতে, তাদেরও পিঠ দেয়ালে ঠেকার উপক্রম। এ অবস্থায় বাজেটে কিছুটা নীতিসহায়তা পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল সবার। বাস্তবে তেমন কিছু লক্ষণীয় নয়। চলমান দুর্ভোগ নিরসনে মানুষ আলোর দেখা পায়নি বাজেটে। পাবেই বা কী করে, সরকারের আয়ের ভিত্তি যে খুব দুর্বল! মূল্য সংযোজন কর ও কিছু অপ্রত্যক্ষ কর আয়খাতের মূল ভরসা, দিনশেষে যার বোঝা টানতে হয় সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে। আয়কর পরিস্থিতির বলতে গেলে কোনো উন্নতিই নেই। যাদের কর দেয়ার ক্ষমতা আছে তাদের কাছ থেকে যথাযথ পরিমাণ কর সংগ্রহে রাষ্ট্র অক্ষম। ১৭ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ৭৫ লাখ লোকের ই-টিন আছে। এর ভেতর রিটার্ন জমা পড়ে ২৫ লাখ। আবার ২৫ লাখের কোনো হদিসই নেই। হদিসবিহীনদের খুঁজে বের করা এবং আয়করের ভিত্তি সম্প্রসারণ জরুরি ছিল, সে লক্ষ্যে শক্ত পদক্ষেপ নেয়ার কথা বাজেট বক্তৃতায় অনুপস্থিত। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে ব্যক্তিকরের আয়সীমা বাড়ানোর দাবি ছিল অনেকের, সে দাবিও পূরণ হয়নি। বিত্তবানদের কাছ থেকে যে পরিমাণ আয়কর সংগ্রহের কথা সে পরিমাণ সংগৃহীত হচ্ছে না, ফলে আয় বাড়ছে না রাষ্ট্রের- এটি এক নিগূঢ় বাস্তবতা।
এমন পরিস্থিতিতে বিদ্বজ্জনরা সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার নিরিখে কথাবার্তা বলছেন, বলছেন ভবিষ্যতের কথাও। সে মোতাবেক প্রস্তাবিত বাজেট কিছুটা সংশোধিত হলে ভালো হয়। বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির ভেতর এবারের বাজেট পেশ হলো। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যাতে অধিক গুরুত্ব পায় বাজেটে সে পরামর্শ আগে থেকেই দেয়া হচ্ছিল বিভিন্ন মহল থেকে। প্রস্তাবিত বাজেটে তার প্রতিফলন নেই। এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হানের বক্তব্য : বাজেটে সমস্যাটির স্বীকৃতি আছে; কিন্তু যে রকম পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল তা নেয়া হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, বাজার অর্থনীতিতে সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কী করতে পারে? বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকারের এমন যুক্ততা তৈরি করতে হবে যাতে তারা কোনো অবৈধ সুযোগ নিতে না পারে। ব্যক্তি খাতকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। তাদের ওপর নজরদারি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সরকার কীভাবে তা করবে সেই নির্দেশনা বাজেটে নেই। প্রতিযোগিতা কমিশন, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যাদের এসব করা উচিত তাদের সক্ষমতা দুর্বল। এ নিয়ে বাজেটে কোনো বক্তব্য বা দিকনির্দেশনা নেই। সেলিম রায়হান আরো মনে করেন, সরকার নিজের নীতি নিজেই লঙ্ঘন করে চলেছে। পঞ্চবার্ষিক ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় যেসব খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে, বাজেটে সেসব খাত গুরুত্ব পায়নি। পলিসি ডকুমেন্টের সঙ্গে বাজেটের মিল নেই। [সূত্র : প্রথম আলো, ১৩ জুন ২০২২]
উন্নয়নের চালিকা শক্তি হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। প্রতি বছরের মতো এ বছরও আলোচনায় এলো খাত দুটি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়নে অন্যান্য দেশ যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয় সেই তুলনায় বাংলাদেশে বরাদ্দ দেয়া হয় খুব কম পরিমাণ অর্থ। অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। স্বভাবতই সমালোচনার শিকার হচ্ছে এ সম্পর্কিত বাজেট প্রস্তাবনা। প্রশ্ন আছে বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যবহার নিয়েও। অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি সরবরাহের দিকে যতটা মনোযোগ থাকে ততটা মনোযোগ থাকে না মানসম্পন্ন সেবা প্রদানের দিকে। উদাহরণস্বরূপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা ধরা যায়। এর সাম্প্রতিক চিত্র ভয়াবহ। শিক্ষক থাকলেও শিক্ষার্থী নেই। এতকাল শহরের চিত্র ছিল এটি, এখন গ্রামেও বিস্তৃত হয়েছে চিত্রটি। অভিভাবকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। কেন এমনটি হলো, প্রতিকারই বা কী- এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না কেউ। স্কুলগুলো এখন আর আগের মতো জীর্ণশীর্ণ নেই, তকতকে দালান উঠছে প্রায় সর্বত্র, শিক্ষকও আছেন পূর্বের তুলনায় বেশি, অথচ ছাত্রছাত্রী নেই। স্বাস্থ্যের বেলায়ও আছে একইরকম আফসোসের খবর। পত্রিকায় প্রায়ই দেখি, অনেক হাসপাতালে দামি যন্ত্রপাতি অযতœ-অবহেলায় অব্যবহৃত পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন তুললে কর্তৃপক্ষের জবাব মেলে চালাবার লোক নেই। সেবার মান নিয়ে অসন্তুষ্টি তো আছেই উভয় ক্ষেত্রে। খাত দুটিতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি এমন আফসোসের চিত্রেরও বদল প্রত্যাশা করি।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় যেসব কর্মসূচিকে ধরা হয় তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের প্রশ্ন পুরনো। কর্মসূচির তালিকায় আছে অবসরভোগী সরকারি চাকুরেদের পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ, করোনার কারণে ব্যাংকের সুদ মওকুফ ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য সুদ ভর্তুকি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি ইত্যাদি। অর্থ বরাদ্দের গরিষ্ঠ অংশ যাচ্ছে এসব কর্মসূচিতেই। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ বাড়িয়ে দেখানোর জন্যই কি সরকারের এমন কৌশলের আশ্রয় নেয়া? বাস্তবিকই অসহায় মানুষদের জন্য বরাদ্দ ও বরাদ্দের বিতরণ-হার অতি সামান্য। উপকারভোগীদের মাসিক ৫০০ টাকা দেয়া হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এত অল্প টাকা দিয়ে কি আজকাল কিছু হয়? এবারের বাজেট-আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বিদেশে পাচার করা অর্থ সামান্য জরিমানা দিয়ে দেশে এনে বৈধ করার প্রস্তাবনাটি। সরকারি মহলের বাইরে কেউ এতে সমর্থন জোগাচ্ছেন না। নৈতিকতা বিচারে এ প্রস্তাব মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। প্রস্তাবনাটি প্রত্যাহার করা হোক। সরকারের কাছে বরং দাবি থাকল পাচারকারীদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনার।

দুই.
৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট, এর ভেতর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ভাগ্যে জুটেছে মাত্র ৬৩৭ কোটি টাকা। বরাদ্দের ৩৯০ কোটি টাকা ব্যয় হবে পরিচালন বাবদ, অবশিষ্ট ২৪৭ কোটি টাকা ব্যয় হবে উন্নয়ন কার্যক্রমে। কত নগণ্য এ বরাদ্দ বলার অপেক্ষা রাখে না। আগের বাজেটেও এ রকম স্বল্প অঙ্ক বরাদ্দ রাখা হয়েছিল সংস্কৃতির জন্য, মাত্র ৫৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল তখন। সংস্কৃতি চর্চাকে কত হালকাভাবে দেখা হচ্ছে, ফিবছর অতি-সামান্য বরাদ্দই এর প্রমাণ। শুধু সরকার সংস্কৃতির ওপর গুরুত্ব কম আরোপ করছে তা নয়, সিভিল সোসাইটির কাছেও সংস্কৃতি মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, এসব আলোচনা-সমালোচনায় সংস্কৃতির ঠাঁই নেই। কেবল উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী এই তুচ্ছ বরাদ্দ নিয়ে কিছুটা উচ্চকণ্ঠ হয়েছে, সংগঠনটি বাজেটের ১ শতাংশ বরাদ্দের দাবি তুলেছে। এমন নয় যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পরিধি ক্ষুদ্র, আসলে যথেষ্ট ব্যাপক এর পরিধি। বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, আর্কাইভস, কপিরাইট অফিস, নজরুল ইনস্টিটিউট এই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান। ক্ষুদ্র বাজেট বরাদ্দ দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান কোনোরকম টিকিয়ে রাখা হয়তো সম্ভব, কার্যাদির সম্প্রসারণ সম্ভব নয়।
সংস্কৃতি বর্তমানে মুমূর্ষু অবস্থায় আছে। শহরে যৎকিঞ্চিত তৎপরতা থাকলেও গ্রামে নেই। ধর্মীয় গোঁড়ামি গ্রাস করছে সংস্কৃতি চর্চাকে। চতুর্দিকে কেবল বাধা আর বাধা। অপপ্রচারের তোড়ে সংস্কৃতির প্রাণ রুদ্ধপ্রায়। স্কুল-কলেজে আগে অনুষ্ঠানাদি হতো, এখন তাও হয় না। সর্ষের ভেতর ঢুকেছে ভূত। কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণ ব্যবহার করতে গিয়েও বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে শিল্পীদের। নির্বিঘœ চর্চার সুবিধা আছে খুব কম স্থানে। লোকশিল্পীরা লোকসমাজে ঢুকতেই পারছেন না, হেনস্তার শিকার হচ্ছেন পদে পদে। এমনকি মেলার আয়োজনও এখন বাধাগ্রস্ত। সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে দেশব্যাপী একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন জরুরি হয়ে উঠেছে এ সময়ে। পরিস্থিতির উত্তরণে রাষ্ট্রকে পাশে চাই। অন্তত প্রতিটি উপজেলায় একটি করে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা দরকার যাতে সংস্কৃতিকর্মীরা চর্চা ও অনুষ্ঠানাদি করার সুবিধা পান এবং সংস্কৃতির প্রসার ঘটে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ওপর মহলের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তারা দেশের সব উপজেলায় একটি করে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এতে থাকবে আধুনিক মিলনায়তন, এম্পিথিয়েটার, গ্রন্থাগার ও সিনেপ্লেক্স। নির্মাণাদির জন্য প্রাথমিকভাবে ৩০টি উপজেলাকে বেছে নেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানাই। পাশাপাশি প্রশ্ন তুলি, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ছাড়া এমন প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে কীভাবে? আমরা যদি একটি সুস্থ-সবল-উদার জাতি চাই তাহলে সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিতেই হবে।

মজিবর রহমান : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়