সোহেল চৌধুরী হত্যা : শেষ দিনেও দাখিল হয়নি কেস ডকেট

আগের সংবাদ

ভয়াবহ বন্যায় দিশাহারা মানুষ

পরের সংবাদ

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন : পরীক্ষা ও পাস-ফেলের পোস্টমর্টেম

প্রকাশিত: জুন ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের দীর্ঘ বছরের অনুশীলনের ভেতর দিয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক একটা সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে। আমরা সে কাঠামোতে দাঁড়িয়ে মোটামুটি নির্বাচন-উত্তর বিভিন্ন ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রাক-ধারণা করতে পারি। এখানে ঠিক তার কোনো অন্যথা হয়নি। নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশন দাবি করবে, নির্বাচন সুন্দর ও সুষ্ঠু হয়েছে। এবারো ঠিক তাই বলেছে। বিজয়ী প্রার্থী জয়লাভের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এটা জনগণের বিজয় বলে উল্লাস প্রকাশ করেন এবং এবারো ঠিক তাই হয়েছে। আর পরাজিত প্রার্থী দাবি করবেন, তার জেতার কথা কিন্তু তাকে সুকৌশলে হারানো হয়েছে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও ঠিক তাই হয়েছে। এরকম একটি প্রতিষ্ঠিত রীতির ফ্রেমওয়ার্কে আমি কুমিল্লার নির্বাচনকে নিয়ে কিছু বাস্তববাদী বিশ্লেষণ করার একটা প্রয়াস নেব আজকের লেখায়।
গত ১৫ জুন অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৩৪৩ ভোটের ব্যবধান হওয়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী নৌকা প্রতীক নিয়ে রিফাত পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট। তুমূল প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ নির্বাচনে অল্প ব্যবধানে হারার পর স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করে আইনি লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে সাক্কু পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট। গোটা বাংলাদেশের দৃষ্টি ছিল কুমিল্লার সিটি করপোরেশনের দিকে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, এ নির্বাচন ছিল অনেকের জন্য পরীক্ষা। ফলে পরীক্ষার সঙ্গে পাস ও ফেলের সম্পর্ক জড়িত। তবে পরীক্ষক কে সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে, কেননা পরীক্ষক কি জনগণ নাকি মিডিয়া নাকি তথাকথিত সুশীল- সেটা নিয়ে জনপরিসরে বিরাট মতানৈক্য আছে। তবে কুমিল্লার নির্বাচন যে অনেকের জন্য একটা পরীক্ষা, সেটা নিয়ে মেজরিটির একটা মতৈক্য আছে বলে আমার মনে হয়েছে। এটা প্রথম পরীক্ষা ছিল নির্বাচন কমিশনের, কেননা নির্বাচন কমিশন গঠন করা নিয়ে সরকারের বাইরের রাজনৈতিক দলগুলো যে ধরনের সমালোচনা এবং বিতর্ক সামনে এনেছিল, এ কমিশন আওয়ামী লীগের দলীয় কমিশন, সেটা মিথ্যা প্রমাণ করা এবং নির্বাচন প্রশ্নে কমিশনের অবস্থান নিরপেক্ষ এবং নির্দলীয়।
তাছাড়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল একটি সুষ্ঠু, সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করা! কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকেন্দ্রিক নানান বিতর্ক এড়িয়ে একটি সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা ছিল নির্বাচন কমিশনের তরফে একটা বড় পরীক্ষা। এছাড়াও ইভিএম মেশিনে ভোটগ্রহণ নিয়ে যে ধরনের বিতর্ক বাজারে জারি আছে, সেটা ভুল প্রমাণ করে আগামী নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার জন্যও কুসিকের নির্বাচন একটি বড় পরীক্ষা ছিল। আওয়ামী লীগের জন্যও বড় পরীক্ষা ছিল, দলীয় সরকারের অধীনের সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব কিনা, কেননা বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বারবার যে কথা বলে রাজনীতির বাজার গরম করছে সেটা হচ্ছে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। যেহেতু আওয়ামী লীগ বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আছে অর্থাৎ সরকারে আছে, সেহেতু সরকারে থাকার পরও কুসিক নির্বাচনে কোনো প্রভাব না খাটিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা করে আওয়ামী লীগের জন্য পরীক্ষা ছিল এটা প্রমাণ করা যে, দলীয় সরকারের আমলেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য পরীক্ষা ছিল নির্বাচনকালীন সম্ভাব্য সহিংসতা রোধ করা এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। এ রকম বহুমাত্রিক পরীক্ষা ছিল কুসিক নির্বাচন। আমরা যখন এসব পরীক্ষা এবং প্রশ্নকে সামনে নিয়ে বিশ্লেষণে বসেছি, ততক্ষণে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী অল্প ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন। নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে অল্প ব্যবধানে হেরেছেন। অন্য প্রার্থীও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোট (২৯,০৯৯) পেয়েছেন। এখন বিচার-বিশ্লেষণের বিষয় হচ্ছে, কে পাস করেছে আর কে ফেল করেছে।
নির্বাচন কমিশনকে পাস মার্ক দেয়া যায় বলে আমার মনে হয়েছে, কেননা কুসিক নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ করতে আমরা এক ধরনের আন্তরিক প্রচেষ্টা লক্ষ করেছি। নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন কমিশনার এবং এর স্থানীয় কর্মকর্তাদের নিরলস চেষ্টা আমরা লক্ষ করেছি। এমনকি নির্বাচনের আগে কুমিল্লা-৬ আসনের সাংসদ বাহাউদ্দিন বাহারকে অফিসিয়ালি চিঠি দিয়ে কনসার্ন জানিয়ে এলাকা ত্যাগ করার অনুরোধ জানিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্থানীয় পর্যায়ে নিয়মিত তদারকি করেছেন যাতে নির্বাচনের আগেই একটা ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড’ বজায় থাকে। ফলে কুসিক নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের চেষ্টা, আন্তরিকতা, সক্রিয়তা এবং কার্যকর পদক্ষেপ বিবেচনায় এ পরীক্ষায় নির্বাচন কমিশনকেও পাস মার্ক দেয়া যায়। তবে ভোটারের উপস্থিতির হার ৬০ শতাংশের বেশি বাড়াতে না পারাটা নির্বাচন কমিশনের দায়-দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাছাড়া ভোট গণনা এবং ফলাফল ঘোষণায় শেষ মুহূর্তের বিশৃঙ্খলাটা এড়ানো গেলে, তার কৃতিত্ব নির্বাচন কমিশনের ঝুড়িতেই যেত।
এরপরও অবশ্য পাস মার্ক দেয়া যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। কেননা কোনো ধরনের বড় রকমের সহিংসতা ছাড়া একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পর্যাপ্ত সহযোগিতা দিয়ে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছে। বাংলাদেশে সহিংসতা ছাড়া নির্বাচনের ইতিহাস খুব বেশি নেই। নির্বাচন হয়তো নিরপেক্ষ হয়, বেশির ভাগ কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় এবং ভোটারের সংখ্যা কম-বেশি কিন্তু দুয়েকটা বড় ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেই। কুসিকের নির্বাচন এ রকম কোনো ধরনের সহিংসতা ছাড়াই একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং এ কৃতিত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই দিতে হয়।
ইভিএমেরও একটা পরীক্ষা কুসিকের নির্বাচনে হয়েছে কিন্তু এ পরীক্ষায় ইভিএম পাস করেছে কিনা সেটা বলা মুশকিল, কেননা ইভিএম তার কাছে প্রত্যাশিত পারফরমেন্স করতে পারেনি বলেই মিডিয়ায় নানান সংবাদে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। ইভিএমের মাধ্যমে দ্রুতগতিতে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করার কথা; কিন্তু এর ধীরগতির কারণে নানান কেন্দ্রে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। খোদ আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইভিএমের ধীরগতির জন্য তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পরাজিত প্রার্থীরা এবং বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটাররাও ইভিএমের ধীরগতির জন্য গোস্সা প্রকাশ করেছেন। তবে নির্বাচন কমিশন দাবি করছে, ইভিএমের কোনো সমস্যা ছিল না; বরং ভোটারদের অনভ্যস্ততার কারণেই ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণে দেরি হয়েছে। নির্বাচন কমিশন যে ব্যাখ্যাই দিক না কেন, কুসিকের নির্বাচন থেকে ভবিষ্যতে ইভিএমের ভোটগ্রহণের ন্যায্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণে তেমন কোনো ক্রেডিট নির্বাচন কমিশন পেয়েছে বলে আমার মনে হয়নি।
কুসিকের নির্বাচনে সরকারের ভূমিকাও নিঃসন্দেহে পাস মার্কস দাবি রাখে, কেননা আমরা লক্ষ করেছি, সরকার এ নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য কোনো ধরনের দৌড়ঝাঁপ করেনি। নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়া ছাড়া সরকারের কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তারের ঘটনা আমরা দেখিনি। এমনকি কোনো মিডিয়া সরকারের প্রভাব খাটানো নিয়ে সংবাদ প্রকাশ বা প্রচার করেছে এ রকম কিছু আমার চোখে পড়েনি। তাই দলীয় সরকারের আমলেও যে নির্দলীয় এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে সেটা কুসিক নির্বাচন প্রমাণ করেছে। তবে কুমিল্লা-৬ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদকে নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে সেটা না হলে সরকারের ভূমিকা আরো সুন্দর হতো বলে আমি মনে করি।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়