আবহাওয়ার পূর্বাভাস : অপরিবর্তিত থাকতে পারে দিন-রাতের তাপমাত্রা

আগের সংবাদ

কুমিল্লায় ভালো ভোটের পর ফলাফল নিয়ে উত্তেজনা : রিফাতকে জয়ী ঘোষণা > অজ্ঞাত ফোনের পর হামলা > মনগড়া ফল : অভিযোগ সাক্কুর

পরের সংবাদ

বেসরকারি আগুন : সরকারি ক্ষতিপূরণ

প্রকাশিত: জুন ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মৌলভীবাজারে পারাবত ট্রেনে বা পদ্মায় চলন্ত ফেরিতে আগুন সীতাকুণ্ডের তুলনায় ঘটনার মধ্যেই পড়ে না। সোজা মাপে সংবাদমূল্যহীন। যে কারণে সীতাকুণ্ডের দগদগে আগুনের মধ্যে ওই দুই আগুন গণমাধ্যমে ভ্যালু পায়নি। প্রাণহানি না থাকায় ক্ষতিপূরণের প্রশ্নও আসেনি। আগুন লাগে, না লাগানো হয়, দায়ী সরকার না মালিকরা- এ ধরনের প্রশ্নের নিষ্পত্তি হয়েও হয় না। প্রশ্নটি হারিয়ে যায় নানান কথায় অথবা আরেক ঘটনায়। তদন্ত কমিটির নামেও কম হয় না। এর মাঝে ঘটে চলে অগ্নিকাণ্ডের ছোট-বড় এক একটি ঘটনা।
প্রাণহানি বা হতাহতসহ ক্ষয়ক্ষতি থাকলে প্রায় প্রতিটা দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসে ক্ষতিপূরণ পর্ব। নিহত, আহতদের জন্য মোটা অঙ্কের আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা। সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরপরই চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার হতাহতদের পরিবারকে কত টাকা দেয়া হবে তার ঘোষণা দেন। পরে অন্যরাও। নিহতদের সঙ্গে, আহতদের সঙ্গে দরদস্তুরের ব্যাপার। অব্যবস্থাপনার শিকার লাশ বা মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা দগ্ধদের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষতিপূরণের রেট ঘোষণা কত অমানবিক! ওই সময় কোনো কর্তৃপক্ষই মন থেকে, বিশ্বাস থেকে দৃঢ়ভাবে বলে না- কোনো অব্যবস্থাপনা ছিল কি-না সেটি খতিয়ে দেখা হবে, কোনো কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ছিল কি-না- খুঁজে দেখা হবে। কেউ যেমন বলে না, তেমন কাজটি করেও না। এ ক্ষেত্রে রাজনীতি, প্রশাসন এমনকি কখনো কখনো মিডিয়ায়ও মানবিকতাবোধের ঘাটতি প্রকট।
অবহেলার আগুনে মানুষ কয়লা হলেই সরকার বা রাষ্ট্রকে দায়ী করার একটি মানসিকতা স্পষ্ট। তখন আর ব্যক্তির অস্তিত্ব থাকে না। মানুষের অবহেলায় তৈরি দুর্ঘটনা বা জানমালের ক্ষতিপূরণ রাষ্ট্র কেন বহন করবে- এ প্রশ্ন উপেক্ষার মতো নয়। রাষ্ট্রকে বা রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানকে দায়বদ্ধ করে প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করার সস্তা সেøাগান এদেশে বড় বড় জ্ঞানীরাও দেন। প্রকৃত অপরাধীর জন্য এটি আড়ালে বসে হাসার মওকা। আর আগুন উৎসব জমানোর সুযোগ। দায়ীদের কাছে তখন এ আগুন উৎসবের দৃশ্য মনোমুগ্ধকর-আনন্দদায়ক।
কঠিন এ বাস্তবতার জেরে ঘটেই চলেছে একের পর এক আগুনের ঘটনা। বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ঘটছে প্রাণহানি। ক্ষতিগ্রস্ত ও অগ্নিদগ্ধ হয়ে বেঁচে থাকা মানুষের আর্তনাদ কর্তৃপক্ষের হৃদয় স্পর্শ করলেও সময়ের ব্যবধানে এতে ধুলো পড়ে যাচ্ছে। বন্ধ হচ্ছে না আগুনে পুড়ে মৃত্যুর মিছিল। পুরান ঢাকার নিমতলী, চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার বা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হয়ে এ সিরিয়ালের কি শেষ থাকতে নেই? বারবারই প্রশ্ন উঠছে, এসব ঘটনার দায় কার? কেউ কেউ দোষেন কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকে। অনেকে ভবন মালিক এবং বাসিন্দাদের অসচেতনতা, অসতর্কতা ও অব্যবস্থাপনাকে দুষছেন। মৃত্যুর ঘটনাকে অনেকে অবহেলাজনিত হত্যা বলেও চিহ্নিত করেন। সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ড নিয়েও তাই হচ্ছে।
আবিষ্কারের পর থেকেই আগুন শক্তিমান। ফলে একে ঘিরে বিকশিত হতে থাকে আগুনের পূজা-প্রার্থনা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। মানুষের আদিম অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়েছিল আগুন আবিষ্কার। তারপর সেটি খাদ্য প্রস্তুত, শীত নিবারণসহ নানাবিধ কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সাধারণত বসন্ত বা মধ্য-গ্রীষ্মকালে বহ্ন্যুৎসব হতো। কোথাও আবার শরৎ শেষে অথবা শীতেও, বিশেষ করে হ্যালো ইভনে, ক্রিসমাসে এবং টুয়ালফথ ডের সন্ধ্যাকালে। বসন্তের অগ্নি-উৎসবটি সাধারণত লেন্ট পর্বের প্রথম রবিবার অনুষ্ঠিত হয়, ইস্টার সন্ধ্যায়। লেন্ট পর্বে বহ্ন্যুৎসবের প্রথা চালু আছে বেলজিয়াম, উত্তর ফ্রান্স ও জার্মানির বেশ কিছু অঞ্চলে। বেলজিয়ামের আর্ডেন মালভূমিতে যেমন বলা হয় ‘মহাবহ্নির দিন’। এর এক সপ্তাহ বা পনেরো দিন আগে কিশোর-কিশোরীরা খামারে ঘুরে ঘুরে জ্বালানি সংগ্রহ করে। গ্র্যান্ড হ্যালিউর সময় কেউ যদি তাদের অনুরোধ না রাখে, তাহলে পরদিন বাচ্চারা সেই বাড়িতে গিয়ে নিভন্ত চুলার ছাই ও কয়লা দিয়ে তার মুখ কালো করে দেয়। দিনটি উদযাপনের জন্য তারা ঝোপঝাড় কেটে পরিষ্কার করে, সেসবও জ্বালানো হয় পাহাড়ে পাহাড়ে। প্রচলিত আছে, দাবানল থেকে গ্রামকে বাঁচাতে চাইলে অন্তত সাতটি বহ্ন্যুৎসব দরকার। গ্র্যান্ড হ্যালিউ উৎসবে একটি বাঁশ পোঁতা হয়, যার নাম মাকরাল বা ডাকিনী। তাতে সদ্য বিবাহিত কোনো ব্যক্তি আগুন জ্বালিয়ে দেয়। মোরলান ওয়েলজের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে খড়মানবকে পোড়ানো হয়। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন পার্বণ ও উৎসব উপলক্ষে মানুষ আগুন জ্বালিয়েছে। এসব পার্বণের প্রাচীনতম দৃষ্টান্ত দীর্ঘ।
পূজনীয়র জায়গা থেকে আগুন ভয়ের জায়গায় এসেছে মানুষের ওপর ভর করেই। আপনা-আপনি বা এমনি-এমনি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা খুব কম। হোক গরিবের বস্তি বা ধনীর অট্টালিকা। নেপথ্য কারণ উদ্দেশ্যমূলক না দুর্ঘটনা তা খুঁজে বের করার দৃষ্টান্ত কম। তবে, যদি, কিন্তু দিয়ে সম্ভাব্য কারণ ও পরামর্শ প্রচুর। সেই সঙ্গে ক্ষতিপূরণ। আর তদন্ত কমিটি গঠন। বরাবরই ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে আসে নাশকতার শঙ্কার কথা। সেখানে ইঙ্গিতটা থাকে সরকারবিরোধীদের দিকে। প্রায় প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড নিয়েই এ চর্চা হচ্ছে। কিন্তু আগুনের কারণ কিংবা উৎস সুনির্দিষ্টভাবে বের করা হচ্ছে না। সব অগ্নিকাণ্ডের একটা পরিণতি হচ্ছে, সরকারের ওপর জনগণের ক্ষোভের মাত্রা বৃদ্ধি।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কন্টেইনার ডিপোতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বিশ্বগণমাধ্যমে আবারো শিরোনাম করেছে বাংলাদেশকে। এর আগে রাজধানীর নিমতলী বা চুড়িহাট্টা বা তাজরীন গার্মেন্ট- সবখানেই দেখা গেছে দুর্ঘটনা প্রতিরোধী ব্যবস্থাপনার অপর্যাপ্ততা। অগ্নি-দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে অত্যাধুনিক শহরগুলোতে সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা ফায়ার হাইড্রেন্ট। অর্থাৎ পানির একটি সংযোগ উৎস, যেখান থেকে দুর্ঘটনা চলাকালে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। এতগুলো ট্র্যাজেডির পরও দেশের কোথাও ফায়ার হাইড্রেন্টের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বাংলাদেশে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, সুরক্ষাসামগ্রী এবং জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই উদ্ধার অভিযানে পাঠানো হয় উদ্ধারকর্মীদের। ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের হিসাবে গত এক দশকে দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৮টি। এসব ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার এবং আর্থিক ক্ষতি ৪ হাজার ২৮৩ কোটি টাকার বেশি। সচরাচর কোনো দুর্ঘটনায়ই মালিকপক্ষ প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করতে চায় না। ফলে বেশিরভাগ উদ্ধার অভিযানেই উদ্ধারকারীরা পড়েন বিপাকে।
তথ্য আড়ালের এ মানসিকতা গুজব তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। পুরান ঢাকার নিমতলী বা সাভারের তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের এক যুগ বা এক দশক পর এসেও সীতাকুণ্ডে কেন আগুন নেভাতে এত সময় লেগেছে- ঘুরেফিরে এসেছে প্রশ্নটি। উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে তথ্যের ঘাটতি। আর গুজবের নানা সুযোগ। আগুন নেভাতে দীর্ঘ সময় ব্যয়ের পেছনে এখন পর্যন্ত চিহ্নিত কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- ডিপোজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের জার, রাসায়নিকের সব কন্টেইনার শনাক্ত করতে না পারা, কন্টেইনার কেটে আগুন নেভানো এবং ডিপোর যন্ত্রপাতির সংকট। আয়তনে ২৪ একরের ডিপোটির পুরোটাজুড়ে ছিল আগুন ছড়িয়ে পড়ার যাবতীয় উপাদান। কিন্তু দায়ী হয়ে যাচ্ছে সরকার। আবার এ দায় মুছতে গিয়ে মন্ত্রীদের দিতে হচ্ছে উল্টাপাল্টা বচন। সীতাকুণ্ডে কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে প্রাণহানির ঘটনায় কারো গাফিলতি থাকলে বিচারের মুখোমুখি করার গড়পড়তা ঘোষণা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণার প্রেক্ষিতে সমগ্র দেশে সৃষ্ট আনন্দ-উল্লাসকে অবদমিত করতেই সীতাকুণ্ডে নাশকতা করা হয়েছে কি-না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে বক্তৃতায় একটু নতুন মাত্রা দিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়