মির্জা ফখরুল : খালেদার কিছু হলে দায় নিতে হবে সরকারকেই

আগের সংবাদ

কুমিল্লায় ইসির ‘এসিড টেস্ট’

পরের সংবাদ

পোশাক নয়, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হোক

প্রকাশিত: জুন ১৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পোশাক একটি রাষ্ট্রের বা দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টির অন্যরকম বাহক। জাতির সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। আচার-আচারণ, জীবনযাপন বলে দেয়। পোশাকই বলে দেয় রাষ্ট্রের সংবিধানের মূল চেহারা। আবার প্রতিটি রাষ্ট্রেই আর সবকিছুর মতোই জাতীয় পোশাক থাকে, যা সেই দেশের সার্বভোমত্ব, সংস্কৃতি, কৃষ্টি আর ঐতিহ্যকে প্রকাশ করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সাধারণত দেশটির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বহনে তাই পোশাকের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে। যদিও আমার জানা নেই যে, বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক কোনটি। কিংবা এভাবে বলা যায় যে, জাতীয় ফল কাঁঠালের মতো জাতীয় পোশাক হিসেবে শাড়িকে আমার মনে হলেও এখন আমি কনফিউজড। এক সময়ে শাড়ি পরতে বিভিন্ন বয়সি নারীকে দেখা গেলেও এখন সেই দৃশ্যে ভাটা পড়েছে। শাড়ির প্রতি এ কিন্তু অনীহা নয়, বরং কর্মব্যস্ত জীবনে জীবনযাপনকে সহজ করে তুলতে শাড়ির বদলে নারীদের সালোয়ার কামিজ, ট্রাউজার টপস, ফতুয়া ইত্যাদি ধরনের পোশাকের ব্যবহার ও প্রচলন বেড়েছে। আবার বিভিন্ন ধরনের পেশায় এখন নারীদের সফল বিচরণ। শত প্রতিকূলতার মাঝে পুরুষের পাশাপাশি পুরুষের মতোই নারীকে কাজ করতে হয়, যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয় এবং পদ মর্যাদায় আসীন হতে হয়। শ্রম ও মেধার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেই নারীকে তার জায়গা করে নিতে হয়। প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হয় বলে কাজ ও পরিবেশকে সহজ করে তুলতে নারী এখন তার বেশবাসকেও সহজ করে নিতে শিখেছে, নিয়েছে।
আর্থসামাজিকভাবে বাংলাদেশের যে অভাবনীয় উন্নয়ন, মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ তাতে কিন্তু এই নারীদের শ্রম ও অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারী তার কাজকে সময় উপযোগী করে তুলতে পোশাক ও তার সময়কে সহজতর করেছে, আধুনিক করেছে। নিজের চিন্তাচেতনায় সহজ করে নিয়েছে। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। ব্যতিক্রম দেখা যায়। যে ব্যতিক্রমটির প্রচলন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে বা অজুহাতে ঘটেছে, ঘটছে। পোশাকটি হলো বোরকা ও হিজাব। শহরের তুলনায় মফস্বল অঞ্চলে এর আধিক্য ক্রমশ বাড়ছে। পথেঘাটে একশ নারীর মধ্যে এখন ষাট-সত্তর জনকে এমন পোশাকে দেখা যায়। চোখে পড়ে। এই পরিবর্তন এখন চোখে বেশ লাগলেও, পরিবর্তনটা দ্রুত ঘটেনি।
সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশ। রয়েছে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার ভোগ করবার একটি পবিত্র সংবিধান। তারপরও সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রচার, প্রভাব, বিচরণ তুলনামূলক বেশি। আধিপত্য বিস্তারে তাদের অপচেষ্টাও সক্রিয় হয়েছে, থেকেছে। প্রায়ই ধর্মীয় উগ্রবাদে একটা শ্রেণি তৎপর হয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাত হেনেছে, হানছে। যা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের জন্ম দিয়েছে বহুবার। হতাহত হয়েছে, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সংখ্যালঘুদের। এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হওয়ায় সমাজে অন্যরকম সংস্কৃতির আবির্ভাব হয়েছে। ‘বোরকা’ ও ‘হিজাব’-এর মতো পোশাকের আধিক্য তারই ফলাফল বলে অনেকেই মনে করেন। শুধু ধর্মীয় কারণে উদ্বুদ্ধ হয়েই যে এমন পোশাকে নারীদের কেউ কেউ অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন, অনেকে মনে করেন সেটাও কিন্তু ঠিক নয়।
একজন তরুণীকে দেখলাম যথেষ্ট আধুনিক এবং ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির জন্য ছোটাছুটি করছে। এক পর্যায়ে নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়ার সময়ে ট্রেনে চড়ে হিজাব ও বোরকা পরে নেয় চটপট। কারণ হিসেবে বলল, মফস্বল এলাকায় হিজাব ও বোরকা পরে না চলাচল করলে ইভটিজিং ও হেনস্তার শিকার হতে হয়। ধর্মীয় দৃষ্টিতে ভালোভাবে দেখা হয় না এসব ছাড়া। নারীদের শিক্ষার হার যতই বাড়–ক না কেন শহর কিংবা গ্রামে, নারীকে অবদমিত করে রাখা, পর্দার আড়ালে রাখার অপচেষ্টা আজো অব্যাহত। বাবার চাকরির সুবাদে অন্য শহরে বসবাস করেন। তাই মায়ের সঙ্গে থেকে তাকে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয় নেহায়েতই নিরাপত্তার স্বার্থে। এমন পোশাক কখনোই তার কাক্সিক্ষত নয়। কিন্তু পরতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। ঢাকা ও তার নিজ এলাকায় বিচরণের বেশবাস ও আচরণ একেবারেই বিপরীত এবং সেটা করেছে এই ভারসাম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে। নারীকে আড়ালে, অন্তরালে নেয়ার এই অপচেষ্টা হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতার ভয় দেখিয়ে, যা কিনা সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে তুলে ধরে।
সাম্প্রতিককালে নরসিংদী রেল স্টেশনে এক নারীর পোশাক নিয়ে আরেক নারীর ক’জন পুরুষসহ হিংস্র হয়ে উঠবার ঘটনাটি বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছে। যে নারীকে হেনস্তা করা হয়েছে তার পরনে প্যান্ট ও টপস ছিল। এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয় ছিল তা হলো, এতদিন দেখা গেছে পুরুষ নারীকে বিভিন্নভাবে যত্রতত্র হেনস্তা করেছে। করেছে লাঞ্ছিত ও নির্যাতন এবং তা বিভিন্ন ধর্মীয় অজুহাতে, দোহাইতে। বিশেষ করে ধর্মীয় গোঁড়ামিতে নারীকে পর্দার ভেতরে আড়াল করে তার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করবার পাঁয়তারা চালানো হয়েছে। যা করত পুরুষ। এখন নারীকে যুক্ত করা হয়েছে এমনতর হীন কাজে এবং নিঃসন্দেহে এটা একটা সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে। সোজাসাপ্টা নারীর পেছনে নারীকেই লেলিয়ে দেয়া হয়েছে, হচ্ছে এখন। এমন যুক্তি অমূলক নয় মোটেও। নারীর সঙ্গে নারীকে সংঘর্ষে লিপ্ত করা হচ্ছে। নারী জাতির ভেতর বিভেদ তৈরি করে নারী জাতিকে দুর্বল করবার অপচেষ্টা চলছে। যদিও প্রচেষ্টা পুরনো হলেও এখন তা দৃশ্যমান। মিডিয়ার সুবাদে নির্যাতনকারী আটককৃত নারীকে দেখার সুযোগ হলো। র‌্যাব তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় সে আঙুল উঁচিয়ে ভি দেখাল এবং তার পরনে বোরকা ছিল। সাধারণত আঙুল দ্বারা যে ভি দেখানো হয় তা জয় বা বিজয়কে প্রকাশ করে। এখানে পরিষ্কার মনে হয়েছে যে, প্যান্ট ও টপস পরনের নারীকে হেনস্তা ও লাঞ্ছিত করে নির্যাতনকারী নারী বিজয়ী হয়েছে বলে আঙুল দেখিয়ে দাবি করছে।
পোশাক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। ব্যক্তি তার পছন্দমতো পোশাক পরিধান করবেন। তবে কোনো পোশাকই যেন পরিবেশ অনিয়ন্ত্রিত করে না ফেলে সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। জিনস প্যান্ট ও টপস কিংবা স্কার্র্ট কখনোই পরিবেশকে অনিয়ন্ত্রিত করে না যদি না তা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়। ধর্মীয় গোড়ামি ও উগ্রবাদে আচ্ছন্ন একজন বোরকা পরিহিত নারী জিনস প্যান্ট ও টপস পরিহিত একজন নারীকে কখনোই ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখবেন না। না দেখার কারণ হলো, তিনি ভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছেন, বিচরণ করছেন। এর পেছনে কোনো চক্র কাজ করছে কিনা। যা নারীকে অবদমিত করার, শত বছরের পেছনে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা। নরসিংদী রেলস্টেশনের ঘটনাটি সংকেত দিয়েছে সমাজের পরতে পরতে কী হচ্ছে, চলছে তার। গ্রামগঞ্জে ধর্মকে অপব্যবহার করে অপরাজনীতির চর্চার কথাই বলছে।
নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার জন্য একটা শ্রেণির পুরুষ নারীর পোশাককেই অতীতে দায়ী করতেন, বর্তমানেও দায়ী করছেন। কিন্তু এই শ্রেণির পুরুষ তখন কিছু বলেন না যখন বোরকা বা হিজাব পরিহিত কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হন, মাদ্রাসার কোনো নারী শিক্ষার্থী ইমাম কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হন কিংবা কোনো কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হন। পোশাক মোটেও নয়, নারীর প্রতি সহিংসতার মূল কারণ হলো নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারিত ও আইনসম্মত না হওয়া। শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর নারীবান্ধব বিষয়াদিও গুরুত্ব না পাওয়া। সর্বোপরি আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা ও প্রতিবন্ধকতা। নরসিংদীর ঘটনা সম্পর্কে একজন সংসদ সদস্য এমনটাই বলছিলেন, নারীকে পোশাক পরিধানে সতর্ক হতে হবে। অবাক হলাম তার কথা শুনে। জিনস প্যান্ট ও টপস কী জাতীয় অসতর্কতার জন্ম দিল! মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের মেয়েদের মুসলিম রীতিতে পোশাক পরিধান করতে হবে এবং সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ কথাটা যেন কথার কথা।
পরিশেষে বলব, নরসিংদী রেলস্টেশনের ঘটনার পেছনের ঘটনা উন্মোচন করতে হবে। ওটা সম্ভব করা না হলে নারীর প্রতি সহিংসতার ধরন ও কৌশল আরো সুদূরপ্রসারী হবে। বর্তমান উন্নয়ন ধারাকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য এ হবে মহাষড়যন্ত্র। সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে। চেতনার জায়গায় সংস্কারের কাজটি করতে হবে এবং সেটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সংরক্ষিত করেই। আর যারা নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করছেন, ভাবছেন, কথা বলছেন তাদেরও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী সক্রিয় হতে হবে। কারণ দেশের সংবিধানই নারীর নিরাপত্তার অন্যতম হাতিয়ার।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়