ঐক্য পরিষদের বিবৃতি : ধর্ম মন্ত্রণালয়ে বাজেট বরাদ্দে ধর্মীয় বৈষম্য অবসান দাবি

আগের সংবাদ

নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা : সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি

পরের সংবাদ

এই খামখেয়ালিপনার শেষ কোথায়?

প্রকাশিত: জুন ৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

হঠাৎ অদ্ভুত শব্দে সবকিছু কেঁপে ওঠে। জানালার কাচ ভেঙে পড়ছে, ঘরে রাখা টিভি থেকে শুরু করে আসবাবপত্র থরথরে কাঁপুনি দিয়ে নিচে পড়তে থাকে। সীতাকুণ্ডের ৪-১০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত ভয়াবহ বিস্ফোরণের প্রভাব পড়ে। আগুনের লেলিহান শিখার ঝলকানি দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। হ্যাঁ যুদ্ধ ঠিকই শুরু হয়েছে সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপোর আশপাশে থাকা সমস্ত জীবের জীবনে। এই যুদ্ধ একাত্তরের মতো প্রস্তুতিমূলক যুদ্ধ নয়; এই যুদ্ধ প্রস্তুতিবিহীন নিশ্চিত প্রাণঘাতী যুদ্ধ। অন্যকে বাঁচাবার সঙ্গে নিজেও বাঁচবার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে বলে যুদ্ধবিরতি নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সীতাকুণ্ডে কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের দৃশ্য হলিউড কিংবা বলিউডের যে কোনো সিনেমার দৃশ্যকে হার মানাতে বাধ্য করেছে। নির্মিত হয়েছে বাস্তবজগতে মানুষসহ অসংখ্য জীবের মৃত্যু, পোড়াদেহের গন্ধ আর হাসপাতালে হাত-পা কাটা মানুষের আর্তনাদ। রাসায়নিক পদার্থ বিস্ফোরণে সারা শরীর জ্বলছে, মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আহাজারির দৃশ্য চারিদিকে। এ যেন আরেক হিরোশিমা কিংবা নাগাসাকি শহর।
গ্রামে বেড়ে ওঠার সুবাদে দেখেছি কারোর বাড়িতে আগুন লাগলে প্রথমে বাড়ির মালিক প্রাণপণ চেষ্টা করেন আগুন নেভাতে। নিজের চেষ্টা ব্যর্থ হলে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন সাহায্যের জন্য। ফলে প্রতিবেশীরা তাৎক্ষণিকভাবে আগুন লাগার কারণ জানার চেষ্টা করেন, কেউ আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন আবার কেউবা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘরে আটকাপড়া মানুষ উদ্ধারের জন্য কৌশলে জ্বলন্ত ঘরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হয়তো পুরো বাড়ি রক্ষা করা যায় না; কিন্তু কিছু না কিছু সম্পদের শেষরক্ষা হয়। কিন্তু আমরা সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডে কী দেখলাম? চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কাজে নামলে ডিপোর মালিক কিংবা কর্মকর্তা কেউই সঙ্গে ছিলেন না। বরং তারা লাপাত্তা! ফলে কন্টেইনারের ভেতর কী আছে পরিষ্কার জ্ঞান না থাকায় আগুন নেভানোর কাজে পানি প্রয়োগ করায় সর্বনাশ ঘটে যায়। কন্টেইনার ডিপোতে যে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ ছিল সেটা অবগত না করার কারণে আজ সীতাকুণ্ড হিরোশিমা নাগাসাকিতে পরিণত হয়েছে। রাসায়নিক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন শুধু হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডে নয়, অন্যান্য দাহ্য রাসায়নিকও বিদ্যমান। বিএম কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক পদার্থ রাখার অনুমতি আছে কি-না সেটিও প্রশাসনের অজ্ঞাত। প্রশ্ন হচ্ছে যেখানে বিদেশের সঙ্গে এদেশের ব্যবসা চলে সেই ডিপোতে কিসের অনুমতি আছে আর কিসের নেই এই তথ্য প্রশাসন কিংবা কোনো মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই কেন? কর্মরত শ্রমিকদের ঝুঁকিতে ফেলে হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে এতবড় দুর্ঘটনা ঘটানোর আয়োজন কি একদিনে হয়েছে? এতদিন ডিপোটি সরকারের নজরে ছিল কি-না? যদি থাকে তাহলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীসহ যে শ্রমিকদের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে এবং মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে চলেছে এসবের দায়ভার কে নেবে? বিস্ফোরণের ফলে যাদের অমানবিক মৃত্যু হয়েছে এবং যারা মৃত্যুর যন্ত্রণা নিয়ে এখনো বেঁচে আছে তাদের পরিবারের জন্য অর্থ বরাদ্দের ঘোষণা এসেছে। এক থেকে নয় অঙ্কের পেছনে পর্যায়ক্রমে শূন্য লাগিয়ে অর্থ বাড়িয়ে কি কখনো জীবন ফেরানো যায়? কখনো কি গিয়েছে? যে মা হাজারো যন্ত্রণা সহ্য করে সন্তানকে পেটে ধারণ করেছে, নিজে কম খেয়ে সন্তানকে খাইয়ে বেঁচে থাকার শেষ সম্বল হিসেবে বড় করেছে সেই মায়ের চোখের সামনে সন্তান যখন আগুনে পুড়ে কালো ছাই হয়ে পড়ে আছে তখন যন্ত্রণায় বুক ফাটা মা অঙ্কের পেছনে শূন্যভরতি অর্থের বিনিময়ে সন্তানকে ফিরে পাবেন? যে সন্তান তার বাবার স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে সে কি কখনো তা অর্থের বিনিময়ে ফিরে পাবে? সারাজীবন একসঙ্গে পথ চলার, সুখে-দুঃখে পাশে থাকার শপথ নেয়া স্ত্রী যে তার স্বামীকে হারিয়েছেন বাকি জীবনে কি আর ভরসার একমাত্র ব্যক্তিকে ফিরে পাবেন? পুঁজিবাদী সমাজে সবকিছুকে পুঁজির বিনিময়ে কেনার চেষ্টা করলেও মা-বাবা তার সন্তানকে, সন্তান তার মা-বাবাকে, স্ত্রী তার স্বামীকে, স্বামী তার স্ত্রীকে পুঁজির বিনিময়ে ফিরে পান না।
আমরা ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের কথা ভুলিনি। কিন্তু ঠিকই ভুলে গেছি রানা প্লাজা ধসের মধ্য দিয়ে আমাদের কী শিক্ষা দিয়ে গেছে। রানা প্লাজার বহুতল ভবন নির্মাণাধীন সমস্যার কারণে, দায়িত্বহীনতার কারণে, জীবনকে নয় বরং পুঁজিকে বড় করে দেখার কারণে কত মানুষের রক্তে মাটি ভিজেছে তা না ভুললেও ভুলে গেছি মানুষের জীবনের নিরাপত্তার কথা। ভুলে গেছি বলেই সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণ এবার অতীতের ইতিহাসকে পরাজিত করেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু মর্মান্তিক নতুন ইতিহাস দাঁড় করিয়েছে। রানা প্লাজা ধসে নিহত ১ হাজার ৩৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে আর পঙ্গুত্ববরণ করেছে প্রায় হাজারখানেক শ্রমিক। ৯ বছরেও কি আমরা এত শ্রমিকের মৃত্যু আর পঙ্গুত্ববরণের বিচার পেয়েছি? তবে কি শ্রমিকের জীবনের কোনো মূল্য নেই? বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফল সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণ নয় কি? এসব কি নতুন কিছু? না! নতুন কিছু না। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লাশের গন্ধ আছে, রূপগঞ্জে কারখানায় শ্রমিকের কান্না ভেসে আছে। আর কত যুক্ত হবে? এভাবে অপমৃত্যুর দায়ভার কে নেবে? সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণের ফলে রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন খাল বিল নলের ভেতর দিয়ে সমুদ্রে গড়ানোর চেষ্টা থামানো হলেও হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডসহ যেসব রাসায়নিক পদার্থ ছিল তা বিস্ফোরণের ফলে বাতাসের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথমে যারা আগুন নেভানোর কাজে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে এসেছে তাদের অজান্তেই শরীরে কেমিক্যাল প্রবেশ করেছে। বায়ুতে মিশে আস্তে আস্তে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাসায়নিক সংরক্ষণ সম্পূর্ণরূপে অবৈজ্ঞানিক। লোকালয়ের মধ্যে এগুলো কোনোভাবেই রাখা যায় না। তবে কার পরামর্শে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক সংরক্ষণ করেছেন? যদি সরকার অনুমোদন দিয়ে থাকে তবে কোন যুক্তিতে দিয়েছে? তার ওপর সামান্য অগ্নিনিরাপত্তা প্রস্তুতিও ছিল না। অবৈজ্ঞানিক ভুল সিদ্ধান্তের ফলে সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণের ফল এলাকাবাসীকে দীর্ঘমেয়াদে ভুগতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাসায়নিকের প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিক দেখা না গেলেও ৬ মাস থেকে শুরু করে কয়েক বছর পরও প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। যেমনটা ঘটেছে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে বোমা হামলায়।
শ্রমিকের জীবন নিয়ে এত খামখেয়ালিপনা কেন? যুগে যুগে শ্রমিকরাই তো জগৎ বিনির্মাণ করেছে, সভ্য সমাজের তথা আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক সমাজের সমস্ত কিছু তৈরি করে চলেছে। তবে তাদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে আমরা ব্যর্থ কেন? মানুষের জীবন নিয়ে যারা খামখেয়ালিপনায় লিপ্ত থাকে তাদের জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে শাস্তি দিতে গড়িমসি কেন?
হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডকে বলা হয় অক্সিডাইজিং এজেন্ট। এটা নিজে দাহ্য না, কিন্তু এর মধ্যে যদি কোনো ইমপিউরিটিস থাকে, যদি সেখানে অন্য রাসায়নিক থাকে, তাহলে সেটা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডকে ডিকম্পোজ (বিক্রিয়া) করে। সেই বিক্রিয়া থেকে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে যে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ছিল, সেগুলো পিওর ছিল না। অথবা সেখানে অন্য কোনো রাসায়নিক থাকার কারণে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন জেনারেট হয়েছে। এই অক্সিজেনটাই প্রকৃত অর্থে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের কারণ হয়েছে। বিস্ফোরণের কারণে আশপাশের এলাকাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিল্ডিংয়ের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসে কিছু সমস্যা হবে। এ অবস্থা রোধে মানুষজনকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে। তাদের সেখানে অবস্থান ঠিক হবে না। এসবের পাশাপাশি যে গ্যাস ছড়িয়ে পড়েছে, সেগুলো সম্পর্কে ধারণা নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে দ্রুত। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার সঙ্গে জড়িত মালিককে গ্রেপ্তার করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। শ্রমিকসহ কর্মক্ষেত্রে সব মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

জাফর হোসেন জাকির : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়