করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা ভাষার বিশ্বসেরা স্মারক : শান্তিনিকেতন

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

উপনিবেশিক প্রবর্তিত প্রচলিত শিক্ষার বিপরীতে নতুন শিক্ষা পদ্ধতি চালু করার কথা বিবেচনা করেই নিজ উদ্যোগে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ সালে এই বোলপুরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘শান্তিনিকেতন’। এ প্রসঙ্গে কবি নিজেই বলেছিলেন, ‘আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল যে এখানকার এই প্রভাতের আলো, শ্যামল প্রান্তর, গাছপালা যেন শিশুদের চিত্ত স্পর্শ করতে পারে।’
ভারতের ঝাড়খণ্ডের গুণী মানুষ ছায়া দি (ড. ছায়া গুহ) আর আমার আরেক দিদিমনি মৌ দি (ড. মৌ ভট্টাচার্য) তাঁদের স্নেহধন্য হয়েই এই ‘শান্তিনিকেতন’কে দেখা ও জানা সহজ হয়েছে আমার জন্য। সুদূর বাংলাদেশ থেকে গিয়ে রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য শান্তি নিকেতনের রেস্ট হাউসে রাত্রিযাপনসহ এতটা কাছে থেকে শান্তিনিকেতনকে অনুধাবন করতে পারার অনুভূতি আমার কাছে অ¤øান হয়ে থাকবে চিরকাল।

যাত্রার প্রথম দিন কলকাতা থেকে ছায়াদীর ভাইয়ের বাসা থেকে তাঁর নিজের গাড়িতে করেই যাত্রা শুরু হয়েছিল। সময় ছিল ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। যাত্রাপথে প্রকৃতি যেন আমার প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশ এর সুন্দর গ্রামীণ দৃশ্যকে হার মানাবে। যেন প্রতিটি গ্রাম পরিপাটি ছবির মতো সাজানো। সবুজ ক্ষেত, কৃষি সমৃদ্ধ জনপদ, কোথাও কোথা ও হাট বাজার। পথিমধ্যে বিখ্যাত ‘ল্যাংচা’ নামক মিষ্টি খাওয়ালেন দিদি। কলকাতা থেকে প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টার জার্নি পেরিয়ে পৌঁছুলাম শান্তিনিকেতন। আগে থেকে বুকিং করে রেখেছেন বিদেশিদের জন্য নির্ধারিত আন্তর্জাতিক রেস্ট হাউস। দুপুরের লাঞ্চ সেরেই এক দণ্ড আর রেস্ট করলাম না শান্তিনিকেতন ঘুরে দেখার তৃষ্ণায়।
ভারতের বীরভূম জেলায় ৩৯ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই শান্তিনিকেতন। দুয়েকদিনে এই শান্তিনিকেতন দেখার জন্য যথেষ্ট নয়। শুধু শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন ক্যাম্পাসসমূহ দেখার রাস্তাই রয়েছে ১৮ কিলোমিটার। তবু ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দেখে নেয়ার জন্য একটি অটো নিয়ে নেমে গেলাম। রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত ছাতিমতলা, তালধ্বজ, গাছের তলায় পাঠশালাসমূহ, রাম কিংঙ্গকর কর্তৃক বেইজকৃত ভাস্কর্যসমূহ, কালো বাড়ী, শ্যামলী, পুনঃশ্চ, উপাসনা মন্দির, কোনার্ক, উদীচী, রবীন্দ্র ভবন, মিউজিয়াম, বাংলাদেশ ভবন। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ভবনটি বেশ আধুনিকভাবেই সুসজ্জিতভাবে করা হয়েছে। দুদেশের ভাতৃত্বের অনেক স্মারক সেখানে সংরক্ষিত করা হয়েছে।
শান্তিনিকেতনের আশপাশের এলাকায় বহু কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করছেন। রাস্তার ধারের কোথাও কোথাও দোকান-পাটগুলো আমাদের দেশ বাংলাদেশের অলিগলি পথের মতোই। পথের ধারে হকারদের দোকানপাট। তাতে হরেক রকম পণ্যের সমাহার। এছাড়া অন্য দোকানগুলোও আমাদের দেশের সাধারণ দোকানপাটের মতো। শান্তিনিকেতন পৌঁছে ফুটপাতের দোকানগুলোতে দেখলাম মাটির ও কাপড়ের তৈরি রবি ঠাকুরের নানান প্রতিকৃতি। দাম ও সাদামাটা।

রবীন্দ্র ভবন এলাকার দৃশ্য :
বিশেষ করে টোটো (ব্যাটারি রিকশা) করেই শান্তিনিকেতন ঘুরতে হয়। কারণ টোটো চালকরা জানে কোথায় কি আছে। রবীন্দ্রভবনে জনপ্রতি টিকেট ২০ টাকা করে। তবে এই নিয়মটি হয়েছে অতি স¤প্রতি। আগে টিকেট কাটার নিয়ম ছিল না। দর্শনার্থীরা বিনা পয়সায় ভেতরে ঢুকতে পারতেন। এখন টিকেট সিস্টেম হওয়ার পরেও আরেক সমস্যা। ইন্ডিয়ানদের জন্য টিকেটের দাম ২০ টাকা হলেও বিদেশিদের জন্য ১০০ টাকা। রবীন্দ্রভবনে ঢুকতেও জারি হয়েছে বিধি-নিষেধ। ছবি তোলা যাবে না, ক্যামেরা নেয়া যাবে না। ক্যামেরা কাউন্টারে জমা রেখে যেতে হবে। আর মোবাইল সেট বন্ধ করে রাখতে হবে। অর্থাৎ কোনোভাবেই ভেতরের ছবি সংগ্রহ করা যাবে না। বাধ্য হয়ে আমরা ক্যামেরা জমা দিলাম। মোবাইল সেট বন্ধ করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম বটে, সুযোগ বুঝে সেট চালুও করেছিলাম। কারণ স্মৃতি/তথ্য ধরে রাখতে পারবো না- তা কি হয়! বিশেষ করে নোবেল পুরস্কারের চিত্র।

টোটো থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে আসার পর হাতের ডানে পড়ে এই রবীন্দ্রভবন, আর বামে বিশাল এলাকাজুড়ে শান্তিনিকেতন, যেখানে দেশ-বিদেশ থেকে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতে আসেন। তাদের জন্য আছে আবাসিক ব্যবস্থাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার মতো সব রকম ব্যবস্থা। রবীন্দ্র ভবন আর শান্তি নিকেতনের মাঝখানে প্রাকৃতিক শোভা সমৃদ্ধ, অর্থাৎ গাছপালায় সুশোভিত জায়গার ভেতর দিয়ে যাতায়াতের পাকা রাস্তা। সেই রাস্তায় চলছে রিকশা, সাইকেল, জিপ, ট্যাক্সি। তবে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকায় জ্যাম লেগে যাওয়ার অবস্থা নেই। গরমের দিন না হয়ে শীতের দিন হলে এই এলাকা যে সত্যিই প্রাকৃতিক শান্তির এলাকা- তা এমনিতেই বোঝা যায়। আমরা রবীন্দ্র ভবনের ভেতর ঢুকেই প্রথম যে ভবনটা পেলাম সেটা বেশ ছিমছাম, ফাঁকা জায়গায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হলুদাভ দ্বিতল ভবন। যদিও বাইরে থেকে দ্বিতল বোঝা যায় না। মূলত এই ভবনেই রয়েছে রবি ঠাকুরের ব্যবহৃত সমস্ত কিছুর সম্ভার। কাঁচের গেট পেরুনোর আগে আরেক দফা ডিটেকটর যন্ত্রে সার্চ করা হয়। প্রতিটি কক্ষে সাজানো রবি সম্ভার। কাঁচের শোকেসে রাখা এসব জিনিসপত্রের প্রত্যেকটির সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি এবং হিন্দিতে লেখা পরিচিতি। বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদিত কবির গ্রন্থাদি। নিজের হাতে লিখা অনেক লিখার পাণ্ডুলিপি। শোকেসের বাইরে দেয়ালগুলোতে রাখা বিশাল বিশাল তৈলচিত্র, যেগুলো রবীন্দ্রনাথের আঁকা। আরো আছে দেশ ভ্রমণের নানা আলোকচিত্র। সবই বড় বড় করে কাঁচের ফ্রেমে বাঁধা। বই এবং গানের স্বরলিপির ভান্ডারেই ভর্তি একটি বিরাট রুম। রয়েছে রবি ঠাকুরের ব্যবহৃত কলম, চশমা, স্যান্ডেল-জুতো-খড়ম, চা তৈরির সরঞ্জাম, নৌকা-বজরা, যে ট্রেন এবং জিপে চড়তেন তার অবিকল প্রতিকৃতি, উপহার পাওয়া সামগ্রী ইত্যাদি। সব মিলে উপরে-নিচে মিলিয়ে অফুরন্ত ভান্ডার। পুরো দিনেও এসব দেখে শেষ করার নয়।

শান্তিনিকেতনের ভেতর আরেকটি রবীন্দ্র সংগ্রহশালা :
এই ভবন ছাড়াও গোটা চত্বরে আরো অনেক ভবন রয়েছে। এর কোনটা রবি ঠাকুরের বসবাসের ভবন, কোনটা অবসর কাটানোর ভবন, কোনটা বিদেশি অতিথিদের নিয়ে আড্ডার ভবন, রয়েছে মহাত্মা গান্ধীর থাকার জন্য তৈরি করা আলাদা ভবন। আরো রয়েছে জলসা ঘর, আলোচনা সভার ঘর, গাড়িসহ গ্যারেজ, উদীচী নামে ভবন। যে ভবনে রবি ঠাকুরের শেষ দিন কেটেছিল সে ভবনও রয়েছে বিশেষ মর্যাদায়। চত্বরটা যে অনেক বিশাল- তা অবশ্য বাইরে থেকে বোঝা যায় না। চত্বরজুড়ে আছে গাছ-গাছালিসহ প্রাকৃতিক শোভা। তারই ফাঁকা ফাঁকা জায়গায় রবি ঠাকুরের নানা স্মৃতি। এই চত্বর বেড়াতেও গোটা দিন লাগার মতো। শান্তিনিকেতন উপনিবেশিক প্রবর্তিত প্রচলিত শিক্ষার বিপরীতে নতুন শিক্ষা পদ্ধতি চালু করার কথা বিবেচনা করেই নিজ উদ্যোগে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ সালে এই বোলপুরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “শান্তিনিকেতন”। এ প্রসঙ্গে কবি নিজেই বলেছিলেন, ‘আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল যে এখানকার এই প্রভাতের আলো, শ্যামল প্রান্তর, গাছপালা যেন শিশুদের চিত্ত স্পর্শ করতে পারে। কারণ প্রকৃতি সাহচর্যে তরুণ চিত্তে আনন্দ সঞ্চারের দরকার আছে। এই উদ্দেশ্যে আমি আকাশ আলোর অন্তশায়ী উদাস প্রান্তরে এই শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেছিলুম।’

রবীন্দ্র ভবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত কক্ষ :
এই শান্তিনিকেতনে প্রাচীন ভারতীয় আশ্রমিক শিক্ষার ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি স্থাপন করেছিলেন শান্তিনিকেতন বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর প্রাচীন ও প্রতিচ্য জ্ঞান অর্জন এবং বিশ্বাত্ম চেতনার লক্ষ্যে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী। ফলে এখানে গড়ে উঠেছে জ্ঞানার্জনের মহা আয়োজন। রবীন্দ্র ভবনের বিপরীত এলাকাজুড়ে গড়ে উঠা এই মহাক্ষেত্রের চত্বরে রয়েছে রবি ঠাকুরের নানা নিদর্শন। রয়েছে শৈল্পিক কীর্তি। আরো আছে রবীন্দ্রনাথের তথ্য ও প্রামাণ্য তথ্য ভবন। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেল, দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্বভারতীর অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে শিশু ভবন (নার্সারি স্কুল), পাঠ ভবন (মাধ্যমিক বিদ্যালয়), শিক্ষা ভবন (উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়), বিদ্যা ভবন (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর), বিনয় ভবন (শিক্ষক প্রশিক্ষণ), কলা ভবন (শিক্ষা ও চারুকলা), সংগীত ভবন (সংগীত ও নৃত্য), শ্রী নিকেতন (পল্লী উন্নয়ন), শিক্ষামন্ত্র (গ্রাম বিদ্যালয়), শিক্ষা সদন (শিক্ষা শিক্ষণ), চীনা ভবন (চীনা, তিব্বতি ইত্যাদি ভাষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান)। যা থেকে প্রসারিত বিজ্ঞান চেতনায় আধুনিক শিক্ষা। শান্তিনিকেতনে শিক্ষার বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে জাতি-ধর্মের পার্থক্য নেই, ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে লেখাপড়া করে, একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া-খেলাধুলা করে, উচ্চ-উন্নত চিন্তা ও সরল জীবন-যাপন করে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের কাজ যেমন- ঘরবাড়ি পরিষ্কার, বাগান পরিচর্যা, পোশাক-পরিচ্ছদ পরিষ্কার, বাস ধোয়ার মতো কাজগুলো নিজেরাই করে। শিক্ষার্থীরা শান্তিনিকেতনে নিজের বাড়ির পরিবেশে বসবাস করে। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক এখানে মধুর। তাই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ও ঘটে না।
রাতের খাবার সেরে রাত্রিযাপন শেষে সকালে আবারো শেষ বারের মতো আরো কিছু স্থান দেখে শান্তিনিকেতনের ছায়াদির সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও সৌজন্য পরিচয় সেরে দুপুরের খাবার সারলাম শান্তিনিকেতনেরই একটি সমৃদ্ধ খাবারালয়ে। দুপুর ২টায় এবার আমরা রওনা হলাম ঝাড়খন্ড রাজ্যের দুমকার উদ্দেশ্যে। সেখানে ছায়াদিদির ছায়াঘেরা সুশীতল বাড়ি। সেখানে ৩ দিন থেকে পরিমল দা, মৌদিসহ ট্রেনে করে কলকাতার পথে রওনা হলাম। ট্রেনের পথে আবার ছুঁয়ে গেলাম শান্তিনিকেতন। এ যেন বাংলা সাহিত্যের রাজধানী। আমার প্রিয় মাতৃভাষার বিশ্বসেরা অলংকার বিশ্বকবির পূর্ণ স্মৃতিধন্য স্থান নয়। আমাদের প্রাণ ও নাড়ির অন্যতম স্পন্দন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়