করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

প্রতিরোধে বঙ্গভঙ্গ-সজ্ঞানে বাংলাভাগ

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গদেশের বাঙালিমাত্রই ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, রুচি, সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে ঐক্য-মিল। একমাত্র অমিলটি ধর্মীয় ভিন্নতা। বাঙালি জাতি প্রধানত দুই সম্প্রদায়ে আগাগোড়াই বিভক্ত ছিল। দুই সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিরোধ-বিভক্তি সৃষ্টিতে তৎপর উপনিবেশিক ব্রিটিশদের শঠতার কূটচালই ভ্রাতৃপ্রতিম দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্ক বিনষ্ট এবং পরস্পর পরস্পরের শত্রæতে পরিণত করেছিল। ১৯৪৭-এর দেশভাগের সাম্প্রদায়িক বিভাজনে বাঙালি আর বাঙালি থাকেনি। হিন্দু-মুসলমানে ভাগ হয়ে গিয়েছিল বলেই বাংলাভাগ বিনে বাধায় সম্পন্ন হতে পেরেছিল। বাংলাভাগে পূর্ব ও পশ্চিমবাংলা দ্বিখণ্ডিতরূপে দুই পৃথক রাষ্ট্রের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। বাংলাভাগের প্রধান এবং একমাত্র অজুহাতটি ছিল সাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতার গিলোটিনেই দ্বিখণ্ডিতে বাংলাভাগ সম্পন্ন হয়েছিল। বাংলাভাগের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তিবিশেষ ভূমিকা পালন করলেও; বাংলাভাগ রোধ করা সম্ভব হয়নি। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ক্ষমতার ভাগাভাগি নিশ্চিত করতেই দেশভাগ অনিবার্য করে তোলে। সাম্প্রদায়িক বিভাজনে ভারতবিভক্তির আদলে বাংলাভাগও নির্মম উপায়ে সম্পন্ন হয়েছিল। বাংলাভাগের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে প্রতিরোধ হয়নি। বাংলাভাগের অপরিণামদর্শী ক্ষতির বিবেচনা দলগতভাবে পর্যন্ত কেউ করেনি। ব্যক্তি বিশেষ করেছিল, কিন্তু বাংলাভাগ প্রতিরোধে অসংগঠিত সে সকল উদ্যোগ মোটেও যথেষ্ট ছিল না। ১৯৪৭-এর বাংলাভাগে উচ্ছেদ, বিচ্ছেদ, উৎপাটনের নজিরবিহীন হৃদয়-বিদারক ঘটনা ঘটেছিল দুই বাংলাজুড়ে। একমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় প্রাণ রক্ষার তাগিদে ভিটেমাটি, সহায়-সম্বল, মাতৃভূমি ত্যাগ করে এপারে-ওপারে চলে যেতে বাধ্য হয়। বাংলাভাগের নির্মম অভিজ্ঞতা যাদের রয়েছে তারা কেউ জীবদ্দশায় মর্মান্তিক সেই স্মৃতি ভুলতে পারেনি। বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি ১৯৪৭-এর বাংলাভাগ। যেটি বিনে বাধায়, বিনে প্রতিরোধে, সজ্ঞানে এবং চরম সাম্প্রদায়িক রক্তাক্ত দাঙ্গায় সম্পন্ন হয়েছিল।
অবিভক্ত বাংলার পূর্ববঙ্গের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ ছিল সম্ভ্রান্ত-সমৃদ্ধ এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় পরিপুষ্ট। অপর দিকে পূর্ববাংলা ছিল ঠিক বিপরীত। অনগ্রসর, আধুনিকতা বঞ্চিত, নদ-নদী, খাল-বিল কেন্দ্রিক মফস্বল সদৃশ। পূর্ববাংলার অর্থনীতি ছিল সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর। ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প ব্যতীত কল-কারখানা বলতে কিছুই ছিল না। নিম্নাঞ্চল পূর্ববাংলার নদ-নদী, খাল-বিলে পানি থৈ-থৈ করত। জন এবং পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাও ছিল নদীকেন্দ্রিক। পানির পর্যাপ্ততার কারণেই পাট উৎপন্নের আদর্শ স্থান ছিল পূর্ববাংলা। পূর্ববাংলার পাটের খ্যাতি সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পাট উৎপন্নের জন্য পূর্ববাংলার খ্যাতি ও কদর ছিল। কিন্তু পূর্ববাংলায় কোনো পাটকল ছিল না। পূর্ববাংলায় উৎপাদিত পাট পশ্চিমবাংলার পাটকলগুলোর চাহিদা পূরণ করত। এমনকি পশ্চিমবাংলায় নানা শিল্পের কাঁচামালেরও জোগান দিত পূর্ববাংলা। অপরদিকে পশ্চিমবাংলায় উৎপাদিত পণ্যের একচেটিয়া বাজার ছিল পূর্ববাংলা। অবিভক্ত বাংলার দুই অংশের বৈপরীত্যের মূলে ছিল উপনিবেশিক শাসনামলে সুদীর্ঘকালের রাজধানী অত্যাধুনিক কলকাতা-কেন্দ্রিকতা। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রহসন যুদ্ধে জয়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বঙ্গদেশ দখলদারিত্বের পর কলকাতাকেই রাজধানী করে। ১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বর মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণায় ভারতবর্ষ শাসনের দায়িত্ব ব্রিটিশ রাজতন্ত্র গ্রহণ করে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বিলুপ্ত করে দেয়া হয়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধের মাশুল স্বরূপ ১৯১২ সালে উপনিবেশিক শাসকেরা ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা থেকে সরিয়ে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করেছিল। অর্থাৎ ১৭৫৭ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রাজধানী ছিল কলকাতা। রাজধানীর মর্যাদায় কলকাতা আধুনিকতায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। প্রাচ্যের লন্ডনরূপে ব্রিটিশ শাসকেরা রাজধানী কলকাতাকে গড়ে তুলেছিল। আধুনিক এবং সমৃদ্ধ কলকাতা শিক্ষা, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক, মুক্তবুদ্ধি চর্চায় পুরো ভারতবর্ষের মধ্যে প্রধান হয়ে উঠেছিল। আলোকিত পশ্চিমবাংলার তুলনায় অনগ্রসর পূর্ববাংলা ছিল অন্ধকারময়। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত পশ্চাৎপদ জনপদ। একই বাংলার দুই অংশের ভিন্নরূপ-পরস্পর বিরোধী এবং চরম বৈপরীত্য।
কৃষি, ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প ব্যতীত পূর্ববাংলায় জীবিকার ক্ষেত্রও ছিল খুবই সংকীর্ণ। শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, সাধারণ পেশা, সম্মানজনক পেশার কারণে কলকাতার গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। পূর্ববাংলার প্রচুর মানুষ শিক্ষা, পেশার কারণে কলকাতায় দ্বিতীয় আবাস গড়ে তুলেছিল। কলকাতা ফেরত ব্যক্তিদের কাছে কলকাতার নানা গল্প শুনে পূর্ববঙ্গীয়রা বিস্মিত-হতবাক হতো। পূর্ববাংলার মানুষের কাছে কলকাতা ছিল স্বপ্নতুল্য। পূর্ববাংলার চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষেরা জীবিকার জন্য কলকাতার পরিবর্তে মিয়ানমারকে (বার্মা) বেছে নিয়েছিল। রেঙ্গুনকেন্দ্রিক নানা পেশার পাশাপাশি জাহাজের খালাসি, সুকানি, সারেং হতে জলে-স্থলের নানা পেশায় যুক্ত ছিল চট্টগ্রাম-নোয়াখালী অঞ্চলের অজস্র মানুষ। ভারতবর্ষের বাইরে মিয়ানমার (বার্মা) এবং শ্রীলঙ্কা দেশ দুটিও ছিল ব্র্রিটিশ ইন্ডিয়ার অন্তর্গত। রাজধানী কলকাতাকেন্দ্রিক শাসনাধীন ছিল ভারতবর্ষসহ মিয়ানমার (বার্মা) এবং শ্রীলঙ্কা। যেটি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া নামে খ্যাত ছিল।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চরম প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিনিধি লর্ড কার্জন ১৮৯৯ সালে ভাইসরয় রূপে ভারতে আসেন। তার কর্মস্থল এবং আবাসস্থল রাজধানী কলকাতা। অত্যন্ত ধূর্ত এবং ভারত বিদ্বেষী কার্জন অগ্রসর বাঙালিদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করতেন। বাঙালিদের প্রখর জাতীয়তাবোধ, দেশপ্রেম তাকে বিচলিত করে তুলেছিল। শিক্ষা, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রসর বাঙালিদের প্রতি মোটেও আস্থা-বিশ্বাস তার ছিল না। ইংরেজ শাসন স্থায়িত্বে বাঙালিদেরই অন্তরায় মনে করেছিলেন। অগ্রসর বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে না আঁচ করেই তিনি ১৯০২ সালে বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। অবাধ সংবাদ পরিবেশনের বিরুদ্ধে সমস্ত সংবাদপত্রকে তিনি রাষ্ট্রীয় গোপন আইনের আওতাধীন করেন। উচ্চশিক্ষা হ্রাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেতন বৃদ্ধিসহ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের যাবতীয় কার্যাবলিকে ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের অধীনস্থ পর্যন্ত করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনকে নিষ্কণ্টক করতে নানা নিপীড়নমূলক কালো আইন জারি করেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সম্পর্কে কার্জনের গর্হিত মন্তব্য- তার সাহায্যের কল্যাণেই এটি শান্তিপূর্ণ মৃত্যুবরণের পথ খুঁজে পাবে। বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতিবিরোধী কার্জন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় প্রকাশ্যে ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে চরম ব্যঙ্গবিদ্রƒপ পর্যন্ত করেছিলেন। লর্ড কার্জনের নিগ্রহমূলক নীতি ও আচরণে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের বৈপ্লবিক উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯০২ সালে কলকাতায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গোপন সমিতি গঠিত হয়। ব্রিটিশবিরোধী লড়াই-সংগ্রাম এবং সশস্ত্র অভ্যুত্থান সংঘটিত করাই ছিল গোপন সমিতির মূল লক্ষ্য। ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় জাতীয়তার উন্মেষে কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালিদের ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব লর্ড কার্জনের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। ভারতবর্ষের অপরাপর জাতিগুলোর থেকে বাঙালিদের সর্বাপেক্ষা সুচিন্তিত জাতীয় স্বকীয়তা-জাতীয় ঐক্য গঠনের ভূমিকায় শঙ্কিত লর্ড কার্জন দ্রুত বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিহার ও উড়িষ্যাকে পশ্চিমবাংলার সঙ্গে যুক্ত করে গঠন করেন ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রদেশ। এবং আসামকে পূর্ববাংলার সঙ্গে যুক্ত করে পৃথক ইস্টার্ন বেঙ্গল প্রদেশের ঘোষণায় বঙ্গভঙ্গ চূড়ান্ত করেন। জরপযধৎফ গ. ঊধঃড়হ-এর ঞযব জরংব ড়ভ ওংষধস ধহফ ঃযব ইবহমধষ ঋৎড়হঃরবৎ গ্রন্থে জানা যায় ভারত স্বরাষ্ট্র সচিব এইচ এইচ রিযলী ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও ডিসেম্বরে পৃথক দুটি নোটে লিখেছিলেন- ইবহমধষ টহরঃবফ রং ধ ঢ়ড়বিৎ. ইবহমধষ ফরারফবফ রিষষ ঢ়ঁষষ রহ ংবাবৎধষ ফরভভবৎবহঃ ধিুং. ঞযধঃ রং ঢ়বৎভবপঃষু ঃৎঁব ধহফ রং ড়হব ড়ভ ঃযব সবৎরঃং ড়ভ ঃযব ংপযবসব. পরে আরো চূড়ান্তভাবে …ড়হব ড়ভ ড়ঁৎ সধরহ ড়নলবপঃং রং ঃড় ংঢ়ষরঃ ঁঢ় ধহফ ঃযবৎবনু বিধশবহ ধ ংড়ষরফ নড়ফু ড়ভ ড়ঢ়ঢ়ড়হবহঃং ঃড় ড়ঁৎ ৎঁষব.
বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯০৪ সালে লর্ড কার্জন পূর্ববাংলা সফরে আসেন। ময়মনসিংহ গিয়ে ময়মনসিংহের মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীকে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব সমর্থনের অনুরোধ করেন। ব্রিটিশ শাসনাধীনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফলভোগী স্থানীয় জমিদার-সামন্তদের কেউ ব্রিটিশদের প্রস্তাব উপেক্ষার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে, সেটা লর্ড কার্জনের চিন্তার অতীত ছিল। অথচ মহারাজা সূর্যকান্ত লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব সরাসরি তার মুখের ওপর প্রত্যাখ্যান করেন। মহারাজা সূর্যকান্ত-কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত কার্জন ঢাকায় এসে নবাব সলিমুল্লাহর অতিথি রূপে আহসান মঞ্জিলে ওঠেন। ঢাকার সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের উপস্থিতিতে আহসান মঞ্জিলে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব পেশ করেন। কার্জন প্রস্তাব করেন, আসাম-পূর্ববাংলা নিয়ে গঠিত নতুন ইস্টার্ন বেঙ্গল প্রদেশের রাজধানী হবে ঢাকা এবং প্রদেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকবে মুসলিম সম্প্রদায়ের হাতে। নবাব সলিমুল্লাহকে প্রদেশ উন্নয়নে সুদমুক্ত দশ হাজার পাউন্ড প্রদানের প্রস্তাবও তিনি দেন। নবাব সলিমুল্লাহর তখন আর্থিক টানাপড়েন চলছিল। সুদমুক্ত দশ হাজার পাউন্ড তার খুবই প্রয়োজন ছিল। নবাব সলিমুল্লাহ এবং ময়মনসিংহের জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী সানন্দে কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব সমর্থন এবং গ্রহণ করেন। বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ঢাকার মুসলিমদের উদ্বুদ্ধ করতে সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় পর্যন্ত নেয়া হয়। যেমন ইস্টার্ন বেঙ্গলের একচেটিয়া কর্তৃত্ব থাকবে মুসলমানদের হাতে। কলকাতার মুখাপেক্ষী হতে হবে না। কলকাতার অগ্রসর সম্পদশালী হিন্দু সম্প্রদায়ের অধীনমুক্ত হবার এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। মুসলমানদের শতভাগ স্বার্থরক্ষায় বঙ্গভঙ্গের গুরুত্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থে অতি আবশ্যিক ইত্যাদি। চতুর-কৌশলী লর্ড কার্জন পরিকল্পিতভাবে ঢাকায় সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ করে কলকাতায় ফিরে যান। ব্রিটিশ শাসন নিরবচ্ছিন্ন-প্রতিরোধহীন নিরঙ্কুশ করতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন স্পষ্ট করার উদ্দেশ্যে ১৮৭২ সালে উদ্দেশ্যমূলক ধর্মভিত্তিক আদমশুমারি করা হয়েছিল। সেই আদমশুমারিতে দেখা যায় যে পূর্ববাংলায় মুসলিম সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, অপরদিকে পশ্চিমবাংলায় হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। ধর্মভিত্তিক আদমশুমারিতে প্রদেশের দুই অংশের হিন্দু-মুসলমানের সংখ্যাধিক্য অবগত হয়েই হিন্দু-মুসলিম পৃথকীকরণের উদ্দেশ্য সাধনে পরবর্তীতে বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগ গ্রহণ এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির সুপরিকল্পিত শঠতায় লর্ড কার্জন অধিক বুদ্ধিমত্তায় এগিয়ে ছিলেন। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচন ও সম্প্রদায়ভিত্তিক ভোট প্রদান দুই সম্প্রদায়ের বিভক্তির পথকে সুগম করে তুলেছিল। যার চূড়ান্ত পরিণতিতে সাম্প্রদায়িক বিভাজনে সাতচল্লিশে বাংলাভাগ সম্পন্ন ব্রিটিশদের পক্ষে সহজ হয়েছিল।
বঙ্গভঙ্গের ঘোষণায় ধর্মীয় এবং জাতিগত বিরোধ-বিভাজন সৃষ্টির সুফল প্রত্যাশী লর্ড কার্জনের পরিকল্পনার কিন্তু বিপরীত ফল হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ক্রমেই বাঙালিমাত্র বিক্ষোভে জ্বলে ওঠে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন দাবানলের ন্যায় কেবল বাংলায় নয়; ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন- ‘এতে বাঙালিরা অপমানিত-অসম্মানিত হচ্ছে এবং তাদের সমগ্র ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়েছে।’ তার মতে বঙ্গভঙ্গ বাংলাভাষী জনগণের বর্তমান ঐক্যের প্রতি সতর্কভাবে পরিকল্পিত আঘাত। নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল লর্ড কার্জন ৭ জুলাই ১৯০৫ সালে সরকারিভাবে আনুষ্ঠানিক বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা প্রদান করেন। সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ সালে। আগস্ট মাসেই কলকাতাজুড়ে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, বিক্ষোভ-সমাবেশসহ ব্যাপক প্রতিরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। বঙ্গভঙ্গবিরোধী সমাবেশ থেকে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া হয়। বাঙালিরা ১৬ অক্টোবর দিনটিকে বঙ্গভঙ্গ দিবসের পাশাপাশি জাতীয় শোক দিবস রূপেও পালন করে। কলকাতায় বঙ্গভঙ্গবিরোধী বিশাল বিক্ষোভ মিছিল গঙ্গাতীরে পৌঁছে সমবেতভাবে বঙ্কিমচন্দ্র রচিত ‘বন্দে মাতারম’ গান গেয়ে বঙ্গদেশকে পুনরায় সংযুক্তিকরণের শপথ নেয়। এ দিন কলকাতায় অঘোষিত হরতাল পালিত হয়। আনুষ্ঠানিক প্রতিজ্ঞার নির্দশন স্বরূপ মণিবন্ধে প্রত্যেকে রাখি বাঁধে। এই রাখি বন্ধন বাঙালি ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন ভারতজুড়ে প্রভাব বিস্তার লাভ করেছিল। সামন্ত-ভূস্বামী, মধ্যবিত্ত, পেশাজীবী, ছাত্রসমাজসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাধান্যের পাশাপাশি প্রচুর মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট নেতৃবৃৃন্দ বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয় জাতিগত আবেগ চেতনায়। এই আন্দোলনের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেটা শাসক ব্রিটিশদের শঙ্কার মুখে ফেলেছিল। জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে কংগ্রেস সভাপতি গোপালকৃষ্ণ গোখলে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে বাংলায় ব্রিটিশ পণ্য বর্জনকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন প্রদান করেন। অধিবেশনে বালগঙ্গাধর তিলক ও তার অনুসারী চরমপন্থিরা সারা ভারতে ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলন বিস্তারে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের প্রস্তাব পেশ করলেও, অধিবেশনে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থিদের অসম্মতিতে সে প্রস্তাব গৃহীত হতে পারেনি। কলকাতার বুদ্ধিজীবী হতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গবিরোধী দেশপ্রেমের-দেশাত্মবোধক গান রচনা করেন, গান গেয়ে প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেন। কলকাতার উপকণ্ঠের বিখ্যাত নাখোদা মসজিদে উপস্থিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ মসজিদের মুসল্লিদের হাতে রাখি পর্যন্ত বেঁধে দেন। কলকাতাসহ বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজ এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন সারাদেশে ব্যাপকতা লাভ করে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন ক্রমেই ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টিতে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। জনগণের তীব্র বিরোধিতার কারণে বঙ্গভঙ্গ স্থায়ী হতে পারেনি। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায়।
ইংরেজ আইনজীবী-সংগীত বিশ্লেষক ফক্স স্ট্যাংওয়েজ (১৮৫৯-১৯৪৮) ছিলেন প্রচণ্ড রবীন্দ্রানুরাগী। নোবেল জয়ী রবীন্দ্রনাথকে লন্ডনের সুধী সমাজে পরিচিত করে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে যাতে অক্সফোর্ড ও ক্যামব্র্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানিত ডিগ্রি প্রদান করা হয় সেজন্য ফক্স স্ট্যাংওয়েজ নানা উদ্যোগও গ্রহণ করেছিলেন। ভারতের এক সময়ের ভাইসরয় লর্ড কার্জন তখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। ভারতীয় বাঙালি রবীন্দ্রনাথের নাম দেখামাত্র ফক্স স্ট্যাংওয়েজ-এর প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ লর্ড কার্জন নাকচ করে দেন। ভারতের এই সাবেক ভাইসরয় লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের স্মৃতি মলিন বা বিস্মৃত হয়নি। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের সক্রিয় অংশগ্রহণ, গান রচনা এবং বঙ্গভঙ্গবিরোধী সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের স্মৃতি লর্ড কার্জনের পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব ছিল না। অতীতের বিব্রতকর স্মৃতিই বাঙালি ও ভারতীয় বিদ্বেষী অক্সফোর্ড চ্যান্সেলর লর্ড কার্জন রবীন্দ্রনাথকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মান সূচক ডিগ্রি প্রদানের প্রস্তাব তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক বঙ্গভঙ্গ রদ স্থানীয় ব্রিটিশ শাসকদের জন্য চপেটাঘাততুল্য ছিল। চরম অপমানের প্রতিশোধ স্বরূপ স্থানীয় ব্রিটিশ শাসকেরা ১৯১২ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করে। এতে কলকাতার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গুরুত্ব হ্রাস পায়। বৃহত্তর ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রাজধানীর পরিবর্তে কলকাতা প্রাদেশিক রাজধানীতে পরিণত হয়। বঙ্গভঙ্গের হাত ধরেই স্বদেশী আন্দোলন পূর্ববঙ্গে এবং কলকাতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ক্রমেই বিস্তার লাভ করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়। দাতার ন্যায় ব্রিটিশদের উপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন দেয়া এবং কংগ্রেস-মুসলিম লীগ তা হাত পেতে নেয়া। সাতচল্লিশের স্বাধীনতা যেমন ছিল ব্রিটিশদের দয়া-ভিক্ষার, তেমনি শর্তাধীনে আপস-সমঝোতার। একমাত্র এই কারণেই সাতচল্লিশের স্বাধীনতায় ব্রিটিশ শাসকদের ইচ্ছাপূরণের দ্বিজাতিতত্ত্বের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছিল।
সাম্প্রদায়িকতার দেশভাগের নিষ্ঠুর পরিণতিতে বাংলাও অখণ্ড থাকতে পারেনি। সাম্প্রদায়িকতার নির্মম শিকারে বাংলাভাগও অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। লর্ড কার্জনের পরবর্তী ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর প্রত্যক্ষ মদদে ১৯০৬ সালে ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত হয় মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগ গঠনের অধিবেশনে নবাব সলিমুল্লাহর প্রস্তাবসমূহের মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ছিল। এক. ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি ভারতীয় মুসলমানদের বিশ্বস্ততার প্রকাশ। দুই. মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার-স্বার্থ এবং প্রয়োজন-প্রত্যাশা সংরক্ষণ। তিন. অপরাপর সম্প্রদায়ের প্রতি বিরূপ-বিদ্বেষ উদ্ভবের প্রতিরোধ। অসাম্প্রদায়িক শেষের এই প্রস্তাবটির পক্ষে মুসলিম লীগ কখনো অবিচল থাকেনি, বরং বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় মুসলিম লীগে তীব্র হতাশার সৃষ্টি হয়। মুসলিম লীগের রাজনীতির একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িকতা। ভারতীয়দের সাম্প্রদায়িক বিভাজনে বিভক্ত করে, একে-অন্যের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবার উদ্দেশ্যেই ব্রিটিশ তত্ত্বাবধানে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল। ব্রিটিশদের ইচ্ছাপূরণে মুসলিম লীগই অনুঘটকের ভূমিকা পালনে দেশভাগ চূড়ান্ত করেছিল। জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের ক্ষমতার ভাগাভাগিতে দেশভাগ সম্পন্ন হয়েছিল রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্য দিয়ে।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধে সংগঠিত উভয় সম্প্রদায়ের বাঙালিরা যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৪৭ সালে বাংলাভাগে তেমনটি ঘটেনি। কেননা তখন বাঙালি আর বাঙালি ছিল না। হিন্দু-মুসলমানে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ধর্মীয় জাতীয়তার কাছে পরাজিত হয়েছিল ভাষাগত জাতীয়তা। সাম্প্রদায়িকতার ছোবলে হারিয়ে গিয়েছিল বাঙালির প্রতিজ্ঞার মণিবন্ধের রাখিবন্ধন। ভ্রাতৃপ্রতিম দুই সম্প্রদায়ে প্রবল সাম্প্রদায়িকতায় বাঙালি হিন্দু-মুসলিম পরস্পরের চরম শত্রæতুল্য হয়ে উঠেছিল। তখন বাঙালি আর বাঙালি ছিল না। পরস্পর হিন্দু-মুসলমানে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। ধর্মীয় উন্মাদনায় চরম সাম্প্রদায়িকতায় বাঙালি জাতীয়তার পতন ঘটে। সাম্প্রদায়িকতার কাছে পরাজিত হয় জাতীয়তা, মানবতা, মনুষ্যত্বের। বাংলাভাগের পেছনে স্থানীয় রাজনীতিক এবং রাজনীতির ভূমিকাকেও খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বাংলার রাজনীতিকদের ভুলেই সাম্প্রদায়িকতা এবং বাংলাভাগ চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছে ছিল। কৃষক প্রজা পার্টির এ কে এম. ফজলুল হক যদি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হবার লোভ সংবরণ করতে পারতেন তাহলে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বাংলায় বিস্তারের অমন সুযোগ সৃষ্টি সম্ভব হতো না। ১৯৩৭ সালের নির্বাচন বাংলাভাগে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। সেই নির্বাচনে একক কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ না করার কারণে যৌথ সরকার গঠনের বিকল্প ছিল না। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ পরস্পরের শত্রæতুল্য। ঐ দুই দলের যৌথ সরকার গঠন তখন ছিল অসম্ভব। কৃষক প্রজা পার্টি কংগ্রেস দলকে যৌথ সরকার গঠনের প্রস্তাব দিলে প্রাদেশিক কংগ্রেস প্রস্তাবে সম্মত হলেও, একমাত্র নেহরুর প্রবল আপত্তি ও বিরোধিতায় সেটি সম্ভব হয়নি। অগত্যা ফজলুল হক যৌথ সরকার গঠনে মুসলিম লীগকে প্রস্তাব দেয়ামাত্র মুসলিম লীগ সেটি লুফে নেয়। বাংলায় গঠিত হয় কৃষক প্রজা পার্টি এবং মুসলিম লীগের যৌথ সরকার। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন ফজলুল হক। নেহরুর এবং কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্তে এবং অসাম্প্রদায়িক বাঙালি ফজলুল হকের মুসলিম লীগের সঙ্গে যৌথ সরকার গঠনের কারণেই বাংলায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ উন্মুক্ত হয়েছিল। বাংলার প্রাদেশিক সরকারে সম্পৃক্ত মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাতাবরণে পাকিস্তান আন্দোলনের পালে হাওয়া পেয়ে যায়। ফজলুল হকের মুসলিম লীগে যোগদান এবং অসাম্প্রদায়িক কৃষক প্রজা পার্টির বিলুপ্তির পর বাংলা প্রদেশ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চারণ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। যা পাকিস্তান দাবির পথকে সুগম করে দেয়। জিন্নাহ কর্তৃক মুসলিম লীগ থেকে প্রত্যাখ্যাত ফজলুল হক তার অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে বাংলাভাগ ঠেকাতে কার্যত কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেননি। ধর্মীয় বিভাজন তখন তুঙ্গে। হিন্দু-মুসলিম পৃথক দুই সম্প্রদায় তখন পরস্পরের মুখোমুখি। একে অপরের চরম শত্রæরূপে রণ সাজে প্রস্তুত। সেই ভয়ানক সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সামাল দেয়া আর কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। চূড়ান্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উচ্ছেদ, বিচ্ছেদ, উৎপাটনের নজির বিহীন ১৯৪৭-এর বাংলাভাগ, বাংলার ইতিহাসে কলঙ্কজনক ট্রাজেডি রূপে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। রাজনীতিকদের ক্ষমতার লিপ্সার বলি হতে হয়েছে নিরপরাধ দুই সম্প্রদায়ের অসহায় মানুষদের। রাজনীতির পাশা খেলায় অবিভক্ত বাংলা আর অখণ্ডিত থাকেনি। খণ্ডিত রূপে পূর্ব ও পশ্চিম বিভাজনে দুই পৃথক রাষ্ট্রের অধীন হয়ে যায়। বাংলাভাগ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল, সেটা ঠেকানোর উপায়-অবলম্বনের শক্তি-সাহস আর কারোই ছিল না।
১৯৪৭-এর বাংলাভাগ পূর্ব ও পশ্চিম দুই বাংলার জন্যই কুফল ব্যতীত সুফল বয়ে আনতে পারেনি। পূর্ববাংলাকে যেমন আড়াই হাজার মাইল দূরত্বের পাকিস্তানি রাষ্ট্রের অধীন হতে হয়েছে। পশ্চিমবাংলাকেও তেমনি বৃহৎ ভারতের পুঁজিপতিদের অধীনস্থ হতে হয়েছে। ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণি। যারা কেবল ভারতীয় পরিমণ্ডলেরই বিত্তবান নয়, বিশ্বমানের বিত্তবান। যে কলকাতা বাঙালি শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত-প্রসিদ্ধ ছিল, সেই কলকাতা অতীত ঐতিহ্য একে-একে হারিয়ে ফেলেছে। পশ্চিমবাংলা এখন বৃহৎ ভারতের মর্যাদাহীন প্রদেশমাত্র। প্রয়াত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী কলকাতাকে ভারতের ডাস্টবিন বলেও উপহাস করেছিলেন। ভারতকে মোটেও অসাম্প্রদায়িক দেশরূপে বিবেচনা করা যায় না। সাতচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের মৃত্যু আজো হয়নি। বারবার সেটি দৃশ্যমান রূপে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করা যায়। ধর্মনিরপেক্ষ বৃহৎ গণতান্ত্রিক ভারতে হিন্দু মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক বিজেপির এ নিয়ে দুইবার জনরায়ে ক্ষমতা প্রাপ্তিকে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রত্যাবর্তন বলেই গণ্য করা যায়।
কলকাতাকে বাঙালিদের শহর বলারও আর অবকাশ নেই। এটি বহুজাতিক ভাষা-সংস্কৃতির শহরে পরিণত। বাংলাভাষা আঞ্চলিক অমর্যাদায় কোনোক্রমে টিকে রয়েছে। বাঙালিরা বহু পূর্বে বাঙালি জাতীয়তা ত্যাগ করে ক্রমেই ভারতীয় জাতীয়তার কাছে নিজেদের সঁপে দিয়েছে। পশ্চিমবাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি বাঙালিদের নাগালে পর্যন্ত নেই। মাড়োয়ারিসহ প্রদেশের বহিরাগতদের করতলগত হয়ে পড়েছে। প্রয়াত বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় জীবদ্দশায় বলেছিলেন- ‘বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি পশ্চিমবাংলাকেন্দ্রিক থাকবে না। সেটা বাংলাদেশ কেন্দ্রিক হয়ে যাবে।’ তার বলা উক্তিটি এখন প্রমাণিত সত্যরূপে দৃশ্যমান। পশ্চিমবাংলা ভারতীয় ইউনিয়নের নগণ্য প্রদেশমাত্র। প্রদেশের নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকার ক্ষমতায় থাকলেও; ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী যে কোনো মুহূর্তে কারণে-অকারণে নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে পদচ্যুত করার এখতিয়ার রয়েছে রাষ্ট্রপতির। রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করে যে কোনো রাজ্য সরকারকে মুহূর্তে গদিচ্যুত করার সাংবিধানিক ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে। সে কারণে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে রাষ্ট্রপতির শাসনের অনেক দৃষ্টান্ত আমরা দেখে এসেছি। রাজ্য সরকারগুলো সাংবিধানিক কারণেই পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। কেন্দ্রের মুখাপেক্ষি যেমন থাকতে হয়। তেমনি কেন্দ্রকে তোয়াজ করেই চলতে হয়। গদি চ্যুতির আতঙ্কে কেন্দ্রের নিকট নতজানু না হয়ে উপায়ও নেই। পশ্চিমবাংলার নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে দর কষাকষি-তোয়াজ যেমন করতে হয়। তেমনি কেন্দ্রের থেকে প্রাপ্ত ঋণ সুদাসলে পরিশোধে নতজানু রূপেও থাকতে হয়। প্রদেশের আয়কর, আবগারি শুল্ক রাজ্য সরকারের হাতে নেই। সমস্তই কেন্দ্রের হস্তগত। কেন্দ্রীয় ঋণের সুদ মওকুফের জন্য কেন্দ্রের নিকট নতজানু নীতি গ্রহণ স্বাভাবিক রূপেই গণ্য হয়ে এসেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বশীভূত হয়ে থাকার অজস্র দৃষ্টান্ত রাজ্য সরকারগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য সমস্তই আঞ্চলিক মানদণ্ডে সীমায়িত। সর্বভারতীয় প্রচার-প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলা ভাষা ত্যাগ করে হিন্দির আশ্রয় নেয়া ছাড়া বাঙালিদের উপায় নেই। বাঙালিত্ব খুইয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অধীনস্থ পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের বাঙালি স্বকীয়তা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি-সাহস তারা বহু পূর্বে হারিয়েছে। কলকাতা শহরের জায়গা-জমি, বৃহৎ স্থাপনা, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সমস্তই অবাঙালি মালিকানায় চলে গেছে। বাঙালির শহর কলকাতায় বাঙালি এখন সংখ্যালঘু। বাংলা ভাষার প্রচলনও শহর কলকাতায় দেখা যায় না। সর্বত্রই হিন্দি ভাষার আধিক্য। আঞ্চলিক ভাষা থেকেও মাতৃভাষা বাংলা ক্রমেই বিলুপ্তির পথ ধরেছে। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের অস্তিত্বরক্ষায় বাংলাভাগের বিকল্প নেই বলে দাবি তুলেছিলেন হিন্দু মহাসভা নেতা বাঙালি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু তাতে করে ভারতীয় ইউনিয়নে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব-স্বার্থের সুরক্ষা হয়েছে; এমনটি বলার মোটেও উপায় নেই।
সাতচল্লিশের স্বাধীনতা পরবর্তী পূর্ববঙ্গের মানুষের মোহভঙ্গে বিলম্ব হয়নি। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান স্রষ্টা-গর্ভনর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে এসে পৃথক দুটি সমাবেশে ‘উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণার পরমুর্হূতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ এবং আন্দোলনে মাতৃভাষার দাবির ভেতর দিয়েই উন্মেষ ঘটে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তিলে তিলে গড়ে ওঠে স্বাধিকার আন্দোলন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ এই সুদীর্ঘ সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামের ভিত্তিমূলে ছিল জনগণের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা। সেই আকাক্সক্ষার মূলে ছিল মুক্তির স্বপ্ন-সাধ। জনগণের মুক্তির স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার প্রবল গণআন্দোলন সীমাহীন দমন-পীড়নেও আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে জনগণকে বিচ্যুত-বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। চৌকষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছিল, সেই স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার কারণেই। স্বাধীনতা অর্জনের পর জনগণ তো মুক্তি পায়ইনি। উল্টো নতুন করে স্বদেশী শাসক শ্রেণির শৃঙ্খলে আটকে পড়েছে। অধিক ত্যাগ-আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা জনগণের ভাগ্যবদলে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। জনগণের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার অপমৃত্যুতে জনগণের সংগঠিত শক্তিও নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে। যার শতভাগ ফায়দা হাতিয়ে চলেছে আমাদের তথাকথিত শাসকশ্রেণি।
পূর্ববাংলার বাঙালিরা পাকিস্তানি শাসন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পেরেছে। নানা পর্বের লড়াই সংগ্রামে এবং চূড়ান্তে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের সামগ্রিক ভাগ্যবদল সম্ভব হয়নি। বিদেশি শাসনের বৃত্ত অতিক্রম করলেও; স্বদেশী শাসক শ্রেণির খপ্পর মুক্ত হতে পারিনি। আমরা তো দান-অনুদানের স্বাধীনতা পাইনি। আমাদের স্বাধীনতা বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করতে হয়েছে। তবুও আমাদের স্বাধীনতা সবাইকে স্বাধীন করতে পারেনি। করেছে কতিপয়দের, যাদের হাতে সমস্ত ক্ষমতা এবং সম্পদ। এই শাসক শ্রেণির অধীনে আমরা অতীতের পরাধীন আমলের ন্যায় আজো শোষণ-বঞ্চনার শিকার। স্বাধীনতার বিপরীত শব্দ পরাধীনতা বা অধীনতা। তাহলে প্রশ্ন জাগে আমরা কি অধীনতা মুক্ত? পৌনে দুইশত বছরের ব্রিটিশ শাসনের অধীন ছিলাম। তারপর ছাব্বিশ বছর ছিলাম পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সামরিকতন্ত্রের অধীন। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতায় ভূখণ্ডের স্বাধীনতা নিশ্চিত হলেও; জনগণ কিন্তু স্বাধীন হয়নি। গণবিরোধী বৈরি রাষ্ট্র পাল্টে স্বাধীন দেশে নতুন রাষ্ট্র নির্মিত হবে। সেটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু রাষ্ট্রের তো পরিবর্তন হলোই না। রাষ্ট্র রয়ে গেল অতীতের আদলে এবং ধারাবাহিকতায়। সে কারণে বলতে দ্বিধা নেই আমরা স্বদেশী
শাসনাধীনে এখনো উপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীন। এই রাষ্ট্র জনগণের প্রবল প্রতিপক্ষ, নিপীড়ক এবং গণবিরোধী। রাষ্ট্র অপরিবর্তিত বলেই সমাজের বদলও ঘটল না। আমরা উপনিবেশিক শাসন মুক্ত হয়েছি কিন্তু স্বাধীন দেশে স্বদেশী শাসক শ্রেণির শোষণের বৃত্তের অধীনে রয়ে গেছি। পাকিস্তানের বাইশ পরিবারের পুঁজির দাসত্ব মুক্ত হলেও, স্বদেশী এবং বহুমাত্রিক পুঁজির দাসত্বের কবলে রয়েছি। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ সাম্রাজ্যবাদে অনুগত পুঁজিবাদী শোষণ যন্ত্রের তাঁবেদার আমাদের স্বাধীন দেশের রাষ্ট্র ও শাসক শ্রেণির সকল সরকার। তাহলে আমরা অধীনতা মুক্ত কোথায়? স্বাধীনতার তেতাল্লিশ বছর অতিক্রমে আলোর দিশা তো আমরা দেখছি না। কিন্তু আমরা আশাবাদী হতে চাই। আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে যোগ্য বিকল্প আমরা দেখতে চাই। নির্বাচনে শাসক বদল হচ্ছে কিন্তু জনগণের ভাগ্য বদল এযাবৎ হয়নি। হবে- সেটাও আশা করা যাবে না। বিদ্যমান ব্যবস্থা অটুট থাকাবস্থায় আমাদের মুক্তি অসম্ভব। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন ব্যবস্থাটির আমূল পরিবর্তন। বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সকল মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য নিশ্চিত করবে। নিশ্চিত করবে জনগণের আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন এবং নিরাপদ-নিষ্কণ্টক ভবিষ্যৎ।
বাংলাভাগ দুই বাংলার কোনোটির জন্য সুফল বয়ে আনেনি। আমরা স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি। আমাদের মাতৃভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীন হয়েছে। স্বাধীনতা সম্পূর্ণ প্রাপ্তিশূন্য নিশ্চয় নয়। স্বাধীনতায় প্রাপ্তি নিশ্চয় রয়েছে। তবে অপ্রাপ্তির পাল্লাটা প্রাপ্তির তুলনায় অধিক ভারি বলেই আমরা প্রকৃত স্বাধীনতা বঞ্চিত। অর্থাৎ পরাধীনতার বৃত্ত অতিক্রম করতে পারিনি। সেটা পশ্চিমবাংলার জনগণের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের ক্ষেত্রেও। এই সত্যটি ধারণ করেই অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধকে সম্পূর্ণ করে একটি শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনেই আমাদের মুক্তির একমাত্র পথ বলেই বিবেচনার দাবি রাখে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়