করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

আবদুল খালেক ওয়ান টু থ্রি ফোর ফাইভ

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আবদুল খালেকদের জন্ম গ্রামে, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা গ্রামের স্কুলে ও মফস্বল কলেজে। রাজধানীতে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তারা স্মার্ট হবার তাগিদ বোধ করে। এ সময় না পারে গ্রামীণ আচরণ ও অভ্যাস পুরোটা বিসর্জন দিতে, না পারে না পারে নাগরিক সংস্কৃতির পুরোটা আত্মস্থ করতে। কালচারাল শক মোকাবেলা করতেই হয়। গ্রামীণ ও শহুরে এই মিশেলের কারণে তাদের সহজে শনাক্ত করা যায়। শহুরে স্মার্ট মেয়েরা তাদের আবদুল খালেক খেতাব দেয়। নাম মাজেদুল হক হোক কি রইস উদ্দিন আহমেদ কি মোস্তাফিজুর রহমান, তাতে কিছু এসে যায় না, স্মার্ট মেয়েরা এবং ছেলেরাও তাদের তখন আবদুল খালেকই বলতে থাকে। তবে এই কাহিনীর সবারই প্রকৃত নাম আবদুল খালেক। আবদুল খালেকের সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে নাম হয় আবদুল খালেক ওয়ান, আবদুল খালেক টু, আবদুল খালেক থ্রি। কয়েকজন আবদুল খালেককে নিয়ে এই উপাখ্যান। বিভিন্নজন আবদুল খালেক কাহিনী বয়ান করে গেছেন, কখনো তাদের স্ত্রী, কখনো তারা নিজেরাই, কখনো তৃতীয় কেউ একজন।
আবদুল খালেক ওয়ান

বাবার মতো গালিভার টাইপের একটা মানুষ মাথাটা নুইয়ে আমার কানের কাছে এসে, ফিসফিস করে বলল, তোর মা যত পছন্দই করুক, ছেলেটার যত বড় ডিগ্রিই থাকুক, এমনকি সে যদি বারাক ওবামা কিংবা বিল গেটসের ছেলেও হয়, তুই যদি রাজি না থাকিস আমি কোনোদিনই এ বিয়েতে মত দেবো না।
বাবা ছ’ফুট পৌনে চার ইঞ্চি লস্বা আর মা পাঁচ ফুট সোয়া ইঞ্চি, মানে পাঁচ ফুটের চেয়ে কিঞ্চিত বেশি। দু’জনের উচ্চতার তফাৎ এক ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চি। গালিভারের সফরনামা মায়ের স্কুলপাঠ্য ছিল। সোহাগ করেই মা বাবাকে কখনো কখনো গালিভার ডেকেছে, আমি নিজেই শুনেছি। অবশ্য এটাও বলতে শুনেছি, লম্বা যতো আহাম্মক ততো।
বাবার সামনে আমি অনেকক্ষণ চুপ করেই ছিলাম।
বাবা জিজ্ঞেস করল, ছেলেটাকে তোর পছন্দ হয়েছে, ঋতু?
এবার আমি ফিক করে হেসে উঠি। বলেও ফেলি, বাবা তুমি কোনো খোঁজখবর রাখো না। ওবামার ছেলে নেই-মালিয়া আর নাতাশা দুটোই মেয়ে। বিল গেটসের ছেলেটা মানে রোরির কথা বলছ তো আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট নাইন্টি সিক্সে জন্ম। আর বিল গেটস মেলিন্দাকে বিয়েই করেছে নাইন্টি ফোরে, আমার জন্মের পর।
বাবা অবাক হয়ে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থেকে বলল, তুই এতকিছু জানিস!
বাবার মুড ভালো, পরের কথাটা বলা থেকে বিরত রইল, মুডের একটু হেরফের হলে বলত, তবুও তোর পরীক্ষার রেজাল্ট সেকেন্ড ক্লাসের ওপর উঠবে না।
বাবা বলল, বিল গেটসের ছেলের নাম তাহলে রোরি। রোরি হোক কি মোহাম্মদ ঘোরি তা বাদ দিলাম, কিন্তু তোকে দেখে ওরা যে পছন্দ হয়েছে বলল, আমাদেরও তো হ্যাঁ বা না কিছু একটা বলতে হবে।
আমি বললাম, বাবা, কেএফসির দাড়িওয়ালা লোকটার মতো দেখতে, যিনি সাধুভাষায় আমাকে তিনটি প্রশ্ন করেছিলেন, আমি তো একটির জবাবও দিতে পারিনি। আমি তো ডিসকোয়ালিফাইড।
বাবা বলল, আমি ঠিক সেই মুহূর্তে ছিলাম না। কী জিগ্যেস করেছিলেন ইস্রাফিল সাহেব? তিনিই তো পাত্রের বড় দুলাভাই! বাবা মারা যাবার পর তিনিই ফ্যামিলির গার্জিয়ান। খুব পরহেজগার কামেল মানুষ।
আমি বললাম, শোনো বাবা প্রথম প্রশ্ন, কোন নারী মা হজরত আছিয়া আলাইহুয়াসাল্লামের সহিত জান্নাতে প্রবেশ করিবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন : রমজান মাসে খেয়ালের বশীভূত হইয়া রোজা ভঙ্গ করিলে কী কাফফারা দিতে হইবে। তিন নম্বর প্রশ্ন : কোন ইবাদত না করিলে ২ কোটি ৮৮ লক্ষ বছর জাহান্নামের আগুনে জ্বলিতে হইবে?
বাবা বলল, কী বলিস এ কো সাংঘাতিক ধরনের প্রশ্ন! তোর মাকে জিজ্ঞেস করলেও পারত না। এটা আমি স্যাঙ্গুইন। খুব বড় বড় কথা বলে, তোর মা’র আরেক ফুপাতো ভাই কবে নাকি মন্ত্রী হয়েছিল-এ কথাটা আমাকে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে তিনবার শুনতে হয়, আমার ফুপাতো ভাই যে সোনালি ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে সে-কথাও। অথচ পিংকি একটা সাধারণ প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারে না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাবা, তুমি কি এই তিনটি প্রশ্নের তিনটিরই জবাব দিতে পারবে? বাবা বলল, প্রশ্নগুলো তেমন সোজা নয়, আমি তো ভেবেই বলেছি সাংঘাতিক। তাছাড়া আমার তো চর্চা নেই আজ অনেক বছর।
তাহলে বাবা জবাবগুলো শুনে রাখো, তিনি নিজেই বলে দিয়েছেন। যে নারী নিজে দ্বীনের পথে থাকিয়া তাহার স্বামীকেও দ্বীনের পথে টানিয়া আনেন তিনি হজরত আছিয়ার সহিত জান্নাতে প্রবেশ করিবেন। রোজা ভঙ্গের কাফফারা ৬০টি রোজা রাখা অথবা ৬০ জন ক্ষুধার্ত মিসকিনকে দুই বেলা পেট ভরিয়া খাওয়ানো। আর ওজর বিনা এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করিলে ২ কোটি ৮৮ লক্ষ বছর জাহান্নামের অগ্নিদহন ঘটিবে।
বাবা বলল, বলিশ কি? তোর তো মেমোরি খুব শার্প। তোর মা হলে একটাও মনে রাখতে পারতো না।
তুমি কি বললে বাবা? মার মেমোরি শার্প নয়, ডাল? তুমিই না মাকে বলেছো, কি শার্প তোমার মেমোরি? তেত্রিশ বছর আগে কখন কি বলেছি, সব মুখস্ত রেখেছো!
বাবা বলল, তা ঝগড়ার সময় বলেছি, তবে এটা ঠিক তোর মা অপ্রয়োজনীয় বিষয় বেশি মনে রাখে।
ওটা এখন থাকুক। তাহলে বল, ওদের হ্যাঁ বলব নাকি না বলব।
বাবা লোকটার নামটা আমার পছন্দ হয়নি। বাকি সব ঠিক আছে।
বাবা বলল, কেন শিঙ্গা বাজাবার ফেরেশতার সাথে ইস্রাফিল সাহেবের নামের মিল রয়েছে তাই? এটা কোনো ব্যাপারই নয়। তাছাড়া তিনি পাত্রের বড় বোনের জামাই। পাত্র তো আর নন। আমার কিছু এসে যায় না।
বাবা, আমি ইস্রাফিল সাহেবের কথা বলিনি। আমি তোমাদের পাত্রের কথা বলেছি। যত বড় শিক্ষিতই হোক, তার নামটা নিয়ে একটা সমস্যা আছে।
কী সমস্যা?
আবদুল খালেক।
সৃষ্টিকর্তার মহান আল্লাহতালার দাস! খুবই পবিত্র নাম।
তা হোক। ইউনিভার্সিটিতে আমরা কাদের আবদুল খালেক ডাকি সেটা তোমার জানা নেই-স্মার্ট হতে খুব চেষ্টা করার পরও সবচেয়ে আনস্মার্ট এবং সবেচেয়ে অগা-কিন্তু রেজাল্ট ভালো করে, শীতের দিন বেমানান কোটের সাথে চওড়া সাত-আট ইঞ্চি লম্বা টাই পরে আর জুতোর বাহার দেখলে তোমার বমি আসবে। তাকে নাম চেঞ্জ করতে হবে। আমার পছন্দমতো একটা নাম রাখতে হবে।
বাবা বলল, ঋতু, নাম রাখাটা যে কোনো সন্তানের বাবা-মা’র এখতিয়ার। এখানে স্ত্রীর পরিবর্তন সংশোধন সংযোজন কিংবা বিয়োজনের কোনো অধিকার নেই। আবদুল খালেক আর তোর যখন সন্তান হবে, যা ইচ্ছে নাম রাখিস- ডাইনোসোরাস রেক্স কিংবা বুফো মেলানস্টিকটাস!
এসব বলার সময় বাবা তার নিজের সাবজেক্টের জ্ঞান ফলাল। জুলজি- প্রাণিবিদ্যা।
এবার বললাম, তাহলে বাবা থাক, না বলে দাও।
কেবল ‘আবদুল খালেক’ নামের কারণে এমন ভালো একটা ছেলে হাতছাড়া হয়ে যাবে, পরে না আমাদের আফসোস করতে হয়। শোন ঋতু, একটু ভেবে দেখ মা।
আমি বললাম, তুমি বলছ ভালো ছেলে, বেশ মেনে নিলাম। আমি রাজি, কিন্তু আবদুল খালেককে বলো নিজের নামটা বদলে যেন আদনান সামি করে নেয়, আর এটা করতে হবে তাড়াতাড়ি। আমাকে বিয়ে করার আগেই। বিয়ের কার্ডে পাত্রের নাম লেখা থাকবে আদনান সামি। আমি চাই না আমার ক্লাসমেট ও কাজিনরা বলে বেড়াক-ঋতু একটা আবদুল খালেককে বিয়ে করেছে।
বাবা খুব কাতর সুরে বলল, এসএসসি, এইচএসসি, বিএসসি, এমএসসি, পিএইচডি, ভোটার আইডি সবকিছুতে আবদুল খালেক আর সবাই জানবে আদমান আলী?
বাবা, আদমান আলী বলিনি, আদনান সামি। ঋতুর সাথে আবদুল খালেক নামটা যায় না।
বাবা বলল, পিংকির সাথে হজরত আলী যায়?
আমি এবার বাবাকে বলি, আচ্ছা বাবা, তুমি মেয়েমানুষের মতো তর্ক করো কেন?
বাবা তখন চুপ হয়ে যায়। আমাকে ছাড়া বাবার উপায় নেই। রিটায়ারমেন্টের পর বাবার কথা শোনার মতো মানুষ মাত্র দুজন। আমাদের বাসার কেয়ারটেকার কাম দারোয়ান কাম ইলেকট্রিশিয়ান কাম ড্রাইভার ঠান্ডু মিয়া আর আমি। হজরত আলী আইএসসির জুলজি লিখে এমনিতেই বিখ্যাত। ছাত্রছাত্রীরা হা করে তার কথা শুনত। এখন কে শুনবে?
মা বাবার ছাত্রীদের সকলকে এবং তাদের বড় আপা, মা এবং এমনকি তাদের অশীতিপর দাদিদেরও সন্দেহ করত, ভাবত নিশ্চয় তারা হজরত আলীর প্রেম পড়েছে, কিংবা পড়ে না থাকলেও যে কোনো সময় পড়বে। নিজেকে একটু স্মার্ট মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য বাবা পাতলা সোনালি ফ্রেমের চশমা নিয়েছিল।
মা বলল, বলো হজরত আলী, তোমার কোন ছাত্রী এরকম চশমাটা কিনতে বলেছে? আমি তার চৌদ্দগোষ্ঠীর খবর নিয়ে ছাড়ব। তারপর চশমাটা ভেঙে ফেলে।
আমার মায়ের নাম পিংকি। হজরত আলী নামটা পিংকির সাথে আদৌ ম্যাচ করে না। তারপরও তাদের বিবাহিত জীবনের তেত্রিশ বছর পূর্ণ হয়েছে। হৃদয়ের বয়স পুরো তিরিশ বছর। চব্বিশ বছর বয়সে বাবার সাথে তুই-তোকারি করে। বাবা মরলেও দেখতে আসবে না এরকম একটা প্রতিজ্ঞা করে, মাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। দশ দিন পর বাবা নিজেই দুটি সংবাদপত্রে হৃদয়ের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন ছাপিয়েছে : ফিরে এসো হৃদয়, তোমার মা মৃত্যুশয্যায়।
মা নিশ্চিত ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনে মহানগর প্রভাতী ট্রেনের চাকার নিচে হৃদয় মাথাসহ শরীরটা বিছিয়ে দিয়েছে।
বাবার ধারণা, হৃদয় হিলি বার্ডারে ড্রাগ স্মাগলিংয়ের কাজ করছে।
আমার ধারণা, গোপনে সিরিয়ায় গিয়ে আইএস-এ যোগ দিয়েছে-এখন হৃদয়ের হাতে একে ফোরটি সেভেন।
আর ঠান্ডু মিয়ার ধারণা, কোনো বদ বেটির পাল্লায় পড়ে টিটিপাড়া কিংবা আগারগাঁও বস্তিতে জীবনযাপন করছে।
সর্বশেষ ব্রেকিং নিউজ তাও প্রায় তিন বছর আগেকার। নিউজিল্যান্ডে ফেরত আমাদের এক দূরসম্পর্কের ফুপু ‘হৃদয়স কুইজিন’ নামে একটি রেস্তোরাঁয় খেয়ে এসেছেন। মালিক তার কাছ থেকে টাকা রাখেনি। তাকে ফুফু বলে সম্বোধন করেছে এবং আমতা আমতা করে বলেছে তার চেয়ে তেরো বছরের বড় দুই কন্যার মা জেনিফার লরেন্সকে বিয়ে করে তার টাকার ব্যবসা শুরু করেছে। জেনিফার খুব কেয়ারিং টাইপের নারী। হৃদয় আমাদের কারো কথা জিজ্ঞেস করেনি।
তারপর আমার মা পিংকির একটি মিসক্যারেজ, একটি স্টিলবর্ন তারপর আমি। তারপরই ওভারিতে টিউমার ধরা পড়ে, ম্যালিগন্যাট। যে কোনো সময় ক্যানসার ছড়িয়ে পড়বে। সুতরাং হজরত আলী জুলজি বইয়ের রয়্যালটির সব টাকার সাথে আরো দেড় লাখ টাকা যোগ পরে ব্যাংকক জেনারেল হসপিটালে গিয়ে স্ত্রীর ওভারিটা রিমুভ করিয়ে আনলেন। সুতরাং সন্তান পাবার সম্ভাবনার সেখানেই সমাপ্তি ঘটল। তারপর মা-র সন্দেহের রোগ আরো বেড়ে গেল। হজরত আলী যদি সন্তানের দোহাই দিয়ে কোনো ছাত্রীকে বিয়ে করে ফেলে!
বাবা বলল, তোর কথাটা কেমন করে আবদুল খালেকদের বলব, বুঝতে পারছি না। নাম চেঞ্জ করে আদনান আলী রাখতে হবে।
আমি আবার বলি, বাবা আলী নয়, সামি। আদনান সামি। তুমি দু’মিনিট এখানেই বসো, আমি কফি নিয়ে আসছি।
দশ টাকা দামের এক-একটা স্যাচেলে কফি, দুধ আর চিনি মেশানোই থাকে। দুটো মগে দুটো স্যাচেল খালি করে ফুটন্ত পানি ঢাললাম, বেশ কফি হয়ে গেল। বাবার সুগার লেভেল মার্জিনে, তবুও চিনি দিয়ে চা খায়, গরম শিরায় চুবানো জিলাপি খায়। বাবার হাতে একটা মগ তুলে দিয়ে বললাম, বাবা আমি চাই না নাম বদলানোর কথাটা বলে তুমি বিব্রত হও। তার চেয়ে বরং তুমিই যদি ওই আবদুলটার ফোন নম্বর আমাকে দাও, আমি আমার মতো করে বলব, আমি আশা করি কনভিন্স পরতে পারব।
বাবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
বলল, যাক মা তুই বাঁচালি। শুধু একটা কথা, পিংকির মতো ক্যাট ক্যাট করে কথা বলিস না কিন্তু। কোমল স্বরেও অনেক কঠিন কথা বলা যায়, তাতে কাজও হয় বেশি।
তখনই মা আবির্ভূত হয়। চেঁচিয়ে বলে, মেয়ের সাথে কিসের এত গুজুর গুজুর। আমি খালেকের মা-র সাথে কথা বলে এসেছি, তারিখও ফাইনাল ১৮ আগস্ট, হাতে সময় একুশ দিন। বাবা অর্ধেক কফি রেখেই উঠে পড়ে।
বলে, পিংকি তুমি ঠিকই করেছ। দেরিতে কোনো লাভ নেই। আমি যদি তোমাকে আরো দুবছর আগে বিয়ে করতে পারতাম আমাদের দাম্পত্য জীবনের পঁয়ত্রিশ বছর হয়ে যেত। মা বলল, আমারও দুবছর আগে বিয়ে করা উচিত ছিল। তবে তোমাকে নয়, জামালউদ্দিন ভাইকে। তখন তিনি আমার পেছনে ঘুরঘুর করতেন, আমি পাত্তা দিতাম না। পাত্তা দিলে সবাই আমাকে বলত, মন্ত্রী ভাবি, মন্ত্রী মামি। কপালে না থাকলে কিছুই হয় না।

দুই.
কথাটা আমি বলার আগেই আবদুল খালেক ভারি ও স্পষ্ট স্বরে ভয়েস অব আমেরিকার নিউজকাস্টারদের মতো বলল, ফোন করে ভালোই করেছেন। আপনার মোবাইল ফোন নম্বর কিছুক্ষণের মধ্যে আমার হাতে আসার কথা ছিল। আপনাকে এবং সবমিলিয়ে আপনাদের আমরা পছন্দ করেছি। ছোট্ট একটি বিষয় ছাড়া আমাদের বলার কিছু নেই। আপনার মা খুব ভালো মানুষ। ১৮ আগস্ট বিয়ের তারিখ চূড়ান্ত করে গেছেন। কার্ড ছাপাতে দেবো। আপনার নাম নিয়ে খুব আপত্তি উঠেছে। ঋতু শুনলেই সবাই ঋতুস্রাবের কথা মনে করে। শুরুতে মনে না হলেও এখন আমারও তা-ই মনে হচ্ছে। কাজেই নামটা পালটানোর কথা বিবেচনা করবেন। আবদুল খালেকের সাথে ঋতুটা ঠিক যায় না। আবদুল খালেকের সাথে যায় আপনার পছন্দ মতো যে কোনো একটা নাম ঠিক করে সাত দিনের মধ্যে জানাবেন। দেখুন আপনাকে যখন আমার ভালো লেগেছে, নামটা ঋতু হোক কি ঋতুস্রাবই হোক আমার কিছু এসে যায় না। কিন্তু আমরা তো একটা সমাজে বাস করি। সমাজের চাহিদাটা তাই উপেক্ষা করা যায় না।
আবদুল খালেক একটু দম নিয়ে বলল, আপনি নাকি গান গাইতে পারেন? তাহলে আমার প্রিয় একটা গান যদি আপনার শেখা থাকে ভালো, নতুবা স্বরলিপি দেখে তুলে নিন, সুচিত্রা মিত্র গেয়েছেন, আকাশ জুড়ে শুনিনু, ওই বাজে/ তোমারি নাম সকল তারার মাঝে।
আমি থ হয়ে থাকি আবদুল খালেক গান শুনতে চায়! আকাশ জুড়ে শুনিনু-র মতো একটা গান।
হঠাৎ আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। আবদুল খালেক বলে, তাহলে সাম-আপ করি : প্রথমত, ঋতু নামটা বদলাতে হবে, দ্বিতীয়ত, যদি আমার পছন্দের গানটা শোনাতে পারেন ভালো, না পারলেও সমস্যা নেই।
আমি শুধু বলি, আচ্ছা, আচ্ছা।
কথা শেষ হয়ে আসে। আমি নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়ি। যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, ক্লাস টেনের সবচেয়ে বয়স্ক ও গোঁফ ওঠা ছেলে সালমান নুন আমার কাছে একটা চিরকুট পাঠিয়েছিল তাতে লিখা- তুমি কি ঋতু না ঋতুস্রাব?
রাগে অভিমানে কিছুক্ষণের মধ্যে আমার মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়। জ্বরের দোহাই দিয়ে টিফিনের পরের ক্লাসগুলো না করে বাড়ি ফিরে আসি এবং শুয়ে শুয়ে কাঁদি।
বাবা ও মায়ের প্রিয় এই পাত্রটি আমাকে তার চেয়েও বিপন্ন অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে-আবদুল খালেকের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি নারীনাম আমাকে ধারণ করতে হবে, সেই নামই ছাপা হবে বিয়ের কার্ডে। আমার আবার মাথাব্যথা শুরু হয়। আমার চোখ ভিজে আসে। আবদুল খালেকের এত দুঃসাহস!
অনেকদিন আগে মন খারাপ থাকায় আমি যখন কাঁদছিলাম আমার বাবা তার স্বল্পঘনিষ্ঠ পাজামা পাঞ্জাবি পরা ছোটখাটো গড়নের একজন বন্ধুকে প্রায় জোর করে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। তাকে দেখে আমি যেন অনুপ্রাণিত হই, সেজন্য। তিনি আমার বাবার ভাষায় ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজের গ্র্যান্ডমাস্টার। আমাদের বাড়ির বিধান অনুযায়ী বয়স্ক মানুষকে পা ছুঁয়ে সালাম করতে হয়। আমিও তা-ই করলাম। তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটা সন্দেশ খেলেন এবং দুধচিনি ছাড়া এক কাপ চা। যে ক’টা শব্দ উচ্চারণ করলেন, সব ক’টা বাংলায়, ইংলিশের ই-ও কোথাও নেই। বসার ঘরের এক কোণায় তার চোখ পড়লে বললেন, ওটা আনো তো দেখি। আমি তুলে এনে টেবিলে রাখতে চাইলাম, কিন্তু তিনি আঙুলের ইশারায় দেখালেন কার্পেটের ওপর রাখো।
তিনি সোফা ছেড়ে কার্পেটের ওপর বসলেন এবং বললেন, পাকড়াশির হারমোনিয়াম তো বেশ ভালো। তিনি গাইলেন, আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে। বললেন, এটি রবি ঠাকুরের একটি অসাধারণ সৃষ্টি, বাণী ও সুর দুটোই।
আমার বাবা অবাক হয়ে বলল, আপনি গানও জানেন? আমি তো জানতাম আপনার ওয়াইফ মানে মিনু আপা ফেমাস সিঙ্গার।
বাবার সেই স্বল্পঘনিষ্ঠ ও বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধুর নাম ওয়াহিদুল হক, আর মিনু আপা হলেন সন্জীদা খাতুন। আমার মনে হচ্ছে, তিনি ঠিক আমার সামনে মেঝেতে বসে আমাকে বলছেন, কেন কাঁদছিস? শোন মা, তোকে একটা গান শুনাই, কান্না থেমে যাবে :

সে নামখানি নেমে এল ভুঁয়ে
কখন আমার ললাট দিল ছুঁয়ে
শান্তিধারায় বেদন গেল ধুয়ে
আপন আমার আপনি মরে লাজে
ওই বাজে ওই বাজে
আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে।
আমিও তার সাথে গুনগুন করতে থাকি, পুরো গানটি আমার ভেতর বাজতে থাকে: ওই বাজে, ওই বাজে। আমার কান্না থেমে যায়। ওয়াহিদুল হককে বাকি জীবনে আর কোনোদিনও আমি আর দেখতে পাইনি।
আবদুল খালেকের সাথে কথা বলার পর পঞ্চম দিন একটি খবর আসে তার মায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। যে কোনো সময় দুঃসংবাদ এসে যেতে পারে। আবদুল খালেকের বড় দুলাভাই ইস্রাফিল সাহেব পরদিন আমাদের বাড়িতে এলেন এবং বললেন, আমার শাশুড়ির জ্ঞান ফিরেছে। কাজটা আমাদের কালই সারতে হবে। পিজি হাসপাতালের কেবিনে, ৩০৭ নম্বরে। আবদুল খালেক থাকবে, আমি থাকব, কাজিকে থাকতে বলব।
তারপর বাবাকে বললেন, আপনি মেয়েটাকে নিয়ে আসবেন। কোনো সাজগোজ করার দরকার নেই। সাথে সাক্ষী হিসেবে কাউকে নিতে পারেন, মেয়ের মা তো অবশ্যই থাকবেন। বোঝেনই তো হাসপাতালের কেবিন আর কত বড়। আমরা চাই আবদুল খালেকের মা ছেলেকে-বউমাকে দোয়া করে যেন যেতে পারেন। কখন কী হয় বলা যায় না। অনুষ্ঠান আমরা পরে করতে পারব।
সপ্তম দিন পিজির ৩০৭ নম্বর কেবিনে আমার শাশুড়ির সজ্ঞান অবস্থায় বাস্তবিকই অনাড়ম্বরভাবে আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। আবদুল খালেক তখনই বললেন, অলংকার নিয়ে চিন্তা করবেন না, মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরার সময় আমি সবচেয়ে ভালো স্বর্ণ নিয়ে এসেছি, আপনাদের মেয়ে তার পছন্দের ডিজাইন অনুযায়ী বানিয়ে নেবে।
তাড়াহুড়োর কারণে আমার নাম বদলের বিষয়টি চাপা পড়ে যায় আর আবদুল খালেকের নাম পালটানোর কথা তো তোলার সুযোগই আসেনি। সেদিন ফোনে লোকটা একনাগাড়ে কথা বলে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করল যে ঋতু নামের কারণে আমি নিজেই বিব্রতবোধ করতে শুরু করলাম। আবদুল খালেকের সাথে মেলাতে গিয়ে একবার ভাবলাম, আমার নাম হোক জান্নাতুল মেওয়া, একবার ভাবলাম আমেনা খাতুন, একবার নুরুন নাহার। আমার আদনান সামি ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকল। পুরুষশাসিত সমাজে এমনই তো হয়। অবশ্য উপশমও পুরুষের হাতে। আমার উপশম এবং আশ্চর্য হবার কথাই আবদুল খালেকেরও উপশম রবীন্দ্রনাথের গান।
যন্ত্রণা মোচনের কী অসাধারণ ঐক্য আমাদের দুজনের। তবুও আমাদের সংসারটা টিকলো না।

তিন.
গøাসগো ইউনিভার্সিটির পিএইচডি ডক্টর আবদুল খালেক তার ভরাট গলায় যখন আমাকে ডাকত ঋতুমণি, আমার মনে হতো অনেক দূরে কেউ একজন তার কণ্ঠস্বরের ওঠানামার সাথে তবলাসঙ্গত করছে।
ঋতুমণি তোমারও প্রতিদিন ট্যাবলেট খাওয়ার দরকার নেই, আমিও কোনো প্রোটেকশন নেব না, আগে একটা বাচ্চা হোক।
আমি সাথে সাথে রাজি হই, হোক না। শুনেছি ট্যাবলেটের নাকি সাইড এফেক্ট আছে।
আমাদের বিয়ের এক বছর যখন পূর্ণ হলো তখন আমাদের মেয়ে বর্ষার ঠিক একশ দিন। ওদিকে মৃত্যু আমার শাশুড়িকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
আমার মা অবশ্য চটে গিয়েছিল, এত তাড়াহুড়ো করার কী দরকার ছিল। মেয়ে মানুষ কি বাচ্চা পয়দা করার মেশিন নাকি। বিয়ে করলাম আর মেশিন স্টার্ট দিলাম। কোথায় হানিমুন? কোথায় দেশ-বিদেশে ঘোরাঘুরি। এমনকি হাড়কিপটে বজ্জাতগুলো বুড়িটার অসুখের দোহাই দিয়ে অনুষ্ঠান পর্যন্ত বানচাল করে দিল।
মা রাগলেও আমার ভালোই লেগেছে, মেয়েটা তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাবে। তাছাড়া সংসারের কোনো সিদ্ধান্তেই আবদুল খালেক নাক গলায় না, ক’টাকা খরচ করলাম, কেন করলাম, জিজ্ঞেসও করে না। তার সময়ও নেই। একদিন টেলিভিশনে দেখলাম ডক্টর খালেক ভার টাইপের একজন ভিআইপিকে বলছেন, এখনই ডিজেল পেট্রোল আর গ্যাসের দাম কমাতে হবে।
সে সারাদিনই ব্যস্ত, অথচ কোনো নির্ধারিত চাকরি নেই। কনসালটেন্ট ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএফসি, আইএমএফ, এদের কাজ লেগেই আছে। আবার দুটো ইউনিভার্সিটিতে পার্টটাইম লেকচার, এসবও চলছে। পান-সিগারেট, হুইস্কি এসবের ধারেকাছেও নেই। নিজেই বলে, কাজের মজা পেয়ে গেলে এর চেয়ে বড় নেশা আর কিছুই হতে পারে না।
সেই নেশাই তাকে পেয়েছে। কাজের তাড়নার কাছে তার জৈবিক তাড়না মার খেয়ে গেছে।
আবদুল খালেক বলে, আমি আর কত কাজ করি, ষোল থেকে আঠারো ঘণ্টা। আইএমএফ-এ আমার কাউন্টারপার্ট অ্যানাস্তাসি দ্য বুভেয় প্রতিদিন কুড়ি থেকে একুশ ঘণ্টা কাজ করে। বিছানায় দুঘণ্টা ঘুম আর গাড়িতে আসা যাওয়ার পথে এক-দেড় ঘণ্টা ঘুমাতে পারলেই হলো। ফ্রেঞ্চ মেয়েদের তো বাঙালিদের মতো ফাঁকিবাজ হবার কথা, কিন্তু এই মেয়েটা একেবারে ভিন্ন ধাঁচের। প্যারিসের মপাঁরনাসে নামের ধনী এলাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছে। দাম শোধ করার জন্য বেশি কাজ করতে হচ্ছে। ঋতুমণি, তুমি দূর থেকে ওকে দেখলে বুঝতে পারবে না পুরুষ না নারী। আমি ভেবেছিলাম হিজড়া।
আমি জিগ্যেস করি, কিন্তু ও যে নারী এটা বুঝলে কী দেখে?
ঘুমোবার আগে হাই তুলতে তুলতে আবদুল খালেক বলল, একেবারে ফ্ল্যাট ব্রেস্ট, মানে বুকে মরা। এর বেশি তো বাইরে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু প্রতি মাসেই তিন-চারটা দিন ভীষণ চেঁচামেচি করে, কখনো কাঁদে। আমি একদিন নোংরা ফ্লোরে গড়াগড়ি করতেও দেখেছি। কারো কিছু জিগ্যেস করতে হয় না, নিজেই বলে, তার ঋতুস্রাব শুরু হয়েছে, মানে মাসিক শুরু হয়েছে, তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। লাখে দু-একজনের এমন হয়ে থাকে।
আমি ক্ষুব্ধ হয়ে বলি, এটা কি পুরুষদের ডেকে বলার মতো বিষয়? প্যারাসিটামল খেলেই পারে। এতে কাজ না হলে অন্য কোনো ঔষধ।
আবদুল খালেক বলল, আমি একবার বিরক্ত হয়ে চারটা পেইনকিলার ট্যাবলেট এনে দিয়েছিলাম। নেয়নি। বলেছে, সন্তানের জননী হতে হলে যন্ত্রণা সহ্য করতেই হবে। মপাঁরনাসের অ্যাপার্টমেন্ট তো তাদের জন্যই কিনেছি।
বলতে গিয়েও বলিনি, মাসিকের যন্ত্রণা কমাতে যখন পেইনকিলার কিনতে পেরেছ… আমার কল্পনা আর এগোয় না। আমি নাক ডাকার শব্দ শুনি। প্রিয়জনকে ফার্স্টনেইমে ডাকা হয়। অ্যানাস্তাসি আমার স্বামীকে তাই আবদুল ডাকে।

কাজই যেহেতু তার জৈবিক চাহিদার খোড়াক জোগায়, আবদুল খালেকের সম্ভবত সে কারণেই স্ত্রীসঙ্গ প্রয়োজন হয় না।
আমি রাতের পর রাত অস্বস্তিতে ভুগতে থাকি। আমি সন্তান চেয়েছি, আমি তো সঙ্গও চেয়েছি। আমি তো দু বেলা বেলপাতার রস খেয়ে আমার কামনাকে দমন করি না। আমি তালাকের আইনকানুন পড়তে শুরু করি। স্বামীর সহবাসে অপারগতার কারণে তাকে তালাক দেয়া যায়। কিন্তু এ অভিযোগ তো টেকাতে পারব না। আবদুল খালেক বর্ষাকে দেখিয়ে বলবে, বিজ্ঞ আদালত, আমি অপারগ হলে আমার মেয়ে পৃথিবীতে আসত না। বর্ষার মুখটা অবিকল বাবার মতো।
আবদুল খালেক ভিন্ন ধাঁচের মানুষ। আমার ধারণা, সে-ই আমাকে সবচেয়ে ভালো বোঝে। এমনিতেই ফিরতে ফিরতে তার রাত সাড়ে এগার কি বারোটা বাজে। বাইরে খুব বৃষ্টি, এমন এক রাতে বাড়ি ফিরে বলল, ঋতুমণি, আমি জানি, তুমি যেমন স্বামী কল্পনা করতে, আমি মোটেও সে-রকম নই। তোমার চেনাজানা সে-রকম কেউ যদি থাকে, তুমি আমাকে ডিভোর্স করতে পারো কিংবা আমাকে যদি বলো আমিও রাজি, কাগজে যেখানে সই করার চোখ বন্ধ করে সই করে দেবো।
আমি বলি, তাহলে বর্ষার কী হবে। বর্ষার বয়স এখন মাত্র সাত। তাতে কোনো সমস্যা নেই। বর্ষার ভালো তুমি চাও, আমিও চাই। তুমি যেভাবে ভালো মনে করবে আমি তা-ই করব। বর্ষার লালন-পালনে যত টাকা লাগবে, আমি তার চেয়ে অনেক বেশি দেবো। তুমি যদি চাও, যখন চাও আমি নিয়ে আসব।
নিঃশব্দ ক্রন্দনে সে রাতটাকে আমার মনে হয় পৃথিবীর দীর্ঘতম রাত! আমি জানি আমি আবদুল খালেককে চাই না, কিন্তু কাকে চাই তাও তো জানি না; কিংবা আমাকে কে চায় তাও আমার জানা নেই। আমি তাহলে বর্ষাকে রেখে দেবো।
সকালে নাস্তার সময় আবদুল খালেক এত স্বাভাবিকভাবে কথা বলল, যেন রাতে আমাদের দারুণ তৃপ্তিকর একটি মিলন ঘটেছে। একবার ভাবি, আমার পন্ডিত স্বামী আসলে কি মানুষ নাকি একটা রোবট।
আমি যে দিনের পর দিন তার মাকে উপেক্ষা করেছি-এ নিয়ে একটি কথাও বলেনি। মা উপেক্ষিত হলে কোনো কোনো স্বামী তো স্ত্রীকে খুনও করে।
আবদুল খালেককে ধন্যবাদও দিই। আমার তালাক চিন্তাটার বাস্তবায়নের পথ সহজ করে দিয়েছে। অলংকার হোক কি আর্থিক ক্ষতিপূরণ- আমাকে একটুও ঠকায়নি। চেঁচামেচি করেছি আমিা খালেকের মেয়ে কেন রাখব? কিংবা আমার মেয়ে তাকে কেন দেব? খালেকের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা দিয়ে জেল খাটাব।
আমার কোনো কথাতেই খালেকের বিরুদ্ধে স্পষ্ট কোনো অভিযোগ নেই।। আসলে আমরা দুজন দুজনার নই, আমরা মিসম্যাচ।

চার.
বর্ষার কেবল আট পেরিয়েছে।
বিয়েটা আমিই প্রথম করি। সদ্য-বিপতœীক সরকারের যুগ্মসচিব ইরফানুল বারীকে। তার স্ত্রী ও এক সন্তান সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত। সরকারি গাড়িতে সন্তানদের নিয়ে খাগড়াছড়ির উঁচু-নিচু পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। গাড়িটা হঠাৎ অগভীর একটি খাদে ছিটকে পড়ে। বড় ছেলে আর ড্রাইভার আহত, স্ত্রী ও ছোট ছেলে নিহত। মেয়েটি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে থাকত, ক্লাস মিস করে যেতে রাজি হয়নি। ইরফানুল বারী বরাবরই স্যুটপরা সুদর্শন মানুষ। আমাদের বিয়ের তৃতীয় মাসে আবদুল খালেক ইস্কাটনে সরকারি কোয়ার্টার সাগরিকার তিন তলায় হাজির। দরজায় ইরফানের নাম লেখা ছিল। ইরফান থাকলে আমার জন্য খুব বিব্রতকর হতো, ব্যাংককে কিসের কনফারেন্সে গেছে। বড় মেয়ে তো হোস্টেলে, এমনকি বড় ছেলে তপনও বাইরে। শুধু আমি আর বর্ষা। দরজা আমিই খুলি। অনেকদিন পর বাবাকে পেয়ে বর্ষা আঁকড়ে ধরে থাকে, বলে, যেতে দেবে না, রাতে থাকতে হবে।
আবদুল খালেকের সাথে ফ্ল্যাটব্রেস্ট-বুকেমরা অ্যানাস্তাসি। অ্যানাস্তাসিই আমাকে বলল, তুমি যদি ব্লেসিংস দাও, আমি শীঘ্রই আবদুলকে বিয়ে করব এবং প্যারিসে নিয়ে যাব।
আমার ঠোঁট কাঁপতে শুরু করল। গলার ভেতরেও কম্পন। বললাম, অফকোর্স।
অ্যানাস্তাসি বলল, আর আমি হয়তো তোমার মতো ভালো মা হবো না, তবুও বর্ষাকে সাথে নিয়ে যেতে চাই।
আবদুল খালেক বিড়বিড় করে মেয়েকে বলল, আমার সাথে প্যারিস যাবি মা? বর্ষা তখনই দৌড় দিল। নিশ্চয়ই যাবে না।
অ্যানাস্তাসি বলল, এক কাপ ব্যাক চা কিংবা কফি পেতে পারি? আর কিছু খাব না।
দুজনকে বসিয়ে আমি কিচেনে যাই। ফ্রিজ থেকে লাড্ডু বের করে মাইক্রোওয়েভে গরম করি। চা, লাড্ডু এবং এক পেয়ালা কাজুবাদাম নিয়ে যখন ফিরে আসি, অবাক হয়ে দেখি বর্ষা তৈরি হয়ে এসেছে, সাথে চাকাওয়ালা একটি টানা স্যুটকেসও। ভেতরে বই আর কাপড়। এখনই চলে যাবে।
আমি নির্বাক হয়ে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে বর্ষার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
অ্যানাস্তাসি বলল, আমি খুব খুশি হয়েছি, আমি খুব কৃতজ্ঞ তোমার কাছে যে তুমি বর্ষাকে আমার কাছে দিয়েছ। আবদুল বলেছিল, ইম্পসিবল, পাবে না। আমার জীবনে এটাই সবচেয়ে বড় গিফট। গড ব্লেস ইউ ঋতু।

পুনশ্চ :
এ পর্যন্ত কাহিনীর কথক আমার বায়োলজিক্যাল মা ঋতু। আমি এখনো মাদমোয়াজেল বর্ষা। ক’মাস পরই আমি হয়ে যাব মাদাম বর্ষা মিতেরা। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া মিতেরা পরিবারের একটি ছেলে আলবেয়র মিতেরা আমার বয়ফ্রেন্ড থেকে হাজব্যান্ড হতে যাচ্ছে। ঋতু ও আবদুল খালেক কাহিনীর বাকিটুকু সংক্ষেপে আমিই বলব।
অ্যানাস্তাসি দ্য বুভেয় প্রতি মাসে ম্রেন্সট্রুয়াল পিরিয়ডে যন্ত্রণায় এত যে চিৎকার-চেঁচামেচি করেছে তার কারণ টিউমার। খুব ধীরগতিতে ক্যানসার ছড়াতে থাকে। বাংলাদেশে থাকা অবস্থাতেই অ্যানাস্তাসি নিশ্চিত হয় তাকে হিস্টেরোক্টোমির পথে যেতে হবে-জরায়ু অপসারণ করলে সন্তানের সম্ভাবনা একেবারেই শেষ। সেজন্যই আমাকে চেয়েছে। আমার বাবা আবদুল খালেকের সাথে তার সম্পর্কটি অনেকদিনের কিন্তু শারীরিক সম্পর্ক তেমন বেশি হয়নি। বাবার কাজ নিয়ে ব্যস্ততা, অ্যানাস্তাসির যন্ত্রণা তার জৈবিক তাড়না একেবারে দমিয়ে দেয়। পার্টনারের এই তাড়না যত কম থাকবে অ্যানাস্তাসিও তত কম যন্ত্রণা পাবে এই বিবেচনায় সে বাবাকেই বেছে নেয়। এসব কথা আমার জানার কথা নয়, আমার নতুন মা নিজেই আমাকে বলেছে। ফ্রেঞ্চ ল মেনে আমাকে অ্যাডপ্ট করেছে এবং মপাঁরনাসের এই দামি অ্যাপার্টমেন্টসহ তার অবশিষ্ট সম্পত্তির পঁচিশভাগ চ্যারিটিতে দিয়ে বাকিটা আমার জন্য নির্ধারিত করে রেখেছে।
ইরফানুল বারীর সাথে আমার মা ঋতুর সংসার এগারো বছরের। ঋতু সেখানেও সন্তান চেয়েছে, কিন্তু তপন ঘোষণা করেছে, নতুন ঘরে ছেলে হোক কি মেয়ে হোক গলা টিপে হত্যা করবে। তপন একবার তার বাবার বিশেষ অঙ্গ কেটে ফেলার ঘোষণাও দিয়েছিল। যদিও ইরফানুল বারীর মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক বলা হয়েছে, মা-র ধারণা তপনই তার বাবাকে হত্যা করেছে।
ইরফানুল বারীর মৃত্যুসংবাদ যখন মা-র কাছ থেকে পাই, আমার অনেক ভালোবাসার নতুন মা ক্যানসার ছড়িয়ে পড়া শরীর নিয়ে প্যারিসের উপকণ্ঠে একটি হসপিসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। আর আমার বাবা আবদুল খালেকের শরীর আপাতদৃষ্টিতে ঠিক আছে বলে মনে হলেও মানুষটি ভয়ংকর রকম স্মৃতিভ্রংশ রোগে ভুগছে। ডাক্তারের পরামর্শে আসলে তাকে বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে। তার ওপর নজরদারি করার জন্য দু’জন সার্বক্ষণিক কেয়ারটেকার রাখা হয়েছে। একা বের হলে বাড়ি ফিরতে পারবে না বলেই ডাক্তারের সন্দেহ।
বাবা দেড় মাস ধরে আমাকে বলে আসছে, ঋতু, তোমার নামটা বদলানো দরকার। সুন্দর একটা নাম খুঁজে বের করো।
আমি কামাই-রোজগার শুরু করার পর একাধিকবার মাকে প্যারিসে আনার চেষ্টা করেছি, রাজি হয়নি।
অ্যানাস্তাসিকে হসপিসে পাঠানোর পর বলেছি, মা চলে এসো। কিন্তু রাজি হয়নি। বলেছে, আবদুল খালেক আমাকে ডিভোর্স করে আইনসঙ্গতভাবে গেছে, কিন্তু তুই তো আমাকে ডেজার্ট করে চলে গিয়েছিস। আমি তোর কাছে কেন যাব?
আমি বাবাকে দিয়ে মাকে ফোন করিয়েছি। কেমন আছ, শরীর ভালো তো, তোমার চুলে কি পাক ধরেছে, এসব বলতে বলতে বাবা হঠাৎ ট্র্যাক চেঞ্জ করে বলল, অ্যানাস্তিসে তোমার বাংলাটা অনেক ইমপ্রæভ করেছে। আর কিছুদিন থেকে ভাষাটা ভালো করে রপ্ত করে তবে এসো।
আমি ফোনের রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে বাবাকে বলি : বাবা অ্যানাস্তিসে নয়, ওপাশে ঋতু। ঋতুকে আসতে বলো। রাজি হলে আমি টিকেট আর ভিসার জন্য দরকারি কাগজপত্র পাঠিয়ে দেবো।
বাবা এতে ক্ষুব্ধ হলো এবং বলল, ফোনে আর কখনো অ্যানাস্তিসের সাথে কথা বলবে না।
আমি বললাম, বাবা আমি আর আলবেয়র নেক্সট উইকে বাংলাদেশে যাচ্ছি। মাকে নিয়ে আসব।
বাবা নতুন ইংরেজি শেখা স্কুলবালকের মতো মাথা নেড়ে বলল, হু ইজ ইয়োর মাদার?
আমি বললাম, ঋতু, তোমার ঋতুমনি।
বাবা বলল, আমি ভয় পাচ্ছি।
তারপর সারাদিনই থেকে থেকে একই কথা, আমি ভয় পাচ্ছি।
পরদিন সকালে প্রথম শিফটের কেয়ারটেকার টেবিলের ওপর সুন্দর খামে ভরা একটি বাংলা চিঠি পেলো আর দেখল, আবদুল খালেক ছাদ থেকে ঝুলানো ভারী শ্যান্ডলিয়ারের দড়ির সাথে আর একটি দড়ি বেঁধে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে আছে। মাথার ওপর জ্বলছে রং-বেরঙের বাল্ব। পুলিশ পৌঁছার আগে এক লাইনের চিঠিটি পড়ে : আমার মৃত্যুর জন্য আবদুল খালেক দায়ী। ইতি ইরফানুল বারী।

আমরা বাংলাদেশে যাবার বুকিং ক্যান্সেল করে দিই।

আবদুল খালেক টু

দুজন ভিন্ন রুচির মানুষ- একজন পুরুষ ও একজন নারী নিজেদের অজান্তে ভাঙনের ঝুঁকি নিয়ে কাবিননামা সই করে প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক আত্মীয়স্বজনের নাকের ডগায় ভেতর থেকে দরজায় তালা মেরে (দরজার খিল-আটা যুগ আর নেই, দুই পাল্লার দরজাও দুর্লভ, দরজার ছিটকিনি-লাগা যুগও প্রায় শেষ; দরজায় তালা মারতে একসেরি বাটখারার সমান তালাও লাগে না, দরজায় ইন-বিল্ট পুশ বাটন টিপলেই যথেষ্ট) খিলখিল করে হাসতে হাসতে যখন বিছানায় গড়িয়ে পড়ে তখন তাদের বলা হয় বিবাহিত। তারা জানে না সামনে কী ভয়ংকর দিন। আনুশকা বলল, তোমার সঙ্গে আমার রুচির একদম মিল নেই, তবুও কেন যে…(অব্যক্ত অংশটুকু হচ্ছে: তোমার মতো একটা গাড়ল কিংবা আহাম্মক কিংবা বদমাশকে আমার বিয়ে করতে হলো!) আমি যথেষ্ট পরিমাণ আউটবই পড়া মানুষ, কাজেই এই বই থেকে চার লাইন ওই বই থেকে ছয় লাইন মেরে দিয়ে ইমপ্রেসড করার মতো জবাব দিতে পারি। আমি বললাম, বেশ তাহলে চলো একটা রুচির পরীক্ষা দিই, দেখি মেলে কি না। কিসের পরীক্ষা?
রুচির। ধরো ভয়ংকর এক ঝড়ের রাতে তুমি এমন একটি বাড়িতে আশ্রয় পেলে যার দুটিমাত্র রুম, দুই রুমে দুটো ডাবল বেড। প্রথমটিতে উঁকি দিয়ে দেখলে বিছানায় ভয়ংকর চেহারার একজন পুরুষ, ড্রাকুলার মতো, তোমাকে তার বিছানায় শুতে ডাকছে। পাশের দ্বিতীয় রুমে উঁকি দিয়ে দেখলে লাবণ্য ঝরানো এক সুন্দরী শুয়ে আছে। তোমাকে তার পাশে শুতে ডাকছে। তুমি কোন বিছানায় যাবে- বীভৎস পুরুষের না, সুন্দরী নারীর? আনুশকা বলল, অভিয়াসলি, দ্বিতীয় রুমে। আমি তখন বললাম, তুমি যে বললে আমাদের রুচির মিল নেই? বাইরে ঝড়বৃষ্টি থাক বা না থাক আমিও তো দু’নম্বর রুমেই থাকতাম।
আনুশকা বলল, তুমি অন্য মেয়েমানুষের…ওহ্ মাই গড! (অব্যক্ত অংশে ছিল: সঙ্গে শুতে! মানে ল²ী বাবুটির মতো শুয়ে অমনি ঘুমিয়ে পড়তে? আর কী করতে সত্যি করে বলো?)-এ প্রশ্নের জবাবে হয়তো বলতে পারতাম আমাকে কাছে পেয়ে ওই সুন্দর মেয়েটি যদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুমপাড়ানির মাসিপিসি মোদের বাড়ি এসো- এটা গুনগুন করে গাইত তাহলে না হয় ঘুমিয়েই পড়তাম। কিন্তু যদি…(এবার আমার বাকি কথা অব্যক্ত রয়ে যাবে আর আনুশকা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু যদি কী?)
আনুশকা চিৎকার করল না, খুব বঙ্কিম স্বরে (সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রভাবিত কোনো স্বর নয়) মৃদু লয়ে বলল, খায়েশ কত, আঠারো-উনিশ বছরের ঘাড়ে তিল, গালে টোল পড়া সি-থ্রু পোশাকে বিছানায় শুয়ে থাকা একটা সুন্দর মেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে লালাবি গেয়ে তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে, আর তুমি…(এবারও আনুশকা বাক্যটি অসমাপ্ত রেখে দিল।)
দুনম্বর রুমে শায়িত সুন্দরীর বয়স কত- উনিশ না ঊনপঞ্চাশ আমি জানি না, আনুশকা জানে। তার ঘাড়ে তিল, গালে টোল পড়ে, সে ভ্রæ কুঁচকে কথা বলে কিনা আমার জানা নেই; আনুশকার জানা। যে পোশাকে সে বিছানায় শুয়ে আছে তা মিরপুরের জামদানি পলি থেকে কেনা লাল কাতান, না বুক ফাঁড়া হালকা গোলাপি সি-থ্রু ম্যাক্সি-আমার কোনো ধারণা নেই, কিন্তু আনুশকা জানে।
পুরনো অসমাপ্ত বাক্যটি নিয়ে আনুশকা আবার আবির্ভূত হলো। বলল, আর তুমি ওই বদমাশ মেয়েটার সঙ্গে এক বিছানায় শোবে?
আমি জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করি। বলি, তুমি কি আমাকে ওই ভয়ংকর ড্রাকুলার পাশে শুতে বলো? তা ছাড়া একজন ভদ্রমহিলা সম্পর্কে তুমি যা তা বলছ?
ভদ্রমহিলার জন্য দরদ কত! আমি বদমাশ বললাম আর অমনি তোমার গায়ে লেগে গেল? কেন, আগে থেকেই জানাশোনা আছে নাকি? ভালো হলে ওরকম সি-থ্রু বুক ফাঁড়া ম্যাক্সি পরে?
কিন্তু ম্যাক্সি যে পরেছে এটা জানলে কেমন করে?
বেডরুমে কেউ ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভার নভোচারী ড্রেস পরে শুয়ে থাকে না, হালকা-পাতলা কাপড়ই পরে।
তা অবশ্য ঠিক।
এই তো এখন নিজের মুখেই স্বীকার করলে। আগে থেকেই এ রকম কথা ছিল, তাই না?
কী রকম?
ঝড়ের বাহানায় তুমি শেগুফতার বেডরুমে ঢুকে পড়বে আর আমাকে বলবে পাশের রুমে ড্রাকুলা!
আমি জিজ্ঞেস করি, শেগুফতা আবার এলো কোত্থেকে? তুমি এসব কী বলছ?
আনুশকা বলল, ঠিকই বলছি। ঘাড়ের ঠিক মাঝখানে আঁচিলের মতো একটা তিল কার? শেগুফতার।
গালে কার টোল পড়ে? শেগুফতার।
আমাদের ফ্যামিলিতে মানে কাজিনদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর কে? শেগুফতা।
ব্যাংকক থেকে পিঙ্ক কালারের একটা বুক ফাঁড়া সি-থ্রু ম্যাক্সি কে কিনে এনেছে? এটাও তো শেগুফতা। তাহলে আর বাকি থাকল কী?
আলোচনার খাত পরিবর্তন করার জন্য বললাম, তুমি বললেই আমি মেনে নেব, আমাকে কী পেয়েছ? তোমাদের ফ্যামিলিতে ইন ট্র– সেন্স অব বিউটি হলে তুমি, শেগুফতার তো শুধু গায়ের রংটা ফরসা। তা ছাড়া গায়ে কেমন বাদামি রঙের ছিট পড়েছে, মার্গারিটা ড্র্যাবলের মতো।
আনুশকা বলল, এটা অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছ। তোমার জাজমেন্ট কারেক্ট। গতবার মিস ইউনিভার্স কনটেস্টে তুমি বলেছিলে পুয়ের্তো রিকোর জুলেইকা রিভেরা চ্যাম্পিয়ন হবে আর আমি বলেছিলাম অস্ট্রেলিয়ার জেনিফার হকিন্স। শেষ পর্যন্ত ওই কালো মেয়ে জুলেইকা রিভেরাই ক্রাউন পরল। জেনিফার সেকেন্ড রানার-আপও হতে পারল না।
আমি বললাম, সুন্দরের একটি বড় অনুষঙ্গ হচ্ছে ইনটেলেক্ট, বাংলায় বুদ্ধিমত্তা, এটা তোমার আছে।
আমি বললাম, ঝড়ের রাতে অজানা-অচেনা জায়গায় তুমি কার কাছে আশ্রয় নেবে-অন্য কোনো অপশন নেই, কেবল দুটি আশ্রয়: ড্রাকুলার বিছানা অথবা এক সুন্দরীর বিছানা। তুমি তোমার বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে বের করে ফেললে এই সুন্দরী আর কেউ নয়, তোমার বোন শেগুফতা। কিন্তু ঠিক এ প্রশ্নই ওকে জিজ্ঞেস করা হলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। তোমার নাম মুখেও নিত না।
আনুশকা বলল, এক্সাক্টলি। ও তো ভীষণ জেলাস। আমার কথা মনে হলেও বলত না। বললে যে আমাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে যায়!
তবুও সত্যটা তো সত্যই।
আনুশকা বলল, তুমি এক মাস ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা বই পড়ছ: ওয়ান হানড্রেড অ্যান্ড ওয়ান ওয়েজ টু স্যাটিসফাই ইয়োর ওয়াইফ- স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার একশ একটা উপায়। এই বইয়ের ১০১ নম্বর টিপসটা হচ্ছে, তোমার স্ত্রী যে সবচেয়ে সুন্দর- এটা নির্ধারিত সময়ের পরপর তাকে স্মরণ করিয়ে দেবে। তুমিও তা-ই করলে।
আমি বললাম, আমি তো অর্ধেকটা বই পড়েছি, এমন কোনো কথা চোখে পড়েনি।
ছিঃ বইটার প্রথম দিকেই কী-সব নোংরা কথা লিখেছে, তোমাদের ওই বাৎসায়নের মতো।
কিন্তু এই বইটা তো একজন আমেরিকান নারী লেখকের।
আনুশকা বলল, আমি সব জানি। গোটা বইটা এক ফাঁকে আমি নীলক্ষেতে গিয়ে একটা বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে ফটোকপি করিয়েছি। আমি তোমার প্রত্যেকটা মুভমেন্ট এবং ডায়লগ ফলো করে বইয়ের সঙ্গে মেলাচ্ছি। তুমি বাৎসায়নের সাফাই গাইতে গিয়ে বললে নারী লেখক। শোনো পৃথিবীর সব দেশেই শেগুফতা আছে, তারা জানে কেমন করে কাকে বিছানায় টানতে হয়।
আনুশকা ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতল বের করে সরাসরি কয়েক ঢোক গিলে, আমি তার গলনালি দিয়ে পানির নিচের দিকে চলে যাওয়া লক্ষ করি।
আমি আনুশকার সৌন্দর্যের যে প্রশংসা করেছি তা কনস্ট্যান্স চ্যাটার্লি যেমন বলেছেন তেমন কাজে লাগেনি। এই কনস্ট্যান্স চ্যাটার্লি স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার ১০১ উপায় গ্রন্থের লেখক। তার জন্ম আমেরিকার জ্যাকসন হাইটসে, বাবা অজ্ঞাত, মায়ের বয়ফ্রেন্ড তাকে অ্যাবিউজ করেছে, নিজের বয়ফ্রেন্ড তাকে ডেজার্ট করেছে। ডি এইচ লরেন্স নামের এক ব্রিটিশ লেখকের লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার নামের একটি বাজে উপন্যাসের নায়িকার নাম নিয়ে লেখালেখি শুরু করে এখন বেশ বিখ্যাত। তার যে বইটি বাজারে আসছে তার নাম: হানড্রেড অ্যান্ড ওয়ান ওয়েজ টু ডিল উইথ ওয়াইফ’স সিস্টার- শ্যালিকা সামলানোর ১০১ উপায়। আমি এই বইটি না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আনুশকার হাতে পড়লে ভুল-বোঝাবুঝি বাড়বে। ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি আনুশকার কণ্ঠ আরও শীতল করল। বলল, বেশ মেনে নিলাম শেগুফতা তেমন সুন্দর নয়, বিদেশি মেয়েদের মতো তার শরীরে বাদামি রঙের ছিট পড়েছে। বলো তো দেখি শরীরের কোন কোন জায়গায় এসব দাগ তোমার চোখে পড়েছে?
প্রশ্নটি বিব্রতকর। ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে আমাদের পাবলিক পলিসি, আরও সরাসরি বলতে গেলে অ্যারন উইল্ডাভস্কির স্পিকিং ট্র–থ টু দ্য পাওয়ার বইটি পড়াতেন মার্গারিটা ড্র্যাবল। বাদামি রঙের বিন্দু বিন্দু দাগ হাতে-মুখে-গলায় তা ছিলই, যেদিন স্কার্ট পরে আসতেন, পায়ের ওপর পা তুলে বসলে হাঁটুর ওপরেও বেশ খানিকটা জায়গায় এই দাগ আমার চোখে পড়ত। কিন্তু শেগুফতার তো তেমন বেশি নয়, হাতে দু-চারটে, গলার কাছেও থাকতে পারে। উইন্ডাভস্কি বলেছেন, ‘ক্ষমতা সত্যকে সহ্য করতে পারে না, কাজেই খুব কায়দা করে দরকার হলে চিনিগুড়ের আবরণ দিয়ে সত্যটা ক্ষমতার কাছে পৌঁছে দিতে হবে।’ মার্গারিটা ড্র্যাবল এর সঙ্গে বলেছেন, ক্ষমতাবানেরা সারাক্ষণ ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় দিন কাটায়, ফুড়–ৎ করে ছুটে যাওয়া ইঁদুরকে ভাবে বিস্ফোরণোন্মুখ ল্যান্ড মাইন। আমার এই প্রিয় শিক্ষকের শরীরে আরও এক লক্ষ বাদামি স্পট যোগ হলেও তিনি আমার একই রকম প্রিয় থাকবেন।
আনুশকা উত্তরের অপেক্ষায় আছে, আমি বললাম, মার্গারিটা ড্র্যাবলের তো হাতে-মুখে-পায়ে এবং সম্ভবত বুকে-পিঠেও ছিল।
আমি মার্গারিটার কথা জিজ্ঞেস করিনি। শেগুফতারও হাতে কয়েকটা আছে?
আছে তা যে কেউ বলতে পারবে, তার সহযোগিতা ছাড়া সংখ্যা জানা সম্ভব নয়।
আনুশকা বলল, সে কথা সত্যি, তোমাকে না দেখালে তুমি জানবে কেমন করে। সে জন্যই সেই ঝড়ের রাতে যখন বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, বঙ্গোপসাগরে ভীষণ নি¤œচাপ, আকাশে হঠাৎ বিদ্যুচ্চমক এবং দুনিয়া-কাঁপানো বজ্রপাত, কোথাও যাওয়ার কোনো উপায় নেই, তুমি একজন পুরুষমানুষের রুমে না ঢুকে তাকে ড্রাকুলা আর কিসব বলে ঢুকে পড়লে শেগুফতার রুমে। সে তোমাকে দেখাবে শরীরের আর কোথায় কোথায় ব্রাউন স্পট লুকিয়ে আছে। তোমার যাতে কষ্ট না হয় সে জন্য তার পরনে সি-থ্রু ম্যাক্সি, তার আবার বুক ফাঁড়া। বলো শুনি, কোথায় কোথায় দেখলে?
আমি এবার একটু উত্তেজিত হয়ে (কনস্ট্যান্স চ্যাটার্লির বইয়ের ৩৭ নম্বর টিপস: পারিপার্শ্বিক অবস্থা যদি উত্তেজনা দাবি করে, তাহলে একটু উত্তেজিত হওয়া বরং ভালো, তবে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে) বললাম, দেখো, বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে, তোমার বোন শেগুফতা ছাড়া পৃথিবীতে কি আর কোনো সুন্দরী নেই?
আনুশকা বলল, কেন থাকবে না। অবশ্যই আছে, আমি তো তার নামও জানতে চাচ্ছি। বলে ফেলো। সত্যটা প্রকাশিত হওয়া দরকার।
আমি বললাম, সত্যটাই বলব। তার জš§ ২১ অক্টোবর, ১৯৮০। তার পুরো নাম কিম্বারলি নোয়েল কার্দাসিয়ান। সবাই তাকে কিম কার্দাসিয়ান নামে চেনে। তোমারও চেনার কথা (আমি কনস্ট্যান্স চ্যাটার্লির বইয়ের ৪৭ নম্বর টিপস ব্যবহার করলাম: যখন স্ত্রী স্বামীকে তার প্রিয় কোনো নারীর নাম বলতে পীড়াপীড়ি করে তখন স্ত্রীর কাছে অবিশ্বাস্য কারও নাম বলে দেবে।)
আনুশকা বলল, ইম্পসিবল।
আমি বললাম ঠিকানাটা মনে রেখো: ৩১৪৫ অ্যাবিংটন ড্রাইভ, বেভারলি হিলস। ক্যালিফোর্নিয়া ৯০২১০। ফোন নম্বরও আছে, দেব?
আনুশকা আবার বলল, অ্যাবসলিউটলি ইমপসিবল।
আমি বললাম, আমার মতো অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে মেট্রোপলিটান ঢাকায় এসে যখন তোমাকে বিয়ে করলাম, সবাই বলল ইম্পসিবল। কেউ কেউ বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমার পোশাকের ধরন, বাটা কোম্পানির ‘খুব ভালো জুতো’ আর মাথা থেকে চুইয়ে পড়া তেল দেখে এমন কি তোমার বোন শেগুফতাও বলেছিল, ইম্পসিবল।
আনুশকা এবার চেঁচিয়ে উঠল, আর একটা কথাও নয়। আমি আর কারও নাম জানতে চাই না। জাস্ট স্টপ। কিম কার্দাসিয়ান ইজ আ হৌর।
এবার আমিই নিস্পৃহ কণ্ঠে একটি জ্ঞানগর্ভ উক্তি আওড়ালাম: সফল নারীকে অন্যরা বেশ্যা বলে গাল দিয়ে নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে চেষ্টা করে।
মাছশূন্য কিন্তু পানিপূর্ণ একটি ছোট্ট অ্যাকোয়ারিয়াম ছিল আনুশকার হাতের নাগালের মধ্যে, ওটাই তুলে ছুড়ে মারল। জুতো ছুড়ে মারার পর জর্জ বুশ যেভাবে মাথা সরিয়ে নিয়েছিলেন, আমিও ধাবমান অ্যাকোয়ারিয়ামের গতিপথ থেকে মাথা সরিয়ে নিলাম। দেয়ালে লেগে ভেঙে শত টুকরো, পানি ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। আনুশকা আর একটা কিছু ছুড়তে যাচ্ছিল, আমি বললাম, আনু, পিজ থামো।
সাবধান আবদুল খালেক টু, তুমি আমাকে আনু বলবে না, আমার নাম আনুশকা।

দুই.
আমার স্ত্রীর নাম অবশ্যই আনুশকা।
আমার নাম আবদুল খালেক।
আমি নিজের যোগ্যতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে এক বছর শিক্ষকতার আশায় বসে থেকে দুই বছর আইসিডিডিআরবিতে কাজ করে দেশের অন্যতম বৃহৎ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পেম্বারটন ফার্মাসিউটিক্যালসে প্রোডাকশন বিভাগে চাকরি নিলাম। যেখানে সমপদে কিন্তু জ্যেষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে পেলাম আমেরিকার ভার্জিনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ফার্মেসিতে পাস করা সুদর্শন ও চটপটে আর একজন আবদুল খালেককে। এ ধরনের মানুষের নাম হওয়ার কথা হ্যারল্ড কাদরী কিংবা ধীমান ইরতিজা। কিন্তু তিনি যে কেন আবদুল খালেক, আমার জানা নেই। স্কুলে আমি বাবুল নামের দুজন সহপাঠীকে পেয়েছি, একজন চোখ ট্যাঁরা, অন্যজন খাটো। একজনের নাম হয়ে ে

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়