করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

বিষণ্ন আলোর খেলা

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আচমকা ব্রেক কষে গাড়িটা দাঁড়িয়ে যেতেই ঘুম ভেঙে গেল অঞ্জনের। সামনে, অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে। রাস্তায় নেমে খোঁজ-খবর নিয়ে ড্রাইভার ছেলেটি ফিরে এসে জানাল, প্রচণ্ড গোলমাল হচ্ছে সামনে। ট্রাম লাইনের ওপর ফেলে কয়েকজন মহিলাকে নাকি পেটাচ্ছে কিছু গুণ্ডা। আর তারিয়ে তারিয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করছেন অন্যরা। কেউ বাধা দিচ্ছে না। পুলিশও আসেনি এখনো।
একটু বিরক্ত হলো অঞ্জন। দিনকে দিন কী যে হচ্ছে শহরটার। গাড়ি তো সামনে যাবে না। পেছনে যাওয়ারও উপায় নেই। তা’হলে? আজ অফিসার নিয়োগের ইন্টারভিউর শেষ দিন। ‘প্যানেল-হেড’ হিসেবে তার থাকাটা খুবই জরুরি। অথচ আজই এমন একটা ঝামেলা। ভাগ্যিস নিজের গাড়িটা আনেনি আজ। অবশ্য বোর্ডের ইন্টারভিউ থাকলে ওরাই গাড়ি পাঠায়। ফেরার পথে নিজের কিছু জরুরি কাজ থাকলেও ওদের পাঠানো গাড়িতেই বেরিয়েছে আজ। ব্যক্তিগত কাজ না হয় পরে একদিন করবে। কিন্তু রাস্তার অবস্থা দেখে একটু চিন্তায় পড়ে গেল অঞ্জন। যদি ঠিক সময়মতো পৌঁছতে না পারে! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল এখনো ঘণ্টা দেড়েক সময় আছে। ওদের গাড়িতেই যাচ্ছে তাই কেউ খুব একটা কিছু হয়তো বলবে না; কিন্তু ইন্টারভিউ নিয়ে রিপোর্ট পাঠানো তার দায়িত্ব এবং সেটা তাকে করতেই হবে। প্যানেলের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করছে যে ছেলেটি তাকে একটা ফোন করল অঞ্জন। পেল না।
আরো কয়েকবার চেষ্টা করেও না পেয়ে শেষ পর্যন্ত একটা মেসেজ পাঠিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ভাবল, ঠিক কী হয়েছে একবার দেখা দরকার। তারপর না হয় অবস্থা বুঝে কিছু করা যাবে।
দরোজা খুলে নামতে গিয়ে একটা চেঁচামেচির আওয়াজে একটু থমকে গেল অঞ্জন। হৈ হৈ করে ভিড়ের দিকে দৌড়ে যাচ্ছেন অনেক মহিলা। সংখ্যাটা খুব কম নয়। বেশ অবাকই হলো সে।
এমন দৃশ্য, খুব একটা দেখেনি আগে।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে যা দেখল, তার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না অঞ্জন। ১০/১২ জন ছেলেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় শ’খানেক মহিলা। সবক’টি গুণ্ডাকেই নাকি ধরে রেখেছে তারা।
পালাতে দেয়নি একজনকেও। এখন পুলিশের জন্য অপেক্ষা।
হঠাৎ ওই ভিড়ের মধ্য থেকে এগিয়ে এলেন এক মহিলা। বছর তিরিশ বয়স হবে। উৎসুক জনতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনারা যারা এতক্ষণ এই অসহায় মেয়েগুলোর ওপর গুণ্ডাদের পরাক্রম দেখছিলেন নীরবে, হয়তো বা এক ধরনের মজাও পাচ্ছিলেন কেউ কেউ, তাদের জানিয়ে রাখি এই গুণ্ডাগুলো পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে মেয়েদের সঙ্গে অসভ্যতা করছিল কয়েক দিন ধরে। গতকাল বিকেলে কিছু মেয়ে দল বেঁধে ওদের দিকে তেড়ে গেলে ওরা পালিয়ে যায়। আজ তারা ফিরে এসে এলোপাথাড়ি হামলা করে এবং এই ক’জন মহিলাকে সামনে পেয়ে তাড়া করে পাড়ার বাইরে এনে আপনাদের সামনেই মারধোর করতে শুরু করে। খবর পেয়ে আমরা ছুটে আসি। পাড়ার ছেলেরাও এসেছে, কিন্তু আজ এই ব্যাপারে আমরা তাদের জড়াতে চাইনি। পুলিশ, হাসপাতাল, ডাক্তার, এ সব নিয়ে তারা ব্যস্ত। একটাই অনুরোধ, নিজের মেয়ে বা বোনের ওপর এমন কিছু হলে, চুপ করে থাকবেন না।’
ভদ্রমহিলার কথা শুনতে শুনতে অঞ্জন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। ওই চোখ, কথা বলার ধরন, কেমন যেন চেনা মনে হচ্ছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারল না কিছুতেই।
এখনই এই রাস্তা খালি হওয়ার কোনো আশা নেই। গাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে অঞ্জন ভাবছিল পাশের একটা গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে এলাকাটা পেরোতে হবে। কিন্তু গাড়ির কাছে এসে বেশ অবাক হয়ে দেখল ইতোমধ্যেই পুলিশ এসে আস্তে আস্তে গাড়িগুলো ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। আর তিন-চারটে গাড়ি ঘোরালেই তাদের জায়গা হয়ে যাবে। কোন রুটে যেতে হবে সেটাও ঠিক করে দিচ্ছে এক পুলিশ সার্জন।
গাড়িতে উঠে বসতে না বসতেই মিঃ সান্যালের ফোন। প্যানেল কো-অর্ডিনেটর। নিজে থেকেই জানতে চাইল রাস্তার অবস্থা। আরো দু’জন নাকি আটকে আছেন এই গোলমালে। একটু নিশ্চিন্ত হ’ল অঞ্জন।
ভিড় পেরিয়ে ফাঁকা রাস্তায় এসে ড্রাইভার বলল- ‘ভাববেন না স্যার। পৌঁছে যাব সময়মতো-
একটু হাসল অঞ্জন। মাথায় তখন অন্য ভাবনা। ওই মহিলাকে কি আগে কোথাও দেখেছে অঞ্জন?
গলার স্বর, উচ্চারণ, বলার ভঙ্গিমা, শান্ত তীর্যক কথাবার্তা সব কিছুই কেমন যেন চেনা। অথচ- অথচ না, খুব দ্রুত রিওয়াইন্ড করে স্মৃতির পাতাগুলো দেখার চেষ্টা করেও তেমন কোনো সূত্র পাওয়া গেল না। মহিলার যা বয়স, স্কুল-কলেজে একসঙ্গে পড়ার প্রশ্ন নেই। তবে কি তার মেয়ে রুমির কোনো বন্ধু? না বোধহয়। এমন তেজস্বিনী কোনো বন্ধু রুমির নেই। অন্তত সে দেখেনি। জয়িতার কোনো বান্ধবীর মেয়ে নয় তো! কিন্তু তাদের অনেককেই সে চেনে। এমন কাউকে তো মনে পড়ছে না।
তা হ’লে?
চাকরি সূত্রে অনেক জায়গায় থেকেছে অঞ্জন। সেখানে কোথাও, কোনো সভা বা অনুষ্ঠানে কিংবা কোনো মিছিলের পুরোভাগে? না মনে পড়ছে না কিছুতেই। তবে কি কখনো কোনো পূজো প্যান্ডেলে, আবৃত্তি বা গানে কিংবা কোনো মেট্রোর লাইনে? না, অথচ খুব চেনা চেনা মুখটা –
ড্রাইভার ছেলেটি হাসিমুখে বলল- দশ মিনিট আগেই পৌঁছে গেলাম স্যার। ভেবেছিলাম পারব না।
অঞ্জন হাসল- আপনি তো এদিক ওদিক ঘুরে খুব সুন্দর করে নিয়ে এলেন।
এই অফিসের কনফারেন্স রুমে ইন্টারভিউ নেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। অঞ্জন ভেতরে যেতেই মি. সান্যাল, মানে কো-অর্ডিনেটর ছেলেটি, আজ যারা ইন্টারভিউ দেবে তাদের নাম, বায়োডাটা নিয়ে এগিয়ে এলো। বলল- আপনার টিমে একজন আসেননি এখনো। ক্যান্ডিডেটরা এসে গিয়েছে সবাই।
প্যানেলে অঞ্জনকে নিয়ে পাঁচজন। বিভিন্ন পেশায় আছেন তারা। এদের মধ্যে একজন, মি. সুশীল সেন বোধহয় দর্শনের ছাত্র ছিলেন। এমন সব প্রশ্ন করেন যা এই চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা বিচারের জন্য একেবারে অপ্রয়োজনীয়। অঞ্জন তাকে বলেছে কয়েকবার। অন্যরাও। কিন্তু ভদ্রলোকের আজব স্বভাব। আর তা সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয় অঞ্জনকে।

আজ প্রথমেই যে ছেলেটি এলো, তার বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দর চেহারা দেখে খুব ভালো লাগল অঞ্জনের। এম.কম-এ ভালো রেজাল্ট করেছে। প্রতিটি প্রশ্নের সুন্দর উত্তর দিয়ে প্রায় মুগ্ধ করেছে সবাইকে।
হঠাৎ সুশীল বাবু প্রশ্ন করলেন- আচ্ছা বলো তো ‘তত্ত্বজ্ঞানী’ কাদের বলা হয়?
খুব বিরক্ত হ’ল অঞ্জন। প্রকাশ করার আগে, সুশীল বাবুর পাশে বসা ভদ্রলোক ক্ষেপে গিয়ে বলে উঠলেন- আপনার সমস্যাটা কোথায় বলুন তো – অঞ্জন থামালো তাকে।
সবাইকে অবাক করে খুব সপ্রতিভ ভঙ্গিমায় ছেলেটি জবাব দিল- যতদূর জানি, সত্যবস্তু সম্বন্ধে যিনি জ্ঞান আহরণ করেছেন তাকে তত্ত্বজ্ঞানী বলা হয়।
সুশীল বাবু কিছু বলার আগেই অঞ্জন হেসে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল- ভেরি গুড, তুমি এবার আসতে পারো।
পরের ক্যান্ডিডেট আসার আগে কো-অর্ডিনেটর ঘরে ঢুকতেই সুশীল বাবুর পাশে বসা দীপক বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন- দেখুন মশায়, এই প্যানেল নিয়ে যদি কোনো অভিযোগ আসে, আমরা কিন্তু দায়ী
থাকব না। কোন পোস্টের জন্য ইন্টারভিউ হচ্ছে সেটাই যেন ভুলে যাচ্ছেন কেউ কেউ।
সুশীল বাবু কি একটা বলতে যাচ্ছিলেন, হাত দেখিয়ে তাকে থামাল অঞ্জন।
-বাইরে এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে প্রথম দিন থেকেই। সুশীল বাবুর নামে হ্যারাজমেন্টের অভিযোগও করেছে দু’একজন। আমি ওকে বলেছিও সে কথা। আসলে উনি খুব পণ্ডিত লোক, তাই হয়তো- যাক গে, আজ শেষ দিন। নিজেদের একটু শান্ত রাখুন আর যোগ্য ছেলেমেয়েদের নির্বাচন করুন, এছাড়া আর কিই বা বলতে পারি বলুন।
সমস্ত কাজকর্ম সেরে বেরোতে বেশ দেরি হয়ে গেল আজ। সব রিপোর্ট তৈরি করে মুখবন্ধ খামে রেখে সিল করে পাঠানোর পর তার ছুটি। একটা দায়িত্ব শেষ। সুশীল বাবু ছাড়া বাকিরা সবাই কমার্সের লোক, অসুবিধা হয়নি। সুশীল বাবু দর্শনের অধ্যাপক, পণ্ডিত মানুষ। বোধহয় বুঝে উঠতে পারেননি ঠিকমতো। যাই হোক, ভালোয় ভালোয় সব শেষ হয়েছে এটাই শান্তি।
ড্রইংরুমে বসে টিভির খবর শুনছিল অঞ্জন। চা নিয়ে এলো জয়িতা। বলল, আজ সকালে অনেকবার ওই গণ্ডগোলের খবর দেখিয়েছে। একবার এক ঝলক তোমাকেও দেখাল ভিড়ের মধ্যে।
– আর কি দেখাল? ছেলেগুলোকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ?
-করবে না? সব ছেলেই ধরা পড়েছে। বাবা, কী দাপট মেয়েদের! দেখে তো অবাক!
-আমি বেশিক্ষণ থাকিনি। তার মধ্যেই বুঝলাম খুব সাহস ওদের। একজনকে খুব চেনা চেনা মনে হ’ল, কিন্তু-
-এমন হয়। পরে দেখবে একদিন হঠাৎ মনে পড়ে যাবে।
একটু হেসে অঞ্জন বলল, আজ রুমির পরীক্ষার শেষদিন ছিল না? কেমন হ’ল, বলেছে?
-ভালোই ত বলল। রাত জেগেছে ক’দিন। এসেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
-ঘুমোক।

খাবার টেবিলে অঞ্জনের পাশে এসে বসল রুমি। কতদিন পর সবাই একসঙ্গে আজ। খেয়ে উঠলেই ঘুম পায় বলে রুমির রুটিন আলাদা। সন্ধ্যে বেলা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আর মাঝরাত্তিরে উঠে পড়াশোনা করে। গত মাস দুয়েক তেমনভাবে কোনো গুল্পগুজব হয়নি মেয়ের সঙ্গে। খেতে খেতে রুমিকে বলল, কতদিন তোর ডেস্কটপে একসঙ্গে সিনেমা
দেখা হয়নি।
-ঠিক। এই শনিবার সবাই মিলে দেখব। মাকেও বসতে হবে আমাদের সঙ্গে।
-মা? তা হলে তো আবার সেই পুরনো দিনের-
জয়িতা কিছু বলার আগে, রুমি বলল, না, বাবা। মা আজকাল আমার সঙ্গে বসে ক্রাইম থ্রিলার দেখছে মাঝে মাঝে।
একটু অবাক হয়ে হাসল অঞ্জন।- বাহ তাহলে শনিবার ক্রাইম স্টোরিই হোক।

সকাল বেলা খবরের কাগজে মন ডুবিয়ে চা খাচ্ছিল অঞ্জন। সংবাদপত্র মানেই খুন-জখম-হিংসা আর সব মন খারাপ করা খবর। অস্তিত্বের ভয়াবহ সংকট। কোথাও কোনো ভালো ঘটনা ঘটছে না আজকাল? সারা পৃথিবীর কোথাও না? নাকি সে সব ঘটনা সংবাদপত্রে জায়গা পায় না? কিংবা জায়গা পেলেও তেমন প্রাধান্য পায় না। এই সব আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছিল অঞ্জন।
চোখ আটকে গেল সাতের পাতায়। কাল সকালের সেই খবরটা ছেপেছে বেশ বড় করে। সঙ্গে একটা ছবি। অন্য অনেকের মধ্যে ওই মহিলাও দাঁড়িয়ে। না, আলাদা করে ওদের সম্পর্কে কিছু লেখেনি। শুধু সাহসিকতার প্রশংসা করেছে। পাশাপাশি ওই গুণ্ডার দলটি সম্পর্কে লিখেছে অনেক কিছু। সে সব পড়ে কেমন যেন আতঙ্কিত হয়ে পড়ল অঞ্জন। প্রায় অকারণেই। ওই ছেলেগুলো, বেরিয়ে এসে যদি আরো নৃশংস হয়ে বদলা নেয়? দুর্বিষহ করে দেয় এলাকার মানুষের জীবনযাপন?
-কী ভাবছো বাপি? সকাল বেলাতেই এমন উদাস?- রুমির গলা শুনে নিজেকে সামলে নিয়ে ওর দিকে তাকাল অঞ্জন-
-না তেমন কিছু না। গতকালের ঘটনার কথা আজ বেরিয়েছে কাগজে। ভাবছিলাম এ সবের শেষ কোথায়?
-নেই, শেষ নেই। এদের পেছনে থাকা মানুষরা এ সব শেষ হতে দেবে না। তাই বলছি বাপি একদম ভেবো না। ভাবনাচিন্তা করা মানুষদের কেউ পছন্দ করে না।
এবার হেসে ফেলল অঞ্জন- যা বলেছিস। কিন্তু
-কোনো কিন্তু নেই বাপি। আমার এই ছোট জীবনে, কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে, দেখলাম তো! সত্যি কথা কেউ সহ্য করতে পারে না। তারা যা বিশ্বাস করে তার বাইরে কোনো ‘সত্য’ আছে বা থাকতে পারে, এটা ওরা বিশ্বাসই করে না। কেউ সেটা নিয়ে কথা বললেই ওদের অপছন্দের তালিকায় চলে যাবে। এমন কি শত্রæ তালিকায় চলে যেতে পারে।
এবার একটু অবাক হলো অঞ্জন। সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে রুমির হঠাৎ এভাবে সিরিয়াস হয়ে যাওয়ার কারণ এখনই খোঁজার চেষ্টা না করে, বলল-
-একদম খাঁটি কথা। কিন্তু মাত্র এক কাপ চা খেয়ে এত শক্ত কথা বুঝতে পারি না আমি-
বাবার কথায় বেশ জোরে হেসে উঠল রুমি। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল-আসছি।
চা নিয়ে এসে বাকি কথা হবে।
রুমির কথাগুলোর মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল, যা বেশ ভাবিয়ে তুলছে অঞ্জনকে। দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল মেয়েটা। ছোটবেলা থেকেই ওর ভাবনাচিন্তা একটু অন্যরকম। যুক্তিবাদী কথাবার্তা। কিন্তু আজ ওর কথাবার্তার মধ্যে কোথায় যেন এক স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা-
শুধু চা নয়, সঙ্গে কিছু ভাজাভুজিও নিয়ে এসেছে রুমি। অঞ্জনের সামনে রেখে হাসল-
-মা ভাজছিল। আমি নিয়ে এলাম।
-খুব ভালো। কিন্তু মাকেও ডাকলি না কেন? একসঙ্গে চা খেতাম।
-ডেকেছি। মা আসছে।
অনেক দিন পর আজ তিনজনে একসঙ্গে সকালের চা খাওয়া হ’ল। জয়িতার রান্নাঘর, অঞ্জনের বেরোবার তাড়া আর রুমির ক্লাস এ সবেই কেটে যায় সকাল। আজ একটু অন্যরকম। নানান গল্প হাসি ঠাট্টার মধ্যেই রুমির দিকে তাকাল অঞ্জন-
-একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে খুব। তোর মুখে ওই কথাগুলো শুনে কেমন যেন লাগল। তোর কোনো সমস্যা হয়নি তো?
-না না আমার কিছু হয়নি বাপি। তবে-
-তবে কী?
একটু চুপ করে থেকে রুমি বলল-
-নীতিহীন মানুষগুলো যখন অন্যকে ধান্দাবাজ বলে, অপছন্দের মানুষদের গায়ে চুপিচুপি দুর্নীতির মোহর লাগিয়ে দেয়, তখন খুব অসহায় লাগে। খুব কাছ থেকে, এ সব দেখে চেনা মানুষগুলোকেও অচেনা মনে হয়। নির্দোষ বন্ধুরা যখন এদের দীনতার শিকার হয়ে ছটফট করে যন্ত্রণায়, তখন খারাপ লাগে খুব।
-তা ঠিক। বিভিন্ন ধরনের রাজনীতিই এখন নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের জীবন। নীতিহীন নীতিবাগীশদের রমরমা চারপাশে। সারাক্ষণ সাবধানে থাকতে না শিখলেই বিপদ।
-তুমি এদের এড়িয়ে দূরে থাকলেও বিপদ। তখন অন্য তকমা লাগিয়ে দিয়ে অতিষ্ঠ করে তুলবে। ভাগ্যিস পরীক্ষাটা হয়ে গিয়েছে ভালোয় ভালোয়। শান্তি।
জয়িতা এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল। রুমির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল- বাপ রে, কত বড় হয়ে গেছিস রে তুই। হ্যাঁ রে, তোর সব বন্ধুরা কেমন আছে? বীথি, শ্যামা, দীপক, নিলয়, ওরা তো আর আসে না তেমন-
-ভালো আছে সবাই। দীপক, পড়াশোনায় খুব ভালো, প্রফেসররা ওকে পছন্দ করে, তাই ওকে ঘিরে অদৃশ্য এক রাজনীতি। সে সব সামলাতে সামলাতে বেচারা নাজেহাল। তবে বীথি, শ্যামা দুজনেই তোমার কথা খুব বলে। আর নিলয় তো বিদেশ যাওয়ার জন্য তৈরি করছে নিজেকে।
-পরীক্ষা শেষ হ’ল। এবার একদিন ডাক সবাইকে। জমিয়ে আড্ডা হোক- অঞ্জনের কথায় হেসে ঘাড় নাড়ল রুমি।

দুপুর বেলা খাওয়া শেষ করে খবর দেখার জন্য টিভিটা খুলতেই, খুব অবাক হয়ে গেল অঞ্জন। গতকালের ঘটনায় ওই ছেলেগুলোকে গ্রেপ্তার করার প্রতিবাদে বিশাল মিছিল। এরাই যে কাল ট্রাম লাইনে ফেলে কয়েকজন মহিলাকে মারধোর করছিল সে ব্যাপারে সবাই চুপ। এমন কি যেসব সাংবাদিক আজ এই খবর কভার করছেন তারাও কিছু বলছেন না। আশ্চর্য!
জয়িতা সব শুনে টিভির চ্যানেলটা বদলে দিয়ে বলল- কাল সবটাই দেখিয়েছিল। আজ এটা দেখাচ্ছে। কাল যদি উল্টোদিকের মিছিল বেরোয় সেটাও দেখাবে। সেটাই স্বাভাবিক। ছাড়ো তো। অন্য কিছু দ্যাখো। খবর মানেই-
-ঠিক বলেছো কোথাও কোনো ভালো খবর নেই।
কিছু না বলে অঞ্জন বন্ধ করে দিল টিভিটা। তারপর প্রায় আপনমনে উচ্চারণ করলো-
-কিংবা কিছু কিছু মানুষ তাদের ভালো থাকার খবর আমাদের জানতেই দেয় না।
জয়িতা এগিয়ে গিয়ে হাতটা ধরলো অঞ্জনের। বিছানায়, বসলো ওর পাশে।
-আবার মন খারাপ করছো? সময়ের হাতে ছেড়ে দাও সব।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে খুব আস্তে আস্তে জয়িতা বললো-
-শোভনকে নিয়ে তোমার কষ্ট আমি বুঝতে পারি। অনেক স্বপ্ন নিয়ে তুমি ওকে মানুষ করেছিলে-
-না গো মানুষ আমি করতে পারিনি। সর্বস্ব দিয়ে পড়াশোনা করিয়েছি, বলতে পারো। আমি না হয়, ওর কথামতো, কর্তব্য করেছি মাত্র, কিন্তু তুমি?
-সেও তো মায়ের কর্তব্য, সকলেই করে।
-ঠিক, মানলাম সেটাই ঠিক। কিন্তু মায়ের প্রতি ছেলের কোনো কর্তব্য নেই?
-ও সব ছাড়ো, আমরা তো কিছু প্রত্যাশা করি না। ওরা ওদের মতো ভালো থাকুক,
বাবা-মা হিসেবে এটাই ত আমাদের একমাত্র চাওয়া।

দুই.
অনেক দিন পর আজ ছাদে এসেছে রুমি। দুপুরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল বোধহয়। এক রাশ বাগানবিলাস, রূপোর ঘুঙুর পরা একটি মেয়ে, তার মলিন বেহালা, কিছু নিঃসঙ্গ জোনাকি আর স্মৃতির চাদরে ঢাকা এক আঁধার প্রতিমা- সবাই মিলে ভাঙিয়ে দিয়েছিল ঘুম।
দূরের আকাশজুড়ে আশ্চর্য এক আলো আঁধারির খেলা। কেমন যেন মায়াময়। এরপর অদ্ভুত আঁধার নামবে মাটির ওপরে। আর সেই আঁধারের মধ্যে দিয়ে নিঃসঙ্গ হেঁটে যাবে অসংখ্য মানুষ।
অন্ধকার রুমির চিরকালের সঙ্গী। না, মানসিক কোনো বিষাদ তার নেই। খুব ছোটবেলা থেকেই এই অন্ধকারের সঙ্গে তার ভালোবাসার সম্পর্ক। অন্ধকারের মধ্যেই স্পষ্ট হয়, মূর্ত হয় প্রকৃতির
সঙ্গে তার আত্মীয়তা। অন্ধকারের বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে ‘রাত’ শব্দটাই কখন যে অবলীলায় ‘রাত্রি’ হয়ে ওঠে, কেউ জানে না। সারারাত এই ছাদে বসে রাতপরীর সঙ্গে গল্প করার ইচ্ছে অনেক দিনের।
বাবা মাকে সে কথা বলেছে অনেকবার। মনে আছে, স্কুলে পড়ার সময়, মাঝে মাঝেই বাবা প্রশ্ন করতেন ‘সময় পেলেই, সন্ধ্যেবেলা ছাদে যাও, কী করো?
রুমি বলেছিল, অন্ধকার দেখি বাবা। খুব ভালো লাগে। একদিন চলো না, একসঙ্গে সবাই মিলে মন দিয়ে অন্ধকারের খেলা দেখি ‘মাঝেমধ্যেই রুমির মনোমালিন্য হয় ঘুমের সঙ্গে। তার আসা যাওয়ার কোনো ঠিক নেই। ইচ্ছেমতো উড়ে এসে দু’চোখের পাতা ছুঁয়ে চলে যায় উত্তরের দিকে। সারা বাড়ি যখন ঘুমে, রুমি জানলার পাশে দাঁড়িয়ে অন্ধকার দ্যাখে। কখনো বা জীবনানন্দের কবিতা উচ্চারণ করে মনে মনে। অন্ধকারের সঙ্গে কথা বলে। কখনো বা তাদের ক্লান্তির কারণ জানতে চায়- আজ তোমাদের ছুটি নেই? বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?’
ঘুমের প্রসঙ্গ এলেই দীপক বলতো ‘রাত্রির ঘুমের মধ্যে কেউ কারো নয়। প্রত্যেকেই নিঃসঙ্গ জ্যোৎস্নায়, চারাগাছ কিংবা কোন মাধবীলতার কাছে হেঁটে যায়, অঝোর বৃষ্টির মধ্যে বসে থাকে বর্ষাতি মাথায়’। ‘কোন এক সুন্দর, নির্মল সকালের স্বপ্নই আমাদের নিশিযাপনকে ঢেকে রাখে সুখের মোড়কে’।
বীথি সাধারণত চুপচাপই থাকত। সেদিন খুব মৃদুস্বরে দীপককে বলেছিল, ‘খুব সুন্দর করে বললি।
রুমির মতো আমার প্রেম নেই অন্ধকারের সঙ্গে। তবু মাঝে মাঝে মনে হয় এই অন্ধকারের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের ঋণ।’
মনে আছে, সেদিন বীথির কথার উত্তর দেয়নি কেউ। রুমি মনে মনে বলেছিল, ‘ঠিকই অন্ধকারের সঙ্গেই আমার প্রেম। সে জন্যই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নয়, এক মায়াবী আঁধারের দিকে হাঁটতে আমার ভালো লাগে।’

অন্ধকারের কথা শুনলেই মা ভয় পায় খুব। রুমি তাই এ সব কথা মাকে বলে না। বাবা তার প্রিয় বন্ধু। সব বলা যায়। মনে আছে, প্রথম প্রথম এই অন্ধকারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা শুনে, বাবাও অবাক হতো খুব। পরে হয়তো বুঝেছে, রুমির কল্পজগতের মধ্যে না ঢোকাই
ভালো।
কী একটা কথায় বাবা শুধু একবার বলেছিলেন- ‘তোর এই ভাবনাচিন্তা বেশ ব্যতিক্রমী। লিখে রাখিস না কেন?’
রুমি সেদিন বলেনি, ইদানীং অনেক কিছুই লিখে রাখছে সে। বেশ কিছু কবিতাও লিখে ফেলেছে রুমি। কাউকে দেখায়নি বা শোনায়নি। বাবা হয়তো শুনলে খুব খুশি হবেন। কিন্তু কেমন যেন লজ্জা করে রুমির। কবিতার ব্যাকরণ, তার জানা নেই। তার ব্যক্তিগত আবেগ ও চিন্তাভাবনা নিয়ে এসব লেখা যদি কারো পছন্দ না হয়।
দীর্ঘদিন পরে ছাদে এসে আজ রুমির মনে হয়েছিল গলা ছেড়ে গেয়ে উঠবে- ‘আজ তোমারে দেখতে এলাম অনেক দিনের পরে-’ সত্যি, কেন জানি না তার মনে হচ্ছিল আজ তার জন্যই বোধহয়, দূরের আকাশ নতুন সাজে সেজেছে। চোখ না ফিরিয়ে স্বপ্নাবিষ্টের মতো তাকিয়ে ছিল রুমি। হয়তো মন্ত্রমুগ্ধও। কেন জানি না, নক্ষত্রময় আকাশ আর এই অন্ধকারের মিলনে যে মায়া পৃথিবী সৃষ্টি করে প্রকৃতি, সেই পৃথিবীতেই বসবাস করতে চায় রুমি। এখন এই মুহূর্তে যেমন তার শুনতে ইচ্ছে করছে সেই প্রিয় গানটি- ‘আজ যেমন করে গাইছে
আকাশ তেমনি করে গাও গো।’
রবি ঠাকুরের ‘শেষের কবিতায় অমিত রে শিলং-এর যে স্রোতস্বিনী ঝর্নার পাশে বসে লাবণ্যকে শুনিয়েছিলেন এই গান, ঠিক সেখানেই এক মধ্যবয়সি ভদ্রলোকের উদাত্ত গলায় এই পাগল করা গান শুনেছিল রুমি। তারপর একদিন ফুলডুংরি পাহাড়ে এক কোণে একটা পাথরের ওপর বসে গাইতে শুনেছিল দাদাভাইকে। এরপর সুচিত্রা মিত্র, অদিতি মহসিন এবং অনেকের গলায় শুনেছে অনেকবার কিন্তু এই গানটির অনুষঙ্গে কেন জানি না এই দুজনকেই মনে পড়ে। প্রথমজন অচেনা। দ্বিতীয় মানুষটাও আর কাছে নেই, সুখের খোঁজে ঘরছাড়া।
জীবন বড়ো অদ্ভুত। দাদাভাই তার খুব কাছের মানুষ ছিল। এখন মনে হয়, কাছাকাছি, পাশাপাশি থাকলেই যে সবাইকে চেনা বা বোঝা যাবে এটা বোধহয় ঠিক নয়। কোনো মানুষের অন্তর্জগতে কখন যে কী ভাঙাগড়া চলে তা কি অন্য কারোর পক্ষে বোঝা সম্ভব, সবসময়? দাদাভাই, ওর প্রাণের মানুষ ছিল ঠিকই, কিন্তু তার অন্তরমহলের সর্বত্র বোধহয় প্রবেশাধিকার ছিল না রুমির।
নাগরদোলার ছন্দে চোখের সামনে ঘুরপাক খায় অনেক স্মৃতি। ছুঁতে না পারার যন্ত্রণায় কষ্ট পায় খুব।
নির্জন প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে এক ধরনের স্তব্ধতার ভাষা শিখে নিয়েছে সে। অনেক ভালোবাসা, হাজার খুনসুটির কথা মনে পড়লেও আর অস্থির হয় না রুমি।
ঠিক এই মুহূর্তে যেমন হঠাৎ বাবার সেই অন্ধকার মাখা মুখটা সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। ছাদের এক কোণে বসে প্রায় একটা শিশুর মতো কাঁদছিলেন বাবা। দাদাভাই তখনও পাকাপাকি বাড়ি ছাড়েনি। দূর থেকে বাবাকে দেখে, এক দৌড়ে দাদার ঘরে গিয়েছিল রুমি। বলেছিল বাবার সেই নিঃশব্দ ভেঙে পড়ার কথা। দাদাভাই উঠে দাঁড়িয়ে, ওর দিকে তাকিয়ে আবার বসে পড়েছিল। রুমিও আর কথা বাড়ায়নি। চলে এসেছিল ঘর থেকে। সেই শেষ। দাদাভাইয়ের সঙ্গে আর কথা বলেনি কখনো। বলতে চায়ও না।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেওয়াল ঘড়িটা দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লো রুমি। বাবার ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে। অবসর নেয়ার পর নানারকম কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন বাবা। প্রায় বেরোতে হয় আজকাল। এই বয়সে বাবার এত কাজ করা, রুমির পছন্দ নয়। ওর বারণ বাবা শোনেন না। মা কিছু বলতে গেলেই বাবা হাসেন। প্রথম দিকে বেশ কয়েকবার কান্নাকাটি করে বাবাকে আটকাবার চেষ্টা করেছিলেন মা। ¤øান হেসে বাবা নাকি বলেছিলেন- মেয়েটার জন্য তো কিছু করতে পারলাম না। সারাজীবনের সঞ্চয় তো ছেলেকে বড় করতে…।
এ সব কথা মায়ের কাছেই শোনা। এ ব্যাপারে রুমি কোনো কথা বলতে গেলেই বাবা থামিয়ে দিয়েছেন। অন্য প্রসঙ্গ টেনে এনে হাসিঠাট্টা করেছেন।
বসার ঘরে ঢুকতেই মা হাসলেন- গরম গরম হিঙের কচুরি এনেছেন বাবা। চা বসিয়ে তোকে ডাকতে যাবো ভাবছিলাম।
-হিঙের কচুরি?
-আর তোর জন্য স্পেশাল-
-ছানার জিলিপি। তাই না?
স্নান সেরে বাবা এসে পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছিলেন মুখ টিপে।
বাবা মার মাঝখানে বসে খেতে খেতে রুমি বলল- ‘আমি বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী একজন মেয়ে- দি হ্যাপিয়েস্ট ডটার। আগামী সাত, না না সাতাশ, সমস্ত জন্মেই আমি যেন তোমাদের মেয়ে হয়েই জন্মাই।’

অদ্ভুত এক অস্বস্তিতে ঘুম আসছিল না রুমির। পুরনো অনেক স্মৃতি আজ বিরক্ত করছে তাকে। হ্যাঁ বিরক্তই। কেননা এ সব কথা ভাবলেই বাবার সেদিনের কালো হয়ে যাওয়া মুখটার কথা মনে পড়ে।
খুব কষ্ট হয়। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক রাশ ঘৃণা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কখনো কখনো ভীষণ রাগ হয় নিজের ওপর। এক সময় এই দাদাকে নিয়ে খুব গর্ব ছিল তার। এই মানুষটাই ছিল তার আদর্শ। মনে আছে, রেকর্ড নং পেয়ে দাদা যেদিন গ্র্যাজুয়েট হ’ল, আর ক্লাবের ছেলেরা কাঁধে করে দাদাভাইকে নিয়ে এলো বাড়িতে, বাবা মা তখন প্রায় আনন্দে পাগল। সেদিন পাড়ার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত হৈ-হুল্লোড় খাওয়া-দাওয়া হয়েছিল বাড়িতে। নিজেকে সেদিন খুব ভাগ্যবতী মনে হয়েছিল রুমির। মনে মনে সেদিনই শপথ নিয়েছিল, দাদার মতো তাকেও একদিন বাবা-মার মুখ উজ্জ্বল করতে হবে। প্রমাণ করতে হবে নিজেকে। এখন নিজের ওপর রাগ হয়।
না, এ সব কথা আর ভাবতে চায় না রুমি। সেই কষ্টের, নারকীয় মুহূর্তগুলোকে সামনে আনার কোনো মানে নেই। এমনকি ওই মানুষটাকে ঘিরে কোনো সুখের স্মৃতিও মনে রাখতে চায় না সে।
বাবা-মার চোখের অব্যক্ত যন্ত্রণা দেখতে দেখতে নিজেকে আরো কঠিন করে তুলেছে সে।
ঈশ্বরের কাছে তার একটাই প্রার্থনা- দাদাভাইয়ের মতো দুর্মতি যেন তার না হয়। সারাক্ষণ তাই সে চেষ্টা করে ওদের একটু হাসিখুশি রাখতে। কখনো পারে। কখনো পারে না।
অথচ এই দাদাভাইয়ের জন্য কি না করেছেন ওরা। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পরই কেমন যেন পাল্টে গিয়েছিল তার দাদা শোভন গাঙ্গুলি। রাত করে বাড়ি ফেরা, সকলকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, যখন তখন বাবার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা চাওয়া, কারণে অকারণে সবাইকে কষ্ট দেওয়া, মাঝে মাঝেই বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যাওয়া তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। অপমানিত হওয়ার ভয়ে এ বাবা মা চুপ করে থাকতেন। রুমি একদিন কিছু বলার চেষ্টা করায়, কিছু না শুনেই চেঁচিয়ে উঠেছিল ‘ওই অপদার্থ লোকটার হয়ে ওকালতি করতে যদি এসে থাকিস, তবে কিছু বলার দরকার নেই। যা, বেরো ঘর থেকে ‘- তোর মতো অসভ্য, অকৃতজ্ঞ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে আসাটাই ভুল হয়েছিল আমার- ঘর থেকে সেদিন বেরিয়ে এসেছিল রুমি।
এরপর থেকে প্রায়ই আর বাড়ি ফিরত না দাদা। কোথায় থাকত, কী করত কে জানে? মনে আছে, মার কথায় ইউনিভার্সিটিতে খোঁজ নিয়েছিল রুমি। এক বন্ধু বলেছিল- ‘ও তো আর ক্লাস করে না।’
পাশ থেকে আর একজন বলেছিল- ‘সত্যিটা হ’ল, ওকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। শুধু এখানে নয়, আর কোনো ইউনিভার্সিটিতেই পড়তে পারবে না সে।’
খুব লজ্জা পেয়েছিল রুমি। তবু অনেক কষ্টে জানতে চেয়েছিল- কেন? কারণটা বলবেন?
সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে এক মহিলা এগিয়ে এসে বলেছিলেন-
-কী বলি বলতো, খুব খারাপ লাগছে -আসলে –
-বলুন না, আমি ওর বোন, আমার জানা দরকার।
-না, শোভন কিন্তু এমন ছিল না। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র, আমরা সবাই খুব পছন্দ করতাম ওকে।
তারপর কী যে হ’ল, আস্তে আস্তে কেমন যেন পাল্টে গেল। সুন্দর, শান্ত ছেলেটি হঠাৎ হয়ে গেল অসহিষ্ণু, বদরাগী। কথায় কথায় সকলের সাথে ঝগড়া, মারামারি -আমরা যারা প্রথম থেকে ওকে দেখছি, মেলাতে পারি না। কোথা থেকে কি যে হ’ল-
খুব অবাক হয়ে শুনেছিল রুমি। লজ্জায়, কষ্টে, কী যে বলবে বুঝতে পারেনি। ভদ্রমহিলা বোধহয় ওর অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিলেন-
-শেষদিকে প্রায়ই দেরি করে ক্লাসে ঢুকতো। স্যারদের কথা গ্রাহ্য করতো না। একদিন দীপালি ম্যাডামের ক্লাসে দেরি করে আসায় উনি কিছু বলেছিলেন। পাগলের মতো রেগে গিয়ে ওকে প্রায় মারতে গিয়েছিল শোভন।
-কী বলছেন? দাদাভাই এমন-
-হ্যাঁ, তারপর যা হয়। অফিসিয়াল অভিযোগ, শুনানি এই সব। সেখানেও অসভ্যতা। ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সে কথা শুনে আবার মারমুখী হয়ে উঠেছিল। কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে ওকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করে। ছাত্র সংগঠন থেকে অনেক রকম চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি শেষপর্যন্ত।
সব শুনে পাথরের মতো বসেছিল রুমি। তার প্রিয় দাদাভাই, ভেতরে ভেতরে এত বদলে গেল তারা কেউ জানতেও পারেনি। এখন কী করবে সে? বাড়িতে গিয়ে এসব কথা বলবে কী করে? বাবা-মা কি সহ্য করতে পারবেন এ সব? দাদাভাই তো অন্ধকারে রেখে দিয়েছে সবাইকে। কিন্তু কী এমন কারণ যা ওকে বদলে দিল এমনভাবে? এই সব ভাবতে ভাবতে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়েছিল সেদিন।
যে ভদ্রমহিলা, এতক্ষণ কথা বলছিলেন তিনি এবার রুমির হাত দুটো ধরে বললেন, বুঝতে পারছি বাড়ি ফিরছে না নিয়মিত। আমার নাম শিউলি। শিউলি সাহা। শোভনের ক্লাসমেট। আমার নং টা রেখে দাও তুমি। আমি কোন খবর পেলে জানাবো।
নিজের নং টা ওকে দিয়ে রুমি জানতে চেয়েছিল- বলতে পারেন, কী এমন হ’ল দাদার?
-মনে হয় কোন খারাপ দলের মধ্যে পড়েছে। বেরোতে পারছে না।
-আপনার সঙ্গে যদি দেখা হয়, বলবেন আমার মা-
-দেখা হওয়ার সুযোগ কম। আমি বিভিন্ন সুত্রে খবর নেওয়ার চেষ্টা করবো। পেলে জানাবো তোমায়।

সেদিন ফিরে এসে ঘর অন্ধকার করে শুয়েছিল রুমি। কেঁদেছিল খুব। ইদানীং ওর ব্যবহারে কষ্ট পেলেও, অজানা এক ভয় অস্থির করে রেখেছিল তাকে। দাদাভাইয়ের কিছু হয়নি তো! শিউলি বলছিল হয়তো কোনো খারাপ চক্রে পড়েছে। নানারকম নেশার ফ্যাশন আজকাল বেড়েছে। রুমিদের কলেজেও কিছু গুণ্ডাদের মতো ছেলেরা এ সব করে। তেমন কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে গেল, না অন্যকিছু?
নেশা করা, সে সব বিক্রি করা নিয়ে নানান গল্প শুনেছে। খুব ভয় হয়েছিল। ওকে যদি কেউ ফাঁসিয়ে দেয়? কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেল না তো? কিন্তু রাজনীতি তো অনেকেই করে,- তাদের তো -তাহ’লে? পাশাপাশি আরো একটি চিন্তায় অস্থির হয়েছিল রুমি। বাবা-মার সামনে এই কথাটা কীভাবে বলবে সে। দু’জনেই খুব আঘাত পাবেন। বাবা ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়লেও, মুখে হয়তো কিছু বলবেন না। কিন্তু মা? সেটা ভাবতেই শিউরে উঠছিল শরীর। ভেবেছিল, শিউলির ফোনের জন্য দু’এক দিন অপেক্ষা করে, তারপর না হয়-
কিন্তু না, ঘর অন্ধকার দেখে, মা ঢুকেছিলেন ঘরে- কি রে সব আলো নিভিয়ে একা বসে আছিস, শরীর ঠিক আছে তো?
একটু অপ্রস্তুত ছিল রুমি। তবু হেসেছিল- না না আমি তো নিচে তোমার কাছেই আসছিলাম।
আর অন্য কোনো কথার মধ্যে না গিয়ে মা জানতে চেয়েছিলেন- কোনো খবর পেলি?
আসল কথাটা এড়িয়ে গিয়ে রুমি বলেছিল, না গো, কয়েকদিন ধরে নাকি ক্লাসে যাচ্ছে না।
-মানে? কোথায় আছে এখন?
-কেউ বলতে পারল না। দ্যাখো, হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছে কোথাও। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানোর নেশা তো ওর আছেই।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই মিলে বসার ঘরে বসে গল্প করা ওদের পুরনো অভ্যাস। কাজকর্ম সেরে মা এসে পান সেজে বাবাকে দিতেই বাবা হেসেছিলেন, জানিস রুমি, এখন তো সিগারেট
খাই না। ডিনারের পরে এই পানটা তাই মনে হয় অমৃত সমান।
ঘুমোতে যাওয়ার আগে পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন নিয়ে হাল্কা কথাবার্তা বলার অভ্যাস তাদের অনেক দিনের। সেদিনও পাশের বাড়ির কাকুর বড় মেয়ে রিঙ্কির বিয়েতে কী দেয়া যায়, তাই নিয়ে কথা হচ্ছিল। ওর হবু বর নাকি খুব নাম করা প্রফেসর।
এ রকম সব কথার ফাঁকে, রুমি বাবার দিকে তাকিয়ে বলেছিল- তোমাদের একটা কথা বলার ছিল-
মার চোখে কেমন যেন ভয়ের আভাস। বাবা হেসেছিলেন বল, কী বলবি? কাল বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাবি কোথাও?
-না বাবা, -একটু থেমে রুমি বলেছিল- আজ দাদার খোঁজ নিতে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। শুনলাম-
বাবা একটু বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন- আমি কিন্তু খোঁজখবর নিতে বারণ করেছিলাম। নিজের ইচ্ছেয় গিয়েছে, নিজের চাড়েই ফিরবে।
মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে দাদার সম্পর্কে শুনে আসা সমস্ত কথাই বলেছিল রুমি। মা’র দু’চোখ ভরতি জল, আর নীরব আর্তনাদে বাবার মাথানাড়া দেখে নিজেকেই অপরাধী মনে হয়েছিল রুমির।
ওদের দু’জনকে জড়িয়ে ধরে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সেদিন।
দিন তিনেক পর ফোন এসেছিল শিউলির। দাদা কোথায় আছে, জানিয়েছিল। ঠিকানা দিয়ে বলেছিল রতন বলে একটি ছেলের বাড়িতেই নাকি থাকে। সঙ্গে সঙ্গে সাবধান করে দিয়েছিল রতন
সম্পর্কে। সে নাকি করতে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। আরো একটা খবর দিয়েছিল শিউলি। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আলোচনায় নাকি এমন কথা হয়েছিল, অন্যায় স্বীকার করে চিঠি দিলে তারা একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবেন শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি বা রিভিউ কমিটিকে বোঝাবার। কিন্তু শোভনকে সে কথা জানানোর সুযোগ হয়নি ওদের।
বাবা সব শুনেছিলেন। বলেছিলেন-
-গিয়ে কোনো লাভ হবে মনে হয়? কিন্তু গেলে একা যেও না। আর তোমার দাদা চিঠি দিতে রাজি হবে কিনা জানি না, তবে আমি কয়েকজন প্রভাবশালী মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। মনে হয় সবাই চেষ্টা করলে- সেটাও জানিয়ে এসো-

রুমি একা যায়নি। দীপক ছিল। ওরা যাচ্ছে শুনে শিউলিও আগ্রহ দেখিয়েছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর, তিনজনে যখন বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়েছিল, তখন প্রায় বিকেল। বেশ কিছুক্ষণ কড়া নাড়ার পর দরোজা খুলেছিল একটি মেয়ে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল- কাকে চাই?
রুমি এক পা এগিয়ে বলেছিল- আমি রুমি, শোভন, আমার দাদা। উনি আছেন?
-আছেন, কিন্তু উনি তো কারো সঙ্গে দেখা করেন না। তাছাড়া এখন তো অসু¯-
মেয়েটির কথা বলার ভঙ্গিতে এক ধরনের উদ্ধত অসভ্যতা দীপককে রাগিয়ে দিয়েছিল বোধহয়।
-তাহ’লে আরো দরকার দেখা করার। ডাক্তার,-
-সে সব তো আমি করছি। আপনারা তো আজ এলেন।
রুমি মেয়েটির কাছে গিয়ে বলেছিল- কিছু মনে করবেন না, আপনি কি রতনদার-
-না-
-তবে?
-সেটা আপনার দাদাকেই জিজ্ঞাসা করে নেবেন।

রুমিকে দেখে খুব অবাক হয়েছিল দাদাভাই। ঠোঁটে ¤øান হাসি নিয়ে বলেছিল- তুই এখানে?
-হ্যাঁ। কিন্তু তোর শরীরের কী হাল করেছিস? এত জ্বর, ওষুধ খাচ্ছিস?
ঘাড় নেড়েছিল দাদাভাই- রূপসা যা করার করছে তো। একটা কথা বল দেখি, এই ঠিকানাটা
তুই পেলি কোথায়?
একটু চুপ করে থেকে রুমি হেসেছিল- শিউলিদি জোগাড় করে দিয়েছেন।
শুনে আরো অবাক হয়েছিল দাদাভাই- শিউলি? মানে আমাদের ক্লাসের-
-হ্যাঁ, উনি এসেছেন আমার সঙ্গে। আমার এক বন্ধু দীপকও আছে। দু’জনেই বাইরে দাঁড়িয়ে।
খুব লজ্জা পেয়েছিল দাদাভাই। বদরাগী মানুষটা কেমন যেন খুশি হয়েছিল সেদিন।
-আমার জন্য এত কিছু করছিস কেন?
-বাড়ি গেলে মা’র অবস্থা দেখলে বুঝবি, কেন পাগলের মতো খুঁজছি তোকে।
কী যেন সব ভেবে দাদাভাই বলেছিল- ‘মা’কে বলিস, চিন্তা না করতে, জ্বরটা কমলেই আমি ফিরবো শিউলি খুব ভালো। ওকে আমার কৃতজ্ঞতা আর দীপককে ভালোবাসা জানাবি। বলিস এই ঘরে ওদের বসতে দেয়ার ব্যবস্থাও নেই। কিছু যেন মনে না করে।’
কেন জানি না খুব খুশি হয়েছিল রুমি। এই মানুষটাই তো তার চেনা। আর সব কিছুই যেন অলীক।
মনে আছে, সেদিন খুব সাহস করে বলেছিল- আমাদের সঙ্গে চল না দা’ভাই।
-না রে, রূপসা যেতে দেবে না। তাছাড়া ও সব কিছু করেছে এতদিন, এখন তোদের সঙ্গে যাওয়াটা ভালো দেখায় না। ভাবিস না, আমি ঠিক আসবো।

ঠিক মনে নেই, বোধহয় দিন দশেকের মধ্যেই এক দুপুরবেলায় এসেছিল দাদাভাই। বাড়িতে ঢুকেই আগের মতোই ‘মা’ ‘মা’ বলে চিৎকার শুরু করে দিয়েছিল। তারপর কিছুদিন মা’র চোখের জলের আনন্দ, বাবার নীরব বিরক্তিহীন গাম্ভীর্য, দাদাভাইয়ের বিভিন্ন রকমের খাবারের আবদার মেটাতে মা’র প্রাণপাত, প্রতিদিন বাজার থেকে দাদাভাইয়ের পছন্দমতো সবজি, মাছ আনা, আর সারাক্ষণ এই তিনজনের ফাইফরমাস নিয়ে রুমির ব্যস্ততা, খাবার টেবিলে নতুন সিনেমা বা রুমির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এ সব নিয়েই কেটেছিল বেশ কয়েকদিন। এই বাড়ির চারজন মানুষের মধ্যে কোনো সমস্যা থাকতে পারে, এ কথা মনেই হয়নি তখন। অন্তত ওই কয়েকটা দিন। প্রায় হঠাৎই পেয়ে যাওয়া ওই সুন্দর সতর্ক দিনগুলোর কথা মনে পড়লে কেমন যেন অন্য রকমের কষ্ট হয় রুমির।
দাদাভাইকে দেখে আসার পর বাবা-মা’র সঙ্গে কথা বলে একটা ব্যাপার, নিজেদের মধ্যে ঠিক করা হয়েছিল। কেউ ওই অপ্রিয় প্রসঙ্গ নিয়ে কোনো কথা বলবে না। বলেওনি। কিন্তু সেটাই হয়তো অস্বস্তিতে রেখেছিল দাদাভাইকে। একদিন দুপুরে রুমির ঘরে এসে বসেছিল।
-কি গান শুনছিস? নিশ্চয়ই আবিদা পারভিন?
রুমি হেসেছিল- কেন? আমি আর কারো গান শুনি না বুঝি- আমার গজলের কালেকশন- জানিস-
-তা নয়, ওর গজল ছাড়াও কাওয়ালি, সুফি সঙ্গীত তোর খুব পছন্দ তো, -তাই ভাবলাম-
-এখন যে গানটা শুনছি, সেটা তুই আমায় উপহার দিয়েছিলি- তোর খুব প্রিয় গান
-রেশমা, লম্বি জুদাই, কারেক্ট?
-হুম শুনবি?
-অনেক দিন শুনিনি। এখন থাক- তোকে একটা কথা বলতে এসেছিলাম- একটু থেমে দাদাভাই বলেছিল- রতন, রূপসা ক্রমাগত ফোন করে যাচ্ছে। আমি ধরছি না। ফোন অফ করে রাখছি।
-কিন্তু কেন? কী চায় ওরা?
-রূপসা হয়তো জানতে চায় কবে ফিরবো? আর রতন তো টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না-
-আচ্ছা দা’ভাই, এই রূপসা কে রে! আগে তো নাম শুনিনি।
-রতনের বোন। ওরা ভাই বোন দুজনেই একেবারে অন্যরকম-
-মানে, কী রকম?
-সারাক্ষণ জোর খাটাতে চায়। যা বলবে, শুনতে হবে, না হলেই অশান্তি।
-একটা কাজ করতে পারিস। আমার আর একটা ফোন আছে সেটা ব্যবহার কর। তোরটা সুইচ অফ করে রেখে দে।
-হ্যাঁ তাই করবো। কিন্তু তুই ওদের চিনিস না- ওরা প্রয়োজনে সব কিছু করতে পারে।
সেদিন আর কথা বাড়ায়নি রুমি। বলার হলে একদিন ঠিক বলবে দাদাভাই।

মাঝেমাঝে রুমির মনে হয়, সে ও বোধহয় স্মৃতির হাতের এক পুতুল। মনে করতে না চাইলেও যখন তখন ইচ্ছেমতো অনেক মুহূর্তই সামনে এসে দাঁড়ায়। পরম্পরা না মেনে যার যখন খুশি এগিয়ে আসে। আপন আনন্দে দৌড়ে বেড়ায় সময়ের অনন্ত প্রবাহে। কখনো পালতোলা নৌকার পাটাতনে, কখনো বা উল্টোমুখী হাওয়ার সঙ্গে। কখনো তীরবিদ্ধ আহত হরিণ, কখনো বা নিস্তরঙ্গ জলের ভেতরে এক সুখী রাজহাঁস। সুখ-দুঃখের নাগরদোলায় এই স্মৃতির খেলায় ভাসতে ভাসতে, শিউলিদির কাছে শোনা কবিতার একটি পঙ্ক্তি ঘুরপাক খায় মাথার ভেতরে- ‘গান শেষ, তবু তখনো তার প্রতিধ্বনিরা দশ দিকে’…। কোন দিক থেকে কখন, কে আসবে কেউ জানে না।

না, দাদাভাইকে নিয়ে কোনো কিছুই আর ভাবতে চায় না সে। অথচ…

তিন.
একজন চিত্রকরের গল্প শুনেছিল শোভন। অসাধারণ সব ছবি আঁকতেন তিনি। প্রতিটি ছবি শেষ করে একদিন রাখতেন। পরের দিন নাকি নানানরকম রঙ দিয়ে নষ্ট করে দিতেন ছবিটিকে।
সেই চিত্রকরের নাম তার মনে নেই। কিন্তু নিজের সঙ্গে কোথাও যেন তার একটা মিল খুঁজে পায় শোভন। নিজের সাজানো সুন্দর জীবনকে বারবার কালো রং দিয়ে নষ্ট করে দিয়েছে সে। নিজের অজান্তেই। জীবনের সব ছেঁড়াপাতাগুলো ওল্টালে শোভন বুঝতে পারে, পবিত্র স্নিগ্ধ এক আলো যখনই দীপ্ত করে তুলতে চেয়েছে তার জীবন, তখনই ঈশান কোণে লুকিয়ে থাকা এক মেঘ হৈ হৈ করে ছুটে এসেছে সামনে। আর প্রায় প্রতিবারই অসহায় নীরব দর্শকের ভূমিকায় বসে থেকেছে শোভন। যেন জয় নয় পরাজয়েই তার মুক্তি। পৃথিবীর আনন্দযজ্ঞের খেলায় তার যেন কোনো ভূমিকাই নেই। নিরীহ পবিত্র এক সবুজমাঠের যে স্বপ্ন সে দেখেছিল একসময়, দিশাহীন হাঁটতে হাঁটতে কখন যে হারিয়ে গেছে সেই মাঠের ঠিকানা, কে জানে!
আজ যেমন বিশেষভাবে মনে পড়ছে শিউলির কথা। ইউনিভার্সিটিতে একই ক্লাসে পড়তো দু’জনে।
শোভনের মতো না হলেও, গ্র্যাজুয়েশন-এ বেশ ভালো রেজাল্ট করেছিল শিউলি। খুব সংবেদনশীল, বুদ্ধিমতী মহিলা। ওর সুন্দর ব্যবহারে মুগ্ধ হতো সবাই। সুসময়ে বন্ধু থাকে অনেকেই, কিন্তু তার ওই অস্থিরতার দিনগুলোতে শিউলি নিঃস্বার্থভাবে পাশে থেকেছে সারাক্ষণ। কিন্তু কেন, কীভাবে যে শোভন এত অসহিষ্ণু এত বদরাগী হয়ে পড়তো মাঝেমাঝে, সে কথা সে নিজেও জানে না। অথচ আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শিরা বা স্কুল কলেজের বন্ধুরা সকলেই তাকে ধীরস্থির এবং ভদ্র বলেই জেনে এসেছে চিরকাল। এমনকি ইউনিভার্সিটিতেও প্রথম দিকে খুব জনপ্রিয় ছাত্র ছিল সে। মনে আছে, পরবর্তীকালে প্রথম প্রথম যখন রাগে মারমুখী হয়ে উঠত সে, অনেকবার প্রকৃত বন্ধুর মতো তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছে শিউলি। পারেনি। বারবার অধ্যাপকদের কাছে গিয়ে, অভিযোগ তুলে নেয়ার জন্য অনুনয় বিনয় করেছে, এমন কথাও শুনেছে শোভন। এ সব বোধহয় তার ভুয়ো সম্মানে বা পৌরুষে লেগেছিল, আর তাই শিউলিকেও অপমান করতে ছাড়েনি সে। সমস্ত অপমান সহ্য করেও শুনানির শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পাশে থেকে তাকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করেছে সে। এমনকি শোভনকে মানসিকভাবে সাহায্য করার জন্য অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট, অ্যাঙ্গারথেরাপি নিয়ে অল্পবিস্তর পড়াশোনাও করেছে। কিন্তু না, শোভন তখন সমস্ত যুক্তি তর্কের বাইরে নিজের অহং নিয়ে ব্যস্ত। এ সব ভেবে আজ খুব খারাপ লাগছে তার।
রুমিও খুব প্রশংসা করেছিল শিউলির। ইউনিভার্সিটিতে সবাই যখন তার সম্পর্কে যা তা বলছিল,
তখন নাকি শিউলি খুব সদর্থক কথা বলে আশ্বস্ত করেছিল, রুমিকে। খোঁজখবর নিয়ে, সে ই দিয়েছিল রতনের ঠিকানা। রুমিকে একা ছাড়বে না বলে সঙ্গেও গিয়েছিল সেদিন। অথচ এই শিউলির সঙ্গে কোনো বিশেষ বন্ধুত্বই গড়ে ওঠেনি শোভনের। তা সত্ত্বেও অদ্ভুত এক সহমর্মিতার মোড়কে ঢাকা ছিল তাদের সম্পর্ক। যদিও শিউলির কোনো পরামর্শই সে কানে তোলেনি তখন। সেদিন প্রসঙ্গটা রুমিই তুলেছিল-
-শিউলিদি বলছিল তুই একটা আবেদন করলেই নাকি মিটে যাবে ব্যাপারটা। উনি নাকি কথা বলেছেন অনেকের সঙ্গে।
-এত সহজ? হেসেছিল শোভন।
-সে সব তো আমি জানি না। শিউলিদির সঙ্গে একবার কথা বলে দেখতে পারিস তো।
-ধুর! আমি তো ক্ষমা-টমা চাইতে পারবো না। কথা বলে কি হবে?
-দা’ভাই, ক্ষমা চাইলি কিনা কেউ জানবে না, কিন্তু তোকে বহিষ্কার করা হয়েছে, এটা তো সবাই জেনে যাবে। বাবা-মা’র কথা ছেড়ে দে। তোর ভবিষ্যৎ এত উজ্জ্বল, নষ্ট করবি?

শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছিল শোভন। শিউলির সঙ্গে এমনিতেই ক’দিন ধরে খুব কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছিল। বিশেষ কিছু না। রুমির কাছে ওর কথা শোনার পর থেকে এক ধরনের কৃতজ্ঞতা বোধ কাজ করছিল। নিজের জীবন নিয়ে এই টানাপড়েন, বাঘবন্দি খেলা আর ভালো লাগে না এখন।
কেমনভাবে যেন তছনছ হয়ে যায় তার সাজানো জীবন। যেন কোনো অশরীরী হাতের ছোঁয়ায় থমকে যায় পথ। তা না হ’লে রতনের মতো একটি ছেলের সঙ্গে তার আলাপ হবে কেন? শুনেছে একসময় সে নাকি ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করত। পরীক্ষার আগে কি এক কারণে পালিয়ে যায় শহর থেকে। তারপর দু’তিন বছর পর আরেকজন ড্রপ আউটের হাত ধরে আবার ফিরে আসে প্রাক্তনীদের আড্ডায়। ওদের ক্লাসের কয়েকজনের সঙ্গে ওকে ঘুরতে দেখেছে মাঝেমধ্যে। সতীর্থদের কেউ বোধহয় ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বিশেষ কোনো আগ্রহ দেখায়নি শোভন।
ধূর্ত শেয়ালের মতো ওর চেহারা দেখলেই কেমন যেন অস্বস্তি হতো তার।
এখন ভাবলে হাসি পায় শোভনের। নিয়তির কী আশ্চর্য খেলা। সেই রতনের সঙ্গেই জড়িয়ে গেল তার নাম। একদিন ক্লাসের পরে বাড়ি ফেরার পথে রতনের সঙ্গে দেখা। সঙ্গে ওদের পরিচিত আরেকজন। সামান্য দু’চার কথার পর একটা নতুন আড্ডায় শোভনকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল রতন। মনে আছে, আপত্তি করায় বেশ বিরক্ত হয়েছিল সে।
-ভালো রেজাল্ট করেছো বলে খুব দম্ভ তোমার, তাই না? আমাদের সব রাস্তার ছেলে ভাবো,
তাই তো?
অবাক হয়েছিল শোভন।
-আশ্চর্য, এমন ভাবছেন কেন? আমার খুব জরুরি একটা কাজ আছে। সেখানে আমায় যেতেই হবে। তাই-
সেদিন না যাওয়ায় রতন নাকি খুব অপমানিত বোধ করেছিল। মুখের ওপর ‘না’ শোনার অভ্যাস ওর নেই। এ সব তার এক সঙ্গীর কাছেই শোনা।
সপ্তাহখানেক পরে আবার একদিন রতনের সঙ্গে দেখা, রাস্তায়। সেই পরিচিত ছেলেটাই পরেশ না কি যেন নাম, ওর সঙ্গী। সেদিন আর না বলার সুযোগই পায়নি শোভন।
রতন বলেছিল নতুন আড্ডার কথা। ভেবেছিল নতুন বন্ধুবান্ধব, গল্পগুজব, এই সব। কিন্তু ভেতরে ঢুকে শোভন বুঝেছিল, সেটা আদৌ কোনো আড্ডা নয়, ‘ঠেক’ বলাই ভালো। ছোট ছোট গ্রুপে তাস খেলা হচ্ছিল- ‘তিন পাত্তি’। দূরে এক কোণে বেশ ভিড়। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে সবাই। প্রায় প্রত্যেকের হাতেই ‘পাউচ’। উল্টোদিকেও কয়েকজন হাসাহাসি করছিল, হাতে ‘পাউচ’ নেই, কিন্তু- না, বুঝতে অসুবিধে হয়নি শোভনের। রতন ও তার সঙ্গীকে তাসের আসরে ব্যস্ত রেখে, সুযোগ বুঝে বেরিয়ে এসেছিল সেদিন। সেই রতন কিন্তু তাকে ছাড়েনি। নিত্যনতুন উপায় বের করে শোভনকে দলে টানার চেষ্টা করেছে। পারেনি।
অথচ আশ্চর্য, পাকেচক্রে একদিন, রতনেরই সঙ্গী হওয়ার অপরাধে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে। রতনকে সে চেনে, কিন্তু কোনোক্রমেই সে তার সঙ্গী নয় এই সত্য এবং সরল কথাটুকু হাজার চেষ্টা করেও থানার বড়বাবুকে বোঝাতে পারেনি শোভন। জানতেও পারেনি ঠিক কী তার অপরাধ! অনেক আগে একবার শুনেছিল পরীক্ষা না দিয়ে রতন নাকি একসময় শহর ছেড়ে পালিয়েছিল। কেন? কার ভয়ে? কী কাজ করে রতন? কী এমন বেআইনি কাজ করেছে যার জন্য তার সঙ্গীদেরও খুঁজছে পুলিশ? রতনকে ধরছে না কেন? তবে কি সে ফেরার? এমন সব প্রশ্ন নিয়ে অকারণেই তাকে সারারাত বসে থাকতে হয়েছিল থানায়। অবস্থা বুঝে ভাগ্যিস রুমিকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল, কিছু কাজে আটকে পড়েছে, শেষ হলে ফিরবে। না হ’লে অহেতুক চিন্তায় পড়ে যেতেন বাবা-মা। সেই প্রথমবার। তারপর বহুদিন বাড়ির বাইরে থেকেছে, বাবা-মাকে না জানিয়েই।
নিজেকে এবার একটু ধমক দিল শোভন। শিউলির কথা ভাবছিল সে। রতনের মতো একটা ছেলের অনুপ্রবেশ সেখানে হয় কী করে? কলেজেও তো তার বন্ধু কম ছিল না। হৈ-হল্লা, আনন্দের অভাবও ছিল না তেমন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়