করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

সেন্সর নেই সার্বিয়ান চলচ্চিত্রে : যা খুশি দেখানো যায় সার্বিয়ান চলচ্চিত্রে

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

হোটেল ক্রাউন প্লাজার সামনে গাড়িতে উঠে বসেছি। দরজা লক করবো, এমন সময় চিঁ চিঁ করতে করতে দৌড়ে এলেন তিনি।
‘ওয়েট, ওয়েট প্লিজ।’ গাড়িবহরের সামনের গাড়ি চলতে শুরু করেছে তখন।
‘সাইড প্লিজ।’ সরে বসলাম। বসলেন আমার পাশে। আমাদের গাড়িও সামনের বহরকে অনুসরণ করে চলতে শুরু করলো। আজ আমার গাড়িতে এই ভদ্রমহিলা।
‘স্যরি, ফ্রেশ হতে গিয়ে পেছনে পড়ে গেছি। আমি মিলঙ্কা ভাসিলজেভিচ। কাজ করছি মিনিস্ট্রি অব কালচার এন্ড মিডিয়া তে, সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি। আজ আমিও আছি তোমার সঙ্গে।’
ইংরেজিতে বলে গেলো গড়গড় করে। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলো। আমি পরিচয় দিলাম।
‘তোমার কথা বলেছে ক্রিভো।’ এই বলার মধ্যেই কিশোরসুলভ দুষ্টুমি। ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসি। মাথা বাঁকিয়ে চুল ঠিক করে নিলো সে। কথাবার্তায় আন্তরিক, বিনয়ী। পছন্দ হলো তাকে। মন খুলে কথা বলার পর আরেকজন লোক পেলাম।
‘কোথায় যাচ্ছি বলো তো?’ জিজ্ঞেস করলাম ভাসিলজেভিচকে।
‘তুমি না কি ভাবুক টাইপের? খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করো। যা দেখো, তাই নিয়ে জানতে চাও? ঠিক বলেছি?’
মেয়েটার উত্তরে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতো অবস্থা। আমাদের দেশে কিশোরকালে, যখন বয়ঃসন্ধি শুরু হয়, ভাবুকটাবুক ভাব আসে। কিশোর মনের প্রথম প্রেমের সময়ও মন উদাস হয়। কে জানে কি বুঝাতে চেয়েছে? ‘আইডিয়ালিস্ট’-এর অর্থ ভাবুক-চিন্তাশীলই ধরে নিয়েই আমার মন সন্দিহান। এই মেয়েটা যে কি বোঝাতে চাইলো?
‘তুমি যেটা দেখছো, তা ভালোভাবেই জানা দরকার। এই যে, তোমার সঙ্গে দেখা হলো। তোমাকে যদি না জানি, ফিরে গিয়ে তোমাকে মনেই না করতে পারি, এই দেখার কোনো মানে আছে? তোমাদের মনে রাখতে চাই বলেই ভালোবাসা-ভালো লাগার চোখে তাকাই, হৃদয় ও মননে ধারণ করি।’
ধবধবে ফর্সা গালে লাল হতে শুরু করে।
বেলগ্রেডের রূপে মুগ্ধ আমি। চারপাশে যা দেখি তাই ভালো লাগে। জিজ্ঞেস করি,
‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
একটা ফোন কল রিসিভ শেষে কথা বলতে শুরু করলো ভাসিলজেভিচ।
‘সার্বিয়ান শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ের দর্শনীয় স্থানগুলো আজকের কর্মসূচিতে রয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছে তোমাদের সঙ্গে। এমন করে প্রতিটি গ্রুপেই কেউ না কেউ নতুন যোগ হয়েছেন। কোনো দলে সংস্কৃতি কর্মী, অভিনেতা, সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিকও রয়েছেন।’
সার্বিয়াতে আজ আমাদের তৃতীয় দিন। শহরের জাদুঘর, সংস্কৃতি কেন্দ্র, সিনেমা- থিয়েটার হল দেখানো হবে। সার্বিয়ার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি না দেখিয়ে-না বুঝিয়ে ওরা আমাদের ছাড়বে না। সার্বিয়ার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস বহু পুরনো। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি- প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের রয়েছে সমৃদ্ধ অতীত। যার বড় কারণ, দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান।
গাছ থেকে পাতা পড়ে টুপ করে। টুপ করে পাতা পড়ার যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সেটা এই পাতা পড়ার মধ্যে নেই। বৃষ্টিতে ভেজা হলুদ পাতা। কাজের চাপে ভারী শরীর নিয়ে কোনো চেয়ারে ঠুস করে বসে পড়ার মতো। কোনো উচ্ছ¡াস নেই, আনন্দের বারতা নেই। সব যেন ছকে বাঁধা রুটিনের আবশ্যিক একটা অংশ, যা অবশ্য পালনীয়! ইউরোপ-আমেরিকার গাছগুলোও যেনো নির্জীব। এসব অঞ্চলে শীতকালও রুক্ষ, কর্কট। পাতা হারিয়ে শুকনো কাঠ হয়ে যায় জলজ¦্যান্ত তাজা গাছ। পাতাগুলো ঝরতে থাকে ধীরে ধীরে। সবুজ পাতা হয়ে যায় লালচে, হলুদ, টুকটুকে লাল, খয়েরি, বাদামি, পীত রং, আকাশি, নীল আরো কত রঙের মিশ্রণ। ঢাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, নামিদামি লোকের বসার ঘরে বড় ফ্রেমে বাঁধাই করা এসব পাতার ছবি দেখেছি কত। ঝরে পড়া পাতার দেশে এখন দেখছি বাস্তবে। এগুলোর সৌন্দর্যও আছে, তবে প্রাণহীন মনে হয়। চিড়িয়াখানায় বন্দি সিংহের বাচ্চার মতো। ঢাকা শহরে খাঁচাওয়ালা ভ্যানে করে স্কুলে যাওয়া অসহায় বাচ্চাদের মতো। অথচ বন্দিত্বের, চাপিয়ে দেয়া দায়িত্বের বেড়াজাল মুক্ত হলে জীবনটা কত সুন্দর হয়ে ওঠে।
ভাসিলজেভিচকে জীবনানন্দের কবিতা শোনাই। না বুঝলেও মনোযোগ দিয়ে শোনে, তাকিয়ে থাকে চোখের দিকে,
আকাশে এমন ছেঁড়া ময়লা মেঘের রাশ- পড়েছে তাদের ছায়া নীলের ঘোলা জলে নিঝুম পিরামিডে
এমনই সোনালি রোদ- সোনার থামের মতো- ঘিয়ের শিখার মতো রয়েছে আকাশ ছিঁড়ে তবু
কেঁদেছে সোনালি চিল এমনই আকাশ ঘুরে- শুনেছি মিসরে আমি হাজার হাজার যুগ আগে
তোমার চুলে যে রোদ- মেঘের মতন চুলে- তোমার চোখে যে রোদ- সেও যে মেঘের মতো চোখ
কেমন বৃষ্টি ঝরে- মধুর বৃষ্টি ঝরে- ঘাসে যে বৃষ্টি ঝরে- রোদে যে বৃষ্টি ঝরে আজ।
মানচিত্রে যেসব সড়ক প্রদক্ষিণ করলে শহরের অস্তিত্ব বোঝা যায়, আমাদের যাত্রাপথ সেই সড়কগুলোতে। রাস্তায় যানবাহনের ভিড় নেই। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কাজ করছে ট্রাফিক পুলিশ। কারো মাথায় ছাতা আছে, কেউ ভিজছেন বৃষ্টিতে। ট্রাফিকের সিগনালে দাঁড়িয়ে পড়ে আমাদের গাড়িবহর।
কয়েক শতাব্দী ধরে সার্বিয়ার ভূখণ্ড রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। এর পর আসে বাইজেন্টিয়াম ও হাঙ্গেরি রাজত্বের আমল। এমনকি আধুনিক যুগে এসেও অটোমান সাম্রাজ্য হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্যের অধীনে দিন কেটেছে সার্বিয়ার। এই যে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর আগমন, ফলে তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে। সার্বিয়াজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। উত্তরাঞ্চলের সংস্কৃতিক ধারা মধ্য ইউরোপের সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকেছে। দক্ষিণের ধারা ঝুঁকেছে বিস্তৃত বলকান ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সংস্কৃতির দিকে।
মধ্যযুগের প্রথম দিকে খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তন হয়। ফলে সার্বিয়ার উপর বাইজেন্টাইনদের প্রভাব পড়েছিল গভীরভাবে। খ্রিস্টধর্মের প্রচার-প্রসারের কারণে সংস্কৃতিতেও যোগ হয়েছে নতুন নতুন উপাদান। গোটা সার্বিয়াতেই তার নজির পাওয়া যায়। দেশটিতে বহু অর্থোডক্স চার্চ, মঠ নির্মিত হয়েছে। সেই সময়ের ভেনিস প্রজাতন্ত্রের প্রভাবও সার্বিয়াতে রয়েছে মোটাদাগে। বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, সাহিত্য এবং স্থাপত্যকলায় তার বড় ছাপ পাওয়া যায়।
আমরা যাচ্ছি শহরের বুলেভার ভোজভোডে মিসিকা এলাকায়। গন্তব্য বেলগ্রেড ফেয়ার হল ওয়ান। বেলগ্রেডে প্রদর্শনী, কনফারেন্স, মুভি, থিয়েটারের সবচেয়ে বড় হল এটি। যেনো মাটির তৈরি একটি বিশাল অর্ধবৃত্তাকার পাত্র বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এমন পাত্রে বাংলাদেশের গ্রাম এলাকায় গৃহস্থরা ধান সেদ্ধ করার জন্য ভিজিয়ে রাখে। অর্ধবৃত্তাকার আকারে ১০৯ মিটারের বিশাল একটি গম্বুজ দিয়ে ঢাকা পুরো এলাকা। প্রেস্ট্রেসড কংক্রিট দিয়ে বানানো এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গম্বুজ। এর বাইরের প্রদর্শনী হলের দেয়াল থেকে গম্বুজ- সবই কাচের তৈরি। হলের মোট আয়তন ২১ হাজার ২৮০ বর্গমিটার, যার মধ্যে প্রদর্শনীর জন্য ব্যবহার হয় ১৫ হাজার বর্গমিটারের মতো। মুভি, প্রদর্শনী, মেলা- সবই চলছে এখানে। রয়েছে খাবারের দোকান, বইয়ের বিশাল পাণ্ডুলিপি- নীলক্ষেতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা বইয়ের সাথে যার মিল রয়েছে।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন-ন্যামের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ সম্মেলন। এই সম্মেলনে অংশ নেয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের আমি একজন সদস্য। ন্যামের আয়োজকরা বেশ স্মার্ট। সম্মেলনে মন্ত্রী মহোদয়রা অংশ নিচ্ছেন। বক্তব্য দিচ্ছেন, জাতীয়-আন্তর্জাতিক ইস্যুতে নিজেদের মত তুলে ধরে বক্তব্য দিচ্ছেন, ঝগড়া করছেন। কোলাকুলি করছেন, ছবির জন্য পোজ দিচ্ছেন। সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত থাকছে নানা কর্মসূচি। এই সময়ে তাদের স্পাউসরা কী করবেন? তাদের জন্য রাখা হয়েছে ঘুরে বেড়ানোর প্রোগ্রাম। স্বাগতিক দেশের পক্ষ থেকে তিন দিনের প্যাকেজ ট্যুর। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি। গাইডের বকবকানি লেকচার অংশটুকু বাদ দিলে বাকি সময় উপভোগ্য। আমার কপাল ভালো, ঘোরাঘুরির এই দলে আমি অন্তর্ভুক্ত। ট্যুর গাইড, গাড়ি, নিরাপত্তা- স্বাগতিক সার্বিয়ার ব্যবস্থাপনাতেই সব। আমাদের টিমের সমন্বয়ক দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি মিলিচা ক্রিভোকাপিচ।
ফেয়ার হল ওয়ানের সামনে চলে এসেছি। পুরো টিম নিয়ে ক্রিভোরা চলে গেলো সামনের দিকে। আমি ভাসিলজেভিচের প্রতি সন্দিহান! যেনো কেবল আমার জন্যই তাকে পাঠানো হয়েছে, টিমের জন্য না। হাত ধরে ডেকে নিয়ে যায় কফি শপে। দাঁড়িয়ে কফির কাপে চুমুক দেই।
তার গল্প শুরু হয়। আমারও কত জিজ্ঞাসা, সার্বিয়ার লোকজন নাটক দেখে কি না, ইউরোপের কোন দেশের মুভি এখানে বেশি চলে? তরুণ প্রজন্ম হিপহপ সংগীতে অভ্যস্ত? ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির চল কেমন? রাঙা ঠোঁট কফিতে ডুবে যায়, হেসে নেয় একগাল। তার গালেও টোল পড়ে! বাঙালি বাদে অন্য মেয়েদের গালেও টোল পড়তে পারে? আমি তাকে মনে করি। ভারতের নায়িকা প্রীতি জিনতার মতো তার চেহারা। এক দৃষ্টিতে তাকাই, লজ্জা পায় সে। নেট থেকে প্রীতির ছবি বের করি। খুশি হয়, তার মতো আরো কেউ আছে?
ভাসিলজেভিচ হেসে কথা বলে। জড়তা নেই, অন্যকে কাছে টানার দারুণ ক্ষমতা তার। সার্ব সংস্কৃতি নিয়ে তার জানাশোনা ভালো।
‘শহরের মধ্যে প্রাসাদের মতো ভবনগুলো দেখেছো, ওইগুলো রোমান ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে নির্মিত। সিরমিয়াম, ফেলিক্স রোমুলিয়ানা, জাস্টিনানা প্রিমা- বিখ্যাত ভবনগুলো সেই সময়ের। সার্বিয়ার বেশিরভাগ মঠে আছে বাইজেন্টাইন শিল্পের ছোঁয়া। এর ঘটনাও দারুণ, ১২০৪ সালে কনস্টান্টিনোপলের পতন ঘটে। জীবন বাঁচাতে বহু বাইজেন্টাইন শিল্পী সার্বিয়ায় পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়া এসব শিল্পীর হাতেই গড়ে ওঠে স্থাপত্য বিদ্যার নতুন কলাকৌশল। রোমান স্থাপত্যকলায় ১১৯০ সালের দিকে নির্মিত স্টুডেনিকা মঠের সৌন্দর্য নান্দনিক। এটাকে অনুসরণ করেই পরে বানানো হয় মাইলেসেভা, সোপোকানি, জিইকা, গ্রাকানিকা এবং ভিসোকি দেকানির মতো মঠ। পরে শাসন আমল পরিবর্তন হওয়ায় এগুলোর অনেক কিছুই আজ নেই।’
আমি আর ভাসিলজেভিচ কফি হাতে। স্পাউসদের সাথে স্রদজিনের আরেকটা গ্রুপ। সিকিউরিটি গার্ডরা ক্রিভোর সঙ্গে রয়েছেন আরেক পাশে। আমরা হাঁটি আর গল্প করি। মৃদু পায়ে হাঁটা। নিউমার্কেটের মতো বইয়ের গলি। ফুটপাতে মেলে রাখা বইয়ের স্তূপ, যার বেশিরভাগই সার্বিয়ান ভাষায় লেখা। একটা বই হাতে তুলে নিলো। ভেতরের পাতায় আঁকিবুঁকি, প্রাচীনকালের কিছু সাদাকালো ছবি। আমার পক্ষে এসব বোঝা দুষ্কর।
এবার আমার অস্বস্তি শুরু। বাথরুম খুঁজছিলাম। ওরে বলতেই খানিক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়। এক পাশে গলির মাথায়। আধুনিক, পাবলিক টয়লেট। পাঁচ সার্বিয়ান ডলার দিয়ে টয়লেট ব্যবহার করতে হয়। ভেতরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মেয়র আনিসুল হকের সময় ঢাকায় কিছু আধুনিক টয়লেট তৈরি করা হয়েছে। কয়েক বছরের ব্যবধানে সেগুলো এখনো ভালো চলছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পাবলিক সার্ভিসের কিছু ব্যবস্থাপনা সন্তোষজনক।
এতক্ষণ ধরে ভাসিলজেভিচের সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ হয়ে গেছে। সামনে নিয়ে গেল একজন আর্টিস্টের সামনে, বসিয়ে দিলো ছোটখাটো কাঠের একটি মোড়ায়। বললো চোখ বন্ধ করো। মাস্ক তো মুখে ছিলোই না। চোখ বন্ধ করে ফেলি। বুঝতে পারি গালে পরশ পড়ছে আর্টিস্টের। মিনিট পাঁচেক পর ভাসিলজেভিচ,
‘জনাব, এবার চোখ খুলুন।’
চোখ খুলি। আমার সামনে মাঝারি সাইজের একটি আয়না ধরে আছেন আর্টিস্ট নিলোভাচ।
ওম্মা, এ দেখি একটা কবুতর। সাদা রঙের কবুতর। মনে মনে চরম বিরক্ত হলাম। এসব ট্যাটু-ম্যাটু বরাবরই আমার অপছন্দের। এখন গালের ওপর এত্ত বড় কবুতর নিয়ে হাঁটবো কি করে? অতিকষ্টে গালজোড়া স্ফীত করে বললাম,
‘দারুণ হয়েছে নিলোভাচ। সুন্দর লাগছে। একদম জীবন্ত! আমি এই কবুতর নিয়ে এখন হাঁটবো, ঘুরবো, ছবি উঠাবো। রাতে ঘুমাবো।’
ভাসেলজেভিচ সার্ব ভাষায় তাকে অর্থ করে শুনালো। আর্টিস্ট খুশি। ভেতরে আমি যে রেগে মহাশয় হয়ে আছি, ওরা কেউ টেরই পেলো না। ভাসেলজেভিচের মোবাইলে ছবি তুলে রাখলো।
আমি তখনো আর্টিস্টের ছোট্ট টুলে বসা। চোখ বন্ধ করতে বললো আবার। তাই করলাম। গালে আরেকটা ছোঁয়া। খুশি হবার কারণ নেই। বালিকার হাতের ছোঁয়া না। একটা ফেসিয়াল টিস্যুর আলতো ছোঁয়া। নিলোভাচ ছাড়া আর কে হবে? চোখ খুলি দুই মিনিট পর। আবার সামনে আয়না। এবার অবাক হবার পালা। আমার গাল আগের মতোই ধবধবে। কোনো পেইন্টিং নেই, নেই রঙের কোনো ছোঁয়া। ভাসেলজেভিচের দিকে তাকাই,
‘বডিওয়াশ, লোশন বা শ্যাম্পু মেখে খসখস করে পেইন্টিং তুলতে হতো- তাই ভাবছিলে?’
ঘাড় নেড়ে তাই বলি, ‘হ্যাঁ।’ এই যে টিস্যুর ছোঁয়ায় সব উবে গেলো- এটাই নিলোভাচের বিশেষত্ব। মনে মনে বলি, তোমারে নিয়ে গিয়ে গুলিস্তান মোড়ে বসিয়ে দেবো। মুখে বলি,
‘অভিভূত হয়েছি। ধন্যবাদ তোমাকে।’
সামনে এগোই। ভাসেলজেভিচের শখ ছবি আঁকা। সার্বিয়ার চিত্রশিল্পের ইতিহাসে তার পাণ্ডিত্য ভালোই। সার্বিয়ান পেইন্টিংয়ে এবিডেরমেয়ার ও নিওক্ল্যাসিসিজমের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে কনস্ট্যান্টিন ড্যানিল, আর্সেনিজে তেওডোরোভিচ এবং পাভেল দুরকোভিচের কাজগুলোতে। অনেক চিত্রশিল্পী তাদের পেইন্টিংয়ে ১৯ শতকের রোমান্টিসিজমের শৈল্পিক প্রবণতাও অনুসরণ করেন। ২০ শতকের প্রথম দিকে সার্বিয়ান চিত্রশিল্পীদের মধ্যে রয়েছে বাস্তববাদের প্রভাব। বাস্তববাদী চিত্রশিল্পীদের মধ্যে অন্যতম হলো পাজা জোভানোভিচ এবং উরোস প্রেডিক, কিউবিস্ট সাভা সুমানোভিচ, মিলেনা পাভলোভিচ-বারিলি। আনাস্তাস জোভানোভিচ ছিলেন বিশ্বের প্রথম দিকের ফটোগ্রাফারদের একজন। তিনি একজন সার্ব ফটোগ্রাফার। পাইরোট কার্পেট সার্বিয়ার একটি ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প।
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পাওয়া পাঁচটি সাংস্কৃতিক স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে সার্বিয়াতে। এগুলো হলো প্রাথমিক মধ্যযুগীয় রাজধানী স্টারি রাস এবং ১৩শ শতাব্দীর মঠ সোপোকানি; ১২ শতকের স্টুডেনিকা মঠ; গামজিগ্রাদ-ফেলিক্স রোমুলিয়ানার রোমান কমপ্লেক্স; মধ্যযুগীয় সমাধি পাথর স্টেচি এবং কসোভোতে বিপন্ন মধ্যযুগীয় স্মৃতিস্তম্ভ।
হাঁটতে হাঁটতে গাছের তলায় এসে দাঁড়াই। ভ্যানেটি ব্যাগ থেকে সে সিগারেট বের করে। আমার দিকেও বাড়িয়ে দেয় একটা। সিগারেটের ধোঁয়ায় তার সাদা দাঁত আড়ালে পড়ে যায়। বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বিড়ির প্রচলন কেমন? অদ্ভুত প্রশ্নে হাসি লাগে, হাসে সেও। তার হাসিতে ফিরে আসি প্রীতি জিনতায়। ভারতীয় মুভি বিশ্বসেরা- বলি তাকে। সে মজার একটি তথ্য জানায়,
‘পৃথিবীর আর যেখানে যাই হোক, সার্বিয়ান মুভিতে কোনো সেন্সরশপ পাবে না। এমন কোনো বিষয় বা দৃশ্য নেই যা তারা ক্যামেরায় তুলে ধরতে পারে না। সেলুলয়েডে গল্প বলার ক্ষেত্রে সার্বিয়ান পরিচালকরা পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেন।’
আমার বিস্ময় বুঝতে পারে সে।
‘চলো একটা সিনেমা দেখে আসি!’
শব্দ করে হেসে উঠি দুজন।
সার্বিয়াতে থিয়েটার ও সিনেমা প্রায় সমানভাবে জনপ্রিয়। কয়েক বছর আগেও তরুণ ও মধ্যবয়স্করাও বুঁদ হয়ে থাকতো থিয়েটার ও সিনেমায়। তবে এখন সময়টা সিনেমার। সার্বিয়ার থিয়েটার ও নাট্য ঐতিহ্যের রয়েছে সমৃদ্ধ ধারা। জোয়াকিম ভুজিচকে বিবেচনা করা হয় আধুনিক সার্বিয়ান থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। সার্বিয়াতে ৩৮টি পেশাদার থিয়েটার এবং শিশুদের জন্য রয়েছে ১১টি থিয়েটার। বেলগ্রেড ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল- বিআইটিইএফ, বিশ্বের পুরনো থিয়েটার উৎসবগুলোর একটি। ১৯৬৭ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে এই ফেস্টিভ্যাল। ইউরোপের যে পাঁচটি শহরে বড় উৎসব হয়, তার একটি এই বেলগ্রেডে। জাতীয় নাটক প্রদর্শনের বড় উৎসব হলো রিজিনো পোজোর্জে।
পকেটে হাত ঢুকাই, যে ঠাণ্ডা। কথা শুনি। মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তার মিষ্টি হাসি।
সার্বিয়ান সিনেমার যাত্রা শুরু হয় ১৮৯৬ সালে। প্রথম সার্বিয়ান ফিচার ফিল্ম, দ্য লাইফ এন্ড ডিডস অব দ্য ইমর্টাল লিডার কারাডোরড মুক্তি পায় ১৯১১ সালে। সার্বিয়ার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচুর ভর্তুকি দেয় সরকার। দেশে ২৩টি চালু সিনেমা হল রয়েছে, যার মধ্যে ১৩টি মাল্টিপ্লেক্স। এদের মধ্যে দুটি ছাড়া সবই সিনেপ্লেক্স বা সিনেস্টার চেইনের অন্তর্গত। সার্বিয়ার জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভ বিশ্বের পাঁচটি বড় ফিল্ম আর্কাইভের একটি। বিখ্যাত সার্বিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা আমির কুস্তুরিকা কান চলচ্চিত্র উৎসবে এ পর্যন্ত দুটি পাম ডি’অর জিতেছেন।
সার্বিয়ায় সেন্সর বোর্ড নেই- এটাই মাথায় ঘুরতে থাকে। আমাদের দেশে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড’ নামে একটা সংস্থা আছে। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির লক্ষ্যে বাংলাদেশে যেসব ছবি নির্মিত হয়, সেগুলো প্রদর্শনের অনুমতি দেয় রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন কারণে সিনেমা প্রদর্শনের অনুমতি বাতিলের এখতিয়ারও রাখে তারা। তবে নানাভাবেই সমালোচনা এই প্রতিষ্ঠানের নিত্যসঙ্গী। সরকারি আমলা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে গঠিত এই বোর্ড। তবে বরাবরই চিত্র সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সিনেমা বোঝেন না, এমন অনেকেই সেন্সর বোর্ডে নিয়োগ পান।
এসব কথা চেপেই রাখি। ভাসেলজেভিচের কাছে গর্ব করি বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে। এই যে, ২০০২ সালে কানের প্যারালাল বিভাগের ‘ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট’-এ মনোনয়ন পেয়ে পুরস্কার জিতেছিল তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’। আর ২০২১ সালের ৭৪তম আসরে তরুণ পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ স্থান করে নিয়েছে বিশ্ব সেরাদের তালিকায়। অবশ্য কান উৎসবে বাংলার অর্জন শুরু দেশ স্বাধীনেরও আগে। ১৯৫৪ সালে ঢাকার ছেলে বিমল রায়ের হাত ধরে বিশ্ব সিনেমা জগতে বাংলার আনাগোনা শুরু। সেই বছর বিমলের সিনেমা ‘দো বিঘা জমিন’ প্রথমবারের মতো বাঙালির হয়ে আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে। ১৯৫৬ সালে উৎসবে সাড়া ফেলেন সত্যজিত রায়। তার ‘পথের প্যাচালী’ পায় সেরা মানবিক দলিলের স্বীকৃতি। এর পর থেকে কান চলচ্চিত্র উৎসবে বলা যায় নিয়মিতই ছিলেন সত্যজিৎ। ১৯৮০ সালে মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে মৃণাল সেনের ‘একদিন প্রতিদিন’ প্রদর্শিত হয়। ১৯৮৩ সালে ‘জুরি প্রাইজ’ জেতে মৃণাল সেনের ‘খারিজ’। মৃণাল সেনের পর কানে ‘অন্তর্জাল’ আর ‘গুড়িয়া’ নিয়ে হাজির হন গৌতম ঘোষ। ফ্রান্সের এই মর্যাদাপূর্ণ উৎসবে ২০১৮ সালে ‘আঁ সার্তে রিগার্দ’ বিভাগে নন্দিতা দাশ অংশ নেন তার ‘মান্টো’ নিয়ে।
কফি বিরতির সময় শেষ, পা বাড়াই গাড়ির দিকে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়