করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

ক্যাসিনোর শহর ম্যাকাউ

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আকাশে আমার অনেক ভয় লাগে। এখানে কোনো সার্ভিস স্টেশন বা গ্যারেজ নেই। বিমানের টুকটাক সমস্যা হলে রাস্তায় একটু সারিয়ে নেয়া বা স্ক্রুটা একটু টাইট দিয়ে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই ভয় হতে বাঁচার একমাত্র বুদ্ধি হলো বিমানে চড়েই ঘুমিয়ে পড়া। আমি নিষ্ঠার সাথে এ কাজটি করি।
আমার যখন ঘুম ভাঙলো তখন ড্রাগন এয়ারের সুপরিসর বিমানটি হংকংয়ের আকাশ ঢেকে রাখা মেঘমালা পেরিয়ে নিচে নামতে শুরু করেছে। আমি জানালার পাশে বসেছি বলে সাগর আর পাহাড়ের বন্ধুত্বটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। প্রতি মুহূর্তেই মাটির পৃথিবীটা আমাদের কাছে চলে আসছে। আমার মনে হচ্ছে, এখান থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়লে কোনো অসুবিধা হবে না। ছোটবেলায় গাছের ডাল থেকে কতই না পুকুরে লাফিয়ে পড়েছি। আমাকে বিমান হতে লাফিয়ে নামার সুযোগ না দিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই ড্রাগন হংকংয়ের মাটিতে চাকা ছোঁয়ালো। আমরা বাক্সপেটরা নিয়ে বাইরে এসে দেখি তাইসির আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমরা হংকং হয়ে ম্যাকাউ যাবো। এটা জেনে তিনি এসেছেন আমাদের সাথে দেখা করতে। আমরা তাকে ধন্যবাদ জানালাম। তাইসির প্রায় বছর চারেক হলো, এখানে কাজ করতে এসেছেন। চলার পথে তিনি হংকং সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটা পরিচিতি জানিয়ে দিলেন আমাদের।
এখান থেকে ম্যাকাউ যেতে হয় ফেরি দিয়ে। এখানে বিভিন্ন যানের ফেরি আছে। প্রায় ৬৪ কিলোমিটারের দূরত্ব অতিক্রম করতে কমপক্ষে এক ঘণ্টা লাগে। কোনো কোনো ফেরিতে আরো বেশি সময় লাগে। ফেরিঘাটে যাওয়ার আগে আমরা উৎসাহী চোখে একটু হংকং দেখে নিচ্ছি অনেকটা ফাউ স্টাইলে। আমাদের এ আগ্রহ দেখে তাইসির আমাদেরকে নিয়ে গেলেন হংকং পিক বা হংকং শীর্ষে। সেখান থেকে পুরো শহরটা এক নজরে দেখা যায়। এখানে শহরের ভেতরে ভেতরে বিশাল বিশাল পাহাড়। আর এসব পাহাড়ের গায়ে লাগিয়ে তৈরি হয়েছে বহুতল ভবনগুলো। পঞ্চাশ তলা বা আরো অধিক উচ্চতার এসব ভবন পাহাড়ের সামনে মাথা উঁচু করতে পারেনি। এগুলোকে অনেকটা হোমিওপ্যাথির শিশির মতো বাবু বাবু লাগে। আমরা হংকং শীর্ষে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম, চারদিকের কিছু ছবি তুলে নিলাম। তারপর সেখানেই সকালের নাশতা সেরে ফেরিঘাটের দিকে রওনা হলাম।
হাজার হাজার মানুষ এই ফেরিঘাট ব্যবহার করে ম্যাকউ যাতায়াত করেন। এখানে প্রচণ্ড ভিড়। সবাই যে যার মতে দৌড়াচ্ছেন। আমরাও ভারী স্যুটকেস নিয়ে দৌড়ালাম। প্রথমেই গেলাম টিকেট কাউন্টারে। সেখানে গিয়ে দেখি ইকোনমি ক্লাসের টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। তবে কালোবাজারিদের হাতে টিকেট আছে। তারা ১৭০ হংকং ডলার দামের টিকেট ২০০ ডলারে বিক্রি করছে। কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়েই ওরা টিকেট বিক্রির জন্যে হাঁকডাক শুরু করেছে। অন্যদিকে সুপার ক্লাসের টিকেট কাউন্টারেই পাওয়া যাচ্ছে। টিকেটের দাম ৩৩০ ডলার; অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। আমরা সবাই সুপার ক্লাসের টিকেট কিনে নিলাম। তখন সময় সাড়ে ১১টা। ফেরি ছাড়বে পৌনে ১২টায়। আমরা আবারো দৌড়ালাম। কিন্তু প্রবেশ কাউন্টারের সামনে গিয়ে দেখি অনেক বড় লাইন। এই সুদীর্ঘ লাইন পেরিয়ে ১৫ মিনিটে ফেরিতে আরোহণ প্রায় অসম্ভব। রব আর কামাল ডিউটিরত কর্মীদেরকে আমাদের তাড়াহুড়োর কথা জানালেও তারা এটাকে গুরুত্ব দিল না। অগত্যা আমাদেরকে লাইনেই দাঁড়াতে হলো। প্রায় কুড়ি মিনিট পর আমরা কাউন্টার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। আমাদের টিকেট দেখে কর্মীরা আমাদেরকে সুপার ক্লাস ওয়েটিং রুমে বসে অপেক্ষা করতে বললো। তারা জানালো যে পনেরো মিনিট পর, অর্থাৎ ১২টায় আর একটি ফেরি ছেড়ে যাবে। আমাদেরকে সেই ফেরিতে যেতে হবে। যাক, সময় পার হয়ে গেলেও আমাদের টিকেট নষ্ট হয়ে যায়নি জেনে আমরা আনন্দিত হলাম।
কিছুক্ষণ পরই আমাদেরকে উঠতে হলো। আমরা ব্যাগ নিয়ে ফেরিতে চলে এলাম। ফেরিতে ঢোকার মুখে আমাদের টিকেটে সিট নম্বরযুক্ত স্টিকার লাগিয়ে দেয়া হলো। অল্পক্ষণ পরই ফেরি হংকং ঘাট ছেড়ে ম্যাকাউ-এর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল। এ সময় আমাদের মাঝে হালকা খাবার পরিবেশন করা হলো। আমরা ক্ষুধার্ত নই। কারণ কিছুক্ষণ আগেই হংকং শীর্ষ হতে আমরা নাশতা খেয়ে এসেছি। আমাদের মূল আগ্রহ ছিল সাগরের দিকে। আমাদের ফেরিটি ছিল খুবই দ্রুতগামী। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে এটি ম্যাকাউ ঘাটে পৌঁছে গেল। পথে আমরা বেশ কিছু ফেরি ও জাহাজকে অতিক্রম করে এসেছি। তাছাড়া সাগরের ভেতরে ভেতরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো দেখতে খুব ভালো লাগছিল। আকাশে তখন নানা ধরনের পাখিদেরও সমাবেশ ছিল। সব মিলিয়ে সাগর পাড়ি দেবার অভিজ্ঞতাটুকু চমৎকার।
ম্যাকাউ ফেরিঘাটে নেমে আমাদেরকে এম্বার্কেশনের লাইনে দাঁড়াতে হলো। ম্যাকাউতে প্রবেশের জন্যে পৃথিবীর বহু দেশের কোনো ভিসা লাগে না। কিন্তু বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের ক্ষেত্রে ভিসা লাগে। কাউন্টারে যারা বসেছেন তারা ধরেই নিয়েছেন যে আমাদের কারো ভিসা নেই। সম্ভবত বাংলাদেশিরা প্রায়শই ভিসা ছাড়া ম্যাকাউ যায়। সেক্ষেত্রে ২৫ ডলার ভিসা ফি আর ৭৫ ডলার জরিমানা, অর্থাৎ মোট ১০০ ডলার জমা দিয়ে ভিসা নিতে হয়। আমাদেরকেও তারা লাইন হতে আলাদা করার উদ্যোগ নিতে চাইলে আমি পাসপোর্টের ভিসার পাতাটি দেখিয়ে দিলাম। বাংলাদেশে ম্যাকাউ-এর দূতাবাস নেই। তাই গণচীনের দূতাবাস হতে ভিসা সংগ্রহ করতে হয়। আমরা এখানে আসার আগে ভিসা সংগ্রহের কাজটি করে এসেছি। এবার আমাদের প্রবেশাধিকার দেয়া হলো। আমরা বাইরে এসে সরাসরি বাসস্ট্যান্ডে চলে এলাম। আমরা যে হোটেলে সিট বুক করে এসেছি সেটির নাম পত্তসাদা মেরিনা ইনফানটে। তিন তারকা মানের এই হোটেলটি স্থানীয় লোকদের চেনাজানার মধ্যেই আছে। তাই এখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার জন্য কর্মীরা আমাদের পরামর্শ দিল। মিনিট দশেক পরই আমাদের হোটেলের সুদৃশ্য বাসটি এসে আমাদের সামনে থামলো। আমরা সবাই বাসে ওঠারও দশ মিনিট পর বাসটি শহরের উদ্দেশে রওনা হলো।
ম্যাকাউ সুন্দর শহর। সাগর পাড়ের এই শহরে অনেক অনেক আকাশচুম্বী দালান। এখানকার প্রধান আকর্ষণ জুয়া। প্রতিটি হোটেলেই বিশাল বিশাল ক্যাসিনো। সারা দুনিয়া হতে জুয়ারিরা এখানে আসে মনের সুখে জুয়া খেলার জন্য।
হংকং এবং ম্যাকাউ গণচীনের অন্তর্গত দুটো পৃথক প্রশাসনিক এলাকা। পার্ল নদীর বদ্বীপ এলাকা এই ম্যাকাউ। এর পশ্চিমে পার্ল নদী, পূর্বে হংকং। তাছাড়া এর উত্তরে গোয়াংডং রাজ্য এবং দক্ষিণ ও পূর্বে দক্ষিণ চীন সাগর। দেশের অর্থনীতি প্রধানত জুয়া খেলার উপর নির্ভরশীল। তবে বর্তমানে কিছু কিছু উৎপাদনমুখী শিল্পও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া গণচীনের মূল ভূখণ্ড হতে প্রতিদিন এখানে হাজার হাজার মানুষ বেড়াতে আসেন বলে পর্যটন খাতেও দেশের আয় উল্লেখ করার মতো।
ম্যাকাউ একসময় পর্তুগিজদের উপনিবেশ ছিল। এরা মূলত জলদস্যু হিসেবে পরিচিত ছিল। পর্তুগিজ সৈন্যরা জলপথে যুদ্ধে খুব পটু ছিল বলে বিশ্বব্যাপী দ্বীপ বা সাগরপাড়ের সমৃদ্ধ স্থানগুলো ছিল এদের দখলে। তখন ভারতবর্ষের গোয়া আর মালয়েশিয়ার মালাক্কা ছিল পর্তুগিজদের উপনিবেশ। ১৫৫০ সালে প্রথম পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা ম্যাকাউ আসেন ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে। ১৯৫৭ সালে চীনদেশের তৎকালীন রাজা ব্যবসা কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে পর্তুগিজদের নিকট ম্যাকউ এলাকা ইজারা দেন। তখন হতে ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত চীনের অধীনতা মেনেই পর্তুগিজরা ম্যাকাউ-এর প্রশাসন পরিচালনা করে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ম্যাকাউ-এর জনসংখ্যা ছিল ২৭ হাজার, যার মধ্যে পর্তুগিজদের সংখ্যা ২ হাজার এবং ক্রীতদাসের সংখ্যা ৫ হাজার জন। এখানে ব্যবসায়ের পরিধি বাড়াবার জন্য আরো পর্তুগিজ মানুষকে বসবাসের অনুমোদন চাইলে চীন তা নাকচ করে দেয়। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ কাজে লাগিয়ে ১৮৪০ সালে পর্তুগিজরা চীনের সাথে একটা চুক্তি করতে সক্ষম হয় এবং ম্যাকাউকে তাদের উপনিবেশে পরিণত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি নিরপেক্ষ বন্দর হিসেবে ম্যাকাউ চিহ্নিত ছিল। কিন্তু জাপানিরা পরে এর কূটনৈতিক দখলদারিত্ব দাবি করে। জাপানি যুদ্ধ জাহাজের কাছে জ্বালানি বিক্রির প্রতিবাদে মার্কিনিরা ১৯৪৫ সালের ১৬ জানুয়ারি বোমা ফেলে ম্যাকাউর বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। পরে অবশ্য এর ক্ষতিপূরণ বাবদ তাদেরকে দুই কোটিরও বেশি মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হয়। এ পর্যায়ে গণচীনের যুদ্ধ-উদ্বাস্তুদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহৃত হয় ম্যাকাউ।
১৯৪৯ সালে চীনের স্বাধীনতা লাভের পর ম্যাকাউ-এর অসম চুক্তি তারা বাতিল করে দেয়। এ নিয়ে দুপক্ষের দর কষাকষির পর ১৯৭৬ সালে ম্যাকউকে অস্থায়ীভাবে চীনের অধীন এবং পর্তুগিজদের দ্বারা শাসিত একটি এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ১৯৯৯ সালের ২০ ডিসেম্বর ম্যাকউকে পুরোপুরিভাবে চীনের অধীনে একটি বিশেষ প্রশাসনিক এলাকায় পরিণত করা হয়। তখন হতেই ম্যাকাউ-এর অর্থনীতি দ্রুত উন্নত হতে শুরু করে। এর পেছনে ছিল চীনের মূল ভূখণ্ডের মানুষদের ম্যাকাউ ভ্রমণ আর নতুন নতুন ক্যাসিনো নির্মাণ।
আমরা যখন হোটেলে পৌঁছলাম তখন দুপুর দুটো। আমরা এখানে এসেছি একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে। যারা হংকং হয়ে জাহাজযোগে এসেছি তারা তো একসাথেই এলাম। আমাদের দলে আরো দুজন যোগ দেবেন। তাদের একজন থাইল্যান্ড হয়ে সরাসরি বিমানে ম্যাকাউ আসবেন। আর একজন আসবেন লন্ডন থেকে। তিনিও বিমানে চড়ে সরাসরি এখানে আসবেন। বিকালের মধ্যে অন্য দুজনও এসে পৌঁছলেন। অর্থাৎ আমরা এখন পরিপূর্ণ টিম।
একটু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধের পর আমরা বেরোলাম। উদ্দেশ্য আশপাশে বিষয়াদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ আর রাতের খাবার গ্রহণ। আমাদের হোটেলের ঠিক উল্টোদিকেই আছে গ্যালাক্সি। এটি একটি সুবৃহৎ হোটেল। এখানে তিনটি বিশালাকার টাওয়ার সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে, পাশে আরো ক’টি টাওয়ারের নির্মাণ কাজ চলছে। পুরো এলাকাটি রীতিমতো উজ্জ্বল করে আলোক প্রক্ষেপণের কাজটি করছে গ্যালাক্সি। এর প্রতিটি টাওয়ারের শীর্ষভাগ ঘুর্ণায়মান। রংবেরংয়ের বাতিগুলোও ঘুরছে। গ্যালাক্সির নিচতলায় বিশাল এলাকাজুড়ে আছে আকর্ষণীয় ক্যাসিনো। বিশ্বের বহু দেশ হতে মানুষ এখানে এসে জুয়া খেলে যায়। আবার ক্যাসিনো হতে বেরিয়ে আসার পথের দুপাশে রয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সব ব্র্যান্ডের পণ্যসামগ্রীর দোকান। জুয়াতে কেউ জিতে বেরিয়ে যাবার সময় যাতে মনের সুখে আন্তর্জাতিক মানের জিনিসপত্র অনেক দাম দিয়ে কিনতে পারে সেজন্য এ ব্যবস্থা। এছাড়া এখানে আছে রেস্টুরেন্ট, ফুড কোর্ট, কনভেনশন সেন্টার ইত্যাদি। পুরো কমপ্লেক্সের স্থানে স্থানে নানাবিধ আকর্ষণীয় বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। একস্থানে রয়েছে জলপ্রপাত। এ জলপ্রপাত আবার একবার উপরে উঠে, একবার নিচে নেমে আসে। গ্যালাক্সির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো এর পরিবহন ব্যবস্থাপনা। এর চারদিক হতে অনেকগুলো বাস শহরের বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়, আবার ফিরে আসে। এসব বাসে চড়তে কোনো টাকা বা পয়সা লাগে না। যে কেউ দিন-রাত যে কোনো সময় গ্যালাক্সির বাসে চড়ে ম্যাকাউ-এর যে কোনো স্থানে যেতে পারে বা এখানে আসতে পারে। আমরা এখানে একটি খাবরের দোকানে বসে রাতে খাবার খেয়ে নিলাম।
পরদিন সকাল হতেই আমাদের সম্মেলন শুরু। আমরা সবাই খুব সকালে উঠেই চলে গেলাম শেরাটন হোটেলে। শেরাটন একটি চেইন হোটেল। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই শেরাটনের শাখা আছে। ম্যাকাউর এই শেরাটন হোটেলটি পৃথিবীর সকল শেরাটনের মধ্যে বৃহত্তর। এখানে বেশ ক’টি বড় বড় টাওয়ার আছে। নিচতলায় সুবৃহৎ ক্যাসিনো তো আছেই। এই হোটেলের বাসিন্দা বা আগত মানুষের সংখ্যা এতই বেশি যে নিচতলাকে সব সময়ই একটা ব্যস্ততম বাজার বলে মনে হয়। দক্ষিণ ভবনের পঞ্চম তলায় আমাদের সম্মেলন হবে। আমাদের পুরো দিন কেটে গেল এই সম্মেলনে।
বিকাল ৪টায় সম্মেলন শেষে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। ঝটপট কাপড়-জামা বদল করে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম অজানার সন্ধানে। ঘুরতে ঘুরতে আমরা গিয়ে ঢুকলাম ‘ভেনিসিয়া ম্যাকাউ’ নামক আর এক সাম্রাজ্যে। বহুতল ভবনের নিচতলায় রয়েছে ক্যাসিনো। এ ভবনের তিনতলায় শপিং মল আর ফুডকোর্ট। এর উপরে আছে কনভেনশন সেন্টার আর হোটেল। আমরা তিন তলার শপিং মলে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। এখানে ইতালির ভ্যানিস নগরীর সবটুকু সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্য তুলে এনে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখানে চমৎকার একটি নদী। নদীতে রংবেরংয়ের নৌকা যাত্রী নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। ভ্যানিসেও ঠিক এমন নদী আছে। নদীর দুপাড়ে দোকানপাট। পায়ে হাঁটার রাস্তা। মাঝে মাঝে খালগুলো পাড় হবার জন্য উঁচু করে বানানো ব্রিজ। এ ব্রিজের নিচ দিয়ে নৌকা চলে। এখানকার সুন্দর নৌকাগুলোর নাম গন্ডুলা। চমৎকার পোশাক পরে সেজেগুজে আধুনিক মাঝিরা এসব নৌকা চালায়।
এখানে কৃত্রিমভাবে নদী, আকাশ সব বানানো হয়েছে। নদীতে যাত্রী নিয়ে গন্ডুলা চলছে। এখানে গান গাইতে গাইতে মেয়েরাও নৌকা চালাচ্ছে। নদীর দুপাড়ে সুন্দর রেলিং, মাঝে মাঝে ভ্যানিস ডিজাইনের উঁচু ব্রিজ। নদীর দুপাড়ে নানা ধরনের দোকানপাট। বিশ্বের সব নামকরা পণ্য সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে এসব দোকানে। আর বেশ উঁচু একটা ছাদকে আকাশ বানানো হয়েছে। আকাশে বিকালের আলোকচ্ছটা উদ্ভাসিত। মেঘগুলো ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানে একবার ঢুকলে আর বেরোতে ইচ্ছে করে না। তাছাড়া যারা ভ্যানিস ভ্রমণ করেছেন এবং হৃদয়ে ভ্যানিসের সৌন্দর্য ধারণ করে আছেন তাদের জন্য তো কথাই নেই।
আমরা অনেকক্ষণ ধরে এখানে ঘুরে বেড়ালাম, নানা জায়গায় ছবি ওঠালাম। ছবি তোলার ক্ষেত্রে সবারই আগ্রহ প্রচুর। সুন্দর সুন্দর সবগুলো স্থানেই ক্যামেরার শাটার পড়ছিল। রাত আটটার দিকে আমরা একটা ভারতীয় রেস্টুরেন্টের সামনের খোলা জায়গায় বসলাম। আকাশে তখন মেঘরাজি সদর্পে ঘোরাঘুরি করছে। গতকালই কামাল বলছিল পেরুর কথা। পেরুর আকাশ সব সময় মেঘাচ্ছন্ন থাকে, কিন্তু কখনো বৃষ্টি হয় না। এই কৃত্রিম ভেনিসিয়ার আকাশে যতই মেঘ ঘুর ঘুর করুক না কেন, এখানেও বৃষ্টি হবে না।
পরদিন সোমবার বাংলাদেশ টিম একেবারেই ফ্রি। আজ আমরা যেখানে ইচ্ছে সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারি। হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় আমরা পাঁচ ঘণ্টার জন্যে একটি গাড়ি ভাড়া করে ফেললাম শহর দেখার জন্যে। রাতে অনেক গবেষণা করে ম্যাকাউ-এর দর্শনীয় স্থানগুলো চিহ্নিত করেছি। এগুলো ঘুরে ঘুরে দেখবো। দশ সিট বিশিষ্ট এসব মাইক্রো বাসের ভাড়া ঘণ্টায় ৩০০ এমওপি। এমওপি হচ্ছে ম্যাকাউ-এর মুদ্রার নাম। প্রতিটি এমওপির মূল্য বাংলাদেশি টাকায় প্রায় দশ টাকা। এসব মাইক্রো বাসে দুই ধরনের ড্রাইভার পাওয়া যায়। এদের বেশিরভাগ হলো ইংরেজি ভাষা না জানার দলে। এসব ড্রাইভার শুধু চীনা ভাষা জানে। আর বাকি মুষ্টিমেয় কিছু ড্রাইভার চীনা ভাষা ছাড়াও ইংরেজি জানে। এসব ইংরেজি জানা ড্রাইভার পেতে হলে সেজন্যে ঘণ্টায় আরো ১০০ এমওপি অতিরিক্ত গুনতে হয়। আমরা ইংরেজি জানা ড্রাইভার প্যাট্রিসকে ভাড়া করায় আমাদের ঘণ্টায় দিতে হবে ৪০০ এমওপি।
দুপুরের পর পর প্যাট্রিস আমাদেরকে নিয়ে রওনা হলো। চলার পথে ইংরেজি জানা ড্রাইভার প্যাট্রিস যে ইংলিশ আমাদের কর্ণকুহরে বর্ষণ করতে শুরু করলো তা শুনে আমরা তো হতবাক। এ রকম চাঁছাছোলা ইংলিশ জীবনে আর কোথাও শুনিনি। ওর প্রতিটি বাক্য বুঝতে কমপক্ষে ১০ মিনিট গবেষণা করতে হয়। এগুলোকে চীনা ভাষার চেয়েও দুর্বোধ্য বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু এর দামই কত আকাশচুম্বী! প্যাট্রিসকে ঘণ্টায় ১০০ এমওপি দিতে হবে, তার মানে বাংলাদেশি টাকায় এর দাম পড়বে ঘণ্টায় এক হাজার টাকা। বাংলাদেশে যারা কোচিং সেন্টার খুলে ইংরেজি পড়ান তারাও ঘণ্টায় এক হাজার টাকা পান কিনা সন্দেহ! প্যাট্রিসকে প্রথমত ইংরেজি গেলানোর জন্য অনেক খাটতে হয়। প্রশ্নটি গেলানোর পর এর জবাব উপড়ানোর জন্য বেচারা ইংরেজি শব্দ খুঁজতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সে ইংরেজি নামক যে ভাষাটি ছাড়ে তাা বুঝে নিতেও আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়। প্যাট্রিসের পাশের সিটে বসেছে আমাদেরই একজন। আমি তাকে বললাম, এক মিনিটের জন্যেও থামবে না। ওর ইংরেজি জ্ঞান কেনা হয়েছে সাড়ে ১৬ টাকা মিনিট দরে। অর্থাৎ ২৭ পয়সা সেকেন্ড। সুতরাং নানা প্রশ্ন করতে থাক, আবোল-তাবোল যা ইচ্ছে ও বলে যাক। কোনো অবস্থাতেই ওকে চুপ করে থাকতে দেয়া উচিত হবে না। তাহলে এটা বাংলাদেশের জন্যে আর্থিক লোকসান বলে বিবেচিত হবে।
প্যাট্রিস আমাদেরকে প্রথমেই একটা সৈকতে নিয়ে গেল। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে যারা জীবনে একবারও গিয়েছেন তাদের কাছে এই ম্যাকাউ সমুদ্র সৈকতটি হোমিওপ্যাথির ছোট্ট শিশির মতো মনে হবে। এখানে সামান্য একটু জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে সৈকত। তীর হতে প্রায় ১০০ গজ জায়গা রশি দিয়ে চিহ্নিত করে দেয়া আছে, এটুকু সাঁতারের জন্যে নিরাপদ। এখানকার সৈকতটি যেমন ছোট, আগত মানুষের সংখ্যাও কম। যারা এসেছে তাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা বেশি। আমাদের মধ্যেই কেউ একজন এর কারণও বের করে ফেলল। তার মতে শিশুদের নিয়ে তো ক্যাসিনোতে ঢোকা যায় না, তাই শিশুদের নিয়ে মায়েরা চলে আসেন সি-বিচে। আমরা এখানে কিছু ছবি তুলে ফিরে এলাম গাড়িতে।

এ-মা মন্দির
এরপর আমরা ম্যাকাউয়ের প্রাচীনতম স্থাপনা এ-মা মন্দির দেখতে গেলাম। বাইরে থেকেই এই মন্দিরের আভিজাত্য সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। এটি নির্মিত হয়েছিল ১৪৮৮ সালে। মন্দিরটি সমুদ্রযাত্রী ও মৎস্যজীবীদের দেবতা মাতসুকে উৎসর্গীকৃত। ম্যাকাউ নামটিও এ মন্দিরের নাম হতেই এসেছে বলে জানা যায়। পর্তুগিজরা সাগরপথে এখানে এসে এই মন্দিরের সামনে জাহাজ হতে নেমে আসে। তারা স্থানীয় লোকজনের কাছে জায়গাটার নাম জানতে চায়। স্থানীয়রা তখন জবাব দেয় যে এই জায়গার নাম ‘এ-মা গাউ’। ‘এ-মা গাউ’ মানে হলো ‘এ-মা দেবতার গাউ’ বা ‘এ-মা দেবতার উপসাগর’। আর এই ‘এ-মা গাউ’ হতেই ‘ম্যাকাউ’ নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। প্রচলিত প্রাচীন উপকথা হতে জানা যায় যে, একটি গরিব মেয়ে একদিন ক্যান্টন যাওয়ার জন্য সাগরের পাড়ে উপস্থিত হলো। কিন্তু নিজের কোনো যানবাহন নেই। তাই সে ঘাটের নৌকা ও জাহাজ মালিকদেরকে অনুরোধ জানাল। যে সমস্ত নৌকা ও জাহাজ ক্যান্টন যাচ্ছে তাদের কেউই এই মেয়েটিকে সাথে নিতে রাজি হলো না। তখন একজন দরিদ্র মাঝি এগিয়ে এলো এবং তার ভাঙা ও ছোট নৌকায় মেয়েটিকে উঠিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর ঝড় এলো এবং সেই ঝড়ে সব জাহাজ ও নৌকা ডুবে গেল। কিন্তু সেই মাঝির ছোট নৌকাটির কিছুই হলো না। নৌকাটি যখন ঘাটে এসে ভিড়ল তখন গরিব মেয়েটি হাওয়ার সাথে মিশে গেল। অনুমান করা হয় যে এই মেয়েটিই সাগরসম্পৃক্ত বিপদ হতে রক্ষার দেবী। তাই নৌকাটি যে ঘাটে ভিড়েছিল সেখানেই এ-মা মন্দিরটি বানানো হয়েছে। তাছাড়া মন্দিরের উপরে এ-মা দেবীর একটি ভাস্কর্যও তৈরি করা হয়েছে।
এ মন্দিরটি মোট ছয়ভাগে বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে গেইট প্যাভিলিয়ন, মেমোরিয়াল আর্চ, প্রার্থনা হল, বেনোভুলেন্স হল ও বৌদ্ধ প্যাভেলিয়ন। ২০০৫ সালে মন্দিরটি ম্যাকাউয়ের ঐতিহাসিক কেন্দ্র ও ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ হিসেবে স্বীকৃত হয়। মন্দিরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে আমরা প্রাচীন ঐতিহ্যগুলো দেখে নিলাম এবং বেশ কিছু ছবি তুললাম।

মৎস্যজীবীদের ঘাট
ম্যাকাউয়ের আর একটি আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে মৎস্যজীবীদের ঘাট বা ফিসারম্যান’স ওর্য়্ফ।ে প্রাচীন আমল হতে এদেশের অর্থনীতিতে মৎস্যজীবীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি উদ্যোগে নির্মিত এই ঘাটটি ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর উদ্বোধন করা হয়। নির্মাণশৈলী ও আকর্ষণীয় স্থাপনার জন্যে এ স্থানটি একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, অ্যাম্পিথিয়েটার, কনভেনশন ও প্রদর্শনী কেন্দ্র, দোকানপাট এবং ক্যাসিনো রয়েছে এই কেন্দ্রে। সাগরের পাড় ঘেঁষে অনেকটুকু জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা এই কেন্দ্রে বসে সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মন নেচে উঠে। শ্বেতপাথরে বাঁধানো বিস্তৃত এ স্থানটুকুতে আমরা অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম এবং ফটো তুললাম। আশপাশে আমাদের মতোই আরো অনেক পর্যটক এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিকেলের দিকে আসতে পারলে এই স্থানটি আরো আকর্ষণীয় হতো। কিন্তু এখন প্রচণ্ড রোদ আমাদের মনোরঞ্জনের পথে একটু বাধা হয়ে দাঁড়ানোতে আমরা আবার ফিরে এলাম প্যাট্রিসের গাড়িতে।

সেন্ট পল চার্চ
সংক্ষিপ্তভাবে আরো দু-একটি দর্শনীয় স্থান আমরা দেখে নিলাম। এগুলোর মধ্যে মন্দির, জাদুঘর, ঐতিহাসিক ভবন ইত্যাদি রয়েছে। সবশেষে আমরা এলাম সেন্ট পল চার্চের ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য। এটিও ম্যাকাউয়ের একটি দর্শনীয় স্থান বলে বিবেচিত। ১৬০২ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এটা ম্যাকাউয়ে সবচেয়ে বড় খ্রিস্টান উপাসনালয়। কিন্তু ১৮৩৫ সালে আগুন লেগে এটি ধ্বংস হয়ে যায়। তবে রাস্তামুখী সামনের অংশের বড় তোরণটি এবং এর পেছনের প্রশস্ত সিঁড়িগুলো রয়ে যায়। এই চার্চটির একটি মজার ইতিহাস আছে। ১৬০২ সালে সেন্ট পল কলেজের সাথে সম্পৃক্ত ও সংযুক্ত করে গির্জাটি তৈরি করা হয়। এটি ছিল খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী পুরোহিতদের জন্য পাশ্চাত্য ধারার প্রথম কলেজ। প্রখ্যাত মিশনারি, যেমন ম্যাথিও রিচি ও অ্যাডাম শ্যাল এই কলেজে চীনা ভাষায় পড়াশোনা করেন। তারপর তারা চীনদেশের বেজিংএরমিং কোর্টে নক্ষত্রবিদ ও গণিতবিদ হিসাবে কাজ করেন। গির্জাটি বানানো হয়েছিল কাঠ দিয়ে এবং এটি চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছিল। গির্জার সামনে ব্যবহৃত পাথরটি জাপানের খ্রিস্টান শিল্পীদের দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। জাপানে খ্রিস্টধর্ম উঠে যাবার পর এই শিল্পীরা শরণার্থী হিসেবে এখানে আসেন। উল্লেখ্য, খ্রিস্টধর্মের অনুসারী পুরোহিত কার্লো স্পিনোলার নির্দেশে তৈরি হয়েছিল।
পরে সরকারি উদ্যোগে গির্জাটি হতে পুরোহিতদের বের করে কলেজটি সৈন্যদের ব্যারাক হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। ১৮৩৫ সালে গির্জাটি পুড়ে গেলেও সামনের অংশটি বেঁচে যায়। এতে চারটি অংশ লক্ষ্য করা যায় যাতে রয়েছে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও খোদাই। এসব থেকে তখনকার আমলের এশীয় চার্চগুলোর কথা জানা যায়। উল্লিখিত অংশগুলোর প্রথমটিতে কুমারী ও সাধুদের ভাস্কর্য রয়েছে। দ্বিতীয় অংশে স্বর্গীয় বাগান দেখা যায়। তৃতীয় অংশে রয়েছে এনজেল, ডেভিল, চিনা ড্রাগন, জাপানি ক্রিসেনথিমাম ও পর্তুগিজ পালতোলা জাহাজ। সবশেষে চতুর্থ অংশে রয়েছে চীনা ভাষায় লেখা কতগুলো সাবধানবাণী।
গির্জার সামনের অংশটি দেখলে মনে হয় যেন এটি এক্ষুণি ভেঙে পড়বে। কিন্তু এটি ইস্পাত দিয়ে তৈরি বলে যথেষ্ট মজবুত। ১৯৯৫ সালে পেছনের দিকে একটি জাদুঘর তৈরি করা হয়েছিল। এতে পবিত্র বলে বিবেচিত চিত্রকর্ম, ছবি আর মূর্তি রয়েছে। তাছাড়া সেখানে একটি সমাধিঘর রয়েছে যেখানে জাপানি ও ভিয়েতনামি শহীদদের কবর আছে।
মূল গেটের পর অনেকগুলো প্রশস্থ সিঁড়ি ধাপে ধাপে নিচে নেমে গেছে। আমরা এসব সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ফটো তুলে নিলাম। আবার এসব সিঁড়িতে অনেকে বসে গল্পগুজব করছেন দেখে আমরাও কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিলাম। সিঁড়ির ধাপগুলো অনেকদূর নেমে গেছে। নিচে একটা ছোট গলি দেখা যাচ্ছে। ওখানে কী আছে দেখার জন্য আমরা সিঁড়ির নিম্নমুখী ধাপগুলো পেরিয়ে নিচে নামলাম। গলির ভেতরে চমৎকার একটি মার্কেট। নানারকম মজার মজার জিনিসপত্রে ঠাসা এখানকার দোকানগুলো। ঢোকার মুখে অনেকগুলো বেকারি। এরা বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট ও কেক বিক্রি করে। তবে এদের দোকানগুলোর প্রধান আকর্ষণ এক ধরনের পর্তুগিজ বিস্কুট। বিক্রেতারা বাইরে দাঁড়িয়ে এসব বিস্কুট বেচার জন্য হাঁকডাক করছে, স্বাদ গ্রহণ করার জন্য বিনামূল্যে বিস্কুট খাওয়াচ্ছে। আমরা ঘুরে ঘুরে সব দোকান হতেই বিনামূল্যে বিস্কুট খেয়ে স্বাদ গ্রহণ করলাম। আমাদের বিকেলের নাশতাটা বিনামূল্যেই হয়ে গেল। দলের কেউ কেউ সামান্য কিছু বিস্কুট কিনেও নিল। এটা প্রয়োজনেই হোক, আর বিনামূল্যে খাবার গ্রহণের খেসারত হিসাবে লজ্জার খাতিরেই হোক। এ মার্কেট হতে আমরা আরো কিছু শোপিস কিনে নিলাম। এদিকে আমার প্রথম নাতির জন্ম আসন্ন। একটি দোকানে আমি একটি চমৎকার ঝুনঝুনি পেয়েছি। এটিতে বেশ কতগুলো ঘোড়া সওয়ারসহ চারদিকে ঘুরে আর মিষ্টি একটা বাজনা বাজে। আমি এটি আমার অনাগত নাতির জন্য কিনে নিলাম।
সন্ধ্যের পর আমরা ফিরে চললাম হোটেলের দিকে। তখন ফেরদৌস স্যার ঘোষণা দিলেন যে আজ তিনি আমাদেরকে একটা ভারতীয় রেস্টুরেন্টে খাওয়াবেন। তার কথা শুনে আমরা বেশ উৎফুল্ল হলাম। বিদেশ বিভুঁইয়ে পরিচিত খাবার খেতে পারব। কিন্তু কোথায় পাব ভারতীয় রেস্টুরেন্ট? ইন্টারনেটে দেখানো রেস্টুরেন্টটি সম্পর্কে কেউ বলতে পারে না। আমরা অনেক ঘুরে ঘুরে রাত সাড়ে আটটার দিকে বের করলাম ভারতীয় রেস্টুরেন্টটি। তবে খুঁজে পেতে কষ্ট হলেও এর খাবার ভালো ছিল। বেশ অনেকটা রাত করেই আমরা ঘরে ফিরে এলাম। ম্যাকাউ অবস্থানকালে প্রায় প্রতিদিন রাতেই আমরা বাজারে বাজারে ঘুরে বেরিয়েছি। ক্যাসিনোতে গিয়েছি। কেউ কেউ ক্যাসিনো ফাঁদে ডলার খুইয়েছেন। তবে আমাদের এই ভ্রমণটি ছিল বেশ আনন্দদায়ক।
আমার হোটেলের লিফট দুটো ভাষা জানে; ইংরেজি আর চীনা। লিফট যখন উপরে যায় তখন বলে ‘গোয়িং আপ, ছু শাং’। আবার যখন নিচের দিকে যায় তখন বলে ‘কামিং ডাউন, শিয়া লাই’। একদিনের কথা। আমি লিফটে উঠে উপরের দিকে যাচ্ছি। আমার সহযাত্রী দুজন চীনা ভদ্রমহিলা। তারা আমাকে চীনা ভাষায় কী যেন জিজ্ঞেস করল। আমি ডান হাত আমার বুকে লাগিয়ে সংক্ষেপে জবাব দিলাম, ‘ইংলিশ’। ভদ্রমহিলা দুজন তখন একে অপরের সাথে কী যেন বললেন। ভাবসাব দেখে আমি বুঝতে পারলাম যে তারা আমার ভাষাজ্ঞান সম্পর্কে কথা বলছে। সম্ভবত তারা বলছে যে আমি ইংলিশ ছাড়া অন্য ভাষা বুঝি না। এ সময় একটা ফ্লোরে লিফট থামল। বাইরে তিনজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তারা লিফটে উঠবেন। তবে ওঠার আগে তারা আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘শিয়া লাই?’ কথা বলার সময় তারা আঙ্গুল দিয়ে নিচের দিকে দেখাচ্ছিলেন। তাই আমার বুঝতে সুবিধা হলো। আমি উপরের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললাম, ‘ছু শাং’। ভদ্রমহিলাগণ আমাকে ‘শিয়ে শিয়ে’ মানে ধন্যবাদ জানালেন। এবার লিফটের ভেতরের ভদ্রমহিলাগণের চোখে প্রশ্ন ফুটে উঠল, তুমি ইংলিশ ছাড়া কিছু জান না তাহলে ‘ছু শাং’ বের হলো কী করে? তাদের এ প্রশ্নের জবাব আমাকে দিতে হলো না। জবাব দিয়ে দিল লিফট নিজেই। কারণ লিফটের দরজা বন্ধ হতে হতে সে বলল, ‘গোয়িং আপ, ছু শাং’। এবার লিফটের ভেতরের সবাই হেসে উঠল।
দেখতে দেখতে ম্যাকাউতে আমাদের শেষদিন চলে এলো। আমাদেরকে ফিরতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে গতকাল হতেই এখানে তিন নম্বর বিপদসংকেত ঘোষণা করা হয়েছে। যে কোন মুহূর্তে তাইফুন হতে পারে। সাগর বেশ উত্তাল। তাইফুনের সময় সাগর যে কতটা উথালপাতাল করতে পারে সেটা তো আমরা জানি। সংকেত ঘোষিত হবার পর হতে আমি বেশ শঙ্কায় পড়ে গেছি। এ রকম সময় সাগরের ৬০ মাইল পাড়ি দিয়ে কী করে আমি হংকং যাব? এদিকে না গিয়েও উপায় নেই। কারণ হংকং হতে পরদিন প্লেনের টিকেট কনফার্ম করা আছে। এছাড়া ম্যাকাউয়ে থাকার খরচও অনেক। আমার পকেটে টাকাও কমে এসেছে। অগত্যা দুরু দুরু বুকে ব্যাগ টেনে নিয়ে জাহাজঘাটে গেলাম। টিকেট কাটার পর জেটিতে গিয়ে দেখি সাগরগামী জাহাজগুলো সিংহের তেজ নিয়ে ঢেউয়ের মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে। কোনো জাহাজ বা কোনো যাত্রীর মুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই। তখন আমিও ভাবলাম, এই সামান্য তিন নম্বর সতর্ক সংকেতে ভয় পাওয়ার কোনো দরকার নেই। তারপরও জাহাজে চড়ার পর বারবার আমি তাকিয়ে থাকছিলাম ঘাটের দিকে, চলার পথে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের দিকে। মনের ভাবনা, এখানে ডুবলে এটুকু পথ সাঁতরে গিয়ে হলেও পাহাড়ে উঠতে পারব। কিন্তু তেজি জাহাজটি এক ঘণ্টার মধ্যেই আমাদেরকে নিয়ে হংকং চলে এলো।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়