করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

শিল্প-সাহিত্যে মার্কসবাদ ও শ্রেণিবাস্তবতা

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মার্কসবাদ সভ্যতার অগ্রগতিতে ও মানবিকীকরণে বিশ্বাসী, আর ওই কারণেই সে শিল্প-সাহিত্যের নিরন্তর অনুশীলন চায় এবং পথ-উন্মোচন করতে সচেষ্ট থাকে সৃষ্টিশীলতার। একই সঙ্গে চায় অর্জনগুলোকে সর্বজনলভ্য করে তুলতে। শ্রেণির বিভাজন ভেঙে শিল্প-সাহিত্য যাতে সবার কাছে পৌঁছে যায় এটি মার্কসবাদীদের সংস্কৃতি চর্চার একটি লক্ষ্য বটে। আরো একটা কাজে সাহায্য করে মার্কসবাদ। সেটি হলো শিল্প-সাহিত্যের ভেতরে কী ঘটছে, কেন ঘটছে, তার ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা।
মার্কসবাদের নানা কৃতিত্বের মধ্যে সর্বপ্রধান হচ্ছে সব মানবিক কাজের পেছনেই যে ইতিহাস আছে অমোঘ সেই সত্যটিকে বিবেচনায় নিয়ে আসা। মার্কসবাদ ভাববাদী ঈশ্বরের ব্যাপারে উদাসীন; কিন্তু বলা হয়ে থাকে যে মার্কসবাদীরা ঈশ্বরের জায়গাতে ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সেটা এই অর্থে যে সব কিছুরই ইতিহাস আছে, ইতিহাসের বাইরে কিছুই নয়, ইতিহাসের ভেতরে থেকে এবং ইতিহাসের সঙ্গে দ্বা›িদ্বক সম্পর্কে নিয়োজিত অবস্থাতেই মানুষের সৃষ্টিশীলতা কাজ করে। ইতিহাসেরও ইতিহাস আছে। ইতিহাসে থাকে শ্রেণি, থাকে শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির দ্ব›দ্ব। দ্ব›দ্ব জিনিসটা সর্বত্রই কার্যকর। কার্য ও কারণের মধ্যে যে সম্পর্কটা কাজ করে তার চেয়েও দ্বা›িদ্বক সম্পর্ক অনেক বেশি সত্য বটে। দ্ব›দ্ব বাধে অধিপতি শ্রেণির মতাদর্শের সঙ্গে অধিপতিত শ্রেণির মতাদর্শের। বিদ্যমান সমাজে অধিপতিদের মতাদর্শই রাজত্ব করে থাকে। আর এইসব দ্ব›েদ্বর ভেতর দিয়েই ইতিহাস এগোয়।
শিল্প-সাহিত্যের সৃষ্টির পেছনে অনুপ্রেরণা নিশ্চয়ই কাজ করে। এমনও মত আছে যে সৃষ্টির কাজটা উন্মাদনার ভেতরেই ঘটে। আরেকটা মত এই যে শিল্পীরা অনুকরণ করেন। অনুকরণ করেন যা কিছু দেখেন ও কল্পনা করেন তার। কিন্তু এই অনুকরণ কখনোই যান্ত্রিক থাকে না, সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠে; শিল্পীর অনুকরণ মানেই নতুন সৃষ্টি। আসলে কিন্তু অনুপ্রেরণা ও অনুকরণ- এই দুই ধারণাই সত্য। দার্শনিক প্লেটো অনুপ্রেরণার কথা বলেছেন, তার দুর্ধর্ষ ছাত্র অ্যারিস্টটল বলেছেন অনুকরণের কথা। একজন ভাববাদী, অন্যজন বাস্তববাদী। ওই ধারণা দুটি কিন্তু পরস্পরবিরোধী নয়; বরং একে অপরের পরিপূরকই। অনুপ্রেরণা ভিন্ন শিল্পের সৃষ্টি যে সম্ভব নয়; এটা সত্য; আবার অনুপ্রাণিত শিল্পী যেহেতু সমাজে বসবাস করেন এবং সমাজের…

* বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের বার্ষিক সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তৃতা, ২০১৯
বাস্তবতার ভেতরে থেকেই যেহেতু তার শিল্প-সৃষ্টি, তাই সমাজ তার কল্পনাকে ছাড় দেয় না, প্রভাবিত করে। নিয়ন্ত্রিতও করতে চায়। জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে শিল্পীরা সেই নিয়ন্ত্রণের ভেতরে থাকেন, কিন্তু আবার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে দ্ব›েদ্বও লিপ্ত হন। হতেই হয়। নইলে তো তারা সাধারণদের একজন হয়ে যাবেন। শিল্পী হবেন না। ইতিহাসের উপস্থিতিটা থাকেই।
উদাহরণ নেয়া যাক। শেকসপীয়র এবং টলস্টয় উভয়েই অতুলনীয় শিল্পী। একজন লিখেছেন নাটক, অন্যজন উপন্যাস। এই যে তারা দুটি ভিন্ন রূপকল্প অবলম্বন করলেন এর পেছনে ইতিহাস কাজ করেছে। নীরবে, কিন্তু দৃঢ়ভাবে। শেকসপীয়রের পক্ষে উপন্যাস লেখা মোটেই সম্ভব ছিল না। নিষেধ ছিল ঐতিহাসিক বাস্তবতার। বাস্তবতা হলো নাটক এসেছে আগে, উপন্যাস পরে। প্রাচীনকালে নাটক লেখা হতো কবিতায়, কারণ কবিতার আগমনই সর্বপ্রথম। গদ্য এসেছে পরবর্তীতে। সেকালে মহাকাব্য ছিল। মহাকাব্য কবিতায় লেখা হতো। মহাকাব্য বীরদের কাহিনী। কিন্তু এক সময়ে টের পাওয়া গেল যে বীরদের আর আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ পাঠক সাহিত্য চাইছে, সে পাঠক আবার মধ্যবিত্ত, কারণ ইতোমধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। মধ্যবিত্ত ঘরে বসে সাহিত্য পড়তে চায়, থিয়েটারে গিয়ে নাটক দেখবে এমন সুযোগ তার জন্য সীমিত। সাহিত্যের চাহিদাটা তখন বিশেষভাবে এসেছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির মহিলাদের কাছ থেকে, যারা লেখাপড়া শিখেছে, কিন্তু থাকে ঘরের ভেতরেই। সাহিত্যিক সেই চাহিদা মেটাবার জন্য আশপাশের মানুষদের নায়ক-নায়িকা করে উপন্যাস লেখা শুরু হলো।
অসামান্য মানের নাটক লিখেছেন শেকসপীয়র। সে সব নাটক মূলত রাজা রানী, রাজদরবার ও অভিজাতদের নিয়েই। শেকসপীয়রের কালে সমাজে এরাই ছিল ক্ষমতাধর। তবে তিনি রাজতন্ত্রের সমলোচনাও করেছেন। তার শ্রেষ্ঠ দুটি নাটকের একটি হ্যামলেট অন্যটি কিং লিয়র। দুটি নাটকেই দেখানো হচ্ছে রাজবাড়ির রাজনীতিটা কেমন নিষ্ঠুর। রাজপুত্র হ্যামলেট এবং রাজা লিয়র দুজন ভিন্ন ভিন্ন দুই দেশের মানুষ, ভিন্ন ভিন্ন সময়েরও; কিন্তু তারা উভয়েই নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন। উভয়ের পরিণতিই নির্মম। শেকসপীয়র রাজতন্ত্রের ভেতরটাকে একেবারে উন্মোচিত করে দেখাচ্ছেন। কিন্তু তাই বলে রাজতন্ত্রের যে উচ্ছেদ চেয়েছেন তা কিন্তু নয়। হ্যামলেট নাটকে রাজ-পরিবারের সবাই শেষ পর্যন্ত মারা গেল; কিন্তু শেষ দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে পাশের দেশের এক রাজপুত্র মঞ্চে প্রবেশ করছে, মঞ্চের ওপর পড়ে থাকা লাশগুলোকে সরিয়ে নিয়ে দর্শকদের জন্য সে নাটকের যবনিকা টানবে। সেকালের মঞ্চে পর্দা টানার ব্যবস্থা ছিল না, লাশ সরানোর কাজটা ওই রাজপুত্রের সৈন্য-সামন্ত দিয়েই সম্পন্ন করা হলো, আবার একই সঙ্গে জানিয়ে দেয়াও হলো যে রাজা মারা গেছে সত্য, রাজত্বের একমাত্র উত্তরাধিকারী রাজপুত্র হ্যামলেটও শেষ, কিন্তু তাই বলে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে অবসান ঘটল তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কিং লিয়র নাটকেও ওই একই আশ্বাস। রাজা লিয়র মারা গেছেন, কন্যারাও কেউ জীবিত রইল না, তবে মৃত কন্যাদের একজনের স্বামী ঘটনাস্থলে উপস্থিত, তুলনায় ভদ্র গোছের মানুষ সে; বোঝা যাচ্ছে রাজত্ব চালানোর দায়িত্ব সে-ই তুলে নেবে নিজের কাঁধে। শেকসপীয়র নিজে রক্ষণশীল ছিলেন। উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ তিনি, রক্ষণশীলতা তার শ্রেণিরই একটি বৈশিষ্ট্য। এই মধ্যবিত্ত জনতাকে পছন্দ করত না, শেকসপীয়রও করেন না, কিন্তু তবু বড় শিল্পী যেহেতু তাই রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নৃশংসতাটাকে না-দেখিয়ে পারেন নি। সেখানেই তার মহত্ত্ব। রাজতন্ত্র যে টিকবে না সেটা তার ওই উন্মোচন জানিয়ে দিচ্ছে।
টলস্টয়কেও রক্ষণশীল বলতে হবে। শেকসপীয়রের তিনশ’ বছর পরের মানুষ তিনি। তার সময়ে তার দেশে অত্যাচারী সম্রাটদের রাজত্ব চলছিল, কিন্তু টলস্টয়ের সাহিত্য জগতে তাদের সরাসরি উপস্থিতি নেই। তবে সম্রাটের সহযোগী আমলাতন্ত্র খুবই তৎপর রয়েছে। টলস্টয় উপন্যাস লিখছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে, তার দেশে তখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রস্তুতি চলছে। টলস্টয় তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস আন্না কারেনিনাতে তার সময়কার বুর্জোয়া আমলাতন্ত্র ও অভিজাত সমাজের সংকটটা দেখাচ্ছেন। পরিবার ভেঙে পড়ছে। ওদিকে আবার পরিবর্তনের জন্য পথানুসন্ধান চলছে। আন্দোলনও গড়ে উঠছে। আন্না কারেনিনা তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস; বিশ্বকথাসাহিত্যেও এই রচনা অনন্যসাধারণ। উপন্যাসের নায়িকা আন্না রূপে গুণে অসামান্য। বুর্জোয়া সমাজের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিই বলা যাবে তাকে, নানা দিক থেকে। কিন্তু নিজের জীবনে ওই নারী চরিতার্থতা পেল না; শেষ পর্যন্ত বাধ্য হলো আত্মহত্যা করতে। বয়সে তার স্বামী আন্নার চেয়ে বিশ বছরের বড়, সামাজিক অবস্থানে আমলাতন্ত্রের সর্বোচ্চ স্তরে তার প্রতিষ্ঠা; স্বামীর বিপরীতে রয়েছে আন্নার সমবয়স্ক ভ্রনস্কি, যে তার প্রেমিক। সেও আমলাতন্ত্রের লোক, তবে বেসামরিক নয় সামরিক আমলাতন্ত্রের। দুজনের কেউই আন্নাকে চরিতার্থতা দিতে পারে না- না তার স্বামী, না তার প্রেমিক। চলন্ত ট্রেনের নিচে নিজেকে নিক্ষেপ করে আন্না তার অতৃপ্ত জীবনের অবসান ঘটায়। চলন্ত ওই ট্রেন আগ্রাসী পুঁজিবাদের প্রতিনিধি যেন। তার চাকার নিচে পিষ্ট হচ্ছে দেশের সম্পদ ও সম্ভাবনা। পাশাপাশি সমাজপরিবর্তনের জন্য ব্যস্ত মানুষেরাও কিন্তু আছে। আছে লেভিন। প্রতিনায়ক সে। কৃষিতে শ্রমের ভূমিকাকেই সে মুখ্য হিসেবে দেখে। নিজের পরিবারের ভূমিদাসদের সে মুক্তি দিয়ে দিয়েছে। তাই বলে সে যে সমাজবিপ্লবী তা নয়। তবে তার আশপাশেই সমাজবিপ্লবীরা আছে। লেভিনের আপন ভাই যোগ দিয়েছে বিপ্লবীদের গোপন দলে। সে-দল কমিউনিস্টদের। বিপ্লবীদের সন্ধান পাবো টলস্টয়ের অপর উপন্যাস পুনরুত্থানে-এও। সেখানে দেখি বিপ্লবীদের নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে সাইবেরিয়াতে। বন্দিরা বই পড়ে, তারা চিন্তা করে, তাদের একজনের কাঁধের থলির ভেতর থেকে মার্কসের বই উঁকি দেয়। না, টলস্টয় নিজে সশস্ত্র বিপ্লবে আস্থাশীল নন, কিন্তু বিপ্লব যে আসছে তার সংবাদ তিনি দিচ্ছেন। সমাজে দ্ব›দ্ব বিকশিত হচ্ছিল। টলস্টয় তার সংবাদ পাচ্ছেন এবং পাঠকদের সে-সংবাদ জানাচ্ছেন। এবং বিপ্লব যাতে ঘটে তার জন্য সাহায্যও করছেন, বাস্তবতাকে সবার জন্য উন্মোচিত করে দিয়ে।
রেনেসাঁর সময়ে ইউরোপে চিত্রকলার অত্যাশ্চর্য বিকাশ সম্ভব হয়েছিল। লেনার্দ দ্য ভিঞ্চি এবং মাইকেল এঞ্জেলো এমন সব ছবি এঁকে রেখে গেছেন যেগুলো তুলনাহীন। মার্কসবাদ বলবে এর পেছনে ছিল ইতিহাস। রেনসাঁ একটা নবজাগরণ এনেছিল; চিন্তায়, উৎপাদনে ও বাণিজ্যে এবং স্বভাবতই দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই নবজাগরণেরই প্রকাশ ঘটেছে চিত্রকলাতে। রেনেসাঁর বিশেষ সমৃদ্ধি ইতালিতে। নবজাগরণের প্রথম কেন্দ্র ছিল ওইখানেই। স্থল ও জলপথে ইতালি যুক্ত ছিল অন্যদেশের সঙ্গে; সেখানে বাণিজ্যের চর্চা চলছিল মহোৎসাহে। বাণিজ্য জিনিসটা নিতান্তই ইহজাগতিক; রেনেসাঁও যেমন মতাদর্শিক তেমনি ইহজাগতিক, তাই দেখি তার শিল্পীরা ধর্মীয় বিষয় নিয়েও যখন ছবি আঁকেন তখন তাতে মনুষ্যজীবনের মহিমা, ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও অনুভূতির বলিষ্ঠতা অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নতুন এক বিশ্ববিভা, শিল্পী ও শিল্প উভয়ের চোখেমুখে।
রেনেসাঁ প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল মুক্তির; কিন্তু প্রতিশ্রæত সে-মুক্তিটা এলো না; কারণ রেনেসাঁ যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিকশিত করল তা পুঁজিবাদী চরিত্রের। পুঁজিবাদ সব মানুষকে সমান করে না, উল্টো মানুষে মানুষে বৈষম্য তৈরি করে। রেনেসাঁর কালে বিকশিত ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যবোধ গণতন্ত্র দাবী করছিল, কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা মোটেই গণতান্ত্রিক নয়। ব্যাহত-গতি সভ্যতাকে তাই আরো একধাপ এগুবার জন্য সচেষ্ট হতে হলো। প্রয়োজন দেখা দিল সামাজিক বিপ্লবের। ওই অগ্রগতির কারণেই ১৭৮৯ সালে ফরাসি দেশে বিপ্লব ঘটে। বিপ্লবের সেই ঘটনার পেছনে ফরাসি লেখকদের দার্শনিক ও সাহিত্যিক রচনার অবদান ছিল। বিপ্লব যখন ঘটল, ঘটেই গেল, তখন ইংল্যান্ডের তরুণ লেখকদের কেউ কেউ অত্যন্ত উদ্দীপিত হয়েছিলেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ তো মনে করেছিলেন পৃথিবীতে এসেছে নতুন দিন। বিপ্লবে যোগ দেবেন বলে তিনি ফ্রান্সে রয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি ফেরত এসেছেন, তার নিজের শ্রেণির কাছেই। সেকালের মধ্যবিত্ত শ্রেণি আসলে ভয় পেয়ে গিয়েছিল সমাজ বিপ্লবের প্রচণ্ডতা দেখে। ভয় পেয়েছিলেন উদারপন্থি এডমন্ড বার্কও। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন জানিয়ে বার্ক পার্লামেন্টে উদার কণ্ঠে বক্তৃতা করেছেন, ভারতে কোম্পানি শাসনে দুর্নীতির ঘটনার বিরুদ্ধে অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন; কিন্তু তাকেই আবার দেখা যায় ফরাসি বিপ্লবের বিপক্ষে বই লিখতে। মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উদারনীতিক বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন, ইংল্যান্ডবাসীকে তারা সতর্ক করে দিতে চেয়েছেন বিপ্লবের ব্যাধিটি কোনমতেই যেন ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ইংল্যান্ডে ঘাঁটি না গাড়ে।
ওদিকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ তার নিজের দেশে পুঁজিবাদের উদ্বেগজনক উত্থান-তৎপরতা দেখতে পাচ্ছিলেন। দেখছিলেন গ্রামের কৃষক কীভাবে উৎপাটিত হয়ে শহরে চলে আসছে, এসে পরিণত হচ্ছে মজুরি শ্রমিকে, আবাস খুঁজছে নোংরা বস্তিতে। এই দৃশ্যে তিনি পীড়িত হয়েছেন। সমাধানটা কি? না, পুঁজিবাদের উচ্ছেদের কথা ভাবেননি; পলায়নই বরঞ্চ করতে চেয়েছেন, প্রকৃতির কাছে। কিন্তু সে তো কবির পলায়ন, মানসিক ভাবে; মেহনতী মানুষ যাবে কোথায়? কে দেবে তাকে জীবিকার নিশ্চয়তা? উত্তর নেই। ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রগতিশলীতা অনস্বীকার্য। কবিতাকে তিনি নিয়ে যেতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছে; ঠিক করেছেন সাধারণ মানুষকে নিয়েই লিখবেন। লিখবেন কথোপকথনের ভাষাতে। ঘোষণাটা দিয়েছিলেন নিজের কাব্যযাত্রার একেবারে সূচনালগ্নে। এগিয়ে তিনি গেছেনও। তাতে কবিতার লাভ হয়েছে, মেহনতীদের বড় একটা লাভ হয়নি। পুঁজিবাদের জোয়াল তাদের কাঁধে ক্রমান্বয়ে শক্তই হয়েছে।
ঔপন্যাসিক জেন অস্টেন ওয়ার্ডসওয়ার্থের সমসাময়িক। ওয়ার্ডসওয়ার্থের তুলনায় তিনি অনেক বেশি রক্ষণশীল। মধ্যবিত্ত শ্রেণির রক্ষণশীল অংশেরই প্রতিনিধি তিনি। একে তো মহিলা তার ওপর থাকতেন মফস্বলে, সাহিত্যিকদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না; নিজে নিজে একাকী চুপিচুপি লিখতেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কার্ল মার্কসের আবির্ভাবের আগেই তিনি মার্কসবাদী হয়ে গেছেন। প্রেম ও বিবাহের বিষয় নিয়েই সাধারণত লিখতেন, কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে পরিষ্কার বুঝে নিয়েছিলেন যে মানবিক সম্পর্কগুলো কোনো মতেই অর্থনীতির বাইরে নয়; আবেগ যতই দুর্দমনীয় হোক সম্পত্তি ও অর্থ না থাকলে সম্পর্ক জমে না। কিন্তু তিনি আবার মার্কসবাদীদের থেকে দূরেই থেকে যান যখন সম্পত্তিব্যবস্থাকে মেনে নেন। বাস্তববাদী অবশ্যই, কিন্তু মোটেই বিপ্লবী নন; ফরাসি বিপ্লবের পরে লিখেছেন কিন্তু বিপ্লব তাকে নাড়া দেয়নি। থেকেছেন তিনি গৃহের বন্ধনে, পারিবারিকভাবে যেমন তেমনি মানসিকভাবেও।
তার পরের কালের লেখকরা কেউ কেউ পুঁজিবাদের নৃশংসতার ছবি এঁকেছেন তাদের লেখাতে। যেমন চার্লস ডিকেন্স। অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের হৃদয়বিদারক চিত্র আছে তার উপন্যাসে। সেদিক দিয়ে জেন অস্টেন থেকে তিনি যোজন যোজন দূরের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও ওই মধ্যবিত্তই, সামাজিক পরিবর্তনে অবিশ্বাসী।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্যে পুঁজিবাদের বিস্তর সমালোচনা আমরা পাবো। ডিকেন্স তো আছেনই, পুঁজিবাদের সমালোচনা ম্যাথু আর্নল্ডও করেছেন; যেমন করেছেন টমাস কার্লাইল। আর্নল্ড ভাবতেন পালাবেন তিনি প্রাচীন ধ্রæপদী সংস্কৃতির কাছে : কার্লাইল ভাবতেন আশ্রয় নেবেন বীরদের পক্ষপুটে। মুক্তির সোজা পথটা যে সমাজ বিপ্লব সেটা তারা ভাবতে পারেননি। নিষেধ ছিল শ্রেণির। ধরে নিয়েছেন সংস্কারেই কুলাবে। মার্কস কিন্তু ওই সময়েই এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ হয়েও সন্ধান পেয়ে গেছেন এই সত্যের যে ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা ছাড়া উপায় নাই। এই যে তিনি ভাবতে পারলেন যথার্থ সামাজিক বিপ্লবের কথা, এটা সম্ভব হলো কি ভাবে? প্রথমত মেধা ছিল; দ্বিতীয়ত ছিল শ্রেণিচ্যুতির ক্ষমতা। অন্যরা পারেননি তিনি পেয়েছেন। সমস্যাটিকে তিনি তার নিজের শ্রেণিস্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেননি, দেখেছেন মেহনতীদের দৃষ্টিকোণ থেকে। মার্কসবাদ ওইখানেই বিশেষভাবে স্বতন্ত্র। মার্কসবাদ জানিয়ে দেয় যে কেবল দেখা নয়, কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা সেটাই বরঞ্চ অধিক জরুরি। আর দেখাটাই যে যথেষ্ট তাও নয়, প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লবের পক্ষে দাঁড়ানো।
বিংশ শতাব্দীর মস্ত বড় ঘটনা বিশ্বযুদ্ধ এবং রাশিয়াতে ও চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। বিপ্লব মার্কবাদীরাই ঘটিয়েছেন। তা বিপ্লবের জন্য শিল্পসাহিত্যে প্রস্তুতিটা কেমন ছিল? ছিল যথোপযুক্ত। রুশ সাহিত্যে তো বটেই, চীনের সাহিত্যেও, বিশেষ করে নবীনদের রচনায়, বিপ্লবের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। রুশ বিপ্লবের নায়ক লেনিন এবং চীন বিপ্লবের প্রধান মাও সে তুঙ, দু’জনেই যেমন সংগঠক ছিলেন তেমনি ছিলেন লেখকও। কিন্তু অন্যত্র? অন্যসব দেশে? হ্যাঁ, অন্যত্র বিপ্লবী চেতনা নিশ্চয়ই ছড়িয়েছে, এমনকি বিপ্লবও ঘটেছে, কিন্তু রুশ ও চীন বিপ্লবের মতো কোথাও নয়। সত্য এই যে রুশ বিপ্লব দেখে বিপ্লব-বিরোধীরা একট্টা হয়ে গিয়েছিল। তারা বিরোধিতা করেছে।
এরই মধ্যে অবশ্য নাটক লিখেছেন বার্টল্ট ব্রেখট এবং আর্থার মিলার। এরা সমাজতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন; ব্রেখট স্পষ্ট করে, মিলার অবশ্য অতটা স্পষ্ট নন। আমেরিকায় বসে তারা লিখতেন। কিন্তু পুঁজিবাদী আমেরিকা তাদেরকে স্বাধীনতা দেয় নি লেখার; পীড়ন করেছে বরঞ্চ। ইউরোপে তরুণ লেখকরা কেউ কেউ বিপ্লবের পক্ষে লিখেছেন, এমনকি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে স্পেনের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন, প্রাণও দিয়েছেন কয়েকজন। অন্যদিকে আবার কেউ কেউ স্ট্যালিনের তথাকথিত একনায়কত্বকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে সমাজতান্ত্রিক শিবির ত্যাগ করে হয় উদারনীতির পক্ষে, নয় তো সরাসরি রক্ষণশীল শিবিরেই চলে গেছেন।
রুশ বিপ্লব দেখে অনেক বুদ্ধিজীবীই আবার ঘাবড়ে গেছেন। তাদের কেউ চলে গেল ধর্মের আশ্রয়ে, কেউ কেউ অতীত ইতিহাসের কাছে। ভেবেছেন উটপাখির মতো মুখ গুঁজে ঝড় থেকে বাঁচা যাবে। আদিমতার কাছে প্রত্যাবর্তনের আকাক্সক্ষাও দেখা গেছে। ইংরেজি সাহিত্যে এলিয়ট আনলেন ধর্মের বাণী, লারেন্স দুঃখ পেলেন পুঁজিবাদ মানুষের ইন্দ্রিয় সংবেদনশীলতাকে খাটো করছে দেখে, ইয়েটস ভাবলেন ঠিক আছে জাতীয়তাবাদীই হবেন। ইয়েটস রবীন্দ্রনাথকে পছন্দ করতেন তার ভেতরে আধ্যাত্মিকতার যে সুর শুনতে পেয়েছেন সেই সুরের জন্য। ইয়েটসের নিজের কৃত্রিম জগতে সেটি শোনা যাচ্ছিল না। এজরা পাউন্ড তো ঝুঁকে পড়েছিলেন ফ্যাসিবাদের দিকেই। পাঠকরা এগিয়ে গেছে, সে-তুলনায় বড় বড় লেখকদের অগ্রগতি ঘটেনি; শ্রেণিগত বিপ্লবভীরুতা তাদের অব্যাহতি দেয়নি। কোথাও কোথাও দেখা গেছে রচনার আঙ্গিক বড় হয়ে উঠতে চাইছে বিষয়বস্তুকে ছাপিয়ে। যার মূল কারণ হচ্ছে বিষয়বস্তুর ভেতর সারবস্তুর সংকোচন। ব্যাধিকে যারা দেখেছেন তারাও ব্যাধির কারণ যে পুঁজিবাদ সেটা ধরতে পারেননি, বা ধরতে চাননি।
একই কারণে চিত্রকলায় দেখা দিয়েছে জীবনমুখিতার বদলে আত্মমুখিতা। এসেছে সুররিয়ালিজম, কিউবিজম, দাদাইজম। ব্যতিক্রম হচ্ছেন পিকাসো। কিন্তু তিনি তো প্রায় একলা পথিক।
কেউ কেউ অবশ্য ঝুঁকেছিলেন কমিউনিজমের দিকেই। কিন্তু থাকতে পারেননি। শ্রেণি অবস্থান তাদের আর এগুতে দেয়নি। টেনে পেছনে নিয়ে এসেছে। কমিউনিজমকে এঁরা ঈশ্বর ভেবেছিলেন, পরে ভাবলেন ঈশ্বরের পতন ঘটেছে। বিপ্লবীদের সাহায্য করবার জন্য জর্জ অরওয়েল যোগ দিয়েছিলেন স্প্যানিশ বিপ্লবীদের সংগ্রামে, কিন্তু বিপ্লবীদের পেছনে তথাকথিত স্ট্যালিনবাদ রয়েছে মনে করে ব্যঙ্গরচনা লিখলেন বলশেভিক বিপ্লবের বিরুদ্ধেই। তার কাছে মনে হয়েছে বলশেভিজমে আর ফ্যাসিজমে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। আবার এটাও জানা গেছে যে শিল্প-সাহিত্যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লববিরোধিতার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী বিশ্বের আদর্শিক নিয়ন্ত্রণ যেমন কাজ করেছে তেমনি বৈষয়িক পৃষ্ঠপোষকতাও যে তৎপর ছিল না এমনও নয়।

দুই.
রাষ্ট্র ও তার অধীন আর্থ-সামাজিক ইতিহাস বাংলা সাহিত্যের চর্চাকেও নানা ভাবে প্রভাবিত করেছে। ধরা যাক আধুনিক বলে কথিত বাংলা কবিতার কথা। এর উদ্ভব ও বিকাশ ইংরেজ শাসনের সূত্রপাতের পর থেকেই। দুহাতে কবিতা লিখেছেন ঈশ্বর গুপ্ত। তার ভাষাটা আধুনিক। সামাজিক অসংগতিকে নিয়ে তিনি চমৎকার হাসিঠাট্টা করেছেন। ইংরেজানুকরণ তার ব্যঙ্গবিদ্রƒপের বাইরে থাকে নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছে তিনি যেন ইয়ার্কি-ফাজলামো করছেন। যে অভিযোগ তার অনুরাগী বঙ্কিমচন্দ্রের ছিল। সবচেয়ে বড় কথা ঈশ্বর গুপ্তের আধুনিকতার অন্তরে ছিল অসংশোধনীয় এক রক্ষণশীলতা। সিপাহী অভ্যুত্থানকে নিয়ে তিনি যে ভাবে হাস্যকৌতুক করবার চেষ্টা করেছেন তার ব্যাখ্যা ওই রক্ষণশীলতার ভেতরেই সংরক্ষিত রয়েছে।
বাংলা গদ্য এসেছে নবীন মধ্যবিত্তের হাত ধরে। এই মধ্যবিত্ত লেখাপড়া শিখেছে, টাকাপয়সাও করেছে, আনুকূল্য পেয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। শ্রেণিটি ছিল কৃত্রিম ও জনবিচ্ছিন্ন; তাদের তৈরি গদ্যেও ওই দুই জিনিসের ছাপ এসে পড়ল। গদ্যের কৃত্রিমতা বিশেষ ভাবে প্রকাশ পেল সংস্কৃত ভারাক্রান্ততায়। কৃত্রিম এই ভাষার নাম দেয়া হয়েছিল সাধুভাষা; অর্থাৎ ভদ্রলোকের ভাষা; চলিত ভাষা নয়। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ভাষা থেকে স্বতন্ত্র। বাংলা গদ্যকে ওই দুই দোষ থেকে মুক্ত হবার চেষ্টাতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে; তবুও নিস্তার মেলেনি।
কোম্পানি শাসনের সময়ে লালন ফকির গান তৈরি করছিলেন, মেহনতীদের ভেতরে বসবাস করে। কিন্তু সে-রচনা যতই সরল ও স্বাভাবিক হোক সে তো কবিতাই, গদ্য নয়। তদুপরি থাকেন তিনি রাজধানী কলকাতা থেকে অনেক দূরে, শ্রেণিগত পরিচয়ে তিনি দেহাতী মেহনতী বৈ নন। তার ভাষা ভদ্রসাহিত্যের বাহন হয় কী করে? তাছাড়া লালনের যে গান তাতে মেহনতীদের জীবন ও সংগ্রামের কথা যে খুব একটা ছিল এমনও নয়। ওটা তাই মুখের ভাষা বটে, তবে পুরোপুরি মেহনতী মানুষের ভাষা নয়।
আসলে ভাষা যে কেবল পোশাকে কাটে এমন তো নয়, ভাষার ভরসা ভেতরের বিষয়বস্তুর ওপরই। তাই দেখি পরে যখন সাধুকে সরিয়ে দিয়ে চলিত চলে এলো তখনো যে তাতে কৃষক ও শ্রমিকের জীবনসংগ্রাম, যা আসলে শ্রেণি সংগ্রামই, সেটা জায়গা পেলো এমন নয়। গদ্যের ভাষা ও বিষয় রইলো মধ্যবিত্তের দখলেই। যেমন প্রমথ চৌধুরীর। তিনি ছিলেন চলিত ভাষার পক্ষে, কিন্তু তাই বলে তার বিষয়বস্তুতে যে সমাজ বিপ্লবের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কোনো ছোঁয়া ছিল তা নয়। রায়তের কথা তিনি লিখেছেন, তাতে রায়তের দুঃখের কথা আছে, কিন্তু বেচারাদের দুঃখের কারণটা যে-জমিদারি ব্যবস্থা তার অবসান ঘটানোর দাবিটা নেই। বোঝা যায় শ্রেণির সীমা কেমন অলঙ্ঘনীয়।
বঙ্কিমচন্দ্রের উদাহরণ তো না দিলেই নয়। তার ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে অল্পকথায় কৃষকের জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণার খবর যেভাবে উঠে এসেছে সেভাবে অন্য কোথাও এসেছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু প্রবন্ধের উপসংহারে এসে সিদ্ধান্তটা কী? না, জমিদারি ব্যবস্থাটা থাকবে। কেন থাকবে? কারণ, না থাকলে আধুনিক বঙ্গ সমাজ ভেঙে পড়বে; ভীষণ অরাজকতা দেখা দেবে। আর এটা তো জানা কথাই, বলেছেন তিনি, যে আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি। আমরা অর্থ মধ্যবিত্তরা। বাংলা সাহিত্যে মধ্যবিত্তের উদারনীতির প্রান্তঃসীমা এমন পরিষ্কার ভাবে আর কেউ দেখিয়ে দেননি। অনেক বছর পরে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অবশ্য বলে দিয়েছেন, ‘সহেনা সহেনা প্রাণে/ জনতার জঘন্য মিতালী’। তবে প্রাণাঘাতের সেই আশঙ্কাবাণী তেমন একটা প্রচার পায়নি। অসামান্য লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের ভেতর ছিল স্বাধীনতার প্রবল স্পৃহা, কিন্তু পাশাপাশি সাম্যের সুপ্তভীতি। এই স্পৃহা, ওই ভীতি- এদের ভেতরই চিহ্নিত অবস্থায় রয়েছে সেকালের এবং একালেরও উদারনীতিকদের বিচরণসীমার নির্দিষ্ট ক্ষেত্রটি। এরা ভদ্র, কিন্তু বিপ্লববিরোধী। সেটা ঘটেছে ভদ্রতার খাতিরেই এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির ‘পবিত্রতা’ রক্ষার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধতার কারণেই।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদ্রোহী ছিলেন। সাহেব হতে গিয়ে তিনি কিন্তু উল্টো ঘটনাই ঘটালেন, বাঙালি হয়ে গেলেন। ঔপনিবেশিক শাসনে পীড়িত বাংলার আর্তহৃদয় তার মেঘনাদবধ কাব্যে আর্তনাদ করে উঠেছে। কিন্তু তিনিও দেখা যাচ্ছে তার ওই মহাকাব্যে সতীদাহের মতো নারকীয় ভারতীয় প্রথাকে রীতিমতো আদর্শায়িত করে দিয়েছেন। এবং যদিও সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় অসামান্য দুটি প্রহসন লিখেছেন যাতে রক্ষণশীল জমিদারদের প্রজাপীড়নের এবং নব্য সাহেবদের উচ্ছৃঙ্খলতাকে তীব্র পরিহাস করা হয়েছে, তথাপি সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা যে সাহিত্যের যথার্থ ভাষা হতে পারে এমন ‘অলুক্ষণে’ কথা মুখে আনেননি। বলেছেন ও তো জেলেদের ভাষা। যতই বলুন যে তিনি খাঁটি বাঙাল, যশোরের, শেষ বিচারে তিনি ভদ্রলোকই তো।
রবীন্দ্রনাথ বহু দিক দিয়েই অসাধারণ। প্রায় সকল অগ্রগতির সঙ্গেই তিনি যুক্ত থেকেছেন। ভূমিকা রেখেছেন। ছিলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ব্যাপ্ত ও গভীর। শিক্ষিত বাঙালি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রুচির ব্যাপারে তার কাছ থেকে নিরন্তর শিক্ষা নিয়েছে। কিন্তু শ্রেণিগত সীমা ছিল তারও। কৃষকের জীবনে প্রবেশ করতে পারেননি, সে-কথা অন্যে বলবে কী তিনি নিজেই বলে গেছেন; নিজের ভাষায়, খেদের সঙ্গে। জমিদারি ব্যবস্থা যে অন্যায় সেটা অবশ্যই জানতেন, কিন্তু ওই ব্যবস্থার উচ্ছেদে যে কৃষকের কোনো সুবিধা হবে এমনটা ভাবতে পারেননি। বিপ্লব-পরবর্তী রুশ দেশে গিয়ে, সেখানকার উন্নতি দেখে তো প্রায় অভিভূতই হয়েছিলেন; কিন্তু বিপ্লবের ভেতরে যে বলশেভিক কার্যকরণ ছিল তার প্রশংসা করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি বইতে স্ট্যালিন তো নেই-ই, লেনিনও নেই।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিয়ে গেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্বে। বিশ্বযুদ্ধ যখন তুমুল দশা। ঠিক সেই সময়েই জাপান ও আমেরিকায় ভ্রমণে গিয়ে তাদের জাতীয়তাবাদের নিন্দা জানিয়ে বক্তৃতা করেছেন। কিন্তু সংকটটা যে পুঁজিবাদের নিজের হাতে তৈরি, ওই জাতীয়তাবাদ যে আসলে পুঁজিবাদী জাতীয়তাবাদ, এটা পরিষ্কার করে বলেননি। নিন্দা যা প্রাপ্য ছিল সে তো পুঁজিবাদেরই। কিন্তু মনুষ্যত্ববিদ্বেষী ওই শত্রæটিকে পুঁজিবাদ বলে চিহ্নিত করেননি। বাধাটা ছিল বিশ্বকবির অন্তর্গত উদারনীতির। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার তদানীন্তন ও ভবিতব্য তাণ্ডব থেকে বের হবার পথটা যে কোথায় তাও বলেননি। ওই পথের পরিষ্কার উন্মোচন ঘটিয়েছিল বলশেভিক বিপ্লবীরা, জাতীয়তাবাদ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার কয়েক মাসের মধ্যেই। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন ভারতের সমস্যাটা রাজনৈতিক নয়, সামাজিক। তা সামাজিক তো ঠিকই, কিন্তু সমাজ তো থাকে রাষ্ট্রের অধীনেই। রাষ্ট্রের ওই কর্তৃত্বের কথাটা রবীন্দ্রনাথ বলতে উৎসাহবোধ করলেন না। উৎসাহের অভাবটা তার উদারনীতি থেকেই এসেছে।
১৯২০-৩০-এর আধুনিক লেখকদের অনেকেই নিজেদের আন্তর্জাতিক বলে ভাবতে পছন্দ করতেন। আসলে তারা ছিলেন অধঃপতিত পুঁজিবাদী সংস্কৃতির অনুরাগী। তাদের আধুনিকতা ছিল পশ্চিমী বুর্জোয়াদের অনুকরণের। এদের মধ্যে কারো কারো জন্য যৌবন হয়ে দাঁড়িয়েছিল জীবনযন্ত্রণা। অগ্রসর যারা, যেমন বিষ্ণু দে, তারা আবার মার্কসবাদকে মেলাতে চাইলেন ঘোরতর রক্ষণশীল টি এস এলিয়টের সঙ্গে। দুধ ও জলকে এক করার চেষ্টা; তাতে দুধের ক্ষতি, জলের লাভ। কারো কারো আধুনিকতা আবার রওনা দিয়েছে মার্কিনদেশাভিমুখী।
যথার্থ আধুনিক ছিলেন কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম। বলশেভিক বিপ্লব পুঁজিবাদবিরোধী যে নতুন এক আন্তর্জাতিকতা তৈরি করেছিল তিনি তাকে ধারণ করেছেন নিজের মধ্যে। কেবল বিদ্রোহী ছিলেন না, বিপ্লবীই ছিলেন। নজরুলের জন্ম ১৮৯৯-তে। একই বছর জন্মেছেন স্পেনের লোরকা এবং চিলির পাবলো নেরুদা। পুঁজিবাদবিরোধিতার যে আধুনিকতা ও আন্তর্জাতিকতা তা এদের তিনজনের মধ্যেই ছিল। তবে বাস্তব ঘটনা তো এই যে লোরকা ও নেরুদা যে ধরনের ইউরোপীয় পরিসর পেয়েছিলেন নজরুল তা পাননি, তবুও আবদ্ধ দেশে এবং দুঃসহ দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও নিজের ভেতরে তিনি একটি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছিলেন। নজরুল, লোরকা ও নেরুদা- তিনজনই ছিলেন মার্কসবাদী।
নজরুল এবং জীবনানন্দ দাশের জন্ম একই বছরে। নজরুল এতটাই প্রবল এবং জীবনানন্দ এমনই গ্রহণ-মনস্ক ছিলেন যে জীবনানন্দের প্রথম জীবনের কবিতায় নজরুলের প্রভাব বিলক্ষণ দেখা যায়। কিন্তু মৌলিক মনীষা-সম্পন্ন ছিলেন যেহেতু, তাই ওই প্রভাবে তিনি আবদ্ধ থাকেননি; বের হয়ে গেছেন অচিরেই। জীবনানন্দও পুঁজিবাদকে চিনেছিলেন, নিজের জীবনাভিজ্ঞতা ও পঠন-পাঠনের ভেতর দিয়ে। পুঁজিবাদ তাকে খাপ-খাওয়া মানুষ হতে দেয়নি। উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ জীবনানন্দ দাশ। পরিবারে সাহিত্যচর্চা ছিল, তার মাতাও কবিতা লিখতেন। কিন্তু জীবিকার অনিশ্চয়তায় তাকে ভুগতে হয়েছে। তার কবিতায় ও গল্পে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরোধিতা আছে, যদিও তিনি বিপ্লবী ছিলেন না মোটেই। সার্বক্ষণিক যন্ত্রণা তাকে বিষণ্ন করে রাখতো।
জসীমউদ্দীনের সঙ্গে তার মিল আছে মনে হবে, কারণ দু’জনেই গ্রাম বাংলা নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু পার্থক্য একেবারেই মৌলিক। জসীমউদ্দীন পুঁজিবাদের মোকাবিলা করেননি, জীবনানন্দ করেছেন। জসীমউদ্দীনের বাংলা-ভূখণ্ডও পুুঁজিবাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত, কিন্তু লেখেন তিনি গ্রামীণ জীবনের কথাই। ইতিহাসের যে চেতনা জীবনানন্দের কবিতাকে গভীরতা দিয়েছে জসীমউদ্দীনের কবিতাতে তা থাকবার কথা নয়, থাকেওনি।
নজরুল যে শেষাবধি টিকতে পারলেন না, নির্বাক হয়ে গেলেন অকালে, তার প্রধান কারণ পুঁজিবাদী নিষ্পেষণ। সংসারে অনটন ছিল, তার মধ্যে আবার দেখা দিল শোক ও ব্যাধি। আরেকটি কারণ সমাজ পরিবর্তনের রাজনৈতিক আন্দোলনের পক্ষে অগ্রসর হতে না-পারা। এ প্রসঙ্গে সমর সেনের কথা আসে। তিনিও বিপ্লবী ধারাতেই থাকতে চেয়েছিলেন; কিন্তু আন্দোলন যে এগুচ্ছে না সেটা বুঝতে পারছিলেন এবং টের পেলেন যে আকাক্সক্ষার সঙ্গে অভিজ্ঞতাকে মেলানো যাচ্ছে না। নিজের সীমানা তার জানা ছিল, সে-জন্য ১৯৪৬-তে এসে কবিতা লেখাই ছেড়ে দিলেন। এরপরেও অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন, পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, কিন্তু কবিতা থেকে গেলো পেছনেই। সুকান্ত ভট্টাচার্যের থামবার কথা নয়, কারণ কমিউনিস্ট পার্টির কাজের সঙ্গে তার যোগ ছিল একেবারে প্রত্যক্ষ; ওই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সাংগঠনিক ভাবে ব্যস্ত ছিলেন, অঙ্গীকার ছিল খুবই দৃঢ়। কিন্তু সুকান্ত তো মারা গেলেন ১৯৪৭ সালে পৌঁছেই, মাত্র একুশ বছর বয়সে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও আন্দোলনে ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি, দলত্যাগ করে চলে গেছেন রক্ষণশীলদের দলে। শ্রেণিগত অবস্থানকে তিনি ত্যাগ করবেন ভেবেছিলেন, চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু শেষ রক্ষাটা হয়নি। অবিকল না হলেও আর, একই রকমের ঘটনা কিন্তু ঘটেছে সমরেশ বসুর বেলাতেও। মেহনতীদের জীবন নিয়ে তিনি ‘গঙ্গা’ লিখেছেন ১৯৫৫-তে। মনে হচ্ছিল আরো এগুবেন। পারলেন না। শ্রেণি তাকে আটকে দিল। ১৯৬৫-তে তাকে লিখতে হয়েছে ‘বিবর’, গঙ্গা থেকে সে অনেক দূরের। ঢাকার সোমেন চন্দ মনেপ্রাণে যুক্ত হয়েছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনে, কিন্তু তিনিও সুকান্তের মতোই বেঁচে ছিলেন ওই একুশ বছরই। নিহত হয়েছেন জাতীয়তাবাদীদের হাতে। জাতীয়তাবাদে সমাজতন্ত্রে দ্ব›দ্বটা তখন বেশ প্রকট হয়ে উঠেছিল।
বুদ্ধদেব বসু ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম একই বছরে, ১৯০৮ সালে। কিন্তু পার্থক্য অনেক। একজন মূলত কবি, অপরজন পুরোপুরি কথাসাহিত্যিক। কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যবধান একেবারে গোড়াতেই। বুদ্ধদেব ভাববাদী, মানিক বস্তুবাদী। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম দুই উপন্যাস, পুতুল নাচের ইতিকথা এবং পদ্মানদীর মাঝি, অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য রচনা; সে-দু’টি উপন্যাসে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মেহনতী মানুষদের জীবনযাত্রার বাস্তব ছবি আছে; কিন্তু মার্কসবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের পরে তিনি যা লিখেছেন সে রচনা অন্যরকম, সেখানে শ্রেণি তো আছেই সঙ্গে রয়েছে মেহনতী মানুষের সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রের সংগ্রামের কথা। এই লেখাগুলো কিন্তু তেমন প্রচার পায়নি; কারণ বুর্জোয়াভাবাপন্ন গণমাধ্যমের জন্য এরা উপাদেয় বস্তু ছিল না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও দীর্ঘজীবন লাভ করেননি। বেঁচে ছিলেন মাত্র ৪৮ বছর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কলকাতায় গণনাট্য সংঘ ছিল। সংঘের কর্মীরা গান লিখেছেন, নাটক লিখেছেন, তাদের কাজ যথেষ্ট চাঞ্চল্য এমন কি উদ্দীপনারও সৃষ্টি করেছিল। গণনাট্য সংঘ কিন্তু যথার্থ অর্থে বিপ্লবী সংগঠন ছিল না। সেজন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বিরোধও দেখা দেয়; শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র আলাদা হয়ে যান, হেমাঙ্গ বিশ্বাস বের হয়ে গিয়ে নতুন সংগঠন গড়েন, সলিল চৌধুরীকে বোম্বে-কলকাতা করতে হয়, ভুপেন হাজারিকা শেষ পর্যন্ত সামিল হন বিজেপি’তে। এসবের পেছনে বড় একটা কারণ তাদেরকে আনুকূল্য দেবার মতো জোর ছিল না তৎকালীন বিপ্লবী আন্দোলনের।

তিন.
বিপ্লবী আন্দোলনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে সাতচল্লিশের দেশভাগে। পূর্ববঙ্গের ক্ষতিটাই বেশি। অখণ্ড বাংলাতে যে সাংস্কৃতিক জীবন ছিল পূর্ববঙ্গ তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। পূর্ববঙ্গে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের আগ্রাসন ক্রমাগত শক্তিশালী হলো। দেশভাগের সময়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বয়স মাত্র পঁচিশ। ওই বয়সেই তিনি পাকিস্তান যে কেমন রাষ্ট্র হবে সেটা বুঝে ফেলেছিলেন; স্বাধীনতা লাভের আনন্দে-উল্লসিত তার শ্রেণির অধিকাংশ মানুষ যেটা বুঝতে পারেনি। লালসালু উপন্যাসে তো কেবল একটি পশ্চাৎপদ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ছবি নেই, আছে ধর্মকে ব্যবহার করে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বাভাসও। পূর্বাভাসটি সত্য হতো, যদি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি গড়ে না উঠতো। শ্রেণির সীমা অতিক্রম করেই ওয়ালীউল্লাহ লালসালু লিখেছিলেন। কিন্তু ওই রকমের ও সমান গভীরতার উপন্যাস তিনি আর লিখতে পারেননি; শ্রেণিই বাধা দিয়েছে। তাকে বিদেশে চলে যেতে হয়েছে। থাকতে হয়েছে সেখানেই। স্ত্রী ছিলেন বিদেশিনী। একাত্তরের যুদ্ধের সময়ে প্রবাসেই ছিলেন; ভেতরে রক্তক্ষরণ ঘটেছে এবং দেশ-স্বাধীন হবার অল্পদিন আগে তিনি প্রাণ ত্যাগ করেছেন। স্মরণ করা যাক শামসুদ্দীন আবুল কালামের কথাও। পাকিস্তান হবার আগেই সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে হৃদয়স্পর্শী ছোট গল্প লিখেছেন তিনি। পাকিস্তান হওয়ার পরে লিখলেন কাশবনের কন্যা। কিন্তু তার শ্রেণি ঠেলে দিল তাকে ইতালির রোম শহরে। সেখনেই রয়ে গেলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। রাজনীতির লোক সত্যেন সেনের কাছ থেকে উপন্যাস প্রত্যাশিত ছিল না। তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে ছিলেন; সেকারণে জেল খেটেছেন ১৭ বছর; সাতচল্লিশের আগে ৬ বছর, পরে ১১ বছর। কিন্তু এর ভেতরই তিনি লিখেছেন এবং লেখাকে রাজনৈতিক কর্মের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। শ্রেণি তাকে নিষেধ করেছে রাজনীতিতে যুক্ত হতে, সে-নিষেধ তিনি মানেননি; এবং রাষ্ট্র আনুকূল্য দেবে কী পীড়ন করে তার সৃষ্টিশীলতাকে নষ্ট করতে চেয়েছে। সৃষ্টিশীলতা তবু অক্ষুণ্ন ছিল; তবে শেষ বয়সে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন লেখক ছিলেন শহীদুল্লাহ কায়সার। তাকেও রাষ্ট্র পীড়ন করেছে, আটক করে রেখেছে এবং রাষ্ট্রের ভৃত্যরা তাকে হত্যা করেছে একাত্তরে। কথাসাহিত্যিক শহীদ সাবের তাৎপর্যপূর্ণ লেখা রেখে গেছেন। আরো নিশ্চয়ই লিখতেন, কিন্তু রাষ্ট্র তার অনুকূলে ছিল না। অল্পবয়সে জেল খেটেছেন, বের হয়ে এসে সেই আন্দোলনকে আর খুঁজে পাননি কৈশোরে যা তাকে প্রাণিত করেছিল রাষ্ট্রশক্তির মুখোমুখি দাঁড়াতে। একাত্তরে প্রাণ হারিয়েছেন হানাদার পাকিস্তানিদের তাণ্ডবে।
চিত্রকলায় চাঞ্চল্যকর কাজ করেছেন জয়নুল আবেদিন; দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে। ভারতীয় চিত্রকলার তথাকথিত রীতির বেষ্টনী ভেঙে তিনি বের হয়ে এসেছেন, সরাসরি চলে গেছেন সমাজবাস্তবতার কাছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সমাজবাস্তবতার ওই নতুন ধারাতেই ছবি এঁকেছেন জয়নুল আবেদিন, তার সহকর্মীরা এবং তাদের ছাত্রছাত্রীবৃন্দ। মনে পড়ে ১৯৫০ সালে ঢাকায় প্রথম যখন প্রদর্শনী হয় এই শিল্পীদের কাজের তখন আমরা চমকে গেছি, বিশেষ করে তাদের ছবিতে সমাজবাস্তবতার মান ও বৈচিত্র্য দেখে। তবে তরুণরা সবাই যে ওই ধারায় থেকেছেন তা কিন্তু নয়। মধ্যবিত্তের জন্য রাষ্ট্র কিছু কিছু সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। মেধাবানদের জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছে বিদেশ গমনের। তরুণ শিল্পীরা অনেকেই বিদেশে গেছেন এবং ফিরে এসেছেন চিত্রকলা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা নিয়ে। তারা নিজের মতো করে এঁকেছেন। ওদিকে দেশে শিল্পকলার চাহিদাও কিছুটা বেড়েছে। পঞ্চাশ সালে যে নতুন যুগ এসেছে বলে মনে হয়েছিল, সেটা ঠিক ওই ভাবে এগোলো না। মূল কারণ সমাজ এগুলো পুঁজিবাদী ধারায়, তার প্রভাব শিল্পকলার ক্ষেত্রে গিয়ে পড়বে না কেন? পড়লো। ব্যতিক্রম হচ্ছেন এস এম সুলতান। তিনি ছিলেন জয়নুল আবেদিনের সমসাময়িক। তার ভেতরে এক ধরনের বিদ্রোহ ছিল। সে জন্য দেখা গেল কৃষক ও কৃষকের জীবন-সংগ্রামকে তিনি চিত্রকলায় নিয়ে এসেছেন; কিন্তু ওই কৃষক বাস্তবের কৃষকের মতো শীর্ণকায় নয়; বলিষ্ঠ, পেশীবহুল, সংগ্রামী মানুষদের যে রকমের হওয়াটা উচিত সে-রকমের। এককালে ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছেন কামরুল হাসান ও আবুল কাসেম; পরে এঁকেছেন শিশির ভট্টাচার্য; কিন্তু তাঁরা সুযোগ পাননি অনেক বেশী আঁকবার। কারণ রাষ্ট্র বদলেছে, কিন্তু আবার বদলায়ওনি, রয়ে গেছে তার স্বৈরশাসন। এবং সে-রাষ্ট্র চিত্রকলার জন্য প্রদর্শনীর আয়োজন করতে প্রস্তুত থাকলেও, ব্যঙ্গবিদ্রƒপ সহ্য করবার মতো নৈতিক সাহস রাখেনি। বলাবাহুল্য রাখছে না সে এখনও। বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন কার্টুনশূন্য। যারা হাসতে জানে না, কিংবা কেবলি অট্টহাসি শোনে, তাদের জন্য কান্না ছাড়া উপায় কি?
চলচ্চিত্রে চেষ্টা হয়েছে সমাজবাস্তবতাকে নিয়ে আসবার। কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। তবুও এগিয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে ছবি করেছেন জহির রায়হান; ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের উপস্থিতি আছে তার জীবন থেকে নেয়া ছবিতে; একাত্তরের যুদ্ধের ভেতর থেকেই ছবি তৈরি করেছেন স্টপ জেনোসাইড। কিন্তু তার পরে তো থেমে গেলেন। তাকে থামিয়ে দেওয়া হলো। তাকে হত্যাই করা হয়েছে। একাত্তরে নয়, তার পরে; নিহত হয়েছেন তিনি ঘাতকদের হাতে; একাত্তরে হারিয়ে-যাওয়া তার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে। আশা করা গিয়েছিল যে একাত্তরের পরে নতুন চলচ্চিত্র আন্দোলন গড়ে উঠবে। কিন্তু উঠলো না। কারণ পুঁজির সেবক জাতীয়তাবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় এলো এবং সর্বত্র যেমন চলচ্চিত্রেও তেমনি ব্যক্তিগত মালিকানা হয়ে দাঁড়ালো প্রধান সত্য। তাছাড়া চলচ্চিত্র তো কেবল পুঁজি চায় না, চায় উপযুক্ত দর্শকও। সেই দর্শক ক্রমশ হারিয়ে গেল, প্রথমে টেলিভিশনের কারণে এবং পরে স্থূল বিনোদনপ্রার্থীদের দাপটে।
স্বাধীনতার পরে বেশ নাড়াচাড়া দিয়ে একটি গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বেশী দূর এগোলো না। একটা কারণ মৌলিক নাটকের সরবরাহ ক্রমশ কমতে থাকলো। সমাজে দেখা দিয়েছিল একদিকে অস্থিরতা অন্যদিকে বন্ধ্যত্ব; তার প্রভাব অন্যত্র পড়েছে, নাটকলেখার ক্ষেত্রেও চলে এসেছে। ওদিকে গ্রুপের চেয়ে ব্যক্তি বড় হয়ে উঠতে থাকলো। যেটা অবশ্য পুঁজিবাদেরই অবদান। শিল্পীরা অনেকেই স্টার হয়ে চলে গেলেন টেলিভিশনে, কেউ কেউ গেলেন চলচ্চিত্রেও। গ্রাম থিয়েটার টিকলো না। সাড়া শব্দ করে গড়ে-ওঠা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যে শেষ পর্যন্ত প্রাণহীন এক সংস্থায় পরিণত হবে সেটাও ছিল অবধারিত। মূল কারণ রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যাবার যে প্রতিশ্রæতি নিয়ে তার আগমন, সে প্রতিশ্রæতি সে ভুলে গেল; অনুগামী হয়ে পড়লো রাষ্ট্রের শাসকদের।
মনে হয়েছিল স্বাধীন দেশে গান পাওয়া যাবে নতুন নতুন রকমের এবং প্রচুর পরিমাণে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গাওয়া গান স্বাধীন বাংলায় আরো অবাধ হবে। উদ্দীপক হবে। সেটাও ঘটলো না। গানের ক্ষেত্রে ব্যান্ড এলো, ইন্ডাস্ট্রি পর্যন্ত গড়ে উঠলো, কিন্তু সেই গান পাওয়া গেলো না যে গান উদ্দীপ্ত করবে মানুষকে, নতুন সমাজ গড়বার জন্য। ওই উদ্দীপনাটা সমাজে ছিল না। সমাজে ছিল ব্যবসা। ব্যবসা চলে এসেছে সঙ্গীতেও।
ওদিকে জনগণের পক্ষে দেশে সংবাদপত্র নেই। সমাজ-পরিবর্তনের আন্দোলন যারা করেন তারা নির্যাতিত হন রাষ্ট্রের দ্বারা, অবহেলা পান সংবাদপত্রের কাছ থেকেও। টেলিভিশনেরও ওই একই দশা। সরকারি টেলিভিশনের তো কথাই নেই, বেসরকারি টেলিভিশনও সরকারবিরোধী উপস্থাপনা পছন্দ করে না। সরকারবিরোধিতাকে রাষ্ট্রবিরোধিতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়; দমনপীড়ন ভীতিপ্রদর্শন সমানে চলতে থাকে। সমাজবাস্তবতা অনুপস্থিত রয়ে যায় গণমাধ্যমে। ক্ষমতাবানরা নিজেদের মধ্যে দ্ব›েদ্ব লিপ্ত হন; কিন্তু তাদের দৃঢ় অবস্থান থাকে সমাজপরিবর্তনকামী শক্তির বিরুদ্ধে; তাদের বিরুদ্ধাচরণ শিল্পসাহিত্যও এসে পড়ে। বছরে একবার বইমেলা হয়। কিন্তু সে-মেলা শিল্পমেলা হওয়ার দিকেই ধাবমান। শিল্পমেলাতে তবু পণ্যের কেনাবেচাটাই মুখ্য থাকে, বইমেলাতে বইয়ের কেনাবেচার চেয়ে ঢের বেশি ঘটে সামাজিক মেলামেশা। বইয়ের বেলাতে প্রধান যে অসুবিধা তা হলো প্রকাশক তবু আছে কিন্তু বিপণনের ব্যবস্থা খুবই সঙ্কীর্ণ। বইমেলার দিকে প্রকাশকরা তাকিয়ে থাকেন; কারণ তারা জানেন অন্য সময়ে বইয়ের খবর যে লোকের কাছে পৌঁছে দেবেন, পাঠকের হাতে যে বই সরাসরি তুলে দেবেন, তেমন সুযোগ অত্যন্ত অপ্রতুল।
সাহিত্যের কথা যখন ওঠে তখন অনুবাদের প্রসঙ্গটাও আসে। অনুবাদের কাজটা মোটেই সহজ নয়। ভাষাজ্ঞান তো লাগেই, প্রয়োজন হয় অন্যকে দেখিয়ে নেয়ার, অনুবাদ ঠিক হয়েছে কিনা সেটা বুঝে নেবার। সবটা মিলিয়ে অনুবাদ একটি সমবায়ী কাজ। একা একা করা মোটেই সম্ভব নয়। সমবায়ী উদ্যোগ চাই। সমবায়ী ওই চেষ্টার জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন, আগ্রহও প্রয়োজন। অভাব কিন্তু দু’টিরই। ফলে নিজেদের সাহিত্যকে আমরা বিশ্বের কাছে নিয়ে যেতে পারছি না; আবার বিশ্বের সাহিত্যকে যে কাছে নিয়ে এসে ভাষার ধারণ ও প্রকাশ ক্ষমতা বৃদ্ধি করবো, শিল্পগত উৎকর্ষের নিরিখকে আত্মস্থ করবো সেই সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।
এর সঙ্গে বলতেই হবে যে জ্ঞানের চর্চা ছাড়া শিল্প-সাহিত্যের বিকাশ একেবারেই অসম্ভব। জ্ঞান না থাকলে শিল্প-সাহিত্যের সারবস্তুতে ঘাটতি ঘটে। জ্ঞানের চর্চা বাংলাদেশে উৎসাহ পাচ্ছে না। এমনকি যথার্থ বিদ্যাচর্চাও অবহেলিত। বিদ্যা ক্রয়বিক্রয়ের পণ্য হতে চলেছে। বিশেষ ভাবে অবহেলিত হচ্ছে ইতিহাসের চর্চা। ইতিহাসের জ্ঞান না থাকলে অন্যজ্ঞান শুকনো হয়ে পড়ে। পড়ছেও।

চার.
মূল সত্যটা দাঁড়ায় এই যে শিল্প-সাহিত্যের প্রত্যেকটি রূপকল্পেরই নিজস্ব একটা ইতিহাস আছে; কিন্তু তাদের ইতিহাস আবার সমাজের ইতিহাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শিল্প-সাহিত্য মহৎ হয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবার চেষ্টা করে। সমাজের বিন্যাসের সঙ্গে তাকে দ্ব›েদ্ব লিপ্ত হতে হয়। দ্ব›দ্ব না থাকলে অস্তিত্ব হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু প্রাণ থাকে না। বিক্ষিপ্ত ভাবে এসব কথা অন্যত্র যে পাওয়া যায় না এমন নয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক ভাবে পাওয়া যায় মার্কসবাদে। সেখানেই সে অত্যন্ত বিশিষ্ট।
মার্কসবাদ এই সত্যটাকে ধরিয়ে দেয় যে শিল্পীরা শ্রেণির ভেতরে থেকেই কাজ করেন। কিন্তু শ্রেণির বন্ধন ডিঙিয়ে তারা হতে চান সর্বজনের, আকাক্সক্ষা থাকে হবেন সর্বকালীন। সর্বজনীনতা ও সর্বকালীনতা শ্রেণি-উত্তরণের দরুনই ঘটে। এই উত্তরণকে শ্রেণিচ্যুতি বললেও অন্যায় হবে না। শিল্প-সাহিত্য ব্যক্তিরই সৃষ্টি, কিন্তু ওই সৃষ্টি ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকে না, সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই চলে যায় সামাজিক মালিকানায়। তৎকালীন এবং অনেককালীন মালিকানায়। আর সর্বকালীন হলে তো কথাই নেই। সেখানে তো অমর সৃষ্টি। চরম সার্থকতা।
পৃথিবী জুড়ে এখন পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য চলছে। পুঁজিবাদ ব্যক্তিমালিকানা ও মুনাফায় বিশ্বাস করে এবং সবকিছুকে পণ্যতে পরিণত করে ফেলবে ভাবে। পুঁজিবাদ মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির বিচ্ছিন্নতা ক্রমাগত বাড়াতে থাকে। বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদ এখন মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির পথে অন্তরায় শুধু নয়, শত্রæপক্ষেই পরিণত হয়েছে। শিল্প-সাহিত্যের কাজ ঐক্যের বন্ধনকে, সহমর্মিতার অনুভবকে শক্তিশালী করা। শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে তাই পুঁজিবাদের দ্ব›দ্ব চলছে।
এই ব্যবস্থাটিকে ভাঙা চাই। শিল্প-সাহিত্য একাই যে একে ভাঙতে পারবে তা মোটেই নয়। তবে শিল্প-সাহিত্য অনুপ্রেরণা ও শক্তি যোগাতে অবশ্যই পারবে সেই আন্দোলনকে। বদলাবে মানুষই, কিন্তু বদলাবার জন্য শক্তি চাই। সে শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিকারীদের নয়, তার বিপরীতে দাঁড়ানো মেহনতী মানুষের। মার্কসবাদ এই সত্যটাকেই বিশেষভাবে জানিয়ে দেয়। জানিয়ে দেয় এই কথাটাও যে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা যেমন ইতিহাসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তেমনি ইতিহাস নিজেও এগোয় শিল্প-সাহিত্যের অগ্রসরমানতার কারণে। সেই সঙ্গে বলে যে মানুষের সভ্যতার ইতিহাস সামনের দিকেই যাবে, পিছনমুখো হবে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়