করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

নমপেনে হারিয়ে যাওয়া চশমা

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এক.
আমি যখন কম্বোডিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সিয়াম রিপে গিয়ে পৌঁছাই তখন ওদের দুপুর গড়িয়ে গেছে। নভেম্বর মাস। এশিয়ার এই অঞলে তখন শীতকাল হওয়ার কথা। সে রকম ধারণা করেই এসেছিলাম তপ্ত রোদের সিডনি থেকে। সরাসরি আসার কোনো সুযোগ নাই। অতটা পথ সরাসরি আসি নাই এসব দেশে। ফলে মাঝপথে থাইল্যান্ডে কিছু সময়ের যাত্রা বিরতি শেষে যখন সিয়াম রিপে নামলাম দেখি বাইরের আবহাওয়া বেশ ঊষ্ণ। শুধু গরম বললে ভুল হবে এ হলো ঘাম ঝরানো প্যাঁচে প্যাঁচে গরম। ছোটখাটো একটা এয়ারপোর্ট। অথচ দলে দলে আসছেন বিদেশি পর্যটক। ফরাসি দেশের পযর্টকরাই সম্ভবত একটু বেশি সংখ্যায়। কারণ এই কম্বোডিয়া তো তাদের দখলেই ছিল একসময়। যে কারণে তার নাম বলা হতো কম্পুচিয়া।
শুরুতে রাজধানী নমপেন না গিয়ে সিয়াম রিপে যাওয়ার কারণ ছিল দুটি। থাইল্যান্ড থেকে ঢোকার পথটা সহজ। আর এটাই মূলত পর্যটন নগরী। দুনিয়াখ্যাত এনকর ওয়াট মন্দিরটি বারশ শতাব্দীতে নির্মিত এক চমৎকার বৌদ্ধ মন্দির। রাজা সূর্যবর্মণ নির্মিত এই মন্দিরটির ভেতরে আশ্চর্য দুটো বিষয় দেখেছি। যারা কোনোদিন ভারতে আসেননি সেসব শিল্পী গল্প শুনে শুনে মন্দিরের গায়ে এঁকে রেখেছেন মহাভারতের পুরো গল্প। আছে রামায়ণও। এ এক অদ্ভুত শিহরণ। বলাবাহুল্য তারা এঁকেছেন তাদের মতো করে। মন্দিরটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কিন্তু সহাবস্থান চমৎকার। আরো একটা বিশেষ কারণ আছে এই মন্দিরে যাওয়ার। সবাই জানি ভয়ংকর সব যুদ্ধ বিগ্রহ আর গৃহযুদ্ধের ভেতর দিয়ে যাওয়া রাষ্ট্র কম্বোডিয়া। আমাদের গাইড গল্পটি বলছিলেন। একসময় রাজা সিহানুকের সৈন্যরা এই মন্দিরের ভেতর আশ্রয় নিয়ে প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল পলপটের গেরিলা যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। একসময় পলপট বাহিনী তাদের প্রায় ঘিরে ফেলার পর ঘোষণা দিয়েছিল তারা যদি বেরিয়ে এসে আত্মসমর্পণ না করে তো পুরো মন্দির উড়িয়ে দেয়া হবে। এ খবর পৌঁছে গেল রাজা সিহানুকের দরবারে। এখানে একটা কথা বলি আমরা আমাদের দেশে বলতাম নরোদম সিহানুক। নামটা বলে ও শুনতে কেমন জানি খটকা লাগত। কম্বোডিয়া যাওয়ার পর ওদের মুখে নামের প্রকৃত উচ্চারণ আর নামটা শুনে জানলাম তার নাম ছিল নরোত্তম সিহানুক। তো রাজা সিহানুক কি সিদ্ধান্ত নেবেন তার ওপর নির্ভর করছিল এই এনকার ওয়েটের ভবিষ্যৎ। রাজা ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যুদ্ধে তার বা বাহিনীর পরাজয় হলেও এই দেশ থাকবে। এই মন্দিরও থাকা উচিত। কারণ এটি তাদের জাতীয় প্রতীক তাদের পরিচয় ও পর্যটনের উৎস। রাজা সিহানুক সৈন্যদের আত্মসমর্পণের আদেশ দিয়ে পরাজয় মেনে এই মন্দির বাঁচিয়েছিলেন। প্রখর রোদে তালুফাটা গরমে আমরা এটি দেখার পর বাইরে দাঁড়ানো সারি সারি তরুণী তাদের হাতে থাকা শামুকের মালা টুপি ওড়না ফটো এসব বিক্রির জন্য ধরনা দিয়ে ছেঁকে ধরেছিল। কি আপনি কিনবেন আর কিনবেন না সেটা আপনার পছন্দ কিন্তু একটা বই আপনাকে কিনতেই হবে। নানা ধরনের নানা সাইজের সেসব বইয়ের বিষয় একটা। এনকার ওয়েট আর তার কাহিনী। আমার বারবার মনে হচ্ছিল বাংলাদেশে যতটুকু বা যেটুকু পর্যটন সেখানে খাবার, বিলাসসামগ্রী পোশাক বা উপহার আইটেম থাকলেও ইতিহাস বা জায়গাটি নিয়ে কোনো বই পাবেন না। বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত বলে আমরা কক্সবাজার নিয়ে গর্ব করি কিন্তু সেখানে বেড়াতে গেলে কি এমন কোনো বইয়ের সন্ধান পাবেন? না কেউ এসে আপনাকে অনুরোধ করবে কক্সবাজারের ইতিহাস জানতে? এটাই আমাদের দেশে পর্যটন আর ভ্রমণ বাণিজ্যের বড় ব্যর্থতা।
সিয়াম রিপে আমার আরো দুটো অভিজ্ঞতা চমৎকার। ভারতের ইতিহাসে বা আমাদের শিল্প সাহিত্যে সমুদ্রমন্থন এক চমৎকার বিষয়। দেবতা ও অসুরের যৌথ মন্থনে সমুদ্রের তলদেশ থেকে যে অমৃত উঠে আসে তা নিয়ে দেবতা অসুরের লড়াই বহুভাবে এসেছে গল্প উপন্যাস বা কবিতায়। গানে গানে বিস্তার লাভ করা এই কথিত অমৃতের জন্য লড়াইয়ের মর্মর মূর্তি দেখলাম সিয়াম রিপে। সময়ের স্রোতে দেখভাল না করার কারণে হয়তো মূর্তিগুলোর গায়ে ছিল কালো দাগ। কোথাও কোথাও নাক মুখ ভাঙা। কিন্তু সে সব ইতিহাস তারা যতœ করে রেখে দিয়েছেন। একদিকে ইন্দ্র বরূন কুবের সব দেবতা অন্যদিকে রাবণ মেঘনাদ এমন সব বীরের দল। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের আগমনে জমে ওঠা এই চমৎকার জায়গাটি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছিল প্রাচীন কালের এক ধূসর জগতে।
আর একটি বিষয় ছিল আধুনিকতা। সব রেস্তোরাঁ হোটেল পর্যটন কেন্দ্রে নারীদের জয়জয়কার। আমি যখন সেখানে যাই তখন মোবাইলে এতসব কিছু করা যেত না। ফলে লেখা পাঠানোর জন্য তাদের দোকানে গিয়ে কম্পিউটার ব্যবহার করা কিংবা ফ্যাক্স করতে হতো। রাত দুপুরেও আমি দেখেছি নির্ভয়ে কাজ করছে একা কোনো তরুণী। মজার ব্যাপার এই যে, আমেরিকা বা ইউরোপের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করেছিল আজ সে সব দেশের মানুষদের ভালোবাসতে পেরে তাদের দেশে আনতে পারলেই ধন্য মনে করত তারা। এখানে একটা বিষয় বলা জরুরি। আমরা যেমন একবার কাউকে শত্রæ বা দুশমন মনে করি সেটা নিয়েই প্রজন্মের পর প্রজন্ম তর্ক-বিতর্কে সময় পার করি, এরা তা করে না। অদ্ভুত ব্যাপার ছিল তাদের এ টি এম থেকে টাকা বের করা। প্রথমটায় বিশ্বাস না হলেও পরে দেখি আসলেই তাই। আপনি হয়তো ওদের টাকা বের করতে পারেন অথবা মার্কিন ডলার। বাটন চিপতেই সবুজ সাদা কড়কড়ে আমেরিকান ডলারগুলো যেন আমার দিকে চোখ পাকিয়ে হাসতে হাসতে বলছিল, দেখলে কাণ্ডটা? বাম বিপ্লবের দেশের এটিএমেও আমার জয়জয়কার। সে রাতে আমরা ১১ মার্কিন ডলারে ঊর্বশীর নাচ দেখে এসেছিলাম। জী না। ঊর্বশী মেনকা এরা শুধু ভারতের না। এরা নাক খাটো প্রশস্ত কপাল আর চোখ ছোট সুন্দরী হতে পারে। সে রাতে সত্যি আমার খুব ভালো ঘুম হয়েছিল। হোটেল রুমের পাশের গাছের কোঠরে লুকিয়ে থাকা তক্ষকের রাত জাগা ডাক অন্যদিন ঘুম ভাঙাতে পারলেও সে রাতে পারেনি।

দুই.
আমি কোনো রাজনৈতিক ইতিহাস লিখছি না। কিন্তু এই দেশটি মানেই রাজনীতি। এর ইতিহাস আর অতীতের সঙ্গে আমাদের মিল আছে। এরাও যুদ্ধ গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত এক জাতি। যাদের জীবনে প্রবীণ মানুষরা নেই বললেই চলে। এখন যারা প্রবীণ হয়েছেন তাদের কথা আলাদা। কিন্তু গৃহযুদ্ধ আর ভিয়েতনামীদের হাতে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছিল এদের অগ্রজরা। আমি কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনের ভ্রমণসূচিতে যতগুলো জাদুঘর ছিল সব অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। সিয়াম রিপ থেকে যখন কম্বোডিয়ার রাজধানীর উদ্দেশ্যে উড়াল দিয়েছিলাম তখন থেকেই আমার মনে একটা ভাবনা কাজ করতে শুরু করেছে। একসময় যৌবনে আমাদের সময় বর্জিত নেতা কাজী জাফর আহমেদ বা রাশেদ খান মেননের মতো নেতারা বিশ্বাস করতেন পলপট না কি একজন খাঁটি বিপ্লবী। সে সময়কালে বাংলাদেশের দেয়াল লিখনে লেখা থাকত : পলপট তুমি এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সাথে। পরবর্তীকালে যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যার দায়ে দায়ী পলপটের হাল আমরা সবাই জানি। এত ঘৃণিত একজন মানুষকে কী করে আমাদের নেতারা ভালোবাসতেন জানি না। একটু চোখ বুলিয়ে নিই ইতিহাসে:
পলপটের দল রাজধানী নমপেন দখল করলে ১৯৭৫ সালে তিনি কম্বোডিয়ার শাসনক্ষমতা লাভ করেন এবং ১৯৭৯ সালে পার্শ্ববর্তী ভিয়েতনাম কর্তৃক ক্ষমতা থেকে উৎখাত হন। পলপট অত্যন্ত নিষ্ঠুর ছিলেন এবং তার চার বছরের শাসনকালে কম্বোডিয়ার ৮০ লাখ জনগোষ্ঠীর ১৫ থেকে ২০ লাখের মতো লোক দুর্ভিক্ষে মারা যায়।
খেমাররুজদের নেতৃত্বে কিছুসংখ্যক চীনা ও ভিয়েতনামী বংশোদ্ভূত ব্যক্তি ছিলেন। তারা জাতিগোষ্ঠী নিধন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য অংশগ্রহণ করেছেন। পলপট সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিলুপ্তি চেয়েছিলেন ও সমাজ ব্যবস্থাকে কৃষিভিত্তিক ব্যবস্থার দিকে ধাবিত করতে চেয়েছেন। ১৯৭৫ সালে চীনে বলেন যে, খেমাররুজদের প্রধান হিসেবে তিনি কালক্ষেপণ না করে মাঝারি পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে চান। শহরগুলোয় অবস্থানকারী চীনা ও ভিয়েতনামীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষিকাজে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতিতে তাদেরকে বিতাড়িত করা হয়, খেমাররুজদের পরিচালিত শ্রমশিবিরে প্রেরণ করা হয় ও নিজেদের ভাষায় কথা বলতে নিষেধ করা হয়।
খেমাররুজদের সমর্থনে সিহানুক তৃণমূল পর্যায়ে পরিদর্শনে গেলে যোদ্ধার সংখ্যা ছয় হাজার থেকে বেড়ে পঞ্চাশ হাজারে পৌঁছে। নতুন যোদ্ধারা চাষি ছিল। তারা রাজার সমর্থনে যুদ্ধ করতে আসে; সমাজতন্ত্রের জন্যে নয়। [১৫] লন নল সরকারের বিপক্ষে খেমাররুজদের পক্ষে অনেক লোক সহায়তার জন্য এগিয়ে আসে। তারা সিহানুকের পুনর্বহাল দেখতে চেয়েছিল। ১৯৭৫ সালে সরকার পতন কেবলমাত্র সময়ের দাবি ছিল। ১৭ এপ্রিল, ১৯৭৫ তারিখে খেমাররুজ দল নমপেন করায়ত্ত করে।
পলপট বিশ্বাস করতেন কৃষক ছাড়া না কি সবার রক্ত দূষিত এবং তিনি তার দেশে কোনো বুদ্ধিজীবী এমনকি লেখাপড়া জানা মানুষদেরও সহ্য করতেন না। আমি এক দুপুরের গনগনে রোদের আঁচ এড়িয়ে ঢুকে পড়েছিলাম হাইস্কুলে সাইজের জাতীয় জাদুঘরে। সাদামাটা জাদুঘরটি বাইরে যেমন হোক ভেতরে মানুষের কান্না আর জান বাঁচানোর আর্তিতে আকুল। তাদের রক্তের মতো লাল দেয়ালগুলো যেন বলছিল এভাবেই হত্যা করা হয়েছিল আমাদের। কীভাবে মারত নিজ দেশের মানুষদের? কীভাবে অত্যাচার করা হতো তাদের ওপর?
১৯৭৫ সালের আগে চোয়েয়ুঙ্গ এক ছিল ফাঁকা মাঠ। মাঠে নানা রকম গাছ। একপাশে চিনেদের কবরখানা। ১৯৭৫ সালের পর ওই চোয়েয়ুঙ্গ এক-ই হয়ে উঠেছিল খেমাররুজদের বধ্যভূমি। প্রায় ২০,০০০ মানুষকে ওখানে মেরে ফেলা হয়েছিল। একটি ১৯৮০ সালের পর ওখানকার একটি গণকবরে প্রায় সাড়ে আট হাজার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। মৃত্যুর আগে প্রায় সবাই টুঅল স্লেঙ্গ এ ছিল। বন্দিরা প্রথমে মাঠের ওপর একটা গর্ত খুঁড়ত। গর্ত খোঁড়া শেষ হলে বন্দিদের গর্তের পাশে দাঁড়াতে বলত খেমাররুজরা। হত্যাযজ্ঞের সময় পলপট সরকার বুলেট খরচ করত না। যে কারণে, খেমাররুজদের হাতে থাকত রড, কখনো কখনো কোদাল নিড়ানির মতো ভোঁতাও ব্যবহার করত তারা। খেমাররুজরা বন্দিদের পিটিয়ে পিটিয়ে মারত। গাছের গুঁড়িতে আছড়ে মারত শিশুদের।
আশির দশকে একটি বৌদ্ধ স্তূপ নির্মাণ করা হয়েছে চোয়েয়ুঙ্গ এক-এ। সাদা রঙের ছোট্ট একটা বাড়ি। চারিদিকে কাচে ঘেরা। বাইরে থেকে দেখা যায় ভিতরে কী আছে। ভিতরের পরপর কয়েকটা প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্মের ওপর খুলির পাহাড়। সর্বমোট ৫০০০ খুলি রয়েছে! নানা বয়েসি মানুষের খুলি। নারী, পুরুষ, শিশুর। বেশির ভাগ খুলিতেই ফাটল। আঘাতের চিহ্ন …
এসব মৃত্যু খেমাররুজ পলপট সরকারের ঠাণ্ডা মাথার পরিকল্পনা। পলপট সরকার যে কোনো সন্দেহভাজনকে প্রথমে দু-বার সতর্কবাণী পাঠাত। তারপর তাদের আসতে বলা হতো কোনো গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলত- দোষ স্বীকার কর। তা হলে তোমাকে ছেড়ে দেয়া হবে। বল তুমি বিদেশিদের চেন, তুমি কি আমেরিকানদের চেন? বল, বল, নইলে তোমার স্লেট ক্লিন করে দেব। তার মানে এখন তুমি প্রথমে যাবে টুঅল স্লেঙ্গ। সেখানে তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সামান্য উত্তম মধ্যম দেয়া হবে। পরে তোমাকে পাঠানো হবে চোয়েয়ুঙ্গ এক-এ। মেরে ফেলার জন্য। তোমার মাথায় মোটা শক্ত কাঠ দিয়ে আঘাত করা হবে। ভবিষ্যতের মানুষ দেখবে তোমার মাথায় ফাটল, আঘাতের চিহ্ন…
এমন নিষ্ঠুরতাই শেষ কথা না। আমি বিস্ময় ও লজ্জায় হতবাক হয়ে পড়েছি পলপটের আমলে কী কী আইন ও রুল জারি করা হয়েছিল সে দেশে। লম্বা তালিকার শেষদিকে লেখা ছিল কেউ যদি মৈথুন করে বা আত্ম মৈথুন করেছে জানা যায়, তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। এমনকি ভারী চশমা পরিহিত তরুণ বা মাঝবয়সি মানুষগুলোও ছিল সরকারের দুশমন। তাদের ধারণা এরা পড়াশোনা করে আর আমেরিকা ইউরোপের সঙ্গে তাল মিলাতে চায়। ফলে বিপ্লবের স্বার্থে এদের জবাই করতে হবে।
আমাদের দেশের একাত্তরের সঙ্গে অনেক মিল পাই আমি। আমাদের দেশ যখন পাকিস্তানিদের বুটের তলায় তখন তারাও চাইতো না আমরা বাংলায় কথা বলি। তারা আমাদের নারীদের পোশাক পরিচ্ছদ পছন্দ করত না। যুবক আর প্রগতিশীল বাঙালি ছিল তাদের মূল টার্গেট। হত্যাকাণ্ড ও মোটামুটি একধরনের। আর একটা যেটা ভাবার বিষয় কম্বোডিয়াতেও পলপটের এসব জঘন্য কাজে সহায়তা করা আর ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার জন্য গড়ে উঠছিল খেমাররুজ বাহিনী নামের লাল দল। যা আমাদের দালাল রাজাকারদের মতো। এরাই তালিকা করত এরাই ধরে নিয়ে যেত এরা যাদের নিয়ে যেত আমাদের দেশের মতো তারা আর ফিরতে পারত না। জাদুঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছড়ানো হাহাকার আর কান্নার শব্দ। দেখে শুনে ফেরার পথে শেষ ঘরটিতে গেলাম। বুঝতে পারিনি এখানে সবুর করছিল চমক।
চমকটা কী? আমাদের দেশের কথা দিয়েই বলি- এত প্রাণঘাতী যুদ্ধ এত হানাহানি আর নারীর ইজ্জত লুণ্ঠনের পরও আমরা সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আপাতত ফাঁসি ও নিষিদ্ধ করার কারণে রাজাকার চক্র দমিত থাকলেও যে কোনো সময় তাদের ফিরে আসা অসম্ভব কিছু না। এর বাইরে আর একটি বাস্তবতা হচ্ছে কিছুদিন পর পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি নামে পরিচিত দলের কেউকেটা কেউ না কেউ জায়গা বদলে অন্যদিকে সরে যান। কথা বলেন ভিন্ন ভাষায়। কিছুদিন এসব নিয়ে হৈ চৈ তারপর আবার সেই নাটক। যার মানে হচ্ছে সমঝোতা বা সহাবস্থান নাই। হয়নি।
নমপেনের জাদুঘরের চমকটা ছিল তাদের দালালদের আত্মসমর্পণ ও সমাজে ফেরার জন্য মাফ চেয়ে লেখা বিশাল বিশাল দরখাস্ত। দেয়ালজুড়ে টাঙ্গানো এসব আবেদন নিবেদন পড়লেই বোঝা যায় কেন আজ তাদের নতুন গৃহযুদ্ধের হুমকির মুখোমুখি হতে হয় না। কেন তারা শান্তি অশান্তি শত্রæমিত্রের বিষয়গুলো ঠিক করে নিতে পেরেছে। এই আত্মগøানি বা নিজের দোষ স্বীকার করার কালচার আমাদের সমাজে নাই। আমাদের দেশে গণহত্যাকারীদের দালালরা কখনো তাদের ভুল স্বীকার করেনি। তারা সম্মিলিতভাবে কিংবা ব্যক্তিগতভাবে কখনো মাফ চায়নি। উল্টো তাদেরই মাফ করে দেয়া হয়েছিল। কেন তারা কৃতকর্মের জন্য মাফ চাইল না? কেন আমরা পারলাম না রিকনসিলিয়েশন বা সমঝোতার চূড়ান্ত জায়গাটি ঠিক করতে? নমপেনের জাদুঘরে এই প্রশ্ন আরো তাড়া করছিল যখন পড়ছিলাম তাদের সরকার বা কর্তারাও এ বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। সবার তখন একটাই ভাবনা- এদেশে যাদের থাকতে হবে তারা কেন সমঝোতা আর শান্তিতে থাকবে না?
আমাদের সমাজ আর রাজনীতির জন্য সংস্কৃতির জন্য এই ভাবনা ভাবার সময় হয়নি কারো। এখন এমন এক অবস্থা কেউ কারো কথা শুনবেন না। মানবেনও না। যারা অপরাধী তাদের বাধ্যও করতে পারিনি আমরা। ওরা তলে তলে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করছে করেছে এবং করবে। আমরা মুখে মুখে মিডিয়ায় বলশালী হলেও বাস্তবে আমাদের ভবিষ্যৎ কী বা কেমন তা সবাই বুঝতে পারেন।

তিন.
দুদিন পর নমপেন এয়ারপোর্টে যাচ্ছিলাম ফিরে আসব বলে। এই ক’দিন গাইড কম্বোডিয়ান মানুষটির সঙ্গে আমাদের বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছিল। তাকে ছোট করে সুক নামে ডাকলেও তার আসল নাম বেশ দীর্ঘ। সে জানে আমি চা পছন্দ করি। পথে ভালো একটি রেস্তরোঁর পাশে গাড়ি থামিয়ে আমাদের জন্য দুকাপ গরম চা নিয়ে এসেছিল সুক। তার হাতেও ছিল ধোঁয়া ওঠা গরম কফির কাপ। চোখে মুখে কেমন জানি বিষণ্নতা। বারবার বলছিল তোমাদের খুব মিস করব। বাঙালিরা কি সবাই এমন ভালো? আমি মাথা নেড়ে উৎসাহ দিচ্ছিলাম আর ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম নিজের মনে। এয়ারপোর্টে নেমে দরকারি কাজগুলো সেরে ফরম পূরণ করার জন্য পকেটে হাত দিয়ে দেখি আমার চশমা নাই। এদিক ওদিক সবদিক খুঁজে ব্যাগগুলো তন্ন তন্ন করেও পাওয়া গেল না সাধের চশমা। ফ্রেমটা দারণ পছন্দের ছিল উল্টোদিক থেকে ঘোরানো বলে। দীপার কাছে সবকিছু মজুদ থাকে। দ্বিতীয় জোড়া চশমা হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে কাকে যেন ফোন করল ও। আমাকে ফোনটা দিলে কানে লাগিয়ে শুনি সুকের গলা। বলছে অজয় তুমি তো চশমাটা গাড়িতে ফেলে গেছো। আসব আমি? আমি বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দেখি ফ্লাইট ছাড়ার বাকি আর মাত্র আধঘণ্টা। আর আমাকে কোনোভাবেই ইমিগ্রেশন করার পর বাইরে যেতে দেবে না। হাসতে হাসতে বলেছিলাম, সুক তোমার পলপট মরলে কী হবে তার ভূত তো আছে তার ভয়েই চশমা ফেলে এলাম যেন ধরে নিয়ে না যায়… সুকের হাসির রেশ মিলিয়ে গেল রাস্তার গাড়ির শব্দে। আমি ফোন রাখতে রাখতে ভাবলাম পলপট থেকে ইয়াহিয়া ঢাকা থেকে কম্বোডিয়া দেবতা ও দানবের চেহারা এক অভিন্ন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়