করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

পদ্ম বিলে জ্যোৎস্না

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রাস্তাটা সোজা উত্তরমুখী। দু’পাশে বর্ষার থইথই পানি। বেশ দূর পর্যন্ত ঘরবাড়ির নিশানা নেই। হু হু করে পুবাল বাতাস বয়ে যাচ্ছে পানি ছুঁয়ে। হালকা ঢেউ তুলে অথই জল রাস্তার ধার অনবরত থাপড়ে চলেছে। তারই ছপছপ শব্দ ছাড়া চারদিক প্রায় নিঃশব্দ। পশ্চিমে সূর্য অদৃশ্য হলেও আকাশের আলোক আভা তখনও পুরোপুরি উধাও হয়নি। তারই মোহনীয় ছটায় চরাচর মায়াময়। একটু পরেই টুপ করে এগিয়ে আসবে অন্ধকার।
বাসটা হু হু করে ছুটছিল ঠাণ্ডা বাতাস কেটে। বাসের ভেতরে নতুন বউ মাবেলা। স্বামী করিমুল্লার সাথে প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। আজ দুপুরে আঁৎকা তার মামি ‘ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’র মতো বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। স্বামীর মুখের দিকে ভালো করে এখনো তাকায়ওনি মাবেলা। লোকটা নিশ্চয়ই খুব বোকা, না হলে জানা নেই শোনা নেই দেখা নেই, বিয়ে করে ফেলল একটা মেয়েকে! বোকা লোক মাবেলার পছন্দ না। মামির কথায় উঠবোস করা মামাকে দেখে দেখে মাবেলা চেয়েছিল তার স্বামীটার যেন একটু বুদ্ধিশুদ্ধি থাকে। এখন বোকা স্বামী নিয়ে কী করবে ভেবে না পেয়ে সে হতাশভাবে বসে আছে। প্রায় ঘণ্টাতিনেক পেরিয়ে গেছে, আর কতদূর যেতে হবে কে জানে। মাবেলার হিসি পেয়েছে। পানি পিপাসাও। কিন্তু পাশে আড়ষ্ঠ হয়ে বসে থাকা বেকুব লোকটাকে কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না।
আরো কিছুক্ষণ চলার পর অন্ধকারে বাজার মতো একটা জায়গায় বাসটা থামলে মাবেলার স্বামী করিমুল্লা আড়ষ্ঠভাবে বলে, ‘উঠো, নামতে হইব।’ বলে সে হাতটা বাড়িয়ে দেয় মাবেলার দিকে। মাবেলার হাত ধরে সাবধানে নামিয়ে নেয় বাস থেকে। এই যতœটুকু পেয়ে মাবেলার এতক্ষণের ক্ষোভ দুঃখ একটু তরল হয়ে পড়ে। সে মুখ তুলে স্বামীর দিকে তাকায়। কিন্তু অন্ধকারে চেহারা দেখা যায় না। কেবল চোখ দুটোতে একটু আলো ফুটে আছে যেন।
বাস থেকে নামার পর কয়েক মিনিটের হাঁটা পথ পেরিয়ে নতুন সংসারে উঠল মাবেলা। বাড়িতে তখন তার শ্বশুর ছাড়া আর কেউ ছিল না। ওদের দেখে শ্বশুর লোকটা শুকনোভাবে, আইছ- বলে স্বাগত জানিয়েই অন্ধকারে হারিয়ে গেল। ফিরল দু’জন মহিলাকে নিয়ে। করিমুল্লার চাচাত ভাইয়ের বউ তারা। অনেকটা রাত পর্যন্ত তারা মাবেলার সঙ্গে থাকল। কোথায় হিসি করার জায়গা, কোথায় রিং সø্যাবের আধপাকা পায়খানা, কোথায় টিউবওয়েল- দেখিয়ে দিল। আর তার ফাঁকে ফাঁকে, বিস্তর অশ্লীল রসিকতা করল। রাতের খাবাব-দাবার তারাই নিয়ে আসলো। মাবেলার সাথে বসে খেতে খেতে একজন বলল, ‘প্যাট ভাইরা খাইওনা, খাওন তো পইড়া আছে।’ বলেই হিহি করে হেসে অন্যের গায়ে এলিয়ে পড়ল। মাবেলার গা কেমন করে। ওকে আবার হিসিখানা থেকে ঘুরিয়ে ঘরে পৌঁছে দিয়ে তারা চলে যায়। করিমুল্লাকে ডাক দিয়ে বলে, ‘লও রেডি কইরা দিয়া গেলাম। তয় বেশি কচলাইও না। বেশি কচলাইলে তিতা লাগব।’ বলে আবার তারা হাসিতে ভেঙে পড়ে। মাবেলা লজ্জায় মাথার কাপড়টা টেনে নামিয়ে দেয় সামনে। তারা চলে যেতেই করিমুল্লা দীর্ঘ হাই তুলে ঘরের দরজায় ছিটকিনি তুলে দেয়।
পরদিন থেকেই সংসারের হাল ধরতে হলো মাবেলাকে। পাঁচ বছর ধরে চলা দু’জন পুরুষ লোকের সংসারের যত গিধড় সাফ করতে শুরু করল সে। নতুন বউ বলে তাকে আল্লাদ দেবার কেউ নেই এ সংসারে। তবে তার জন্যে মাবেলার দুঃখ হয় না কোনো। সে অভ্যস্ত দক্ষতায় সংসারে শ্রী ফেরাতে মগ্ন হয় খুশি মনেই।
দু’দিন পরে, খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিনও। করিমুল্লা আর তার বাপ ঘরের বারান্দায় বসে ছিল মুখ ভার করে। তাদের দেখে মাবেলা অবাক। দু’দুটো মানুষ কাছাকাছি বসেও চুপ করে থাকে কীভাবে? শ্বশুরকে সে এ পর্যন্ত কথা কমই বলতে শুনেছে। করিমুল্লাও বাপের মতোই। দরকার ছাড়া কথা বলে যেন গুনে গুনে। তাই বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাছাকাছি বসে দু’চারটে কথা বলবে না! বাড়িটা খুব বেশি নিরিবিলি। একটু দম আটকানো লাগে। তবে খন্ডারনী মামির সারাক্ষণ দাঁত খিঁচানো সহ্য করার চেয়ে ভালো।
দু’দিন একনাগাড়ে বৃষ্টির পরদিন একেবারে ঝকঝকে রোদ নিয়ে সকাল হলো। ঘুম ভেঙে মুড়ি চা খেয়েই বাপ-পুতে বেরিয়ে গেল তাড়াতাড়ি। মাবেলাকে করিমুল্লা শুধু বলে গেল, ‘কামে যাই। দুফারে আইয়া খামু।’
খালি বাড়িতে একটু কাজ করতে করতে মাবেলা গুনগুন করে গান করতে লাগল-

ক্যান বোজোনা লকখি সোনা সত্যি কইতাছি
তোর দিলের দরজায় আমি খটখট করতাছি
ক্যান বোজোনা জাদু সোনা হাচা কইতাছি
তোর দিলের দরজায় আমি ঘুইরা যাইতাছি
সাচ্চা দিল দিয়া আমি তোরে ভালোবাসি।…
দুপুর পার করে করিমুল্লারা ফিরে আসে। সঙ্গে শাপলা বোঝাই একটা ভ্যান রিকশা। ভারী রিকশা টানায় করিমুল্লার শরীর থেকে বড় বড় ফোঁটায় ঘাম ঝরে পড়ছে। শ্বশুরও ঘামছে। পেছন থেকে ভ্যান ঠেলতে হয়েছে তাকে। তাদের দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে থাকে। একদিনে কিছুটা চিনে ওঠা মানুষটা যেন পুরাই অচেনা লাগে। পাড়ার পালোয়ানের কথা মনে আসে তার।
কিন্তু সে মুখে কিছুই বলে না। তাদের গামছা-পানি এগিয়ে দিয়ে মাবেলা শাপলা ভরা ভ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকে। এত শাপলা সে জীবনে দেখেনি। এত শাপলা কেন আনা হয়েছে, তাও তার মাথায় ঢুকছে না। মামাকে বলতে শুনেছিল, পোলায় ব্যবসা করে, খেতিও করে। শাফলার আবার কিয়ের ব্যবসা! ব্যবসা মানে তার মনে হয়েছিল বাজারে কোনো দোকান-টোকান আছে। ক’দিন ধরে সন্দেহ হচ্ছিল, দোকান থাকলে দোকানে যায় না কেন? জানার জন্যে ব্যস্ত হয়নি, মামির হাতে মার খেতে খেতে মাবেলা শিক্ষা পেয়েছে অনেক, তার একটা হলো টপ করে কথা না বলা। এখনো তাই চুপ করেই থাকল।
স্বামী-শ্বশুর জিরিরে গোসল সেরে নিলে সে তাদের সামনে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, মাছের সালুন, শাক ভাজি, বেগুন ভর্তা আর ডাল রাখল। হাতের পাখাটা নাড়তে নাড়তে দেখতে পেল, মানুষ দুটোর চোখ চকচক করছে। হাপুস-হুপুস করে খেতে খেতে পাতিলের শেষ ভাতটি পর্যন্ত তারা খেয়ে ফেলল।
আর ভাত রান্নার ঝামেলায় না গিয়ে মাবেলা চুপচাপ মুড়ি চিবিয়ে পানি খেলো। তবু আনন্দে তার পেট ভরে আছে। মাত্র ক’দিন আগেও আনন্দ কী জানত না সে!
সারা বিকেল বাপ-পুতে শাপলাগুলো বাড়ির বাইরে বাঁশের সার বাঁধা আড়ায় ঝুলানো কাজে ব্যস্ত থাকল। মাবেলা সেই প্রথম বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দেখে আশপাশের অনেক বাড়িতেই একইরকম আড়ায় শাপলা ঝোলানো হচ্ছে। পুরুষদের সাথে মহিলাও আছে। করিমুল্লা তার দিকে তাকিয়ে হাসে। তার বাপের মুখটাও যেন হাসি হাসি।
রাতে সোহাগকর্ম শেষ করে করিমুল্লা ওপাশে কাত হয়ে চোখ বন্ধ করতে যাচ্ছিল, মাবেলা নিজের দিকে ফেরাল তাকে।
-এটটু পরে ঘুমাইয়েন।
-কিছু কইবা?
-আপনার কিয়ের ব্যবসা?
এসময়ে এমন প্রশ্নে মিতবাক করিমুল্লা থতমত খায়। সে কোনোমতে বলে, ‘কাইল কমুনে।’
মাবেলা কথা বাড়ায় না।
পরদিন শোয়ার আগে মাবেলা আবার প্রশ্নটা করে। করিমুল্লা নির্বিকার মুখে বলে, শাফলা বেচি।
-শাফলা বেচন যায়?
-যাইব না ক্যান? শহরের মাইনষে তো পছন্দ কইরা খায়, ইচা মাছ দিয়া পাক করে।
-তাইলে আপনেরা শাফলা হুকাইতে দিলেন ক্যান? শাফলা তো তাজাডি খায় দেখছি।
-ওই গুলান সাদা শাফলা। আমরা যেগুলা আনছি এইগুলা খাওনের না। এইগুলা রোইদে শুকানির পর পাইকার আইয়া কেজি দরে কিন্না নিব। শুকনা শাফলার দাম বেশি। ভাদ্দর মাস থিকা অগ্রান মাস তমতি এই ব্যবসা করি।
-এত শাফলা আনলেন কই থিকা?
-আসনের সুম দেহো নাই? বিলের পাশ দিয়াই তো আইল বাস। বিরাট বিল। লাখে লাখে শাফলা ফুটে রুজ। গ্রামের বহুত মাইনষে শাফলার ব্যবসা করে এহন। অনেক বচ্ছর আগে আমার বাপেই শুরু করছিল। সাদা শাফলা তুইলা বেচত। শহরের বাজারে বিক্রি হইত। লাল শাফলা খায় না। হিন্দুরা মনসা পূজার লাইগা ফুল কিনে কিছ ুকিছু। আর বাদবাকি যায় বিদেশ।
– বিদেশ? হ্যারা কী করে শাফলা দিয়া?
-ওষুধ বানায়।
-পানির ভিতরে থিকা ক্যামনে তোলেন শাফলা?
করিমুল্লা হাসে এই বার। বউয়ের মসৃণ পিঠে তার কর্কশ হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ‘কামডায় কষ্ট আছে। নৌকায় বইয়া কিছু তোলন যায়, তয় মাঝে মৈইদ্দে পানিতে নাইমা পড়নও লাগে।’
মাবেলা চিন্তিত মুখে বলে, ‘পানিত হাপ, পোক নাই?’
-জুক আছে, রুজই জুক লাগে শইল্লে। রক্ত খাইয়া ফুইলা থাহে।
-ডর করে না?
-জুকের মুখে লবণ দিলেই ছুইটা যায়। অল্প খাউযায়। অল্প হাসে করিমুল্লা। পানিতে ভিজে যে শরীর বেমাক্কা চুলকায়, কথাটা চেপে যায় সে।
-আর হাপ?
-তাড়া দিলে সইরা যায়। তয় মাঝে মৈইদ্দে হাপের কামড়ে দু’একজন মইরাও যায়।
-এই কাম না করলে অয় না?
এবার করিমুল্লা একটু জোরেই হেসে ওঠে। বউয়ের পিঠে আদরের চাপড় দিতে দিতে বলে, ধুর পাগলি!
-আমারে একদিন নিয়া যাইবেন বিল দেখাইতে?
করিমুল্লা ততক্ষণে অস্থির হয়ে সুখ খুঁজছে মাবেলার দেহঘরের কোনায় কোনায়। সে কোনোমতে বলে, ‘আইচ্ছা।’
কিছুক্ষণ পরে করিমুল্লা বালিশে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে, মৃদু নাক ডাকে তার।
মাবেলার ঘুম আসে না, সে বিস্রত কাপড় সামলে শুয়ে থাকে চালের দিকে চেয়ে।

শাপলা শুকানো বেশ ঝামেলার কাজ। বর্ষাকাল বলে রোদ পাওয়া যায় কম। টানা রোদ তো পাওয়াই যায় না। যতটুকু পাওয়া যায় ততটুকুই কাজে লাগাতে হয়। শাপলা বৃষ্টিতে ভিজলে পচে যায়। তাই বারবার তোলাপাড়া করে শুকাতে হয়। খুব পরিশ্রম হয়। সারাদিনই আকাশের দিকে চোখ রেখে চলতে হয়। বাপ-পুতের সাথে সময়ে মাবেলাকেও হাত লাগাতে হয়। আশপাশে তাকিয়ে দেখেছে, বাড়ির মেয়েলোকরাই শাপলা শুকানোর কাজটা বেশি করে।
কোনো অঘটন ছাড়াই শাপলা তোলার মৌসুম শেষ হলে মাবেলা খুশি হয়। বিলের পানিতে টান ধরলে বাপ-বেটা ক’দিন মাছ ধরে বেড়ায়। কিছু খায় নিজেরা, কিছু বিক্রি করে। মাবেলার শ্বশুর এখনো বেশ জোয়ান। গাট্টাগোট্ট ধরন। সারাদিন ছেলের সাথে সমানে খাটতে পারে। নিজের কাজ নিজে করে নিতে পছন্দ করে। মাবেলাকে কোনো হুকুম করে না। সংসারের কোনো বিষয় নিয়েও কোনো কথা বলে না। পিতৃহীন মাবেলা তাকে বাপের মতই জানে, যতটা পারে যতœ করে।
পানি পুরোপুরি নেমে গেলে বাপ-পুতে নেমে পড়ে চাষের কাজে। পেশার এই বৈচিত্র্যের সাথে খাপ খাওয়াতে মাবেলার প্রথম দিকে অসুবিধা লাগলেও সে চেষ্টা করে অভ্যস্ত হতে। তার ভাগ্য ভালো যে সংসারে শাশুড়ি, ননদ নেই কাজের খুঁত ধরার জন্যে। সে মনে মনে আল্লাহ’র কাছে শুকরিয়া জানায়।
পরের বছর শাপলা মৌসুম শুরু হলে করিমুল্লা বলে, শাফলা ডি তুমি কাইটা ছুটু কইরা দিবা। ছুটু শাফলা তরাতরি হুকাইব। পাইকাররা দামও বেশি দিব।
কাঠের গুঁড়ির ওপর ফেলে দায়ের কোপে শাপলা টুকরো করা, কথাটা শুনে যতটা সহজ মনে হয়, আদতে ততটা সহজও না। এক নাগাড়ে দায়ের কোপ মেরে চলা বেশ কষ্টের। মাবেলা প্রথম দিকে বঁটি দিয়ে কাটা শুরু করেছিল। তাতে কাজটা তেমন এগোয় না দেখে হাতে দা তুলে নিয়েছে। দুপুরের মধ্যে সংসারের সব কাজ সেরে রেখে, স্বামী-শ্বশুর শাপলা নিয়ে ফিরলে সে তাদের খেতে দিয়ে নিজে বসে শাপলা টুকরো করতে। খাওয়ার পরে করিমুল্লা আর তার বাপও হাত লাগায়। টুকরো করা শাপলা সরকারি পাকা রাস্তায় ছড়িয়ে দেয়া হয় শুকানোর জন্যে। ঝুড়ি ঝাঁটা হাতের কাছে গুছিয়ে রাখতে হয়, হুট করে বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই সেগুলো তুলে নেয়ার জন্যে। শুধু যেদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হতেই থাকে সেদিন বাপ-পুতের সাথে মাবেলাও বিশ্রাম নেয়। ঘরের ভেতর আর বারান্দায় শাপলার টুকরো ছড়িয়ে রেখে বাপ-পুত বারান্দায় বসে থাকে দয়ের মতো হাঁটু ভাঁজ করে। মাবেলা সুযোগ পায় আয়নায় তাকানো। চুলে তেল দেবার। কানের পাশে আধ ফোটা শাপলা ফুল গোঁজার।
টানা বৃষ্টির দিনে মুখ ব্যাজার করে বসে থাকলেও পরদিন তারা খুশি, না তোলায় বিল ভয়ে যায় শাপলা ফুলে। করিমুল্লারা অনেক শাপলা তুলতে পারে।
এইসব দিন যাপনের কালে একদিন, পূর্ণিমা আগের রাত থেকে নামল বৃষ্টি। একেবারে ঘন ঘোর অন্ধকার করে গলগলিয়ে পড়তে থাকল জলধারা। থামল বিকেলে। রাত্রিকালে আকাশে চাঁদ উঠল ঝলমলে। করিমুল্লা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার উদ্যোগ নেয়। খুব ভোরেই যেতে হবে বিলে।
মাবেলার শুতে ইচ্ছে করে না, সে একাই বসে থাকে উঠোনে চাঁদের আলোর নিচে। আজ তার মন উচাটন। মামা বাড়ি থাকার সময় চাঁদনি রাতে তারা উঠোনে বসত। কিচ্ছা বলত মামি। কোনো কোনোদিন মনের ভুলেই হয়তো মাবেলার বাপ-মায়ের কথাও বলে উঠত। মা-বাপের চেহারা মাবেলার মনে নেই। সে গল্প শুনে শুনে একটা চেহারা এঁকে নিয়েছে নিজের মতো করে। মামির মুখ ফসকে পড়া কথাগুলো মাবেলাকে যে কী পরিমাণ আনন্দ দিতো তা মামি কোনোদিন টেরও পায়নি। মাবেলার ভয় ছিল, যদি মামি বোঝে সে এই সব কথা শুনে আনন্দ পায় তবে হয়তো আর কোনোদিন বলবে না। আজ এই ধবল জ্যোৎস্নাভাসা রাতে তার মা-বাপের কথা শুনতে ইচ্ছে করল। মনটা ভার হয়ে উঠল। চোখে কান্না জমছে টের পেয়ে মাবেলা ঘরের ভেতর ঢুকে করিমুল্লাকে ডেকে তুলে বলল, ‘চলেন দেহি, শাফলা দেইখা আসি।’
কাঁচা ঘুমভাঙা চোখে বউয়ের এমন আবদারে করিমুল্লা বিস্মিত। কিন্তু জানালা গলে আসা জ্যোৎস্নার আলোয় ভেসে যাওয়া মাবেলার চোখ দুটোতে এমন জাদুকরী আকুতি ছিল যে সে উপেক্ষা করতে পারল না। বাপ যাতে না জেগে ওঠে সে জন্যে খুব সাবধানে বেরোলো বাড়ি থেকে। বেশি দূরে নয় ছৈত্যের ডোপ বিল। পাকা রাস্তা ধরে মিনিট পঁচিশ-ত্রিশ হাঁটার পরই পৌঁছে গেল ওরা। ব্যাঙ আর ঝিঁঝিঁর ডাকে মুখর বিল। চাঁদের আলোয় বিলের পানি হীরের দুত্যি ঝিলিক দিচ্ছে। সামান্য খপাৎ খপাৎ শব্দ তুলে ঢেউ ভাঙছে পাড়ে। বৃষ্টির কারণে বিলে মানুষের পা পড়েনি। সারা বিল জুড়ে ফোঁটা/ আধ ফোঁটা শাপলা চাঁদের আলোয় স্নানমগ্ন।
বিলের পাড়ে পৌঁছে মাবেলা তবদা মেরে যায়। এমন সুন্দর কোনো দৃশ্য সে আগে কখনো দেখেনি। বিস্ময়ে যেন সে বোবা হয়ে যায়। তার মধ্যে অদ্ভুত একটা ঘোর ঘনিয়ে আসতে থাকে। মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে তুলে আনা বউয়ের এই রকম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা দেখে করিমুল্লা কী করবে ভেবে পায় না। খানিক পরে সে বলে ওঠে, ‘ওই দ্যাহো পাতার উপরে বইসা ব্যাঙ ডাকতাছে। এহনই হাপ আইব। সইরা আহো এদিকে।’
ঘোর ভেঙে মাবেলা ঘুরে করিমুল্লার খুব কাছে চলে এসে ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমারে একটা ফুল আইনা দিবেন?’
করিমুল্লা চমকে ওঠে, ‘এহন ফুল দিয়া কী করবা তুমি?’
-দিবেন?
করিমুল্লা বিভ্রান্ত। এত রাতে আর বিলের পানিতে নামতে ইচ্ছে করে না। মাবেলা তার গালে নিশ্বাস ফেলছে ঘন ঘন। সহসা করিমুল্লার মনে হয় মাবেলা তার পৌরুষ চ্যালেঞ্জ করছে। সে পরনের লুঙি কাছা মেরে গুটিয়ে নেয়। পানিতে নেমে একটা নৌকা টেনে আনে পাড়ে। নৌকা রেখে সে চলে আসে মাবেলার কাছে। দু’হাতে তাকে কোলে তুলে নিয়ে এগিয়ে যায় নৌকার কাছে। নৌকায় তাকে নামিয়ে দিয়ে লাফিয়ে উঠে বসে সে নিজেও। লগি তুলে নেয় আবার ফের পুঁতে দেয় বিলের তলায়, তার শক্ত হাত দুটো লগির মাথার দিকে উঠতে থাকে আর নৌকা এগোতে থাকে বিলের গভীরে। খানিক এগিয়ে সে নাগালে পায় একটা আধ ফোটা পদ্ম।
ফুলটা বাড়িয়ে দেয় মাবেলার দিকে। মাবেলা সে ফুল ধরার জন্যে হাত বাড়িয়ে দেয় কিন্তু ফুল না ধরে জড়িয়ে ধরে করিমুল্লাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় করিমুল্লার হাত থেকে লগি ছুটে যায়। নৌকা হঠাৎ সামনে খানিক এগিয়ে যায় দ্রুত, নৌকা টলমল করতে থাকে। মাবেলা সেদিকে খেয়াল করে না, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে করিমুল্লার মুখের ওপর। চুমুতে চুমুতে অস্থির করে তোলে তাকে। আর এই প্রথম বিষ্ময়কর এক আনন্দে শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে করিমুল্লা। সে অচেনা আকাক্সক্ষায় আঁকড়ে ধরে মাবেলার মোলায়েম স্তন।

জ্যোৎস্না একটু মøান হয়ে আসে, বিল জোড়া লাল নীল সাদা পদ্মরাশি যেন সুর ছড়াতে ছড়াতে মেলে দেয় দল সকল। সে সুর তুমুল ঝঙ্কার তোলে যুগল দেহে। নৌকাটা অল্প অল্প দুলতে দুলতে এগোতে থাকে পদ্ম বিলের গভীরে।
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়