করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

তুমি শুনিতে চেয়ো না

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পরিচ্ছেদ : ১

আজ কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না আমার সচ্চিনানন্দ অবস্থায় পৌঁছানোর কথা। যারা যোগ সাধনা করত, আমি যাদের জন্য এই পথে এসেছিলাম তারাই বিশ্বাস করেনি। নলিনীকান্তকে যেদিন আমার এ অবস্থার কথা বললাম, সেদিন তো সেও আমায় রীতিমতো পাগল ঠাওরালো।
এতদিনের বন্ধু ওর আর দীলিপের কারণেও আমার এই যোগের পথে আসা। বরদাপ্রসাদ মজুমদারের সঙ্গে ওরা আগে থেকেই যুক্ত ছিল। আগেই বলেছি, সজনীকান্ত আমায় পরীক্ষা করার জন্য একটি চিঠি লিখে হতাশ হলো। আমি কবিতায় ঠিকঠাক মতো জবাব দেয়ায় ওরা ভাবল- আমি বুদ্ধিভ্রষ্ট হইনি এখনো। সংসারি মানুষের কাছে বুদ্ধিভ্রষ্ট আর যোগভ্রষ্টের মধ্যে পার্থক্য কম। অনেক আগে এক গ্রিক দার্শনিক তার সমর্থন করে গেছে- উন্মাদ আর সন্ন্যাসী ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হতে পারে না। এ ধরনের সরলিবাক্য যদিও জগতে সকল ক্ষেত্রে চরমভাবে সত্য নয়। পাগল ও সন্ন্যাসীদেরও কিছু বিষয়ে পক্ষপাতিত্ব থাকতে পারে।

বুদ্ধিভ্রষ্ট না হলেও যোগভ্রষ্ট যে হয়, তার উদাহরণ আমি অনেক দেখেছি। সাক্ষী হিসাবে একদিনের কথা প্রেমেন্দ্র মিত্র উল্লেখও করেছে তার এক লেখায়। তখনো আমি এ লাইনে নতুন। এক ফিল্ম কোম্পানির হয়ে সংগীত পরিচালনার কাজ করছিলাম। এটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের বছর। স্টুডিওর ভেতরে বিরাট হলঘর। তার শেষে একটি লম্বা ঝিলের কোল ঘেষে মার্বেলের কয়েকটি বসার আসন রয়েছে। আমি সেখানে গানের সুর সংযোজনে চেষ্টা করছি। সেই আসরে কারা ছিল- আজ সবার নাম মনে নেই। তবে প্রেমেন্দ্র ছিল, নিতাইও থাকতে পারে, কে মল্লিক আর আব্বাস সেদিন ছিল না- এটি নিশ্চিত। যে সিনেমার জন্য গান তৈরি করছিলাম, সেটি প্রেমেন্দ্রের গল্প, প্রেমেন্দ্রের চিত্রপরিচালনাও হতে পারে। প্রেমেন্দ্র কবি হিসাবে যেমন খাঁটি ছিল, মানুষ হিসাবেও। ওর গল্প উপন্যাস খুব বাজার পেয়েছিল। তার প্রতিভাকে তার সমকালীন কবিরা ঈর্ষার চোখে দেখতো। তিরিশের কবিতায় যারা পঞ্চপাণ্ডব প্রকল্প চালু করেছিল, প্রেমেন্দ্রকে তার বাইরে রাখা হয়েছিল। ওর সাহিত্যে কামার কুমোরের কথা সরাসরি থাকত বলে ভাষার মারপ্যাঁচে পেছনে পড়ে যায়। ওর মনটা আমার মতো ভবঘুরে বেদুঈনদের মতো। ওর কবিতায় উঠে এসেছিল রাস্তার গান। স্বপ্ন দেখত কেরামান খোরাশান আর বাদাকশানের পথে পথে ঘোরার। একটি কবিতায় লিখেছিল-
‘যাযাবর হাঁস নীড় বেঁধেছিল বন-হংসের প্রেমে,
আকাশ-পথের কোন্ সীমান্তে থেমে’
সেদিনের কলকাতার অধিকাংশ অঞ্চলে সন্ধ্যার পরে অন্ধকার নেমে আসত। যদিও কিছুদিন আগে থেকে কলকাতায় বিদ্যুৎ বাতির প্রচলন হয়েছে, তবু এখনকার মতো সারা শহর আলোতে ঝলমল করে রাখার ব্যবস্থা ছিল না। আমি যে সময়ের কথা বলছি, ঠিক সে সময়ের কাছাকছি ১৯৩৩ সালের দিকে ধর্মতলায় ক্যালকাটা ইলেক্টিক সাপ্লাই করপোরেশনের অফিস স্থাপন করা হয়। এ সময়ে সন্ধ্যার পরে অধিকাংশ শহর জনমানবহীন হয়ে যেত। রাস্তায় কদাচিৎ একটি আধটি গাড়ির হর্নের শব্দ শোনা যেত। লোক চলাচল ছিল বিরল। তবে নওয়াব ওয়াজেদ আলী শাহর মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে অনেক বাড়িতে জলসা, মুজরা ও কত্থকের ঢেউ জেগে থাকত সারারাত। নবাব সেখানে নিজস্ব গ্যাসের বাতির ব্যবস্থা করলেও তার মৃত্যুর পরপর ইংরেজ বাহাদুর আবারো সব কুক্ষিগত করে নিয়েছিল। প্রকৃতির আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার রাতের আলো নিস্তেজ হয়ে আসত।

তবে তার লীলা বোঝা বড় দায়। ভারতে ইংরেজের দাপটে যখন মুসলিম ও দেশি শাসকদের একে একে সকল দেউটি নিভে যাচ্ছিল, তখন আওধের নবাব ওয়াজেদ আলী শাহকে ইংরেজ ছলনায় প্রথমে ভিক্টোরিয়া তারপর মেটিয়াবুরুজে নির্বাসিত করা হয়। মূলত মুচিখোলা, সাহেববাগান, আকড়া- এই তিনটি অঞ্চল নিয়ে ছিল মেটিয়াবুরুজ। মেটিয়াবুরুজ মানে মাটির প্রাসাদ। একজন নির্বাসিত রাজার পক্ষেও যে কিছু করার থাকে- নওয়াব ওয়াজেদ আলী শাহ তার প্রমাণ। লোকটা যদি শিল্পী হয় তাহলে তো কথাই নেই। একজন রাজা রাজ্য হারালে সব হারায়। কিন্তু একজন শিল্পী কখনো তার রাজ্য থেকে পুরোপরি নির্বাসিত হয় না। তার সাম্রাজ্য মানুষের মনোরাজ্যে অধিষ্ঠিত। পরাক্রমশালী নেপোলিয়ানকে ব্রিটিশ সরকার হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত করেছিল। বই পড়ে, বাগান করে মিছে মিছে রাজা ও সেনাপতি খেলায় ব্যস্ত ছিল। কিন্তু নেপোলিয়ান নবাবের মতো শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন যোদ্ধা। নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ কখনো যুদ্ধ করেননি, শতরঞ্জি খিলাড়িতে তার আনন্দ, হারজিত। তাকে উচ্ছেদ করায় প্রকৃতপক্ষে তার কোনো রাজ্যের পতন ঘটেনি। সে জানত বাইরের রাজ্য পুরোটা শতরঞ্জি খিলাড়ির মতো। হারজিত সাময়িক। ইংরেজ শাসনে ভারতের শত শত রাজ্যের অবসান হয়েছে, রাজাদের নাম মুছে গেছে। কিন্তু ওয়াজেদ আলী শাহর কলকাতা এখনো জেগে আছে- গানে সংগীতে, মুসলিম ঐতিহ্যে, খাদ্যে, পোশাকে। রসনা পরিতৃপ্ত করতে বিরিয়ানি দমপোক্ত, বাসনা পরিতৃপ্ত করতে কত্থক-নৃত্য- এসব আজো নবাবের স্মৃতি বহন করে চলেছে। এমনকি ভাগ্যহারা এই নবাবের কবিতা আজো উদ্ধৃতি হয়। ভারতীয় ভাষায় তিনিই প্রথম অপেরা রচনা ও মঞ্চস্থ করেছিলেন। বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন মোগলদের মধ্যে সর্বাধিক ঢাল-তলোয়ারবিহীন সম্রাট। ভাগ্য-বিড়ম্বনা আর কাব্যশক্তি তাকে কালের গহ্বর থেকে কিছুটা টেনে তুলেছে। অথচ ইংরেজ রাজত্বের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার খুব কমই আছে। স্বামী বিবেকানন্দ আমার জন্ম বছরে (১৮৯৯ খৃ.) মিস মেরি হেলকে এক পত্রে লিখেছিলেন-
‘ভারতবর্ষে কয়েক বছর ধরে চলছে ত্রাসের রাজত্ব। ব্রিটিশ সৈন্য আমাদের পুরুষদের খুন করছে, মায়েদের মর্যাদা নষ্ট করছে, বিনিময়ে আমাদেরই পয়সায় জাহাজে চড়ে দেশে ফিরছে পেনশন ভোগ করতে।’ খোদ ইউরোপের মাটিতে দাঁড়িয়ে (১৮৯৫) তাদের দিকেই আঙুল তুলে তীব্র ভাষায় তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন : ‘ভারতের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন, হিন্দুরা রেখে গেছে অপূর্ব সব মন্দির, মুসলমানরা সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ। আর ইংরেজরা? স্তূপীকৃত ভাঙা ব্রান্ডির বোতল, আর কিছু নয়। আমাদের গাঁয়ে গাঁয়ে দেশে দেশে যখন মানুষ দুর্ভিক্ষে মরছে, তখন ইংরেজরা আমাদের গলায় পা দিয়ে পিষছে, নিজেদের তৃপ্তির জন্য আমাদের শেষ রক্তবিন্দুটি শুষে নিয়েছে, আর এদেশের কোটি কোটি টাকা নিজের দেশে চালান করেছে।’
আমার সঙ্গে কোথায় যেন ওয়াজেদ আলী শাহের মিল আছে। তার নবাব হওয়ার কথা না থাকলেও হয়েছিল। দাবা, পানের নেশা- আমি কি তবে ওর কাছ থেকেই পেয়েছি। নাকি এই ভারতে রাজ্যহারা বাদশাদের স্মৃতি আমার জাতিস্মরে বাসা বেঁধেছিল। আমি তার মতো মুসলমান হলেও বিশ্বাসে ও সংস্কৃতিতে ছিলাম খাঁটি ভারতীয়। ওয়াজেদ আলী কেবল অসম্প্রদায়িকই ছিলেন না বিশ্বাসেও দুই ধর্মের মিলিত সুরের অনুসারী ছিলেন। তিনিই আধুনিক হিন্দুস্থানি থিয়েটারের জন্ম দেন। তার লেখা নাটক ‘রাধা কানাইয়া কি কিচ্ছা’ আধুনিক হিন্দুস্থানি থিয়েটারে তিনি প্রথম মঞ্চস্থ করেন। ভাই সিকান্দার হাসমতের অভিষেকে তিনি এই নাটকের মহড়া দেন। কৃষ্ণ ছিল তার রোল মডেল। আমাকেও অনেকে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এমনকি তিরিশের আধুনিকদের গোদা বুদ্ধদেব বসুও আমার অসুস্থতার পরে স্মৃতি হাতড়ে লিখেছিলেন-
‘দেহের পাত্র ছাপিয়ে উছলে পড়েছে তার প্রাণ, কাছাকাছি সকলকেই উজ্জীবিত করে, মনের ময়লা, খেদ ও ক্লেদ সব ভাসিয়ে দিয়ে। সকল লোকই তার আপন, সব বাড়িই তার নিজের বাড়ি। শ্রীকৃষ্ণের মতো, তিনি যখন যার তখন তার। জোর করে একবার ধরে আনতে পারলে নিশ্চিন্ত, আর উঠবার নাম করবেন না- জরুরি এনগেজমেন্ট যাবে ভেসে।’
বুদ্ধদেব খুব বাড়িয়ে বলেনি। মোহিতলাল মজুমদার বুদ্ধদেব বসুকে খুব ভালো চোখে দেখত না। ইংরেজ আধুনিকদের মধ্যে যে ধরনের হীনমন্যের জন্ম হয়- বুদ্ধদেবের মধ্যেও তার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। মোহিতলাল তাকে চরিত্রহীন ‘শিশ্নোদরপরায়ণ’ বলতেও ছাড়ত না। যদিও মোহিতলালের সঙ্গে আমার সম্পর্ক একভাবে যায়নি। তবে আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম, আমার জীবদ্দশায় ১৯৪০ সালে যখন আমার খ্যাতি তুঙ্গে- তখন সে ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ বলে একটি সংকলন করেছিল। সেখানে আমার তিনটি কম-পরিচিত কবিতাকে জায়গা দিয়েছিল। অথচ তার নিজের ছিল চৌদ্দটি, তার গ্রুপের সবারই তাই। ওর বিচারে আমি সত্যেন্দ্রনাথের চেয়েও ছোট কবি, ডিএল রায়ের পরে আমার গানের অবস্থান। এসব নিয়ে আমার ভাববার সময় কোনো দিন ছিল না। নিজের ভেতরে বিস্ফোরিত তরঙ্গ স্রোতই আমি থামাতে পারিনি, ওসব নিয়ে ভাববো কখন! আমি তো আমার সৃষ্টিশীল অস্থির মনকে বশে আনতে যোগের পথে অগ্রসর হয়েছিলাম। আমি অসুস্থ হলে বুদ্ধদেব বসু ওর কবিতা পত্রিকার একটি সংখ্যা করেছিল। সবাই বলতো- প্রতিভা বসুর চাপে করেছে। তবে বুদ্ধদেব নিজেই ছিলেন অনুরুদ্ধ প্রতিভাধর। তার কাজ অনেকদিন থেকে যাবে। তারও শৈশবটি আমারই মতো ভাগ্য বিড়ম্বিত- জন্মের পরেই মা মারা গিয়েছিল, মায়ের শোকে বাবা দেশান্তরী হয়েছিল- এসব কষ্ট তার অনুভূতিকে তীক্ষè করে তুলেছিল।

বলতে ছিলাম ওয়াজেদ আলী শাহের কথা, যমুনাতীরে পূর্ণিমা রাতে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের লীলা নবাবের চিরকালীন অনুপ্রেরণা। কৃষ্ণের রাসলীলা থেকেই লখনউয়ে ‘রহস’ সৃষ্টি করেন তিনি। ওয়াজেদ আলীর রহস মূলত অপেরা, যেখানে তিনি ব্রজ অঞ্চলে কৃষ্ণের জীবন নিয়ে প্রচলিত নৃত্যের সঙ্গে নিজস্ব কত্থকের কম্পোজিশন মিলিয়ে ছিলেন। নবাব কলকাতার মেটিয়াবুরুজে ১৮৫৯ থেকে ১৮৭৫-এর মধ্যে অন্তত ২৩টি রহস মঞ্চস্থ করেন। নতুন কলকাতার একেবাবের প্রান্তে নির্বাসিত অস্তমিত নবাবের মেটিয়াবুরুজ অন্যদিকে উদিয়মান পাইকপাড়া রাজাদের বেলগাছিয়া নাট্যশালা- সবটা মিলেই তো নববাবু কলকাতা। আজ বিদেশি লেবেদেফের কথা শোনা গেলেও স্বদেশি নবাব ইতিহাস থেকেও নির্বাসিত। এ নবাব রাজ্যহারা হলেও আপন খেয়ালে আপন মদে মাতাল, একটু শান্তি করে শতরঞ্জি খেলার জন্য রাজ্যপাট ছেড়ে এক লহমায় চলে যেতে পরে চালচুলোহীন অচিনপুরে। তার মতো শিল্পী ছিলেন না বলে ওয়াজেদ আলী শাহর একশ বছর আগের বাংলার শেষ নবাব কোনো স্মৃতি ধরে রাখতে পারেননি। অবশ্য এই কলকাতা নবাবের সৃষ্টি নয়, এই কলকাতা ইংরেজের।
যুদ্ধ বিগ্রহ রাজ্য শাসনের থেকে ওয়াজেদ আলীর মন ছিল বেশি গান-নাচ-কবিতার প্রেমে। তিনি ছিলেন এক আদ্যন্ত শিল্পী। গায়ক, গজল লিখিয়ে, সুরকার, নাট্যকার, কত্থক নাচিয়ে- সাহিত্যের অনেক শাখাতে তার বিচরণ। চল্লিশটির বেশি বই লিখেছিলেন নবাব। শের, গজল, ঠুমরির পাশাপাশি লিখেছিলেন- ভারতীয় মার্গ সংগীতের ইতিহাস। আর তারই সঙ্গে নিজের আত্মজীবনী, পঞ্জিকা, নাটক। যদুভট্ট বা সৌরিন্দ্রমোহন ঠাকুরের মতো সংগীতবেত্তারা ছিলেন তার বন্ধু। তার চিড়িয়াখানাই ছিল কলকাতার প্রথম- তখনো আলীপুর জু’র জন্ম হয়নি। চালর্স ডারউইনও এসেছিলেন তার চিড়িয়াখানায়। পাশাপাশি নবাব ছিলেন প্রচণ্ড ধর্মভীরু। ইসলামের শিয়া মতের ইবাদত-বন্দেগি ও ইমামবাড়া মসজিদ নির্মাণে যতœবান ছিলেন। তার দরবারে প্রথমবারের মতো মায়ের সঙ্গে গহরজান নেচেছিল। গহর প্রথম বাংলা কলের গানে কণ্ঠ দিয়েছিল। রেকর্ড গানের ইতিহাসে সেই ছিল ‘ফাস্ট ড্যান্সিং গার্ল’, তার গাওয়া প্রথম গান ‘ফাঁকি দিয়ে প্রাণের পাখি উড়ে গেল আর এলো না।’ গহরজান তিরিশের দশকের শুরুতে বেঁচে থাকলেও তার পক্ষে আমার গান গাওয়া হয়ে ওঠেনি। যেভাবে তার ঘরানার পরবর্তী শিল্পীরা- কাননবালা, আঙুরবালা, ইন্দুবালা, কমলা ঝরিয়া আমার গান গেয়েছিল। আমি যখন কলের গানে এলাম- ততদিনে গহরজানের বয়স হয়েছে। কলকাতায় ভালোভাবে টিকতে না পেরে মহীশুরের রাজার দরবারে চলে গেছে। তারও জীবন ছিল আমার মতো উত্থান পতনে ভরপুর। আমার মতো অসহায়- সব হারিয়ে অসম্মানে জীবন অবসান করতে হয়েছে। তাকে নিয়ে কবি গোপাল দাস খেউড় গান লিখেছিল-
‘রাইচাঁদ বড়াল আদি করে/ বড় বড় ভাইরে ধরে/ রেখেছে ভাই অন্ধ করে/ কলেতে ভরে/ রেখেছে এক মেয়েকে ধরে/ তার নাম গহরজান বাই/ ধনদৌলতে টাকা কড়ি/ জুড়িঘোড়া ঘরবাড়ি/ কলেতে গিয়েছে সব/কিছু বাকি নাই/ এখন কলের গানে/ মাতিয়ে প্রাণে ন্যাংটা করতে চায়।’
নবাবের রাসলীলা দিয়ে এ প্রসঙ্গ শেষ করি। তবে এ ব্যাপারে আমার গানের শিষ্য মণীন্দ্র চক্রবর্তীর দোহাই মেনে বলা যায়। যেহেতু মণীন্দ্র আমার সঙ্গে অনেকদিন ছিল, এবং ওর বিশ্বাস ছিল- আমার এ উন্মত্ত অবস্থার কারণ যোগভ্রষ্টতা। মণীন্দ্র এক সাক্ষাৎকারে বলেছে, আমি ‘সাধনায় অনেক দূর এগিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ সম্পর্কে যে বিধি নিষেধগুলো বিশেষভাবে মেনে চলা উচিত- তা আমি মেনে চলতাম না।’ কোনো গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকার ফলে আমার এই বিপর্যয় ঘটেছিল। আমি মস্তিষ্কে একেবারে চির-সমাহিত অবস্থায় পৌঁছে গেছি আর ফিরে আসতে পারিনি।
এই গল্পটিও মণীন্দ্র চক্রবর্তী করেছিল, ১৯৩০ সালের দিকে ‘আমরা গ্রামোফোন অফিসের একটা ঘরে বসে গল্প করছি। হঠাৎ সেখানে নবদ্বীপ থেকে দুজন বৈষ্ণব ধর্মপ্রচারক বৈষ্ণব ভজন গান রেকর্ড করার জন্য উপস্থিত হলেন। অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে কাজীদা তাদের আপন করে নিলেন, এটি তার চরিত্রের বিশেষ গুণ। কাজীদা ওদের তার পাশে বসালেন এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিলেন। কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ রাসলীলা প্রসঙ্গটা ওঠে। কাজীদা রাসলীলার উপর একটি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দিলেন। এই ব্যাখ্যায় ওই দুজন অভিভূত হয়ে কাজীদাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল, সত্যিই আপনি পণ্ডিত- এতসব আপনি কি করে জানলেন? সত্যি কথা বলতে কি, সেদিনই বুঝলাম যে কাজীদা সত্যই মহান ও পণ্ডিত।’ রাসলীলা নিয়ে সেদিন আমি যে সারৎসার বলেছিলাম তা অনেকটা এ রকম-
“গোপিবৃন্দ আপনাপন কর্তব্যকর্ম বিসর্জন দিয়ে সংসারের সকল মোহ পরিত্যাগ করে বৃন্দাবনে উপস্থিত হয়- শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিজেদের সমর্পন করতে। প্রথমে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের স্ব-গৃহে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন; বলেন, তাদের সংসার-ধর্ম পালন করা উচিত। কিন্তু গোপিনীরা নিজেদের মতে দৃঢ় ছিলেন। ভগবান ভক্তের অধীন। শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের দৃঢ়ভক্তি দেখে তাদের মনোকামনা পূরণার্থে রাসলীলা আরম্ভ করেন। কিন্তু যখনই শ্রীকৃষ্ণ তাদের অধীন বলে ভেবে গোপিনীদের মন গর্ব-অহংকারে পূর্ণ হলো, তখনই শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের মধ্য থেকে অন্তর্ধান হয়ে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণ যখন রাধাকে নিয়ে উধাও হলেন, তখন গোপিনীবৃন্দ নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। ভগবানকে ‘একমাত্র আমার’ বলে ভেবে অহংকারের ফলে শ্রীকৃষ্ণকে তারা হারিয়ে ফেলেছিলেন। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ত্রিজগতের পতি, তাই তাকে কোনো মায়া-বন্ধনে বেঁধে রাখা যায় না। তখন গোপিনীবৃন্দ একাগ্রচিত্তে শ্রীকৃষ্ণের স্তুতি করতে শুরু করেন। ভক্তের ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান গোপিনীদের মানব জীবনের পরমার্থ বুঝিয়ে দিয়ে তাদের অন্তর পরিশুদ্ধ করেন। গোপিনীদের ইচ্ছাকে তিনি সম্মান জানিয়ে ‘যতজন গোপিনী, ততজন কৃষ্ণ’ হয়ে গোপিনীদের মনের অভিলাষ পূর্ণ করেছিলেন আর গোপীবৃন্দর জাগতিক ক্লেশ থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন। এইভাবে জগতে রাসোৎসবের প্রচলন ঘটে।”
আমি পণ্ডিত হওয়ার তাগিদ বড় একটা দেখি না- আমি কবি। এখানে বিষয়টি এ জন্য উল্লেখ করলাম, ওয়াজেদ আলী শাহের রাসলীলা মুসলমানগণ নিন্দা করেন। শরিয়তের দৃষ্টিতে হয়তো নিন্দার যোগ্য। নিন্দা বা প্রশংসা আমার উদ্দেশ্য নয়, ভারতের হিন্দু-মুসলমান অনেকের মধ্যে আধ্যাত্মিকভাবে সম্মিলিত ধর্ম-চর্চার একটা রেওয়াজ গড়ে উঠেছিল মুসলিম শাসনামলে। যে ধারায় সন্ত কবীর, নানক, রামানুজ, মালিক মুহম্মদ জাইসি, লালন প্রমুখ। আমাদের সাংসারিক বুদ্ধি দিয়ে তাদের সব সময়ে স্পর্শ করা যাবে না। আমিও এই বোধে রাধা-কৃষ্ণ নিয়ে অনেক কীর্তন লিখেছিলাম, যেমন-
‘শ্যাম যে তরুর তলে বসিবে লো ধ্যানে/ সেথা অঞ্চল পাতি’ রব,
আমার বঁধুর পথের ধূলি হব/ আমায় চলে যেতে দলে যাবে/ সেই সুখে লো ধূলি হব।’
ঠিক আমার নবীকে নিয়েও আমি লিখেছি- ‘আমি যদি আরব হতাম মদিনার পথ/ সেই পথ দিয়ে হেঁটে যেত নূরনবী হযরত।’
প্রেমেন্দ্র যখন লেখেন- ‘সাড়ে তিন হাত চওড়া একটা সংকীর্ণ লম্বা দোকান ঘরের মেঝেয় কাগজপত্রের জঞ্জালের মধ্যে প্রায় দিন-রাত বসে আমি দাবাখেলায় মগ্ন। গান নয় কবিতাও নয়, শুধু দাবার চালই চালই ধ্যানজ্ঞান। রসদ শুধু চা পান।’ তখন মুন্সি প্রেমচাঁদের ‘শতরঞ্জি কি বাজি’র ওয়াজেদ আলী শাহ আর আমার মধ্যে কোনো তফাত থাকে না। শৈলজানন্দের ভবানীপুরে গলির মধ্যে ছোট্ট ভাড়াবাসায় যখন আমি নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দি করি তখনো মেটিয়া বুরুজের নবাবের কথায় আমার মনে পড়ে। এক জীবনেই রাজা- এক জীবনেই প্রজা।
আসলে তখনকার সময়টি বোঝাতে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ আছে ডিকেন্সের টেল অব টু সিটিজ-এর শুরুতে। যেখানে একই সঙ্গে দুই সংস্কৃতির লড়াই চলছে। একদিকে পুরনো মূল্যবোধ ভেঙে যাচ্ছে, অন্যদিকে নতুন সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। তার যেমন সংঘর্ষ আছে তেমন সহাবস্থানও আছে। মোগলের ভারত ইংরেজের ভারত আর আদি ভারত একই সঙ্গে জেগে উঠতে চাচ্ছে।
‘এটি ছিল সর্বকালের সেরা সময়, এটি ছিল সবচেয়ে খারাপ সময়, এটি ছিল জ্ঞানের যুগ, এটি ছিল বোকামির যুগ, এটি ছিল বিশ্বাসের যুগ, এটি ছিল অবিশ্বাসের যুগ, এটি ছিল আলোর মৌসুম, এটি ছিল অন্ধকারের মৌসুম, এটি ছিল আশার বসন্ত, হতাশার শীত, আমাদের আগে সব ছিল, আমাদের আগে কিছুই ছিল না, আমরা প্রত্যেকে সরাসরি স্বর্গে যাচ্ছিলাম, আমরা সবাই সোজাসাপ্টা অন্য পথে যাচ্ছিলাম, সময়টি ছিল অনেকটা আজকের সময়ের মতো, এই বিশৃঙ্খল সময়ের স্রষ্টারা ভালো হোক, মন্দ হোক- সে-সব মেনে চলতে বাধ্য করছিল।’
বাইজিদের উপস্থিতিতে যেমন সভা মাঝে এক আনন্দোচ্ছ¡ল জীবনের আন্দোলন উপস্থিত হয়। আমার উপস্থিতিও অনেকটা তেমন। কেউ পায়ের কষ্ট, রক্তের দাগ দেখতে চাইত না। বৃত্তের মাঝে একটি ষাড়ের বাঁচার লড়াই থেকেও মানুষ আনন্দ লাভ করতে চায়। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না, যত রাতই হোক আমার উপস্থিতি যে কোনো জলসা ও সভাকে সদা হাস্যোজ্জ্বল করে তুলত। গানে, পানে, হাসিতে, কথায় পুরো ঘর চনমনে হয়ে উঠত। পানে বলাতে ভুল বোঝার অবকাশ থাকতে পারে। কলকাতা শহরে তখন প্রচুর পানাহারের ব্যবস্থা থাকলেও তরল পানে আমার আগ্রহ ছিল না। ইংরেজের রাজধানী ততদিনে দিল্লি চলে গেলেও ইংরেজের পানাভ্যাস রেখে গিয়েছিল। উনিশ শতকের কলকাতায় মদ, মেয়ে মানুষ, ছোকড়ার প্রচলন ছিল- আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে। ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়দৌড়, পায়রা-উড়ানো, গড়ের মাঠে ফেটন গাড়িতে হাওয়া খাওয়া নববাবুদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দীনবন্ধুর ‘সধবার একাদশী’ ও ‘মধুসূদনের মদ খাওয়া বড় দায় জাত রাখার কি উপায়’, কিংবা শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’-এ তার নিখুঁত চিত্র পাওয়া যাবে। আমার সময়ে সেগুলো কিছু কমে আসলেও অবক্ষয়ী আকারে টিকে ছিল। আর নতুন নতুন উৎপাত এসে হাজির হচ্ছিল। এই যে থিয়েটারের কথা বলছি, যেখানে আমি গানের মহড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি- সে সব নিয়ে পরে বলা যাবে। তবে, তখনো যথেষ্ট বাংলা কিংবা ভারতীয় চলচ্চিত্রের আবির্ভাব হয়নি। ইংরেজি বা ইউরোপ থেকে যে সব সিনেমা আমদানি করা হতো, তা সপরিবারে দেখার যোগ্য ছিল না। তখনো সেন্সর নামক কাঁচিকলের আবির্ভাব না হওয়ায় অশ্লীলতার আধিক্য ছিল।
তবে আমি কখনো পানাহার করেছি কিনা সে আলোচনা এখানে করা ঠিক হবে না। আমি যদি বলি কখনো আমি মাদক জতীয় পানীয় কিংবা কখনো গঞ্জিকা সেবন করিনি, তাহলে মোটেও মিথ্যা নয়। কিন্তু মাঝখানে নলিনী কিছুটা বাগড়া দিয়েছে। খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন লিখেছিল- নজরুল ‘কোনো প্রকার মাদকদ্রব্য কোনোদিন স্পর্শ করেননি।’ ল্যাঠা এখানেই চুকে যেতো পারত। নলিনী তার চিঠিতে মঈনুদ্দীনকে বলেছে, ‘এই লাইনটি একেবারে বাদ দিলে ভালো হয়।’ বন্ধুদের যে কোনো সাক্ষী খণ্ডন করা কঠিন। তবে এ কথা ঠিক এটি আমার অভ্যাসের মধ্যে ছিল না।
সেদিনও আমার গানে প্রাণখোলা হাসিতে চারিদিকে নির্জনতা কেঁপে উঠছিল। হঠাৎ মনে হলো কে যেন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এই আসরে ঢুকে পড়েছে। এই দুর্ভেদ্য বাড়িতে কীভাবে বাইরের একজন লোক ঢুকে আমার এই গানের আসর পর্যন্ত চলে আসতে পারে। বাইরের ফটকে রয়েছে বন্দুক হাতে পোশাকধারী উড়িয়া দারোয়ান। কেউ বলতে পারে না কীভাবে সে এখানে ঢুকেছে। কিন্তু তার আগমন আমি টের পেয়েছি। আমি দেখেছি অন্ধকার হলেও একটি দীর্ঘ চেহারার লোক আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সুন্দর সৌম্য স্থির অথচ উদাস দৃষ্টিকোণ; যেন কোথায় যেতে চায়- কিন্তু সে জানে না।
তার কথাবার্তায় প্রেমেন্দ্রসহ উপস্থিত সবাই তাকে অপ্রকৃতস্থ বলে ঠাহর করল। এটা ওর জন্য ভালোই হলো- অযাচিত আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেল। কিন্তু আমার তা মনে হয়নি। মনে হয়েছিল, সে যেন আমায় কিছু বলতে এসেছে, সতর্ক করতে এসেছে। কারণ যে যত কথাই বলুক সে কেবল আমার দিকে চেয়েছিল। হতে পারে আমার বাসন্তী রঙের পোশাক, বাবড়িচুল, হাসিখুশি চেহারা ওর পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু ওকে দেখার পর থেকে আমার মুখ থেকে হাসি হারিয়ে গেল। মনে হলো সে যেন আমায় কোন দূর লোকে আহ্বান করতে এসেছে। ধ্যানে মহাস্থবির, অন্যলোকের বাসিন্দা। কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সবাই তাকে পাগল ঠাওরালো। উত্তম মাধ্যমসহ গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে চাইল। আমার ইঙ্গিতে কেউ ওর গায়ে হাত দিতে সাহস পেল না।
আমি তাকে সঙ্গে করে বিশাল স্টুডিও হলের বাইরে রেখে এলাম। সবাই আমাদের কথাবার্তা লক্ষ্য করল। কেউ সন্দেহ করল। আমি না হয়ে অন্য কেউ হলে ভাবত সরকারি গোয়েন্দা। গোপন তথ্যের জন্য এখানে ঢুকেছে। আমাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল, সে সব আজ অর্থহীন। অনেকেই মনে করে, যোগ, ধ্যায়ান- এসব নৈর্ব্যক্তিক, আসলে ঠিক নয়। মানুষের শরীর না থাকলে সকল আধ্যাত্মিকতার অবসান ঘটে। বস্তুর প্রয়োজন যেমন বস্তুময় শরীরের উপলব্ধি ও পরিপুষ্টির জন্য, তেমনই বিশ্বজগতের উচ্চ রহস্যময় স্থানের সঙ্গে মিলিত হওয়ার ইচ্ছে বা প্রক্রিয়াও দেহের উপস্থিতির জন্য। দেহ ছাড়া পৃথিবীর রূপরসের কোনো অর্থ নেই। যদি কিছু থেকে থাকে সে আলোচনা বস্তুময় পৃথিবীতে না থাকলেও ক্ষতি নেই।
সবাই জানত গরিব দুঃখী অসহায় মানুষ সর্বদায় আমায় আকৃষ্ট করেছে। ঘর ছাড়া এই আমার জীবন যাপনও তো এক ভবঘুরে, পাগল উন্মাদের মতো। ফলে লোকটির মানসিক অবস্থার প্রতি আমার সহানুভূতি স্বাভাবিক হওয়ার কথা। হয়তো সে সব ভাবার পরেও প্রেমেন্দ্র একটু রসিকতা করে বলল, কাজী দা যে এবার পাগলের সর্দার হয়ে যাবে।
প্রেমেন্দ্র আরো বলল, ‘এমনিতেই তোমার নাগাল পাই না। পাগলের ভিড় বাড়লে তো আমাদের এখানেও ঠাঁই হবে না।’
আমি জানি প্রেমেন্দ্র রসিকতা করে বলেছে। তবু কথাটি আমার ভালো লাগেনি। তার সম্বন্ধে কিছু বলা আমার ইচ্ছে ছিল না। তবু বললাম, ‘প্রেমেন্দ্র তোমার এ ধরনের রসিকতা সাজে না। যে এসেছিল, সে আসলে বুদ্ধিভ্রষ্ট নয়। তুমি বড়জোর তাকে যোগভ্রষ্ট বলতে পার।’
ঘটনাটি যদিও সবাই ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আমি খুব কমই হেসেছি।
আমিও কি যোগভ্রষ্ট হয়েছিলাম?
যোগের মূলভাব তার স্মৃতি। সাধারণ মানুষ মনে করে সকল স্মৃতির আঁধার তার মস্তিষ্ক। সেখানেই মানব জীবনের সব স্মৃতি বুদ্ধি ধরা থাকে। তারা স্মৃতি বলতে বোঝে তার দৃশ্যজগতের অভিজ্ঞতার সারাৎসার। তারা মনে করে মস্তিষ্কের বাইরে কোনো স্মৃতি নেই। এখানেই যোগী ও বিযোগী মানুষের মধ্যে পার্থক্য। যোগী মহাবিশ্বের চলমান স্থিতি অবস্থার সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। তার কাছে অতীত ও বর্তমান জগতের তেমন কোনো ফারাক নেই। একজন যোগীর কাছে কোনো বর্তমান নেই, সবই অতীত। অন্যভাবেও বলা যায়, অতীতই বর্তমান। মানুষ এক মুহূর্তের জন্যে বর্তমানে বাস করতে পারে না। বর্তমান তার উপর দিয়ে এত দ্রুত প্রবাহিত হয়, যা সে বর্ণনা করতে পারে না। বিচ্ছিন্ন সব কিছু কেন্দ্রে যুক্ত হতে চায়। যোগ কেবল হিন্দুদের জন্য নয়, হিন্দু ধর্মের একচ্ছত্র আধিপত্য নয়। যোগই হলো আধ্যাত্মিকতা, মহাবিশ্ব ও তার স্রষ্টার সঙ্গে একত্রিত হওয়া।
প্রকৃত যোগীর কাছে ভবিষ্যৎ বলেও কিছু নেই। যেহেতু মানব মনে কিংবা দেহে ভবিষ্যতের কোনো স্মৃতি নেই। ফলে সে কেবল ভবিষ্যৎ বর্ণনা করতেই অক্ষম নয়। বলা চলে ভবিষ্যৎ বলে আলাদা কোনো সময় বা বস্তুর অস্তিত্ব নেই। ভবিষ্যৎ তৈরি হতেও পারে নাও পারে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকেই কেবল আমরা ভবিষ্যৎকে বর্ণনা করতে পারি। সময়ে অস্তিত্ব বলতে কেবল আছে অতীত। অতীতের স্মৃতিই ভবিষ্যতে বাস করে। অতীতে যা ঘটেনি ভবিষ্যৎ তা চিন্তা করতে পারে না। চিন্তার মাত্রাভেদ হলেও কোথাও তার উপস্থিতি আছে।
এই মহাবিশ্ব যে অনন্ত ছুটে চলেছে; ছুটতে ছুটতে স্মৃতি নির্মাণ করছে, যার কোনো অস্তিত্ব ছিল না বা নেই। আর এই স্মৃতির বসবাস সময়ের অতীত নামের গহ্বরে। নদীর উৎপত্তির সঙ্গে সময়ের ত্রিকালকে তুলনা করা যেতে পারে। হিমালয়ের শৃঙ্গ থেকে প্রথমে যে জল সমতলের দিকে ছুটে চলল, তার তো কোনো আঁধার ছিল না, পথ চলার নালা ছিল না। সেই পানি যতই সামনের দিকে ছুটতে থাকে ততই নদীর বিস্তার বাড়তে থাকে। যতক্ষণ না সে অনির্দেশ্য আদি উৎস সাগরের দর্শন না পায়, ততক্ষণ চলতেই থাকে। প্রথম নদী নির্মাণ সম্পন্ন হলে ওই একই আঁধারে কিংবা পথে সমুদ্রের দিকে নামতে থাকে। এই একই পথে চলার নাম স্মৃতি। তবে পানির চলার পথ স্মৃতি অনুস্মৃত হলেও প্রতিটি কণার আবার আলাদা চলার পরিচয় আছে।
আমাদের শরীর কোনো অতীত শরীরের অংশ। অতীত শরীরের স্মৃতি সে শরীরে বহন করে, অদূর অতীতের পরিচিত স্মৃতিচিহ্নগুলো আমরা আমাদের পরিচিত মানুষের মধ্যে খুঁজে পাই। বংশগতির মানুষ জানার আগেও যা ছিল, এখনো তা আছে। বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, এইভাবে অতীতের দিকে বাবা আদম, মা হাওয়ার সঙ্গে আমরা যুক্ত। কিন্তু মস্তিষ্কের উপর বেশি নির্ভরশীল হওয়ায় আমরা তা অনুভব করতে পারি না। অনুভব করতে আমাদের বিযুক্ত হতে হয়। বিযুক্ত হয়ে যুক্ত হওয়ার নাম যোগ। সেই যোগে আমি আসলে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলাম। যেখানে মানুষের প্রতিটি অঙ্গ, ভগ্নাংশ কোষ বিভাজিত হয়ে মেয়োসিস মাইটোসি হয়ে ন্যানো অংশে অবতীর্ণ হয়। চাইলেই সেখানে নতুন করে সব কিছু আকার দান করা সম্ভব। এই কথাটিই আমি নিতাই ঘটককে বলেছিলাম।
নিতাই ঘটকও তার লেখায় উল্লেখ করেছে, তার ভাষ্যে- ‘আপাতত একটি কথা বলছি সেটা বোধ হয় ১৯৪০ সাল। বৌদির হঠাৎ পায়ের নিচের দিক থেকে অবশ হতে লাগল। প্রায় হাঁটু পর্যন্ত যখন এই অবস্থায় পৌঁছেছে- ড. বিধান রায়কে ডাকা হলো- তিনি দেখেশুনে বললেন- এ রোগটির নাম ‘মাইলাইটিস’ (যতদূর সম্ভব এই নামটিই বলেছিলেন)- ধীরে ধীরে উঠতে উঠতে হার্ট অ্যাটাক করবে, রোগীকে বাঁচানো যাবে না। শুনে তো মাসিমা (কবির শাশুড়ি) কাঁদতে লাগলেন। কিন্তু কবি ভাবলেশহীন। কিছুদিন আগে থেকে তিনি অনেকের অমতে অনেক অজান্তে যোগ সাধনা শুরু করেছিলেন। বললেন, যখন যোগে বসি, মনে হয় আমার মাথা আকাশে ঠেকে। আমি এখন যোগ মার্গের অনেক উপরে উঠেছি- যোগবলে আমিই তোর বৌদিকে সারিয়ে তুলব। সত্যিই তিনি তখনই বৌদির মাথার কাছে যোগাসনে বসলেন এবং আশ্চর্যের বিষয় বৌদির যতদূর পর্যন্ত ওই রোগে ইতোপূর্বে আক্রান্ত হয়েছিল রোগ আর ঊর্ধ্বে উঠল না। শেষদিন পর্যন্ত কেবল পা দুখানাই প্যারালাইজড হয়েছিল। শরীরের আর সব কার্যকলাপের ব্যতিক্রম ঘটেনি। ড. রায়কে এ কথা পরে জানানো হয়েছিল- কিন্তু তিনি বলেছিলেন- কি জানি ডাক্তারি শাস্ত্রে এর কোনো খবর জানি না, সবই দৈবের ব্যাপার।’
আমি এখানে নিতাই ঘটকের পুরো বক্তব্যই তুলে দিয়েছি। জগৎ ও নিতাই সারা জীবন আমার ভাইয়ের মতো, অনুগত শিষ্যের মতো আমার সাহিত্য-সংগীত সাধনার মধ্যেই ছিল। এরপরেও লোকজন রহস্যময় কোনো বিশ্বাস করতে চায় না। না হয় আমার কথার সত্যাসত্য নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক মনে সন্দেহ থাকতে পারে। কিন্তু বিধানচন্দ্র রায়, তিনি কেন বললেন, এই রোগ উপরে উঠে হার্ট স্পর্শ করলে কয়েক দিনের মধ্যে প্রমীলা মারা যাবে। তাকে বাঁচানোর কোনো সুযোগ নেই। কই সেদিন কার ইঙ্গিতে প্রমীলার রোগটি থেমে গিয়েছিল। কে তার নিরাময় করেছিল। সেদিনের সবচেয়ে বড় ডাক্তার, ডাক্তারি বিদ্যা সব মিথ্যা হয়ে গেল, তবু আমার যোগাবস্থায় উন্নীত হওয়া নিয়ে মানুষের মধ্যে আছে সন্দেহ। আমার রোগটিও কি কেউ দেখেছে- তাদের জীবনে আরেকজন এমন রোগী। অহেতুক ডাক্তার ধরে নিয়ে গিয়ে, উন্মাদ চিকিৎসার মতো দশ লক্ষ পাওয়ারের পেনিসিলিন আমার শিরায় ঢুকিয়ে দেয়া হলো। ওরা ভাবল, আমার সিফিলিস হয়েছে। যেহেতু আমি সেনাবাহিনীতে কাজ করতাম, সেহেতু বালা ও বাইজিরা আমার কাছে গান শিখতে আসত, যেহেতু অসংখ্য মেয়ে আমায় ভালোবেসেছিল, সেহেতু আমার সিফিলিস না হয়ে যায় কোথায়! এই তো আধুনিক ডাক্তারি বিদ্যা! তাদের নিজেদের শাস্ত্রের অনুরূপ না হলে বিশ্বাস করতেই চায় না। কই প্রতিনিয়ত তো চিকিৎসা শাস্ত্রের পরিবর্তন হচ্ছে। পরে বলা হলো না আমার ভুল চিকিৎসা হয়েছে, সিফিলিসের চিকিৎসা আমায় চিরতরে পঙ্গু করে দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তো কেউ বলেনি, সেই ডাক্তার বা ডাক্তারি বিদ্যার মানুষদের- এই ভুল চিকিৎসার জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত।
তবে এ কথা আজ স্বীকার করতেই হবে- আমার যোগ বিদ্যার মধ্যে দ্বিধা ছিল, চাঞ্চল্য ছিল কিন্তু মহত উদ্দেশ্যও ছিল। কিন্তু দীলিপ বা অরবিন্দের সঙ্গে মিল ছিল না। দীলিপ তার আত্মজীবনীতে লিখেছে- ‘কেন কাজী পাগল হয়েছিল তাও জানি কিন্তু বলব না আরো এই জন্য যে তার সঙ্গে আমার অন্তর্জীবনের বিকাশের কোনো সম্বন্ধই নেই।’
দিলীপের এ ধরনের মন্তব্য ওর চরিত্রের দুর্বলতার প্রকাশ। জেনে থাকলে বল, সত্য লুকানো কোনো সাধুর কাজ নয়। আসলে এ দেশে একজন মুসলমানের পক্ষে যোগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়া সম্ভব তা ওর পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব হয়নি। ও মনে করে আমার একটি বাংলা নাম না থাকলেও মার্জনা করা যায়, উল্লাস করা যায়- ঘরে টানা যায় না। দীলিপ রায়, হেমন্তকুমার সরকার, ওরা আমার বন্ধু, তুখোড় ছাত্র বিলাত ফেরত, বাবা কবি, জমিদারীর অংশভাগী, আমার জন্য ওরা অনেক করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি আমি ওদের ঘরের সন্তান হতে পেরেছিলাম। ওদের গুরু অরবিন্দ- যাকে আমি গুরু বলে ডেকেছি, তাদের অনুসরণে সন্ত্রাসের পথ থেকে যোগের পথে এসেছি। তবু আমি পণ্ডিচেরির পথ খুঁজে পাইনি।
আমার যোগের পথের সকল প্রাপ্তি লোকজন সন্দেহ করেছে, হ্যালুসিনেশন ভেবেছে। আমি আমার মৃতপুত্রকে চাক্ষুষ করেছিলাম বলে, সবাই মনের ভ্রম বলে মত দিয়েছে। কিন্তু শমীর মৃত্যুর পরে কবিগুরুর প্ল্যানচেট করে প্রিয়পুত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ, কণ্ঠ শোনার আকাক্সক্ষার কি ব্যাখ্যা দেয়া যাবে। পিতার হৃদয়! মহাকালের সকল দুঃখ-বেদনা প্রকাশের ভার প্রভু আমাদের দিয়েছিলেন। তাই ‘বক্ষে বেদনা অপার।’
আমার চূড়ান্ত অসুস্থতার শেষপ্রান্তে কালীকৃষ্ণ গুহ যদি শুনে থাকে আমার একান্ত উপলব্ধি ‘নামাজ নিলে ভালো হতো’- সে আর এমনকি দোষের! যুগে যুগে আসা ভারতীয় জ্ঞানীদের মতো আমিও একটা সমন্বয়ের পথ নির্মাণে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করেছিলাম।
এই ভারতে বৈচিত্র্যই ঈশ্বর! আমি সেই ঈশ্বরের অনুসন্ধানে নিজের মধ্যে সমাহিত হয়েছিলাম।
‘আজি নাহি কিছু মোর মান-অপমান ব’লে
সকলি দিয়াছি মোর ঠাকুরের রাঙা চরণের তলে।’

পরিচ্ছেদ : ২

আমি এখন নিজের বর্জ্যরে মধ্যে বসে আসি। নিজের মল ও মূত্রের মধ্যে মাখামাখি করছি। শরীর থেকে পরিত্যক্ত পদার্থ দুই হাতে চটকাচ্ছি। এ নিয়ে আমার কোনো ঘৃণা নেই, অনুশোচনা নেই। কেন থাকবে? মানুষের শরীর এখনো বহন করলেও আমি মানুষের বুদ্ধির জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। আমি সচ্চিদানন্দ স্তর পার হয়ে বিশ্ব-প্রকৃতির সঙ্গে লীন হয়েছি। আমি চাইলেই মানুষের সমাজ থেকে বাইরে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু যাই নাই। দেখব, এরা কতটা নিচে নামতে পারে। আমার চিন্তা ফানাফিল্লাহ পর্যায়ে পৌঁছে গেলেও শরীর রয়েছে মানুষের। মানুষের শরীর- প্রকৃতির জগৎ নিঃসংকোচে নিতে পারে না। সহস্র বছর ধরে মানুষের প্রধান চিন্তা ছিল সে কীভাবে প্রকৃতির প্রভু হয়ে উঠবে। বিশ্ব-জগৎ নিয়ন্ত্রণে নেবে। হয়তো নিয়েছে, অথবা নেয়নি। কিন্তু হারিয়ে ফেলেছে আনন্দ, জগতের বৃহত্তর যোগাযোগের উপায়।

সকালে কালীকৃষ্ণ গুহ এসেছিল, হায়দার এসেছিল, তারা আমায় এ অবস্থায় দেখে গেছে। আমার শাশুড়ি তাদের বলেছিল, ‘যাও দেখে এসো নুরুর কাণ্ড।’ আমার এই অবস্থায় আমার শাশুড়ির জগৎ থেকে সব আলো কেড়ে নিয়েছে। আমার শ্বশুর মারা যাবার পরেও, বালিকা বয়সে বিধাব হলেও এমন নিরাশ হয়নি। তার এই হতাশাকে আমি দুনিয়ার কোনো হতাশার সঙ্গে তুলনা করতে পারব না। এমনকি বুলবুল মারা গেলে, দুলি নিস্তরঙ্গ হয়ে গেলে- সে অনেক ব্যথা পেয়েছিল, ভেবেছিল- এই ব্যথা বয়ে তাদের সারাজীবন বেঁচে থাকতে হবে। কিন্তু এখন আর এ কথা ভাবতে পারছে না। বাঁচা-মরার বিষয়টি এখন আর তার মাথায় কাজ করছে না। কেবল তার মনে হচ্ছে, সহমরণে না গিয়ে মহাপাপ হয়েছে। জীবনের প্রতি মোহ মুক্তির কারণ হয় না। তবু মনে মনে একটি গান গুনগুনিয়ে উঠছে। ‘শূন্যে মহা-আকাশে তুমি মগ্ন লীলা বিলাসে/ প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা/ নিরজনে প্রভু নিরজনে।’ গিরিবালা দেবীর গান গাওয়া, কবিতা লেখার অভ্যাস ছিল।

তখন আমি ১৫/৪ শ্যামবাজার স্ট্রিটের বাসায় থাকি। আমাকে সেখানে একটি ছোট্ট ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। অবশ্য বাড়িতে এর চেয়ে বেশি বড় কোনো কক্ষ নেই। যেহেতু এখন আমি উন্মাদ। ‘আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!/ আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।’ যাদের সঙ্গে এতদিন আমি কাজ করেছি, যাদের হয়ে কাজ করেছি, তাদের সঙ্গে আমার চিরদিনের জন্য সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটেছে। কিংবা আমি মানুষের জগৎ থেকে নির্বাসিত হয়েছি। কই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আবুল কাশেম ফসলুল হক! সে তো আমার এই অবস্থার কথা শুনে একদিনও দেখতে আসল না। আমার আর্থিক কষ্টের কথা জেনেও কোনো পদক্ষেপ নিল না। হিন্দু-মুসলিম ইকুইটি ফান্ড থেকেও তো আমার জন্য কিছু করতে পারত। আসলে সে তো এখন মানুষ নেই, এখন সে মানুষের সমাজ থেকে পশুদের সমাজের অধিপতি হয়েছে। গত বছর লাহোরে গিয়ে ভাগাভাগির ফর্মুলা দিয়ে শেরে বাংলা খেতাব নিয়ে এসেছে। অথচ একদিন বাংলার মেহনতি মানুষের কৃষক মজুরের সে-ই ছিল ভরসা। তার নেতৃত্বেই তো আমার যুগবাণীর নবযুগের উত্থান।

অর্থের অভাবে এখন আমার চিকিৎসা চলছে হোমিপ্যাথি, আয়ুর্বেদ। এখন আমার ডাক্তার কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থ, আর হোমিওপ্যাথ ডি.এল সরকার। তারা আমার উত্তেজনা কমানোর ওষুধ দিচ্ছে। যাতে আমি নিজের মল নিজে চটকাতে না পারি। মূত্র ও মলের উপর শুয়ে না থাকি। আর এই সব জাতীয় নেতাদের, নির্বোধ নেতাদের- কষে গালি দিতে পারি। আমার রাগ সপ্তমে উঠে যাচ্ছে- কোথায় তোর ফজলুল হক, নাজিমদ্দি, সোহরাওয়ার্দী, তজিমদ্দি। তোরা হবি এই বাংলার ভাগ্য-বিধাতা, আধ-মরা মুসলিম কৃষকের নেতা! তোদের কবিই তো না খেয়ে, বিনা চিকিৎসায় মরে যাচ্ছে। তোরা আছিস পিঠা ভাগাভাগিতে। তোদের কবির চিকিৎসা করছে কবিরাজ, পানিপড়া। পানিপড়ার পাকিস্তান গড়া ছাড়া তোদের আর কি যোগ্যতা আছে।
আমার অসুখের খবর পেয়ে চুরুলিয়া থেকে এসেছে ছোট ভাই আলী হোসেন। বড় ভাই সাহেবজানও এসেছিল। আর জুলফিকার হায়দার নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো লেগে আছে। কালীকৃষ্ণ গুহ মাঝে মাঝে আসছে। আর আছে কাঠিয়া, সাহু- কথা বলতে পারে না- কথা বলা এমন কোনো ভালো কাজ নয়। তারা আমার দেখভাল করছে। জোর করে কুয়োতলায় নিয়ে যাচ্ছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। কিন্তু আমার তাতে কিছু এসে যায় না। আমি সুযোগ পেলেই ওদের মুখে কয়েক ঘা মেরে দিচ্ছি। পাগলের গায়ে কোথা থেকে যে শক্তি ভর করে কেউ জানে না। প্রকৃতির শক্তি। পাগলকে দেখে তাই তথাকথিত সুস্থ মানুষ ভয় পায়।

আমি আজ মানুষের পরিচ্ছন্নতা বোধের বাইরে চলে গেছি। যারা এসব পরিষ্কার করছে, সেটা তাদের প্রয়োজন। যেহেতু তারা এ অবস্থায় আমায় বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারছে না। আমার যেহেতু পরিচয় আছে, লোকজন চিনে ফেলবে। কিন্তু কিসের লোকজন, আমি নাকি সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি! আমার গানের রেকর্ড বিক্রি হয় কাড়ি কাড়ি। বাইরে প্রকাশক, শিল্পীর ভিড় লেগে থাকে। এখন প্রকাশক, গ্রামোফোন কোম্পানি, কলেরগান কোম্পানির মালিকেরা কোথায়। আমার লেখায় নাকি ভারতে ব্রিটিশ সম্রাজ্য যায় যায়। আমার পেছনে লেগে থাকা ব্রিটিশ স্পাই, দেশি টিকটিকি আজ কোথায় গেল। আমার পতনে কি তারা তাদের পতন থামিয়ে দিতে পেরেছে। আমি আর তাদের জন্য ভীতিকর নই। তাই কেউ আর আমাকে ধরে নিতে আসছে না, অনশনে থাকলে কেউ জোর করে খাওয়াচ্ছে না। কেবল রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করলে, পুলিশের সিপাইরা বলবে, এই লোক একদিন ইংরেজ ট্রিগার্ড সাহেবের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। যদিও সময় হলে আমার ঘরের মধ্যে খাবার থালা দিয়ে যাচ্ছে আলী হোসেন, কখনো হায়দার। কখনো দু-এক নলা খাচ্ছি, বাকিটা মেঝেতে ঢেলে চটকে লেপে দিচ্ছি। সব কিছু খাবারের বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর এসব ওরাই সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কখনো আমার শাশুড়ি গিরিবালা দেবীকেও করতে হচ্ছে। প্রমীলা তো নিজে নিজে উঠতে পারে না। পারছে না বলে কষ্ট পাচ্ছে। তবু ভালো- সবটা ওর চোখের আড়ালে হচ্ছে। সানি ও নিনির চোখে মুখে কি অসহায় অনিশ্চয়তার ভয় ফুটে উঠেছে। ওদের স্নেহময়ী বাবা আজ এতটাই অপরিচিত।

আমার এই কাজটি কেউ পছন্দ করছে না। অনেকে ভাবছে, আমরা তো আগেই জানতাম একদিন আমার এ অবস্থা হবে! আমার জন্য কোন এক পাপ নির্ধারিত হয়ে আছে জীবনে। ঘৃণায় তাদের গা ঘিন ঘিন করছে। আমাকে ত্যাগ করে চলে যেতে চাচ্ছে। প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করতের তাদের দ্বিধা নেই। যাদের সঙ্গে আমি এতকাল বাস করেছি, তারা কেউ মনে মনে পছন্দ করছে না। নিকটাত্মীয়রা ভাবছে, সুস্থ হওয়ার যদি কোনো পথ খোলা না থাকে- মরে যাওয়া ভালো। কিন্তু আমি কেন মরতে যাব। আমি তো পৃথিবীর জগতের সঙ্গে আমার এই অবস্থার কোনো বিরোধ দেখছি না। বরং এতদিনে আমি এই ভারতবর্ষের মানুষের মধ্যে, ধর্ম রাজনীতি ছোঁয়াছুঁয়ির সে তীব্র সংকট দেখে আসছি, তাতে আমার কাছে মনে হয়েছে- তাদের এক দল যদি মানুষ হয় তাহলে অন্যদল পশু। একে অন্যকে কোনো বিচার বিবেচনা ছায়াই হত্যা করতে পারে। তারা মানুষের শরীর স্পর্শ করলে অচ্ছুত হয়ে যায়। তারা গরু নিয়ে বিবাদ করে। কেউ গরু কাটে, কেউ গরু পূজা করে। গরুর এতে কি এসে যায়। আর এসে যায় না বলেই গরু নিজের গোবরের মধ্যে, চানার মধ্যে শুয়ে থাকে। নিজের বিষ্ঠা শরীরের সঙ্গে লেপ্টে রাখে। তাতে কারো কোনো অসুবিধা হয় না। যারা কাটছে তাদেরও না, যারা পূজা করছে তাদেরও না। বরং গোবরটুকু চেটেপুটে পরিষ্কার করে নিয়ে যাচ্ছে। গরুর গু দিয়ে ঘর লেপে পবিত্র করছে, মানুষ ছোঁয়ার পাপ মুক্ত হতে গরুর গু ভক্ষণ করছে। কোনো ধর্মের লোকই গরুর বিষ্ঠাকে অপবিত্র মনে করে না। তারাও ঘর লেপে, উঠান লেপে। ভাত রাধে। এই গরুর জন্য তারা নিজের দেশ ভাগ করে নিচ্ছে। জিন্নাহকে ব্রিটিশ সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিল- হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে পার্থক্য কী। জিন্নাহ বলেছিল, এদেশের হিন্দু ও মুসলমানকে একমাত্র গরু পার্থক্য করেছে।

সাংবাদি আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলেন, কীভাবে?
জিন্নাহ বললেন, মুসলমানরা গরু জবাই করে খায়। আর হিন্দুরা গরুর পূজা করে।
তখন আমার কেবল গাইতে ইচ্ছে করে- ‘দে গরুর গা ধুইয়ে।’
আমি যে আমার মলের মধ্যে শুইয়ে আছি, এই ভারতবর্ষে, এই কলকাতা শহরে প্রায় প্রতিটি মানুষই তো এর চেয়ে ভয়াভয় দুর্গন্ধপূর্ণ মলের মধ্যে প্রতিদিন শুয়ে থাকে। তাদের মাথার মধ্যে অনেক অনেক বছরের মল জমা হয়ে আছে। যারা একজন আরেকজনের গন্ধ সইতে পারে না। স্পর্শ সইতে পারে না। তারা শরীর পশুর গোবর দিয়ে লেপে পরিশুদ্ধ করতে পারলেও এক মানুষ আরেক মানুষকে পবিত্র ভাবতে পারে না। মানুষ ছুঁইলেও তাদের পশুর বিষ্টা খেতে হয়। তাদের মনের ময়লাকে পরিষ্কার করতে হয় পশুর বিষ্ঠা দিয়ে। গরু যদি এসব জানতো তাহলে বিষ্ঠা দিত না, বাছুর দিত না, দুধ দিত না। মানুষ মাংস খায় তাই সে বাচ্চা দেয়, মানুষ দুধ খায় তাই সে দুধ দেয়। গরু যদি মানুষের মতো করে ভাবত, তাহলে দুধও দিত না, বাচ্চাও দিত না। নিজের দুধ নিজে খেত। বাচ্চাকে বলত মানুষের বাচ্চা দেখলে এক ঢুসে নাভি ফাটিয়ে দিবি। গরু এসব ভাবে না, মানুষ ছাড়া আর কাউকে এসব ভাবতে হয় না। মানুষ শ্রেষ্ঠত্বে দাবিদারের নিকৃষ্ট প্রাণী।
তাহলে আমি নতুন করে কি সমস্যা করলাম। আমি তো আমার মলের মধ্যেই শুয়ে আছি, আমি তো অন্যের শরীরে মল মাখাতে যায়নি। আমার পেটের মল আমি বাইরে নিয়ে এসেছি, আমার ভেতরে এখন কোনো ক্লেদ নেই, ময়লা নেই। কিন্তু যারা পেট ভর্তি মল, মাথার ঘিলু ভর্তি বিষ্টা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা আজ ভারতবর্ষকে টুকরো টুকরো করার জন্য, নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়ার জন্য নানা ফন্দি আটছে- হিন্দু আটছে, মুসলমান আটছে। তারা মুখে দুর্গন্ধ বাক্য বলার আগে যদিও একটু কথার সুগন্ধি মেখে নিচ্ছে; যাতে প্রতিপক্ষের কাছাকাছি থেকে নিজেদের মাথার মলভর্তি চিন্তাগুলো প্রকাশ করতে পারে।
আজ এদেশে অনেক বড় বড় নেতা। ব্রিটিশের কোম্পানি থেকে পড়ে এসেছে, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, মেঞ্চেস্টার। যদিও আমি সেই সব দেশে যাইনি। কিন্তু মহাত্মা তো গেছে, জিন্নাহ গেছে, নেহরু গেছে, শ্যামাপ্রসাদ গেছে, আম্বেদকার গেছে, কবিগুরু গেছে, অনেক পাতি কবি, পাতি নেতা গেছে। কিন্তু তাতে কার কী হয়েছে- তারা শুধু পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে কূটচিন্তাপূর্ণ দুর্গন্ধময় বিষ্ঠাই উপহার দিচ্ছে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যেমন, অক্সফোর্ড- মানে ষাঁড়ের নাদি। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যেমন ক্যাম্প নদীর ছোট সেতু; সেহেতু তাদের শিক্ষা এমন কি উন্নত, দুর্গন্ধ ছড়ানো ছাড়া, অন্যের প্রতি অসম্মান এবং পরাস্ত করার চেতনা ছাড়া তারা কি-ই বা শিখে এসেছে সেখান থেকে। এই সব মেট্রিক পাস ব্যারিস্টার আজ ইংরেজ প্রভুদের সুরে কথা বলছে।
ইংরেজের দেশে গিয়ে কী শিখে এসেছে তারা। তাদের ভাষা, তাদের কেতা, তাদের পোশাক, হাতের বদলে কাটা চামচে খাওয়া, মদের টেবিলে চেয়ারস বলা, ম্যাম বিয়ে করা! ইংরেজ কি এদেশে প্রসপেরো নয়। তারা কি জলে ভেসে এসে এদেশের মালিক বনে যায়নি!
কোথা থেকে একটা ঝড় বয়ে এলো। শেক্সপিয়ারের টেম্পেস্টের ঝড়। ‘সহসা এলো উর্ধ্বে-গগনে বৈশাখী ঝড়, প্রগাঢ় নীলকৃষ্ণ মেঘলোকে জড়িয়ে। ঘনঘন গভীর দমরু-ধ্বনিতে, বহ্নিবর্ণা দামিনী-নাগিনীর ত্বরিত সঞ্চারণে আমার বাহিরে অন্তরে যেন অপরূপ আনন্দ তরঙ্গায়িত হয়ে উঠল। সহসা আমার কণ্ঠে গান হয়ে, সুর হয়ে আবির্ভূত হলো- এলো রে প্রলঙ্কর সুন্দর বৈশাখী ঝড় মেঘমালা জড়ায়ে। আমি সজল ব্যাকুল কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলাম, তুমি কে? মধুর সহজ কণ্ঠে উত্তর এলো, তোমার প্রলয়-সুন্দর বন্ধু।’
তারো আগে ঝড়ে নৌকাডুবিতে বেঁচে আসা দেশ দখলকারী প্রসপেরো আমায় শাসনের স্বরে বলল, ‘তোর এই অভিশাপের জন্য আজ রাতেই তোর ভয়ংকর পেটের ব্যথা হবে। আর সারারাত তোর শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হবে, এক ধরনের পোকা মৌমাছির থেকেও তীক্ষè হুল দিয়ে বিদ্ধ করবে তোকে।’
আমি ক্যালিবানের মতো বললাম, ‘এই দেশ আমার। আমার মা ভারতমাতার তৈরি। আমরা হিন্দু, মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ, শৈব, পার্শি- সবাই মিলে আমরা মাকে সৃষ্টি করেছি। আমাদের নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো বিবাদ থাকলেও মা আমাদের সমান ভালোবাসতেন। আমাদের তার পক্ষ তলে আগলে রেখেছিলেন, কোথাও দস্যুবৃত্তির জন্য পাহাড় পেরুতে দেয়নি। সমুদ্র পেরুতে দেয়নি। চোখে চোখে রেখেছে। আর তুমি আমার কাছ থেকে আমার মাকে কেড়ে নিয়েছ। যখন তুমি প্রথম এখানে এসেছিলে তখন তুমি আমাকে আদর করতে, আমাকে দিন-রাতের আলোর গতি-প্রকৃতি শেখাতে এবং আমিও তোমায় ভালোবাসতাম। ভালোবেসে তোমায় এই ভারতবষে

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়