করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমার সঙ্গে মেহজাবিনের পরিচয়ের গল্পটা অদ্ভুত। ভ্রমের গল্প। আমি দুটো ক্লাসের মাঝের সময়ে লাইব্রেরির নিচতলায় যে ক্যাফেটেরিয়া আছে সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। কফি নিয়ে দশ মিনিটের মাঝে পাশের বিল্ডিংয়ে ক্লাস ধরতে যেতে হবে।
আমি কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না মেয়েটিকে কোথায় দেখেছি। হয়তো ইলেক্টিভ ক্লাস হবে। আমি চেহারা নাম এগুলো ভালো মনে রাখতে পারি না। আমি আরেকবার মেয়েটিকে ভালো করে লক্ষ করলাম। জিন্সের ওপর বেশ লম্বা মতন টপ পরা। বাদামি রঙের চোখ আর লম্বা কালো চুল। এই মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। মেয়েটি এশিয়ান, ওর চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে কিন্তু কোনো দেশি ঠাহর করতে পারছি না। আমার একটা অভ্যেস আছে উত্তর ভারতীয় চেহারার কাউকে দেখলে চট করে তাকে জিজ্ঞেস করি না সে ইন্ডিয়ান কিনা।
এক অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খবর? তোমার ল্যাব রিপোর্ট করা শেষ?’
আমি হাসিমুখে উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ। সব ঠিক আছে। আমি একটা ক্লাসে যাব। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
আমি প্রথম সাক্ষাতের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এর ঠিক তিন দিন পরে আমি আর সাকিব ক্যাফেতে দাঁড়িয়ে আছি মেহজাবিনের সঙ্গে আবার দেখা হলো।
ও এসে আমাদেরকে বলল, ‘জানো সাকিব তোমার বন্ধুকে তুমি ভেবে আমি কয়েক দিন আগে গল্প করেছি? তোমাদের দুজনের চেহারায় অনেক মিল আছে।’
আমি আর সাকিব দুজনেই হাঁ হয়ে গেলাম। আমরা দুইজন বাঙালি। চেহারায় দৃশ্যত কোনো মিল নেই।
সাকিব হেসে ফেলল, ‘ঠিক বলেছ আমাদের দুইটা কান, দুই চোখ আর একটা নাক আছে। অনেক মিল।’
মেহজাবিন লজ্জা পেল একটু। এরপরে যতবার দেখা হয়েছে আমার দিকে দেখে হেসে কুশল বিনিময় করেছে। ওর আরেকটা কথা আমার বেশ মনে আছে। স্পষ্ট উচ্চারণে আমাকে শোভন বলে ডাকত। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ বিদেশিদের নাম একটু ভেঙেচুরে উচ্চারণ করে নামের দফা রফা করে দ্যায়।
সাকিব আমার হাউসমেট। ইউনিভার্সিটির কাছেই একটা বাড়িতে আমরা থাকি। বাড়ির সদস্য মোট পাঁচজন। ফে নামের এক মেয়ে আছে জ্যামাইকান। আর ক্লডিয়া নামের এক শ্বেতাঙ্গিনী। আমি আর সাকিব বাদে বাড়িতে পুরুষ মানুষ ছিল আলজেরিয়ান একটি ছেলে নাম জাফির। সাকিব ছাড়াও জ্যামাইকান মেয়েটির সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব ছিল। মেয়েটি উচ্চস্বরে কথা বলত। ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে জোরে হাসতো।

সাকিবকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম মেহজাবিনের কথা।
সাকিব হাসতে হাসতে বলল, ‘কেন বস? তোমার পছন্দ?’
আমি হেসে বললাম, ‘এমনি জিজ্ঞেস করি।’
মেহজাবিন যেমন সুন্দরী তেমন মেয়ের সিঙ্গেল না থাকারই নিয়ম। এদেশে কেউ একা থাকে না এমনিতেও।
‘ওকে আমি অনেক দিন থেকে চিনি। স্যাড কেস বুঝছো?’
‘থাক তাহলে বাদ দাও।’
‘ওর বাবা-মা পাকিস্তান থেকে এসেছে। তুমি নিশ্চয় জানো?’
‘ওর সাথে একজনের চেহারার দারুণ মিল। ও কার মতো দেখতে জানো সাকিব? ও নায়িকা লিসারের মতন দেখতে।’
‘ঠিক বলেছ শোভন। আসলে আমি তেমন খেয়াল করে দেখিনি কখনো। ওর সাথে এবার বেশকিছু বিজনেস কোর্স কমন পড়েছে আমার। নিয়মিত দেখা হয় আমাদের।’
সাকিবের স্বভাব এমন। কাউকে নিয়ে কটু কথা বলে না। ছোট ইউনিভার্সিটি শহর। অনেক বাঙালি। এখানে সবাই একজন আরেক জনের হাঁড়ির খবর রাখে। সাকিব অন্যরকম। ও মেহজাবিনের প্রসঙ্গ পাল্টে আমার সঙ্গে টোয়েন্টি নাইন খেলতে বসে গেল।
এমনিতেও মেহজাবিনের খবর জেনে আমার তেমন কোনো লাভ হতো না। মেহজাবিনের মতো সুন্দরী মেয়েরা আমার মতো ছেলেদের সঙ্গে প্রেম করে না। আমি ওই চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দিলাম।
প্রায় মাসখানেক পরের কথা।
সেবার রোজার মাস পড়েছে গ্রীষ্মের শুরুতে। এখানে ডে নাইট সেভিংস বলে একটা ব্যাপার আছে। গ্রীষ্মকালে দিনের বেলা অনেক লম্বা হয়। রোজার সময় প্রায় ১৬ ঘণ্টা। এত লম্বা রোজা আমার সব সময় রাখা হয় না। প্রথম দিকের কয়েক দিন রোজা রাখলেও উইন্ডসরের অতিরিক্ত গরমে শেষের রোজাগুলো রাখা আমার জন্য অসম্ভব।
এখানকার এক মেয়ে গরমে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিল। গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর অতিরিক্ত গরমে রাস্তা সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করছিল। অতিরিক্ত গরমে আধ ঘণ্টা পরে জ্ঞান হারিয়েছিল।
সেদিন আমি নিজের ঘরে বসে পড়াশোনা করছি। বসার ঘরে কথার আওয়াজ ভেসে আসছে। মিডটার্ম পরীক্ষা দেখে ইচ্ছে করেই ঘর থেকে বের হলাম না।
এখন শেষ মুহূর্তে পড়া ঝালিয়ে নিতে হবে। আমার একটা বাজে অভ্যেস আছে আমি নিজের পড়ার টেবিল ছাড়া অন্য কোথাও বসে মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারি না।
ঘরের দরজায় খুটখুট শব্দ। আমি দরজা খুলতেই দেখি মেহজাবিন। হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি দরজা থেকে সরে ওকে ঘরে ঢুকতে বললাম। ও দরজায় দাঁড়ালো। আমার হাতে প্যাকেট দিয়ে বলল, ‘আমি আজকে রান্না করেছি। এ বাড়ির সবার জন্য ইফতার এনেছি। সাকিব বলল তোমার নাকি পরীক্ষা, তাই ভাবলাম তোমার ঘরে দিয়ে যাই। হয়তো রাত হয়ে যাবে পড়া শেষ করতে।’
‘অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি তো রোজা রাখিনি মেহজাবিন।’ বলে আমি হেসে ফেললাম।
‘তাতে কী হয়েছে? আমি তো সবার জন্যই রান্না করেছি। কালকের পরীক্ষার জন্য বেস্ট অব লাক।’
আমি ভদ্রতা করে ওকে বাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। মেহজাবিন বলল, ‘তুমি ভেতরে যাও।’
আমি দরজার এপাশ থেকে দাঁড়িয়ে থাকলাম। রাত প্রায় সাড়ে ১০টা। একটা দামি স্পোর্টস কার এসে দাঁড়ালো। মেহজাবিন আমার দিকে হাত নেড়ে সেই গাড়িতে গিয়ে উঠে বসল।
ডাইনিং টেবিলে দেখি সাকিব বসে খাচ্ছে। আমিও গিয়ে বসলাম ওর সাথে।
আমাকে দেখে সাকিব বলল, ‘মেহজাবিনের রান্না ভালো। বিরিয়ানি ভালো রেঁধেছে।’
‘আমিও বসি। আসলে রুমে খেলে পরে কাপড়ে বিশ্রী গন্ধ হবে।’
‘আর বোলো না। এই এক যন্ত্রণা। আমাদের দেশি রান্নার যে গন্ধ তাতে জ্যাকেটের বারোটা বেজে যায়। আমি সবসময় ঘরে ফিরিয রাখি। পারফিউমে বা বডি স্প্রেতে গন্ধ দূর হয় না।’
আমি বললাম, ‘মেহজাবিনের বন্ধুর গাড়িটা বেশ দামি। অডির বেশ দামি স্পোর্টস মডেল।’
আমার দেখার ভুল হতে পারে তবে সাকিব বিরক্ত হলো তারপর বলল, ‘মুখে এলাচি পড়েছে। দাঁড়াও ফেলে আসছি।’
‘এলাচি জিনিসটা খেতে আমার কাছে জঘন্য লাগে। মনে হয় সাবান খাচ্ছি।’
আমি হাসলাম। সাকিব হাত ধুয়ে চলে গেল। আমি ঘরে ঢুকে পড়ায় মন দিলাম। মেহজাবিনের কথা মাথা থেকে সরিয়ে মন দিয়ে ল্যাপল্যাস ট্র্যান্সফর্ম শিখতে বসলাম।
এর কিছুদিন পরই এক অনভিপ্রেত ঘটনায় আমি মেহজাবিনের জীবনের অজানা অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। মেহজাবিন আর আমি একসঙ্গে বসে টিভি দেখছিলাম। সাকিব ওর ঘরে বসে পড়াশোনা করছে। মেহজাবিনকে সেদিন বেশ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম জ¦র আছে কিনা। ও উত্তরে বলেছে কিছু হয়নি।
আমি কিচেনে চা বানাতে গিয়েছিলাম। লিভিং রুমে ফিরে দেখি মেহজাবিন মেঝেতে পড়ে আছে। ওর কপালে রক্তের ধারা।
আমি ৯১১-এ কল করলাম। ঠিক মিনিট পনেরোর ব্যবধানে ও কী করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল আর কপাল কী করে কাটলো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করছি তখন সাকিব চলে এসেছে।
ও বলল, ‘কপাল কেটেছে কারণ কাচের টেবিলের পাশে ওর মাথায় আঘাত লেগেছে।’

ঠিক পনের মিনিটের মাথায় অ্যাম্বুলেন্স এলো। প্যারামেডিক এসে আমাদের কাছে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করল ও ঠিক কীভাবে জ্ঞান হারিয়েছে। তারপর ওকে অ্যাম্বুলেন্স তুলে নিলো। মেহজাবিনের ব্যাগের ভেতর ওর হেলথ কার্ড পাওয়া গেল। হেলথ কার্ডের সঙ্গে আনুষঙ্গিক অনেক ইনফরমেশন থাকে যেমন ওর ইমার্জেন্সি কন্টাক্ট।
অ্যাম্বুলেন্সের পেছন পেছন সাকিব আর আমি গাড়ি চালিয়ে গেলাম। চাইলে অ্যাম্বুলেন্সে যেতে পারতাম কিন্তু সাকিব নিষেধ করল। ও বলল আমরা পেছনে আসছি। আমিও যেতে চাচ্ছিলাম কিন্তু সাকিবকে কী করে বলবো বুঝতে পারছিলাম না। মনের মাঝে একটা চিন্তা বারবার উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। যদি আমি ওকে রেখে একা না যেতাম তবে ওর এই দুর্ঘটনা ঘটত না এমন আর কি।
হাসপাতালে নার্স আমাদের একটা অদ্ভুত কথা বলল। সাকিব নাকি মেহজাবিনের ইমারজেন্সি কন্ট্যাক্ট। সাকিব নিজেও বেশ অবাক হয়ে গেল। এখানে বেশিরভাগ সময় বাবা মা বা ভাই বোন থাকে ইমার্জেন্সি কন্ট্যাক্ট। অথবা বয়ফ্রেন্ড বা জীবনসঙ্গী। মেহজাবিন সাকিবের নাম কেন লিখেছে কে জানে? ডাক্তার বললেন ওর প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। ইন্টারনাল হেমারেজ। ওর ব্লাড গ্রুপ বি নেগেটিভ। রক্ত দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।
আমার মনে তখনও অসংখ্য প্রশ্ন। সাকিব কিছুক্ষণ পরে ফোন নিয়ে বসল ও বুদ্ধি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেহজাবিনের বোনকে খুঁজে বের করল। তারপরে ওকে মেসেজ করে বলল হাসপাতালে আসতে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর ওর বোন আসল। মেয়েটার মাথায় ঘোমটা। এসে ওর বোনকে খুঁজলো। সদ্য কৈশোর পেরোনো এক মেয়ে। আমাদের বলল ওর বাবা-মা দেশে নেই এই জন্য ও একাই এসেছে।
সাকিব একটু পরে আমাকে এসে বলল মেহজাবিনের নাকি মিসক্যারেজ হয়েছে।
আমার দেখার ভুল হতে পারে তবে সাকিবের চোখ টকটকে লাল। ওকে দেখে মনে হলো ও কান্নাকাটি করে এসেছে। সাকিব খুব শক্ত ধরনের ছেলে। ওর দাদি যেদিন মারা যান সেদিন ও নামাজ পড়ে মিডটার্ম পরীক্ষা দিতে গেছে। ওর যুক্তি ছিল দাদি পড়াশোনা ভালোবাসতেন। ও কোনো অজুহাত দিয়ে পরীক্ষা বাদ দেবে না।
আমি বেশি কথা বাড়ালাম না। সাকিবকে জিজ্ঞেস করলাম ওর খিদে পেয়েছে কিনা। হাসপাতালের ক্যাফে থেকে ওর জন্য একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে আসলাম। হাসপাতালের নাম হোটেল ডিউ গ্রেস। অনেক পুরনো আমলের দোতলা একটা বিল্ডিং।
আমরা সেই রাতে বাড়ি ফিরে এলাম। সাকিব দেখলাম সারারাত পায়চারি করছে। ওর চোখে মুখে প্রবল অস্থিরতা। আমি সারাদিনের ক্লান্তিতে দুই চোখ এক করার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এমন যদি হয় হাসপাতাল থেকে ফোন এলো অথচ ধরতে পারলাম না।
পরদিন সকালে আমাদের ক্লাস বাদ দিয়ে আমরা হাসপাতালে গেলাম। মেহজাবিন একটু বিপদমুক্ত। তবে হাতের সঙ্গে ক্যানলা লাগানো হাসপাতালের বেডে আধ শোয়া মেহজাবিনকে দেখে আমার খুব মায়া হলো। ওর পরনে হাল্কা নীল হাসপাতালের গাউন। আমাদেরকে দেখে হাসার একটা চেষ্টা করল। সাকিব চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে এক কোনায়। আমি ওখান থেকে বের হয়ে ওদের দুই জনকে একা কথা বলার সুযোগ করে দিলাম। কেন যেন মনে হচ্ছিল সাকিব ওর সঙ্গে একা কথা বলতে চায়।
সাকিব বের হয়ে বলল, ‘ও হাসপাতালের খাবার খেতে পারছে না। চল বার্গার কিঙ যাই। ও খুব পছন্দ করে।’
আমরা ওর খাবার নামিয়ে দিয়ে চলে আসলাম। পরদিন সাকিবের কাজ পড়ে যাওয়ায় ও মেহজাবিনকে দেখতে যেতে পারল না। আমি একাই গেলাম।
হোটেল ডিউ গ্রেস হাসপাতালের পেছন দিকে একটা বাগান মতো আছে। আমি মেহজাবিনকে ওখানে নিয়ে বসলাম।
মেহজাবিন নিজে থেকে বলল, ‘তুমি আমাকে খুব খারাপ মেয়ে ভাবছ আমি জানি।’
আমি হেসে বললাম, ‘তোমার ধারণা ভুল’।
‘তবে শোনো আমার বাবা-মা আমাকে ত্যাগ করেছে। ওরা কোনোদিন আমার খবর নেবে না। সাকিব আমার এমারজেন্সি কন্ট্যাক্ট ঠিক এই কারণেই। আমার বয়স তখন আঠার। এক সামারে আমাকে বাবা-মা বললেন পাকিস্তান বেড়াতে নিয়ে যাবেন। আমি খুব এক্সাইটেড ছিলাম। খুব মজা হবে ভেবে ওদের সঙ্গে গেলাম। আমাকে আসলে বিয়ে দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নিজের বাবা-মা আমার সঙ্গে এমন প্রতারণা করলেন। আমার সঙ্গে আমার কাজিনের বিয়ে দেয়া হলো। আমাদের বয়সের পার্থক্য ছিল আঠারো বছরের। আমি অনেকবার বাবা-মাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বাবা আমাকে হুমকি দিলেন। আমার চলাফেরা পশ্চিমাদের মতো হয়ে যাচ্ছে। উনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমি মায়ের কাছেও সাহায্য পেলাম না। মা হাউস ওয়াইফ। বাবার কথার বাইরে একটা কথাও বলেন না। তবে মায়েরও প্রচ্ছন্ন সায় আছে বুঝলাম।
যার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল তাকে আমার মানুষ ভাবতে ঘেন্না হয়। একটা টিনেজার মেয়ের সঙ্গে বর্বরদের মতন আচরণ ছিল লোকটার। বন্দুক চালাতে পারত। আমাকে প্রায় বলত কথার অবাধ্য হলে তার কী পরিণাম হতে পারে।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করলাম। কানাডা এসে আমি ওই ছেলেকে ডিভোর্স দিলাম। বাবা-মা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলো। আমার রেজাল্ট ভালো ছিল। ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেলাম। তারপর আমার আফজালের সঙ্গে পরিচয়। আফজাল কয়েক দিন আগে বলেছে ওর দেশে গিয়ে খালাতো বোনকে বিয়ে করতে হবে। এখন বাবা-মায়ের অজুহাত দিচ্ছে।
মেহজাবিন এই পর্যায়ে কাঁদতে শুরু করলো। এদেশের লোকজন কারো দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায় না।
দূরে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আমরা যে জায়গাটাতে বসেছি একটা বেদি মতন আছে। ভারি সুন্দর জায়গা। মেহজাবিনের মুখে শেষ বিকেলের আলো। বিষাদের অপূর্ব মূর্তি যেন ওর মুখ।
ও আমার দিকে ঘুরে বলল, ‘একটা কথা জানো? আমার কি মনে হয় জানো আমার ধর্ম-কর্ম কিছু নেই। আমার নামাজ কবুল হয় না।’
‘তেমন কিছু না মেহজাবিন। তুমি বেশি ভাবছ।’
মেহজাবিন বলল, ‘ঊাবৎু ংরহহবৎ যধং ধ ভঁঃঁৎব ধহফ বাবৎু ংধরহঃ যধং ধ ঢ়ধংঃ.’
আমি আর কথা বাড়ালাম না। ওর ডান হাতের ওপর আমার হাত রাখলাম। এই স্পর্শে প্রেম বা কাম নেই; শুধুই বন্ধুতা।
এর পরে মেহজাবিনের সঙ্গে আমার আর যোগাযোগ ছিল না। ও অন্য শহরে চলে গেল কাজের সন্ধানে। ক্রেডিট ট্রান্সফার নিয়ে আমিও অন্য শহরে চলে গেলাম। বছর পাঁচেক পর ইটন সেন্টারে মেহজাবিনকে আবার দেখলাম ওর দুই কন্যা আর স্বামীর সঙ্গে। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরল। ওর মেয়ে দুটো অবিকল মায়ের মতন দেখতে। ওর স্বামীর দিকে ফিরে বলল, ‘শোভন আমার বিদেশি বন্ধু। আমরা অনেক আগে একসঙ্গে পড়তাম।’
বাইরে বের হতেই দেখি ঠিক সেদিনের মতন লালচে আকাশ। প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল। মেহজাবিনের সঙ্গে দেখা হতেই যেন গোধূলি নামে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়