চন্দনাইশে পুকুরে ডুবে শিশুর মৃত্যু

আগের সংবাদ

সব বাঙালির উৎসব : সনজীদা খাতুন

পরের সংবাদ

সাম্প্রদায়িকতার বিস্তৃতি তৃণমূলেও : সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা কমছে, অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকশিত করার প্ল্যাটফর্ম অনুপস্থিত

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : অসাম্প্রদায়িক চিন্তার বিপরীতে সাম্প্রদায়িক চিন্তার বিকাশ-লালন-পালন দীর্ঘদিনের। কোথাও কোথাও এর শেকড় অনেক গভীরে। যা মোকাবিলা করার জন্য অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকশিত করার প্ল্যাটফরম অনুপস্থিত। একদিকে মৌলবাদের আস্ফালন, অন্যদিকে আকাশ সংস্কৃতির জোয়ারে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার বছরের দেশীয় সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য। আর এর সুযোগ নিচ্ছে মৌলবাদীরা। তৃণমূলেও ছড়িয়ে পড়েছে ধর্মীয় উগ্রবাদের কালো থাবা। এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না ছোট ছোট কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও। সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয়কৃষ্ণ মণ্ডল এবং নাটোরের শিক্ষক আমোদিনী পালকে ফাঁসানোর অপচেষ্টাকে তৃণমূলে ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়িয়ে পড়ার লক্ষণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। এজন্য সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার অভাব, সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব, আদর্শ ও মূল্যবোধের অবক্ষয়কেই দায়ী করছেন তারা।
বিশ্লেষকদের মতে, ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন মনে হলেও সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি এক সুতোয় গাঁথা। রাজনীতি থেকে সংস্কৃতিকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। যার ফলে এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটছে। তাদের মতে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ যত বিকশিত হবে, ধর্মীয় সা¤প্রদায়িকতা তত অপসারিত হবে। ১৯৭২ সালে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান ক্ষমতা সংহত করার জন্য আপস করলেন পাকিস্তানি ভাবাদর্শের সঙ্গে। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি দলকে রাজনীতি করার সুযোগ দিলেন; নিজের দলে ও মন্ত্রিসভায় তাদের স্থান দিলেন। এভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তি পুনরুজ্জীবিত হলো। সাম্প্রদায়িকতাও ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করল। জাতীয়তাবাদী শক্তির বিশ্বাসঘাতকতা ও বাম শক্তির ব্যর্থতাও এর জন্য দায়ী। এ ব্যাপারে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ পংকজ ভট্টাচার্য ভোরের কাগজকে বলেন, গণতন্ত্র চর্চা সংকুচিত হলে লাভবান হয় সাম্প্রদায়িক শক্তি। বিপদ আরো ঘনীভূত হচ্ছে। সুপরিকল্পিতভাবে ফাঁদ পেতে ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক চর্চা হচ্ছে না। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ পথ হারিয়ে এখন সংস্কৃতি শূন্য। গ্রাম-শহর কোথাও সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা নেই। একাত্তরের হাতিয়ার ভোঁতা হয়ে গেছে। প্রশাসনিকভাবে দেশ চলে। সাম্প্রদায়িকতা থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা অবজ্ঞা করেছি। যার মাশুল এখন গুনছি।
গবেষকদের মতে, ধর্মের নামে দেশে এ রকম সংগঠিত অপরাধ এই প্রথম নয়। আগেও ঘটেছে-

কক্সবাজারের রামুতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে, সুনামগঞ্জের শাল্লায়, কুমিল্লায়, রংপুরে। কিন্তু কোথাও এদের বিচার হয়নি। উল্টো সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর মামলার চার্জশিটভুক্ত ৩ আসামি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নও পেয়েছিল। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই অপরাধীদের অপরাধে সাহস জোগায়। জানতে চাইলে গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল ভোরের কাগজকে বলেন, এদেশে সাম্প্রদায়িক চিন্তার পরিস্ফুটন দীর্ঘদিনের। যার বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বিকশিত করার প্রয়াস স্তিমিত। এই ভাবনাগুলো নতুন প্রজন্মকে প্রভাবিত করছে। মৌলবাদ শেকড় গজাচ্ছে। কিন্তু বিকল্প চিন্তা প্রসারিত হচ্ছে না। তিনি বলেন, সারা দেশে আগে যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছিল, আজ তা অনুপস্থিত। সুফিবাদ হারিয়ে যাচ্ছে। বাউল গান আর তেমন হয় না। যাত্রাপালা নেই। সর্বত্র সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব। আর এই জায়গা দখল করছে মৌলবাদ ও ধর্মীয় উগ্রবাদ।
গবেষকদের মতে, রাষ্ট্রধর্ম, প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াত, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুতির কারণেই ধর্মীয় উগ্রবাদ বাড়ছে। এ ব্যাপারে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চেয়ে মুজিব কোট বেশি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নেই। শিক্ষানীতি নেই। ইতিহাস চর্চা নেই। শিশুদের মগজে নানা কৌশল ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাচ্চা মেয়েদের হিজাব পরাতে বাধ্য করা হচ্ছে। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াত-শিবির, পাকিস্তানি ও মৌলবাদী চিন্তাধারার মানুষ। তিনি বলেন, বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের মামলাসহ সব সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাই। এসব ক্ষেত্রে ভিক্টিমকে অপরাধী বানানো হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এজন্য দায়ী। আমরা বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি।
এসব সাম্প্রদায়িক চিন্তার পেছনে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মনস্তাত্ত্বিক কারণটাই বা কী- এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও কাউন্সেলিং মনোবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মাহজাবিন হক ভোরের কাগজকে বলেন, দিন দিন অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে স্বার্থান্বেষী মানুষ সবসময় ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে তাদের প্রধান টার্গেট শিশু-কিশোররা। কারণ এদের আবেগ দিয়ে কিছু বোঝালে যাচাই-বাছাই না করেই তারা তা গ্রহণ করে নেয়। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়