রাস্তা পারাপারকালে ট্রাকের ধাক্কায় এক ভ্যানচালক নিহত : দুজনের অস্বাভাবিক মৃত্যু

আগের সংবাদ

আলোচনায় নজর গোটা বিশ্বের : যুদ্ধবিরতি ও সেনা প্রত্যাহার চায় কিয়েভ > উভয় পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করতে চায় মস্কো

পরের সংবাদ

নতুন ইসির বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ : সব দল ও ভোটারের আস্থা অর্জন > লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা > প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এন রায় রাজা : শপথ নিয়েই সংবাদমাধ্যমের একরাশ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালকে। এর মধ্যে তার সামনে চ্যালেঞ্জটা কী এবং সেটা মোকাবিলা করবেন কীভাবে- তা জানতে দেশবাসীর কৌতূহল সবচেয়ে বেশি। তবে নতুন সিইসি সব প্রশ্নের খোলাসা জবাব না দিয়ে সরাসরিই জানিয়ে দিলেন তিনি- ‘চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পাই না’। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন- একটা নয়; বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখে নতুন নির্বাচন কমিশন। বিগত নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে পারেনি। গত দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়েও কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া ভোট ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভোটারদেরও আস্থার সংকট- কেন্দ্র বিমুখিতা দেখা গেছে। আবার সংবিধানে নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসন ইসির অধীনে থাকার কথা থাকলেও বহু ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। নির্বাচনে পেশিশক্তি ও অর্থের অপব্যবহার হয়েছে। নির্বাচনী সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে শত শত মানুষের। কমিশনের এসব ব্যর্থতার কারণে নির্বাচন অনেকাংশে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতাকে সরিয়ে রেখে সব দলের সমন্বয়ে একটি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন উপহার দেয়াই কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন ইসির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।
এদিকে দেশের অন্যমত প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপি নতুন নির্বাচন কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তারা আগামীতে বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। দশম জাতীয় নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি, বরং দেশে অগ্নিসন্ত্রাস করে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। পরে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে তারা অংশ নিলেও নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ আখ্যা দিয়ে পরবর্তীতে কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তারা সরাসরি অংশ নেয়নি। যা নিয়ে আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে নির্বাচন কমিশন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এসব

কারণে বিএনপিসহ দেশের সবগুলো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করাও কাজী হাবিবুল আউয়ালের কমিশনের কাছে বেশ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বিগত দুটি কমিশনের ওপর ভোটারদের আস্থা ছিল না বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনের পাশাপাশি ভোটারদেরও আস্থা অর্জন করতে হবে নতুন ইসিকে। তাদের ভোটকেন্দ্রমুখী করা বর্তমান কমিশনের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ভোটের দায়িত্বে থাকা পোলিং-প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে যদি ইসি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত না করতে পারে তা হলে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হওয়া কঠিন। সেই সঙ্গে সব দলের অংশ নেয়ার বিষয়ে আরো চিন্তাভাবনা ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা দরকার। যা সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অনেকে। ইসির সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা বাড়ানো এবং একই সঙ্গে তার কঠোর প্রয়োগের জন্য নতুন সিইসি ও অন্য কমিশনারদের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এ লক্ষ্যে নতুন কমিশনের প্রথম কাজ হবে সব দলের সঙ্গে সংলাপ আয়োজন। এছাড়া আগামী মাসের মধ্যে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করতে হবে এ ইসিকে। আগামী বছরের প্রথমে দেশের চার বড় সিটি করপোরেশনের নির্বাচন রয়েছে। তাই জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করে নতুন ইসিকে প্রমাণ করতে হবে তারা কতটা গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ।
এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর সাংবিধানিকভাবে আইন করে এবার একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। এটাকে আমি স্বাগত জানাই। আমি আশা করব, তারা শুধু জাতীয় নির্বাচন নয়; সব ধরনের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে উপহার দেবে। ভোটাররা যাতে নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারেন সে ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা ইসির গুরু দায়িত্ব। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ প্রতিষ্ঠান। নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে গতিশীল করার চ্যালেঞ্জ তো আছেই। সেই সঙ্গে ১৬ কোটি ৮০ লাখ মানুষের দেশে জাতীয়সহ সব নির্বাচন যেন প্রশ্ন মুক্ত থাকে, দেশের জনগণ সেটা দেখতে চায়- এটাই বর্তমান কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব সবগুলো দলকে নিয়ে একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন উপহার দেয়া। একই সঙ্গে বিগত বেশ কয়েকটি নির্বাচনে ভোটারদের নির্বাচন বিমুখতা দেখা গেছে। তারা ইসির ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। সেটা পরিবর্তন করতে হবে সুষ্ঠু ভোট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। নতুন ইসির উচিত হবে সব অংশীজন- বিশেষ করে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন ও ভোটারদের নিরাপত্তা বিধান করা। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া সুন্দর করে, একই সঙ্গে সাংবিধানিক ক্ষমতার কঠোর প্রয়োগ করে আগামীতে যেসব নির্বাচন রয়েছে সেগুলো পরিচালনার ব্যবস্থা করা- যাতে সব দল ও ভোটাররা ইসির ওপর আস্থা ফিরে পায়। একই সঙ্গে যেসব নির্বাচন ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে তার ময়নাতদন্ত করে দায়ীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা ও তা থেকে শিক্ষা নিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করাও এই কমিশনের দায়িত্ব। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় একটা বড় ফ্যাক্টর- এই মন্তব্য করে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনাও এ ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেন সাবেক এ কমিশনার।
আরেক সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহম্মদ শাহনেওয়াজ বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশনের সব চেয়ে বড় দায়িত্ব সব দলগুলোকে নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দেয়া। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসে তাদের কথা শোনা, আস্থাভাজন হওয়া। একই সঙ্গে ভোটারদের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ওপর যে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে- আগামী নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করে ইসির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে। এছাড়া ইসির সাংবিধানিক ক্ষমতার কঠোর প্রয়োগের আহ্বান জানান তিনি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নতুন ইসির কাছে প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো আজকে তারা যে শপথ নিলেন, তার সারমর্ম অনুধাবন করে সেটাকে নিজেদের মধ্যে আত্মীকরণ করা। তারা এতদিন পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, সেখানে দীর্ঘদিন একটা আনুগত্য তারা লালিত করেছেন, সেখান থেকে বের হয়ে একটা মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, তারা এখন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তারা প্রতিদিন যে কাজকর্ম করবেন, তার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে তারা সরকারের কাছ থেকে সরে এসে সংবিধানের প্রতি, জনগণের প্রতি আনুগত্য দেখাতে প্রস্তুত। তাদের সব ধরনের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়াস নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, এ দেশে নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। এর মধ্যে কয়েকটি আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে- প্রথমত যে দল ক্ষমতায় থাকবে তাদের প্রভাব থাকবে- তারা কতটুকু নিরপেক্ষ নির্বাচন চাইবে তা বলা যায় না। তাই এ ইসির দায়িত্ব হবে সব ধরনের চাপ বা প্রভাব মুক্ত হয়ে জাতিকে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়া। দ্বিতীয়ত নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা জড়িত, যেমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন- এরা নির্বাচনকালীন সময়ে ইসির এক্তিয়ার ভুক্ত। তাই এ দুটি সংস্থা কতটা নির্বাচনী ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের আত্মস্থ করতে পারবে, ইসি কতটা তাদের নিজেদের আয়ত্বে রাখতে পারবে- সেটাও ইসির জন্য বেশ বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা এরা কিন্তু রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রভাবিত প্রতিষ্ঠান। এদের কাছে নিরপেক্ষ ভূমিকা পাওয়া জটিল ও কঠিন। তারা কতটা নিরপেক্ষ থাকবে সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা ও নির্বাচন সুষ্ঠু করার কাজে জবাবদিহিতার মধ্যে আনাও এ ইসির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর তৃতীয়ত সরকারি দল বা অন্য দলগুলো মনে করে নির্বাচনের অর্থ যেনতেন প্রকারে জিততেই হবে। সেক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন অবস্থান থেকে তারা সেটাই চাইবেন। তা হলে জনগণ ও ভোটারদের কাছে নির্বাচন কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। ড. ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, নির্বাচন কমিশন সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করবে। সব ভোটার ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করাই বর্তমান কমিশনের জন্য সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এদিকে গতকাল রবিবার বিকালে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী নতুন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে শপথবাক্য পাঠ করান। সুপ্রিম কোর্টে তাদের শপথ অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল শপথ নেয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, প্রতিটি নির্বাচনই একটি চ্যালেঞ্জ। সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে নির্বাচন করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। শুধু নির্বাচন কমিশন (ইসি) চাইলেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সবার সহযোগিতা লাগবে। সর্বোচ্চ ভালোটা দেয়ার চেষ্টা থাকবে আমাদের।
আজ সোমবার নতুন কমিশন ইসি ভবনে তাদের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন বলে জানান ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়