সেমিনারে সেলিনা হোসেন : বাংলা ভাষার ঐতিহ্য রক্ষার্থে শুদ্ধ চর্চা করতে হবে

আগের সংবাদ

আউয়ালের নেতৃত্বে নতুন ইসি : চার নির্বাচন কমিশনার- রাশিদা সুলতানা, আহসান হাবীব খান, মোহম্মদ আলমগীর ও আনিছুর রহমান > শপথ আজ

পরের সংবাদ

আর ‘ফেরানো যাবে না’ তাকে

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাওসার আহমেদ চৌধুরী। তাকে কোনো একটি বিশেষণে পরিচয় করিয়ে দেয়াটা অনেকটাই কষ্টসাধ্য। রাশিফল লেখার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া একজন কবি, লেখক, গীতিকার,
মুক্তিযোদ্ধা ও চিত্রশিল্পীর নাম। শুধু তাই নয় ইচ্ছা ছিল চলচ্চিত্র নির্মাণের। গল্প ও চিত্রনাট্য দেখিয়েছিলেন ঋত্বিক কুমার ঘটককে। শারীরিক নানা জটিলতায় পূরণ হয়নি সে স্বপ্ন।
১৯৪৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর সিলেটে জন্মগ্রহণ করা স্বনামখ্যাত কাওসার আহমেদ চৌধুরী না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন ২২ ফেব্রুয়ারি
রাশিফলে জীবন
কিছু করতে হবে বলে এমন কোনো পরিকল্পিত পরিকল্পনা ছিল না তার। আর হবেই বা কেন, ছিলেন তো পরিবারের সবচাইতে আদুরে ছেলে। যখন যেটা করতে চেয়েছেন, করেছেন। পরিবারের কোনো বাধা নিষেধের বালাই ছিল না বলেই হয়েছিলেন বাউণ্ডুলে স্বভাবের। তাই তো যখন যা মনে হয়েছে তা করেছেন। কবিতা আর জ্যোতিশাস্ত্রের প্রতি আগ্রহ তার ১১ বছর বয়সে। তবে শেষমেশ নিজেকে জ্যোতিষী বলেই পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। ‘আপনার রাশি’ নামে নিয়মিত রাশিফল লিখছেন একটি দৈনিক পত্রিকায়। ‘আপনার রাশি’র শুরুতেই তিনি বলে নিতেন, ‘আপনি নিজেই আপনার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন শতকরা ৯০-৯৬ ভাগ। বাকিটা আমরা ফেট বা নিয়তি বলতে পারি। ভাগ্য অনেক সময় অনির্দিষ্ট কারণে আপনা থেকেও বদলাতে পারে।’ এই লাইনগুলো পড়েও মানুষ সপ্তাহভর অপেক্ষায় থাকত শনিবারের ‘আপনার রাশি’ পড়ার জন্য।

গানের মানুষ
এখনকার প্রজন্ম কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে চেনেন জ্যোতিষী হিসেবে। তবে বাংলা গানের যারা নিয়মিত শ্রোতা, তাদের কাছে শ্রোতা, কাওসার আহমেদ চৌধুরীর রেখে যাওয়া গানগুলো কানে বাজবে ঠিকই। বাংলাদেশের সংগীতের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে দেখা যায় আধুনিক ও ব্যান্ড সংগীতের কালজয়ী বেশকিছু গানের গীতিকার ছিলেন তিনি। তার এই গান লেখার শুরুটা অনেকটা আকস্মিকভাবেই। পাকিস্তান আমলে আজিমপুর কলোনিতে বোনের বাসায় থাকার সময়। তখন সেই কলোনিতে থাকতেন খ্যাতনামা শিল্পী খন্দকার ফারুক আহমেদ। তার হাত ধরেই এই গীতিকার হওয়া। সিলেট বেতারে তার লেখা প্রথম গান প্রচারিত হয়।
১৯৭২ সালের দিকে, গান লেখার প্রতি তার আগ্রহ ও ভালোবাসা যখন তুঙ্গে, তখন পরিচয় হয় লাকী আখন্দের সঙ্গে। এই দুজনের মেলবন্ধনেই তৈরি হয় বেশকিছু কালজয়ী গানের। কয়েকটি কালজয়ী গানের মধ্যে রয়েছে কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া ‘যেখানেই সীমান্ত তোমার সেখানেই বসন্ত আমার’, নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে’, লাকী আখন্দের কণ্ঠে ‘আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না’, সামিনা চৌধুরীর গাওয়া ‘আমায় ডেকো না’, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে’ এবং সৈয়দ আব্দুল হাদীর কণ্ঠে ‘চলনা জলসা ঘরে এবার যাই’। পরে এ গানটি সালাউদ্দিন জাকীর ঘুড্ডি সিনেমায় ব্যবহার করা হয়। ৯০ দশকের দিকে ব্যান্ডের জন্য গান লেখেন তিনি। যার মধ্যে ফিডব্যাকের ‘মৌসুমি কারে ভালোবাস তুমি’, আইয়ুব বাচ্চুর ‘এই রুপালি গিটার ফেলে’, ফেরদৌস ওয়াহিদের কণ্ঠে ‘পলাতক সময়ের হাত ধরে’ ও নিলয় দাসের গাওয়া ‘কত যে খুঁজেছি তোমায়’। তার লেখা গান গেয়েছেন শম্পা রেজাও।

কবিতা এবং ছবিতা
চিত্রশিল্পী হওয়ার দুর্বার বাসনা নিয়ে পড়তে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। কিন্তু বেশিদিন স্থির হয়নি সেই স্বপ্ন। বন্ধুত্বের খাতিরে নির্মলেন্দু গুণের অনুরোধে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ এর প্রচ্ছদের নকশা করেন তিনি। এরপর আরো অনেক বইয়েরও প্রচ্ছদের কাজ করেন। লিখতেন কবিতা। শুধু দেশেই নয় কলকাতার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার কবিতা। তার কবিতা পড়ে ভূয়সী প্রশংসা করেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একমাত্র কবিতার বই ঘুম
কিনে খাই। এছাড়া লিখেছেন বেশকিছু রাশিফলের বই।
চলচ্চিত্র মন আমার
চলচ্চিত্রকর ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের মতো। ঋত্বিক ঘটকের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’তে একটি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রস্তাব পেয়েছিলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। কিন্তু সময় এবং ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে আর কাজ করা হয়ে ওঠেনি। ঋত্বিক ঘটক বাংলাদেশে এলেই দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন কাওসার চৌধুরীর সঙ্গে। গল্প আর আড্ডায় পার করতেন সময়। অসাধারণ প্রতিভাধর, সৃজনশীল, জ্ঞানী এবং ক্ষেপাটে মানুষটির কাছ থেকে কাওসার চৌধুরীর শিখেছেন এবং জেনেছেন অনেক কিছু। তার কাছ থেকেই মূলত প্রেরণা পেয়েছিলেন চিত্রনাট্য লেখার। বিটিভিতে একসময়ের প্রচারিত জনপ্রিয় হাসির নাটক ত্রিরতœর চিত্রনাট্য লেখেন তিনি।
চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন তিনি। ইউএনডিপি, ইউএনএফপিএর অর্থায়নে চলচ্চিত্রের ওপর প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ যান। ফিলিপাইনে গিয়ে ভিডিও ফিল্ম কীভাবে তৈরি করতে হয় তা শিখেছেন। প্রখ্যাত প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা পিটার কিংয়ের সংস্পর্শে এসে শিখেছেন চলচ্চিত্র তৈরির বিভিন্ন কৌশল।
থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায় ছুটেছেন চলচ্চিত্র তৈরির ওপর নিজের জ্ঞান বাড়ানোর জন্য। এই সময় সরকারি কিছু প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরিবার পরিকল্পনার ওপর
বাংলা ও ইংরেজিতে বিভিন্ন তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন।
এছাড়া কাজ করেন বিভিন্ন বিজ্ঞাপন নির্মাণেও। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাসনা থাকলেও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং টাকার অভাবে সেই স্বপ্ন আর বাস্তবে রূপ নেয়নি।

এবং মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের অধীনে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের গোয়েন্দা হিসেবে তথ্য সংগ্রহের কাজ করেছেন তিনি। বিভিন্ন কৌশলে পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ডেরার খবর নিয়ে আসতেন। ছবি আঁকার হাত ভালো থাকায় সেসব জায়গার নকশা এঁকে বিভিন্ন অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন।
জীবন নিয়ে কোনো অনুশোচনা ছিল না তার। তাইতো অবলিলায় বলেছিলেন আমি এক স্টেশনে যাবার জন্য টিকেট কেটে নেমে গেছি অজানা স্টেশনে। যে স্টেশন থেকে আর ফিরবেন না কাওসার আহমেদ চৌধুরী। কেননা ফেরারী পাখিরা কুলায় ফেরে না…।
:: মেলা প্রতিবেদক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়