ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

শোষিতের বন্ধু বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এ বিশ্বে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের জন্ম হচ্ছে। অল্প কিছুসংখ্যক অপমৃত্যু ছাড়া প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে তারা সবাই বেড়েও উঠছে। কিন্তু সকলে বড়ো হচ্ছে না। বড়ো মানুষ হতে হলে বিশেষ কতকগুলো গুণ থাকা দরকার। এর প্রধান গুণটি হচ্ছে মানব কল্যাণ সাধন। মানুষের কল্যাণে সাধনে যে মানুষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং নিজের সুখস্বাচ্ছন্দ্য, স্বার্থ বিসর্জন দেন, তিনিই কেবল বড়ো মানুষ হবার যোগ্য। বিশ্বের খ্যাতিমান মানুষদের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁরা শৈশব থেকে মানুষের কল্যাণের কথা ভাবতেন, দুঃখী মানুষের কষ্ট দেখে তাঁদের কদর বিগলিত হতো। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও তাঁরা মানুষের সেবা করে গেছেন। এসব ক্ষণজন্মা মানুষের একজন হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মানুষের কল্যাণে তিনি ছিলেন বিশেষ তৎপর এবং নিবেদিত প্রাণ।
১৯২০ সালে ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতার নাম সাহেরা খাতুন। শেখ মুজিবের পূূর্বে তাঁর দুবোন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা-মায়ের একটি পুত্র সন্তান কামনা ছিল দীর্ঘদিনের।
শেখ মুজিবের ডাক নাম ছিল খোকা। দেখতে সাধারণ আর পাঁচটা ছেলের মতো মনে হলেও শৈশবেই খোকার চরিত্রে কতকগুলো বৈশিষ্ট্য সকলের নজর কাড়ে। দুর্দান্ত প্রকৃতির হলেও খোকার মনটা ছিল অত্যন্ত নরম। দুঃখীদের মধ্যে ধানচাল বিতরণ করত। এতে বাধা পেলে খোকা বলত, আমরা খেতে পাই, ওরা খেতে পায় না কেন? খোকার এই আদিম প্রশ্ন গৌতম বুদ্ধ, যিশুখ্রিস্ট, হজরত মুহম্মদ (স.), লেলিন, মাও সে তুং, হো চি মিন থেকে শুরু করে সকল মহামানবের জীবনকে আলোড়িত করেছিল। খোকা মাকে প্রশ্ন করে, মা, মানুষ গরিব হয় কেন? মা বলেন, আল্লাহ মানুষকে গরিব করেন। কথাটা খোকার বিশ্বাস হয় না। সে বলে, কিন্তু ওরা তো সব সময় আল্লাহকে ডাকে। নামাজ পড়ে। বেশির ভাগ বড়োলোকই ধর্মকর্ম করে না। আল্লাহ ওদের ডাকে সাড়া দেয় না কেন? মা একথার কোনো জবাব খুঁজে পান না।
একদিন কিশোর মুজিব দেখে, পথের ধারে এক বৃদ্ধ শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। তার গায়ে জামা নেই। খুব কষ্ট হলো খোকার। সে নিজের গায়ের গরম কাপড়খানা খুলে বৃদ্ধকে পরিয়ে দেয়। আর একদিনের ঘটনা খোকা বৃষ্টিতে ভিজে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছে। দাদি জিজ্ঞাসা করেন, খোকা তোর ছাতা কোথায়? খোকা বলে, ছাতা আমার এক বন্ধুকে দিয়ে দিয়েছি। ওর ছাতা নেই। বাড়ি অনেক দূরে। বেশি ভিজলে ওর জ¦র হবে।
গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক খালি-গা বালককে দেখে খোকা নিজের জামাটি ওকে পরিয়ে দেয়।
একবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল ভালো না হওয়ায় দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করে। অনেক লোককে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হয়। বাবার অনুপস্থিতিতে মুজিব গোলার ধানের একটি অংশ দুর্গত মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়। মুজিবের শৈশবকালের এ ধরনের অনেক মানবিক ঘটনার কথা জানা যায়।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়বান মুজিবের চরিত্রে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনাও জন্ম নিতে থাকে। অন্যায়ের প্রতিকার করার জন্য তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ছাত্রাবস্থায় মুজিব গোপালগঞ্জ মুসলিম সেবা সমিতির সম্পাদক ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ছাত্ররা মুষ্টিভিক্ষা করে তা গরিবদের মধ্যে বিতরণ করত।
একবার অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল পরিদর্শনে এলে ছাত্রদের পক্ষ থেকে মুজিব তাঁদের ছাত্রদের নানাবিধ অসুবিধার কথা বলে তা পূরণের দাবি করেন।
রাজনৈতিক কারণে একটি মামলায় মুজিবকে একবার গ্রেপ্তার করা হয়। সাতদিন থানায় আটকে রাখা হয়। এসময় মুজিবের বয়স আঠারো। এই প্রথম মুজিব বন্দিজীবনের স্বাদ পেলেন। মাত্র সাতদিনের জন্য আটক বলেও এখানে বসেই মুজিবের রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। তিনি উপলব্ধি করলেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই কেবল গণমানুষের সার্বিক মুক্তি সম্ভব।
মুজিবের শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের প্রথম দিনগুলো কেটেছে ইংরেজের রাজত্বকালে। তিনি গ্রামবাংলার মানুষের দুর্দশা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। এই সময় সারা দেশে ইংরেজবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিল। শেখ মুজিব ইংরেববিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন। যে কয়টি কারণে শেখ মুজিব রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন তার প্রধান তিনটি হচ্ছে :
(১) সা¤্রাজ্যবাদ ইংরেজদের অধীন থেকে দেশকে মুক্ত করা।
(২) দরিদ্র প্রজাদের ওপর সামন্ত প্রভু ও জমিদারদের অত্যাচার বন্ধ করা।
(৩) দেশের অসহায় সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করা।
১৯৪০ সালে মুজিব ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪২ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন এবং পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন, এ সময় থেকে ইংরেজবিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট হিন্দু-মুসলিম দুই জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হলো- স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম হলো। ভারত স্বাধীন হলো ১৫ আগস্ট। পূর্ববঙ্গ এবং ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের ৪টি প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হলো।
শেখ মুজিব কলকাতা ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় চলে এলেন। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান গণপরিষদে ঘোষণা করলেন, ‘পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। অন্য কোনো ভাষা নয়। লিয়াকত আলীর সুরে সুর মিলিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও বললেন, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষও উর্দুকে তাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেতে চায়, অন্য কোনো ভাষা নয়। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রমনা মাঠে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এবং ২২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও ঘোষণা করলেন, উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়।’ ছাত্ররা ‘না’ ‘না’ ধ্বনি তুলে তার প্রতিবাদ করল। ভাষাকে কেন্দ্র করে রোপিত হলো পাকিস্তান ভাঙার বীজ।
কোনো জনগোষ্ঠীকে তার মাতৃভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারলে সে জনগোষ্ঠীকে তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করা যায়। মূলত বাংলার মানুষকে সার্বিকভাবে শোষণের লক্ষ্যেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র শুরু করে। তরুণ রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিব পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর শোষণের এই অপকৌশলকে অনুধাবন করে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। ইংরেজদের মতো পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও তাঁর মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ জানুয়ারি মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। লিয়াকত আলী খান ও খাজা নাজিমুদ্দিন কর্তৃক রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার বিরোধিতার প্রতিবাদে ২ মার্চ ফজলুল হক হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে শেখ মুজিবের প্রস্তাবক্রমে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। ভাষার দাবিতে ১১ মার্চ ধর্মঘট পালনকালে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৫ মার্চ তিনি মুক্তিলাভ করেন। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিব।
১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া আন্দোলনে অংশগ্রহণ করায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবসহ পাঁচজন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে। অপরাধ স্বীকার করে চারজন মুচলেকা দিয়ে শাস্তির হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলেও শেখ মুজিব মুচলেকা দিতে রাজি হননি। বহিষ্কারের কারণে তাঁর পক্ষে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা সম্ভব হয়নি। এরপর থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনসহ দেশের প্রতিটি গণআন্দোলনে শেখ মুজিব ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয়। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন তিনি বাংলার মানুষের মুক্তিসনদ ৬ দফা ঘোষণা করে পরোক্ষভাবে বাংলার স্বাধীনতাই ঘোষণা করলেন।
বাংলার মানুষকে শোষণের হাত থেকে রক্ষা করার আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানের অপরাধে দীর্ঘ ১৪ বছর তিনি কারাগারে আটক ছিলেন। শাসকগোষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধে আনীত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রমনা রেসকোর্স মাঠে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লাখ জনতা তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৭০ সালে দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ শতকরা ৯৮ ভাগ ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। শাসকগোষ্ঠী বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করায় ‘বঙ্গবন্ধু’ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এই অসহযোগ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হতে থাকে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রমনা রেসকোর্সের বিশাল ময়দানে দেশবাসীকে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৫ মার্চ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দেশে ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে। গ্রেপ্তার হবার পূর্বক্ষণে বঙ্গবন্ধু এক বাণীতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। দীর্ঘ নয় মাস তিনি পাকিস্তানি কারাগারে আটক ছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতি অথচ তাঁরই নামে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হতে থাকে। কারাগারে তাঁর সেলের পাশে তাঁর কবর খোঁড়া হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়, বহু ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।
দেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু দেখলেন, তাঁর সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে হাজারো সমস্যায় ডুবে আছে দেশ। হানাদার বাহিনী শুধু মানুষ হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা দোকানপাট, কলকারখানা, বাড়িঘর, শস্যভাণ্ডার সব জ¦ালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে গেছে। রাস্তাঘাট, যানবাহন ধ্বংস করে দিয়েছে। পশ্চিমা পুঁজিপতিরা তাদের মূলধন নিয়ে গেছে। ব্যাংকের সোনাদানা, টাকাপয়সা লুট করেছে। এক কথায় দেশের গোটা অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়ে গেছে।
এতসব সমস্যা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ঘাবড়ালেন না। তিনি দেশ গড়ায় মন দিলেন। দেশের মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে সংবিধান প্রণয়ন করলেন এবং তাতে চারটি মূলনীতি গ্রহণ করলেন। এগুলো হচ্ছে- (১) জাতীয়তাবাদ (২) গণতন্ত্র (৩) সমাজতন্ত্র (৪) ধর্মনিরপেক্ষতা।
বঙ্গবন্ধু সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তিনি উপলব্ধি করলেন, পশ্চিমা গণতন্ত্র এই অনুন্নত দেশে সম্ভব নয়। এখানকার শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ অশিক্ষিত, তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। কাগজে কলমে মৌলিক অধিকার স্বীকৃতি থাকলেও দারিদ্র্যের কারণে তারা তা ভোগ করতে পারে না। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ঔপনিবেশিক ও সামন্ততান্ত্রিক শাসন ও সমাজব্যবস্থায় বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণির মুষ্টিমেয় মানুষ তাদের শোষণ করে। তাই দেশে একটি শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি দেশের আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন, ত্রæটিপূর্ণ বিচারব্যবস্থা এবং উৎপাদন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু নিজ দল আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি গঠন করেন, ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ।’ একে সংক্ষেপে বলা হয় ‘বাকশাল’।
বাকশালের মূল লক্ষ্য ছিল চারটি : (১) গণমুখী প্রশাসন (২) গণমুখী বিচারব্যবস্থা (৩) বাধ্যতামূলক বহুমুখী গ্রাম সরকার (৪) শোষিতের গণতন্ত্র।
সাধারণ মানুষকে শোষণের পর রুদ্ধ হবার আশঙ্কায় বাকশালের কার্যক্রম শুরু হবার পূর্বেই শুরু হলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। তারা নানাভাবে বাকশাল গঠনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করল। অব্যাহত ষড়যন্ত্রের এক পর্যায়ে ষড়যন্ত্রকারীরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। এর কয়েক মাস পর তারা জেলে আটক তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে গুলি করে হত্যা করে। হত্যাকারীরা সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাতিল করে। খোন্দকার মোশতাক ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ‘ইনডেমনিটি’ বা দায়মুক্তি আইন পাস করে। তারা যুদ্ধাপরাধ আইন বাতিল করে একাত্তর সালের খুনি হত্যাকারী রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্যদের জেল থেকে মুক্তি দেয়। পরবর্তীকালে তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করে।
১৯৭৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, পৃথিবী আজ দুভাগে বিভক্ত- শোষক শ্রেণি আর শোষিত শ্রেণি, আমি শোষিতের পক্ষে। তাঁর একথা শুনে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, মনে রেখ, আজ থেকে তোমাকে হত্যা করার জন্য একটি বুলেট তৈরি হয়ে আছে। কাস্ট্রোর এই সতর্কবাণী মিথ্যা হয় নাই।
বাংলার মানুষকে শোষণের হাত থেকে মুক্ত করে ‘সোনার বাংলা’ গড়া ছিল বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের লালিত স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির পক্ষে লড়তে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। জীবনের একটি বড়ো অংশ কারাগারে কাটিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, বুকের রক্ত দিয়ে হলেও আমি বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য লড়ে যাব। জীবন দিয়ে তিনি তাঁর ওয়াদা রক্ষা করে গেছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়