ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

ভাষা আন্দোলন, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর অবদান

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২২ , ১:৪১ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হয়েছে মূলত বাঙালি সংস্কৃতির ভিত্তির ওপর। বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর (আদি-অস্ট্রেলীয়, মঙ্গোলীয়) ‘পাচমেশালীজাত’ বাঙালি। প্রাচীনকালে পূর্ব-ভারতের যে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এদের বসবাস ছিল, আজকের বাংলাদেশ এর অংশবিশেষ। বঙ্গ, গৌড়, পুণ্ডু, রাঢ়, সমতট, হরিকেল প্রভৃতি জনপদে বিভক্ত ছিল এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল ও এর মানুষ। কীভাবে এসব জনপদ ও এর মানুষ ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হলো, যা ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অপরিহার্য শর্ত, সেটি জানা আমাদের আবশ্যক। নানা সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে একটি ভৌগোলিক ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হয়ে কালক্রমে সেখানে বঙ্গ থেকে বঙ্গাল, বাঙ্গালা বা বাংলা, সুবে বাংলা, নিজামত, বেঙ্গল, পূর্ববাংলা, পূর্ব পাকিস্তান, পরিশেষে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালি জাতির অভ্যুদয় (রশিদ, ২০১৬:৬৮)।
বাংলার বহিরাগত তুর্কি-আফগান-মুঘল মুসলিম শাসনাধীন মধ্যযুগ ছিল সাড়ে পাঁচশ বছরব্যাপী বিস্তৃত (১২০৪-১৭৫৭)। এ সময়ের প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এক. ভৌগোলিক ঐক্য, দুই. বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার প্রতি শাসকবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা দান। এই মুসলিম শাসন আমলেই বাংলায় প্রধানত ধর্মান্তর প্রক্রিয়ায় ইসলামের বিস্তার ঘটে। বাংলার ইসলাম ছিল সুফিবাদী ধারা বা এর আদর্শভিত্তিক। মুসলমান সুফি-সাধকদের উদার ইসলামী দর্শন, বৌদ্ধধর্মের শান্তি ও অহিংস নীতি এবং শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩) প্রমুখের বৈষ্ণববাদ বা ভক্তিবাদ মিলে বাঙালির জীবনে সৃষ্টি হয় এক ধরনের সহনশীল ও সংশ্লেষণাত্মক সংস্কৃতি (ঝুহপৎবঃরংঃরপ ঈঁষঃঁৎব) পরবর্তী অসাম্প্রদায়িকতা বা ঝবপঁষধৎরংস যার উত্তরাধিকার ও রাষ্ট্রীয় ভিত্তি (রশিদ, ২০১৬:৬৯)। নবম-দশম শতকে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের গীতিমূলক রচনা চর্যাপদ থেকে মধ্যযুগের পদ্যছন্দের দোভাষী পুঁথিসাহিত্য রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) কল্যাণে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সূত্রপাত। দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩), মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) কবি নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রমূখ তাদের সৃষ্টিশীল কর্মের মাধ্যমে একে সমৃদ্ধ করেন। বিদেশি শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম নেতা নেতাজী সুভাষ বসু, ফকির মজনুশাহ, ক্ষুদিরাম, তিতুমীর, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্যতম। এদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন এক অন্যতর বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, এমন একজন প্রাণপুরুষ যিনি নিজের জীবদ্দশায় সর্বসমর্পণের বিনিময়ে, সুবিশাল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি ভৌগোলিক ভূখণ্ডকে ঔপনিবেশিকতাবাদের প্রভাব ও কূট চক্রান্তের নাগপাশ হতে উদ্ধার করলেন। শেখ মুজিবই তো রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক কবিতা, সুভাষের সাহস, নজরুলের বিদ্রোহ আর জীবনানন্দের বাংলার মুখ এবং চর্যাপদ, সুফিবাদ, বাঙালিত্ব ইত্যাকার চিন্তার সমন্বয় সাধন করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক, মানবিক, ধর্মনিরপেক্ষ বা অসাম্প্রদায়িক চারিত্র্য নির্ধারণ করেন (খান, ২০১৮:৭৫)। বাঙালি জাতি অধ্যুষিত এই দেশকে, দেশের মানুষকে তিনি শুধু স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষান্ত হননি। জাতীয় চেতনাবোধে জাগ্রত করেছেন, জাতীয় সত্তা সম্পর্কে সচেতন করেছেন, নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক মুক্তি না থাকলে জাতির প্রতিষ্ঠা লাভ হয় না, সেই বিষয়টি বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে উপলব্ধি করেছেন এবং তার অসাধারণ আকর্ষণীয় ক্যারিশমা (পযধৎরংসধ) দ্বারা জাতিকে চরম লক্ষ্য অর্জনের দিকে নিয়ে গেছেন এবং পরিশেষে এদেশের জন্য জীবন দিয়েছেন।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, মূল ‘লাহোর প্রস্তাব’ (১৯৪০) পরিবর্তন করে জিন্নাহর উদ্যোগে ‘১৯৪৬ খ্রি. মুসলিম লীগের দিল্লি কনভেনশনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি অঞ্চল নিয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয় চূড়ান্ত হলে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও তমদ্দুন মজলিস বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার লক্ষ্যে গণসচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে গঠিত হয় প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। “….১৯৪৮ সালের ১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। এই পরিষদের পক্ষ থেকে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনের দিন অর্থাৎ ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহ্বান করা হয়। …এক পর্যায়ে পুলিশ শেখ মুজিবসহ কয়েকজন ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করে” (চৌধুরী, ২০১৪:৭০)। গভর্নর জেনারেল জিন্নাহর ঢাকা সফর এবং ‘উর্দু, কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’- এমন ঘোষণার পর “রাষ্ট্রভাষার দাবি রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে পরিণত হয়। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল সেই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।… শেখ মুজিবুর রহমানসহ ২৪ জনকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়…ব্যক্তিগত মুচলেকা প্রদানের মাধ্যমে অনেকেই নিজেদের ছাড়িয়ে নেন, কিন্তু শেখ মুজিব ছিলেন আদর্শ ও নীতিতে অটল। তাই ভাষা আন্দোলনের চরম মূহূর্তেও (২১ ফেব্রুয়ারি, ’৫২) তিনি জেলখানা থেকে ছাড়া পাননি” (চৌধুরী, ২০১৪:৭২)।
প্রসঙ্গত, উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রথম পর্বের ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু জেলের বাইরে ছিলেন এবং তমদ্দুন মজলিস, মুসলিম ছাত্রলীগ, যুবলীগ ইত্যাদি সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। বস্তুত: সে কারণেই ১৯৪৯ সনে তিনি সেক্রেটারিয়েটের সামনে ভাষা আন্দোলনের প্রচারপত্র বিলি করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে যান (আকাশ, ২০১৫:২০)। তবে ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব বা মূল পর্বে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা মূল্যায়নের সময় আমাদের মনে রাখতে হবে যে ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু জেলখানায় বন্দি ছিলেন। সেখান থেকেই তিনি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে অনশনের মাধ্যমে তার যতটুকু ভূমিকা সম্ভব ততটুকু ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধু অনশন শুরু করেছিলেন ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ফরিদপুর জেলের ভেতরে। তার সঙ্গী ছিলেন পরবর্তীতে ন্যাপে যোগদানকারী নেতা আরেকজন সহরাজবন্দি মহিউদ্দিন আহমেদ। তাদের অনশনের মূল দুটি দাবি ছিল ‘রাজবন্দিদের মুক্তি’ এবং ‘রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার প্রতিষ্ঠা’। বঙ্গবন্ধু অনশন ভঙ্গ করেন প্রায় এক সপ্তাহ পরে অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। তাঁকে মুক্তি দেয়া হয় তার দুদিন পর অর্থাৎ ২৭ ফেব্রুয়ারি (আকাশ, ২০১৫:২০)।
ভাষা আন্দোলনের একটি পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম দায়িত্ব ছিল রাজবন্দিদের মুক্ত করা এবং বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিটি তাঁর দল আওয়ামী লীগে, বিশেষত সোহরাওয়ার্দীর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। বিভিন্ন সূত্র থেকে (গোয়েন্দা রিপোর্ট এবং শেখ মুজিবকে লেখা সোহরাওয়ার্দীর চিঠি) আমরা এখন জানতে পেরেছি যে ভাষা প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দীর অভিমত ছিল ‘বাংলা’ হবে পূর্বপাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষা, অন্যতম রাষ্ট্রভাষা নয়। এই প্রশ্নে শেখ মুজিবের সঙ্গে ও সোহরাওয়ার্দীর মতের মিল হয়নি। শেখ মুজিব এক্ষেত্রে তার প্রিয় নেতার বিরোধিতা করতে কার্পণ্য করেননি (আকাশ, ২০১৫:২১)। গোপন সংস্থার একটি রিপোর্টে এই সময় উল্লেখ করা হয়েছে, “ঝশ গঁলরনঁৎ জধযসধহ ফরংধঢ়ঢ়ৎড়াবফ ঃযব ংঁমমবংঃরড়হং ড়ভ গৎ. ঝঁযৎধধিৎফু ঃড় মরাব ৎবমরড়হধষ ংঃধঃঁং ড়ভ ইবহমধষর. ঝশ. গঁলরনঁৎ জধযসধহ ৎবপবরাবফ ঃযব ংঁমমবংঃরড়হং ড়ভ গৎ. ঝঁযৎধধিৎফু ঃযৎড়ঁময ধ ষবঃঃবৎ. ঙঃযবৎ ড়িৎশবৎং ধষংড় ফরফ হড়ঃ ধমৎবব রিঃয ঝঁৎধধিৎফু. ঞযবরৎ সধরহ ফবসধহফ ধিং ঃড় সধশব ইবহমধষর ধং ড়হব ড়ভ ঃযব ংঃধঃব ষধহমঁধমবং ড়ভ চধশরংঃধহ” (সরকার, ২০০৮:১৮৪)। পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব সম্পর্কে এমন অসংখ্য গোপন নথিতে উল্লেখ রয়েছে। ১৯৪৯ সালের ৯ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর খুলনা সফরের বিষয়ে বলা হয়, “অফফবহফধ ঃড় ঃযব নৎরবভ যরংঃড়ৎু ড়ভ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ, ংবহঃ ভৎড়স ঝচ, উওই কযঁষহধ ঃড় ওইঊই, উধপপধ, যিবৎব ধ হঁসনবৎ ড়ভ ঢ়ড়ষরঃরপধষ ধপঃরারঃবং ড়ভ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ বিৎব সবহঃরড়হবফ. ওঃ ধিং ধষংড় ৎবঢ়ড়ৎঃবফ ঃযধঃ যব ফবষরাবৎবফ ংঢ়ববপযবং ফবসধহফরহম ঃড় ধফড়ঢ়ঃ ইবহমধষ ধং পড়ঁৎঃ ষধহমঁধমব… ” (ঝবপৎবঃ উড়পঁসবহঃং ড়ভ ওহঃবষষরমবহপব ইৎধহপয (ওই) ড়হ ঋধঃযবৎ ড়ভ ঃযব ঘধঃরড়হ ইধহমধনধহফযঁ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ, ঠ-১, ঢ়ধমব-৬৬ (আহমেদ, ২০২১:৮৮)।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৫০ ও ৫১ সালে প্রবল ছিল না। কেননা এ সময় শাসকশক্তি ভাষা প্রশ্নে নিশ্চুপ থাকে। ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমউদ্দীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সারাদেশে এর প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। শেখ মুজিব তখন জেলে বন্দি, কৌশল করে জেল থেকে হাসপাতালে চলে আসেন। তাঁর এই হাসপাতালে আসার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল ভাষা-আন্দোলনকে বেগবান করা। তিনি বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্রভাষা না থাকলে জাতি হিসেবে বাঙালির অস্তিত্ব থাকবে না। বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলার মানুষের অস্তিত্বের প্রয়োজনে ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। তিনি বন্দি থাকা অবস্থায় সে কাজটি করেছেন। জেল হাসপাতাল থেকেই ৩ ফেব্রুয়ারি শামসুল হক চৌধুরী, আবদুস সামাদ আজাদ ও ডা. গোলাম মাওলার মাধ্যমে তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল ডেকে গণপরিষদ ঘেরাও করার পরামর্শ দেন (আহমেদ, ১৯৯৯:৩৯)। নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে শেখ মজিবুর রহমান জেলখানাতে বসে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে আহ্বান জানান।…বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৫২ সালের ২১ জানুয়ারি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গড়ে উঠে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ (চৌধুরী, ২০১৪:৭৩)।
১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষার প্রশ্নে তাঁর প্রদত্ত ভাষণ ছিল উল্লেখযোগ্য। গণপরিষদে শেখ মুজিব তাঁকে বাংলা ভাষায় বক্তব্য রাখার সুযোগ প্রদানের জন্য স্পিকারকে অনুরোধ জানালে স্পিকার বললেন, ‘আপনি উর্দু এবং ইংরেজি জানেন না এটা বললে বাংলার বিষয়টি ভেবে দেখবেন।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বাংলা আমার মাতৃভাষা। এ ভাষায় হাজার বছরের ঐতিহ্য রয়েছে, আমি বাংলাতেই ভাষণ দিব।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘না, যে ভাষার জন্য আমার ভাইয়েরা রক্ত দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, সেই ভাষায় বক্তৃতা করে বিশ্বের দরবারে আমার মায়ের ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে চাই।’ মাতৃভাষায় বক্তব্য রাখার অধিকার দাবি করে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা এখানে বাংলায় কথা বলতে চাই। আমরা অন্য কোনো ভাষা জানি কি জানি না তাতে কিছুই যায় আসে না। যদি মনে হয় আমরা বাংলাতে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি তাহলে ইংরেজিতে কথা বলতে পারা সত্ত্বেও আমরা সবসময় বাংলাতেই কথা বলব। যদি বাংলায় কথা বলতে দেয়া না হয় তাহলে আমরা পরিষদ থেকে বেরিয়ে যাব। কিন্তু পরিষদে বাংলায় কথা বলতে দিতে হবে। এটাই আমাদের দাবি’ (আহমেদ, ২০২১:৯৩)। ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ পাকিস্তান ‘কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি’তে খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনাকালে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে, ‘যেহেতু বাংলা এ দেশের ৫৬ শতাংশ লোকের ভাষা, তাই উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা প্রদান করতে হবে’ (চৌধুরী, ২০১৪:৭৯)।
ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন করার সংকল্পে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহান একুশে উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে সপ্তাহব্যাপী এক কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বক্তৃতা দিতে গিয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘যেদিন থেকে তাঁর দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে, সেদিন থেকেই অফিস আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার শুরু হবে (জাহিদ, ২০২০:৩৩)। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সরকার ক্ষমতায় এসে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করে অফিস-আদালতের ভাষা বাংলা করেন। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক জারিকৃত অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রজ্ঞাপনটি ছিল নি¤œরূপ: ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার তিন বৎসর পরেও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই দেশের প্রতি তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বৎসর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথিতে লিখবেন সেটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছুঙ্খলতা চলতে দেয়া যেতে পারে না’ (ঈরৎপঁষধৎ ংবহঃ ঃড় ঃযব টহরাবৎংরঃু ড়ভ উধপপধ, উ-জবমরংঃবৎ, উধপপধ টহরাবৎংরঃু জড়ড়স, ইঁহফষব ঘড়. ২৮৭, ঋরষব ঘড়. ৪২৩অ, ১৯৭৫. (সম্পা, ২০০০:৩৭৫-৩৭৬)।
বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদী ভাবনার যে রূপ পাওয়া যায়, তার পুরোটাই ছিল আদি ও অকৃত্রিম বাঙালি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বাংলার মাটি ও মানুষের প্রতি, বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি, বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আজন্ম গভীর মমত্ববোধ ও স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলার ভাষা, লোকাচার, জীবন-যাপন, বিনোদন, সাহিত্য ইত্যাদি সব কিছুকেই তিনি ধারণ করতে চেয়েছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যে। বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে উপলব্ধি করেছেন নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক মুক্তি না থাকলে জাতির প্রতিষ্ঠা লাভ হয় না, তাইতো ভাষা-আন্দোলনসহ পরবর্তীকালের প্রতিটি আন্দোলন তিনি প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিয়ে সংগঠিত করেছেন। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনের এই দীর্ঘ বন্ধুর পথে বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম সাহস, সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সঠিক দিকনির্দেশনা জাতিকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার স্থায়িত্ব নিশ্চিত হয় এবং বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় (জাহিদ, ২০২০:৩৫)। জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় বক্তৃতার মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যায়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সাফল্যের কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান লাভ করে।

ড. মো. আবুল হোসেন

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়