ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও জনকল্যাণে প্রযুক্তি ভাবনা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাইগার নদীর তীরে বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের কাদা পলি মাটির বুকে জন্ম নেয়া খোকা থেকে মুজিব স্বাধীন বাংলা-বাঙালির স্থপতি হিমালয়সম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশতবর্ষ উদযাপনের যাত্রা শুরু হয়েছে।
ভারত বাংলার শতকোটি মানুষসহ বিশ্বের সমগ্র মুক্তিকামী সচেতন মানুষের কাছে বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এক অনন্য মাত্রা নিয়ে উপস্থিত। প্রান্তিক গ্রামবাংলার প্রকৃতিতে মেঠোপথের ধুলাবালি ও বর্ষার কাদাপানিতে বেড়ে ওঠা খোকা মুজিবকে আবিষ্কার করবে বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার পাথেয় হিসেবে।
দুই শতাধিক বছরের ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ, অবজ্ঞা, অবহেলা, অনাচার ও নির্যাতনের শিকার বাংলা ও বাঙালি জাতিকে শোষণ-বঞ্চনামুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখতেন বঙ্গবন্ধু। প্রশ্ন হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সেই চিরকাক্সিক্ষত ও অরোধ্য ‘সোনার বাংলা’ কি শুধুই স্বপ্ন বা কল্পনা ছিল?
নিশ্চয়ই নিছক কল্পনা বা স্বপ্নের কারণে বঙ্গবন্ধুর জীবনের অধিকাংশ সময় জেল-জুলুম সীমাহীন ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাঙালি ও বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মহান স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে অকাতরে জীবন উৎসর্গ দিতেন না।
বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। তাই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলার স্বাধীনতা এবং আর্থ-সামাজিক মুক্তি। মানবতা ও মানবিক মূল্যবোধের সমাজ বিনির্মাণে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষকে সত্যিকার স্বাধীনতা স্বাদ দিতে হলে অবশ্যই তার ভেতরের সুপ্ত প্রতিভা ও প্রবল আকাক্সক্ষাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। জাগরণের এ ভিত্তিভূমির হাতিয়ার হিসেবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমনস্ক শিক্ষা দর্শনকেই তিনি অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন।
১৯৫৪ সালে তৎকালীন সরকারের শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালীন বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে সর্বাত্মকভাবে জনস্বার্থে ব্যবহার করে তারই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ‘পূর্ব পাকিস্তান পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেন। যা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ‘ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট’ হিসেবে পরিচিত। তিনি যথার্থভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, শিল্পাঞ্চলে শিল্প-কারখানা পরিচালনায় মধ্যমস্তরের প্রকৌশল জনবলের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
তাছাড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট যদি শিল্প-কারখানার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে ছাত্রছাত্রীরা ‘ঙহ ঃযব লড়ন’ (অন দ্য জব) প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ প্রকৌশলী হিসেবে গড়ে উঠবে। তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবের এই সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা রাজনৈতিক বিজ্ঞতার স্বাক্ষর বহন করে।
তৎকালীন তরুণ এই রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবের ঐ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে, বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন যে, প্রাগ ঐতিহাসিক যুগ থেকে সমাজ পরিবর্তনের মূল হাতিয়ার ছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির একেকটি আবিষ্কার। সমাজ সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসই হলো প্রযুক্তির নব নব উদ্ভাবনের ইতিহাস। যা তৎকালীন তরুণমন্ত্রী শেখ মুজিবের কাছে সুস্পষ্ট ছিল। তাই তিনি সরকারি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পলিটেকনিক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তিনি বুঝেছিলেন প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ গড়তে পারলে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি দেয়া সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর এই প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত আজ জাতিকে নতুনভাবে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করছে।
সেই ১৯৫৬ সালে তিনি বলছেন, ‘দেশের প্রাপ্তব্য সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার এবং ইহাকে জনগণের কাজে লাগানই হইতেছে দেশকে শিল্পায়িতকরণের উদ্দেশ্য। কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধার সম্প্রসারণ ও ইহাকে সর্বস্তরে বহুমুখীকরণই ইহার যুক্তিসঙ্গত ও অপরিহার্র্য পরিপূরক।’
স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বর্তমান শিক্ষার নানাবিধ অভাব ও ত্রæটি-বিচ্যুতি দূরীকরণ, শিক্ষার মাধ্যমে সুষ্ঠু জাতি গঠনের নির্দেশনা দান এবং দেশকে আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান করার পথ নির্দেশের উদ্দেশ্যেই সরকার এ কমিশন নিয়োগ করেছেন।’
‘আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান’ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের নির্দেশনা দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শুধু সুদূরপ্রসারী প্রাজ্ঞ রাজনৈতিকেরই প্রকাশ ঘটাননি বরং তাঁর বহুকাক্সিক্ষত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পথ নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষা দর্শন অনুযায়ী শিক্ষার জন্যই শিক্ষা নয় বা কেরানি সৃষ্টি বা আজ্ঞাবহ সৃষ্টির জন্য শিক্ষা নয়। তিনি বলেছেন স্বাধীন বাংলার শিক্ষা হবে ‘আধুনিক’ এবং ‘কর্মশক্তিতে বলীয়ান’। চলমান প্রজন্মের সুধীজনের অনেকেই আধুনিক শব্দটি ব্যবহারে অভ্যস্ত। কিন্তু ‘কর্মশক্তিতে বলীয়ান’ শিক্ষাব্যবস্থার কথা বঙ্গবন্ধুর পূর্বে আর কেউ ব্যবহার করেছে এমন জানা যায়নি।
এই ‘কর্মশক্তিতে বলীয়ান’ শব্দেই প্রযুক্তি জ্ঞান নির্ভরতার অস্তিত্ব বিদ্যমান। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করতেন মানুষের কর্মশক্তি বা কর্মসক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হলে প্রযুক্তি নির্ভরতার বিকল্প নেই। তাই তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমনস্ক জাতি গঠনের তাগিদ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু আজীবন কাজ ও কাজের সংস্কৃতি তথা দক্ষতা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন।
১৯৭৪ সালের মে মাসে শিক্ষা কমিশন তাদের প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। যেখানে সকল স্তরে সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা চালু, ভবিষ্যৎ কর্ম-সংশ্লিষ্ট কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি, মাধ্যমিক দ্বাদশ এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে গণমুখী সুপারিশ করা হয়েছিল। মূলত বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় এ প্রতিবেদনে বৈষম্যমুক্তি, সকল মানুষের সমান অধিকার, বিজ্ঞানভিত্তিক সার্বজনীন শিক্ষা এবং শিক্ষা-উত্তর কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন তাঁর দেশের নাগরিকরা সেই শিক্ষায় দীক্ষিত হোক, যার মাধ্যমে মানুষ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, দেশপ্রেম, মানবতা, নৈতিক মূল্যবোধে জাগৃত হওয়ার পাশাপাশি বিজ্ঞানের অধিকতর প্রয়োগমুখী জ্ঞান ও দক্ষতার গুণাবলির মাধ্যমে সৃজনশীলতা ও গবেষণা এবং সামাজিক অগ্রগতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক প্রগতিতে কার্যকর অবদান রাখতে সক্ষম হবে। তিনি কায়িক শ্রমের মর্যাদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। প্রযুক্তিমনস্ক শিক্ষার গুরুত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ১৯ আগস্ট ছাত্রলীগের সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে সাবলীল ভাষায় বলেছিল-
‘কাজ কর, কঠোর পরিশ্রম কর, না হলে বাঁচতে পারবে না। শুধু বিএ, এমএ পাস করে লাভ নেই। আমি চাই কৃষি কলেজ, কৃষি স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল, কলেজ ও স্কুল, যাতে সত্যিকারের মানুষ পয়দা হয়। বুনিয়াদি শিক্ষা নিলে কাজ করে খেয়ে বাঁচতে পারবে।’
১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহীর জনসভায় বলছেন, ‘আমি চাই- আমার বাংলার বেকার কাজ পাক।’ শিল্পায়ন ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘গ্রামে গ্রামে সব শিল্পকে এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে, যার ফলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বিভিন্ন প্রকার শিল্প সুযোগ পৌঁছায় এবং গ্রামীণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।’
১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক কলঙ্কজনক ঘটনার পর উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করা বাংলাদেশ শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারেনি। ফলে নানামুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার হার বেড়েছে বটে, কিন্তু সেই শিক্ষা বা শিক্ষার্থী বাস্তব জীবনে এসে কতটা জাতির প্রয়োজনে মেধাশ্রম দিতে পারছে সেটি আমাদের প্রবলভাবে ভাবায়। বিজ্ঞানের এক একটি ধাপ ডিঙিয়ে প্রযুক্তির বিকাশ আজ বিশ্বকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। অথচ সেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষার বিস্তার দেশ কাক্সিক্ষত মাত্রায় বিকশিত হচ্ছে না। যদিও জাতির পিতার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় নীতি ঘোষণা ও বাস্তবায়নে বারবার যথাযথ নির্দেশনা প্রদান করেছেন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও নানামুখী অপতৎপরতায় সরকারি শুভ উদ্যোগ ঝিমিয়ে পড়ছে। যার মাশুল ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিতে হবে।
আগামীদিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনশক্তিকে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রথমেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ধারণা স্পষ্টকরণ প্রয়োজন। শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীদের মাঝে স্পষ্ট করতে হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে। বিজ্ঞান হচ্ছে মানুষের মেধা আর অনুসন্ধিৎসার ফসল। প্রকৃত সত্য হচ্ছে বিজ্ঞান কোনো পণ্য তৈরি করে না। শুধু পণ্য উৎপাদনের জন্য তাত্ত্বিক জ্ঞানটুকু আমাদের জানিয়ে দেয়। আর প্রযুক্তিবিদরা সেই জ্ঞানটুকু ব্যবহার করে টেকসই ও সাশ্রয়ী প্রযুক্তিপণ্য তৈরি করে, যার ব্যবসায়িক মূল্য আছে। অর্থাৎ প্রযুক্তি হচ্ছে বিজ্ঞানের প্রায়োগিক দিক ও বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ। অর্থাৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একে অপরের পরিপূরক। একবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবনির্ভর প্রযুক্তিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসমৃদ্ধ বাংলাদেশই কাম্য। এই কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ গড়তে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সঠিক জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতি প্রণয়ন এবং সেই অনুযায়ী ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন। এর জন্য বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শনকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
সমাজ দর্শনের আলোকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রযুক্তিচর্চায় কতটা মনোনিবেশী ছিলেন, তা তাঁর নয়াচীন সফরের অভিজ্ঞতা থেকে কিছুটা উপলব্ধি করা যায়। নয়াচীনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “কোনো অন্যায় কাজই বন্ধ করা যায় না, অন্যায় বন্ধ করতে হলে চাই সুষ্ঠু সামাজিক কর্মপন্থা, অর্থনৈতিক সংস্কার ও নৈতিক পরিবর্তন। তাহারা নতুন বিবাহ আইন প্রবর্তন করেছে। ছেলেমেয়ে একমত হয়ে দরখাস্ত করলেই তাদের যার যার ধর্মানুযায়ী বিবাহ দিতে বাধ্য। ‘পুরুষ শ্রেষ্ঠ আর স্ত্রী জাতি নিকৃষ্ট’ এই পুরোনো প্রথা অনেক দেশে বহুকাল থেকে চলে আসছে, তাহা আর নয়াচীনে নাই। আইন করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাই আজ নয়াচীনে সমস্ত চাকরিতে মেয়েরা ঢুকে পড়ছে। নয়াচীনের মেয়েরা আজকাল জমিতে, ফ্যাক্টরিতে, কল-কারখানাতে, সৈন্যবাহিনীতে দলে দলে যোগদান করছে। সত্যকথা বলতে গেলে, একটা জাতির অর্ধেক জনসাধারণ যদি ঘরের কোণে বসে শুধু বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ না করে তা হলে সেই জাতি দুনিয়ায় কোনোদিন বড় হতে পারে না।” প্রযুক্তিকে সমাজদর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার বা মূল্যায়ন করার যে দৃষ্টিশক্তি বঙ্গবন্ধুর ছিল, নয়াচীনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তার কিছুটা ধারণা আমরা পেতে পারি।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন সামনে রেখে সরকার একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ ও শ্রমবাজারের দক্ষতার সংকট মোকাবিলায় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও শিক্ষা আইন প্রণীত না হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন, সংবিধান ও জাতীয় শিক্ষা নীতির সঙ্গে রাষ্ট্রকে একীভূত করা যায়নি। ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে কর্মক্ষম মানবসম্পদের আকার হবে ১২ কোটি ৮০ লাখ, যা বিশ্বের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার ২.০২% এবং অষ্টম বৃহত্তম জনসম্পদের দেশ। যদি সত্যিকার অর্থে এই জনসম্পদকে একবিংশ শতকের শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ ও যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০টি দক্ষ মানবসম্পদের মধ্যে একটি দেশ হিসেবে আবির্ভূত হবে। বাংলাদেশ যোগ্যতা কাঠামো (ইছঋ) গঠনের মাধ্যমে এ দেশের শিক্ষার সকল স্তরকে শ্রমবাজারের চাহিদার আলোকে সমন্বয়পূর্বক একবিংশ শতক তথা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী করে পুনর্গঠনের বিকল্প নেই।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই প্রযুক্তিমনস্কতা এতটা উচ্চতায় যে, তা সাধারণের জন্য বোধগম্য নাও হতে পারে। আমরা লক্ষ করি যে, তথ্যপ্রযুক্তির গোড়া পত্তন করেন ১৯৭৫ সালে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে। এই ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে বিনাতারে সারা বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হয়। স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গঠনে যোগাযোগে এর অবদান ছিল অপরিসীম।
বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র মূলত কৃত্রিম উপগ্রহের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে শক্তিশালী এন্টেনার মাধ্যমে ওভারসিস সিগন্যাল গ্রহণ করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে টেলিফোন ডাটা কমিউনিকেশন, ফ্যাক্স, টেলেক্স আদান-প্রদানের জন্য রাঙ্গামাটির পাহাড়ে একশ একর সমতল ভূমিতে স্থাপন করা হয়। এটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গত শতকে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ব্যয়বহুল স্থাপনা।

প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। এ পরিবর্তন আমরা কোনোভাবেই স্তিমিত বা বিপরীত ¯্রােতে প্রবাহিত হতে পারব না। পরিবর্তনকে গ্রহণ করে কীভাবে প্রযুক্তির কাক্সিক্ষত সুফল কাজে লাগিয়ে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যাওয়া যাবে, সেটাই নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। প্রযুক্তিজ্ঞান, দক্ষতা ও বিজ্ঞান চর্চার আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে মানবসম্পদের প্রকৃত উন্নয়ন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অভিযাত্রা দীর্ঘায়িত হয় না। প্রযুক্তি পরিবর্তনে জীবনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ আসবে। সেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধে ভর করে উন্নয়নের সোপানে পৌঁছানোর জন্য মানবিক বিশ্ব চরিত্রের গুরুত্ব রয়েছে। ভোগবাদ প্রকট আকার ধারণ করলে সমষ্টি উপেক্ষিত হয়। ফলশ্রæতিতে বিজ্ঞান প্রযুক্তির সর্বোচ্চ উৎকর্ষতা সত্ত্বেও বঞ্চিত মানুষের হিং¯্রতায় পৃথিবী বাসযোগ্যহীন হয়ে পড়ার শঙ্কা থেকে যায়। তাই উন্নয়নের পথপরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, উৎপাদন, উন্নয়ন ও মানবিক মূল্যবোধকে জাগৃতকরণের মাধ্যমে সামগ্রিক যে পথ নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, আমাদের সেই একই সমাজদর্শনের ভিত্তিতে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারকের মনে রাখতে হবে ‘প্রযুক্তি চিন্তাহীন রাজনীতি শোষণের হাতিয়ার’। মনে রাখতে হবে প্রযুক্তিনির্ভর জীবন ব্যবস্থায় কাজ ও কাজের মানুষকে অবজ্ঞা-অবহেলা, ঘৃণা করে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়