৯১ হাজার ইয়াবা উদ্ধার : জিপ গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডারে আনা হয় চালান

আগের সংবাদ

বিদ্রোহীদের বিষয়ে নমনীয় দল! : ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কয়েক হাজার বিদ্রোহী প্রার্থীকে বহিষ্কারের সুপারিশ করেছে স্থানীয় কমিটি

পরের সংবাদ

সক্ষমতা বেড়েছে, সঙ্গে দুর্নীতিও > ফিরে দেখা : স্বাস্থ্য খাত

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ২৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেবিকা দেবনাথ : ২০২০ সালে করোনা মহামারির অভিঘাত ২০২১ সালের শুরুতে অনেকটাই সামলে নিয়েছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। তবে বছরের মাঝামাঝিতে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে আবারো বেসামাল হয়ে পড়ে এই বিভাগ। স্বাস্থ্যসেবার পরিধি আগের চেয়ে বাড়লেও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দেশের স্বাস্থ্য খাতের ভিতটা আবারো নাড়িয়ে দেয়। করোনা প্রতিরোধে দেশে টিকাদান কার্যক্রম শুরুর পর টিকা প্রাপ্তি নিয়ে খানিকটা জটিলতা সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময়ে তা কাটিয়ে উঠে বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। দেশে কয়েক দফা বিশেষ টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনা, শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় নিয়ে আসা, প্রতিকূলতা কাটিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সারাদেশে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) এবং কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ এগিয়ে নেয়া, বুস্টার ডোজ কার্যক্রম শুরু, বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় দেশে করোনা টিকা উৎপাদনের কাজ শুরু, দেশীয় প্রতিষ্ঠান গেøাব বায়োটেকের উদ্ভাবিত করোনা প্রতিরোধী টিকা বঙ্গভ্যাক্সের পরীক্ষামূলক প্রয়োগে অনুমোদনের বিষয়টি প্রশংসিত হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য বিভাগে দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা এত সফলতাকে ¤øান করে দিয়েছে। ২০২০ সালের বৈশ্বিক দুর্নীতির সূচকে দুই ধাপ নিচে নেমে বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১২তম। আর এই অবনমনের পেছনে করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক দুর্নীতিকে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এদিকে ২০২১ সালে বাংলাদেশ উদযাপন করেছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এই ৫০ বছরে অনেক কিছুর খতিয়ানও উঠে এসেছে সামনে। থানা হেলথ কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা বিপ্লব থেকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ সব অর্জনের পর ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা স্বপ্ন দেখাচ্ছে নতুন বাংলাদেশের। ৫০ বছরে বেড়েছে জনসংখ্যা। বেড়েছে রোগী, সেই সঙ্গে বেড়েছে চিকিৎসা সেবার পরিধিও। ১৯৭১ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক শূন্য ৯৮ শতাংশ। ২০২১ সালে তা কমে হয়েছে ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ’৭১ সালে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ দশমিক ১৪ বছর। মাতৃমৃত্যু (প্রতি লাখে) ছিল ৩ হাজার, নবজাতকের মৃত্যু (প্রতি হাজারে) ১৫০। ২০২১ সালে গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৮, মাতৃমৃত্যু ১৬৫ আর নবজাতকের মৃত্যু ১৭ দশমিক ১। টিকাদানের হার এখন ৯৮ শতাংশের বেশি। পোলিও, গুটিবসন্ত নির্মূল হয়েছে। নির্মূলের পথে ফাইলেরিয়া, কালাজ¦র, ম্যালেরিয়া, হাম, কুষ্ঠ, জলাতঙ্কসহ বিভিন্ন রোগ। কলেরা ও ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে সাফল্য অর্জন করেছে। ওষুধ শিল্প খাতেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে রপ্তানি করছে। সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জেলা-উপজেলায় বেড়েছে বেসরকারি ক্লিনিকের

সংখ্যা। আর তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক এখন দোড়গোড়ায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা এখন ৬৩৯টি। বেড আছে ৬৭ হাজার ৭৩৫টি। নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল আর ক্লিনিক আছে ৫ হাজারের মতো। যেখানে বেড আছে প্রায় ৯৫ হাজার। প্রশাসনিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বিভাগকে দুটি বিভাগে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
এত সব সফলতার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে দীনতাও কম নয়। এই করোনাকালে নগ্নভাবেই প্রকাশ পেয়েছে নানা অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার চিত্র। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়লেও স্বাস্থ্যসেবা পেতে গিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ের খরচ এখনো অনেক বেশি। বেসরকারি খাতের অধিক মুনাফা আর চিকিৎসার জন্য সামর্থ্যবানদের বিদেশমুখিতাও ভাবনার বিষয়। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য মানসম্মত আর সহনীয় ব্যয়ের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে স্বাস্থ্য খাতকে গণবান্ধব করার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পর্যাপ্ত ও দক্ষ জনবল নিশ্চিত, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন, রাজনীতি, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা এই সেবা খাতের অর্জনকে ¤øান করে দিয়েছে। প্রশাসনিক উন্নতি করা না গেলে সার্বিক উন্নয়ন হবে না।
১৮ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, যদিও আমরা স্বাস্থ্যসেবা খাতে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছি, করোনা মহামারি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কিছু ত্রæটিও উন্মোচিত করেছে। আমাদের এখনো আরো দক্ষ মানবসম্পদ বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্সিং স্টাফ এবং চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ প্রয়োজন। করোনা মহামারির মতো রোগ মোকাবিলার লক্ষ্যে দেশের স্বাস্থ্য খাতকে আরো কার্যকর ও গতিশীল করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
গত ৫০ বছরে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অর্জন কম নয়। আমরা পোলিও নির্মূল করেছি ২০০০ সালে। আর ভারত পোলিও মুক্ত হয়েছে ২০১১ সালে। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু কমেছে। স্বাস্থ্যসেবা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবার যে চেইন তা দক্ষিণ এশিয়ার আর কোথাও নেই। আমাদের খাঁচাটা আছে, সার্ভিসগুলোকে আরো সুনির্দিষ্টভাবে বাড়াতে হবে। করোনা শুরুর পর স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদের মতে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা এখন আধুনিকতম জায়গায় পাল্লা দিচ্ছি। এই করোনার সময় তা দৃশ্যমান হয়েছে। তিনি বলেন, আগে বাইরের দেশে কোনো ওষুধ অনুমোদন পেলে আমাদের দেশে তা অনুমোদন পেতে ৫ বছরের মতো সময় লাগত। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। এই করোনা মহামারির সময় আমরা দেখেছি যেদিন যুক্তরাজ্যে কোনো ওষুধ অনুমোদন পাচ্ছে তারপরের দিনই সেই ওষুধের অনুমোদন দিচ্ছে বাংলাদেশ। যা অবশ্যই বিশাল ব্যাপার। তবে স্বাস্থ্যসেবা খাতে এখন বাণিজ্যমুখী মনোভাব বেশি প্রকট। এই বাণিজ্যমুখী ভাবটাই বদলাতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কল্যাণমুখী করতে হবে। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতেই যেন সেখানকার ৮০ শতাংশ মানুষকে সেবা দেয়া সম্ভব হয় সেই দিকটা বিবেচনায় নিয়ে সেখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা বা সমস্যাগুলোর কথা বলা মানে সরকারের সমালোচনা করা- এটি ঠিক নয়। একক কারো ভুলের দায়িত্ব সরকারের ওপর চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়। ঘাটতির কথা যেমন বলতে হবে তেমনি সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও করতে হবে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব ডা. এম এ আজিজ মনে করেন, স্বাস্থ্য খাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কাটাতে হবে। এই জটিলতার কারণে অনেক কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। এই জায়গাগুলোই স্বাস্থ্য খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গঠিত জনস্বাস্থ্য পরামর্শক কমিটির (সিলেট বিভাগ) সদস্য ড. আবু জামিল ফয়সাল মনে করেন, কাঠামোগতভাবে স্বাস্থ্য খাতের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বিগত ৫০ বছরেও স্বাস্থ্য খাতের অর্জন কম নয়। তবে গত ৫০ বছরে দেশের স্বাস্থ্য খাতের যে অর্জন তা ২০২০ ও ২০২১ সালে কিছুটা পিছিয়ে পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। ড. আবু জামিল ফয়সাল ভোরের কাগজকে বলেন, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাস এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আমাদের যে সাফল্য, তা করোনা মহামারির কারণে ব্যাহত হতে পারে। কারণ আমরা দেখেছি করোনার সময় বাল্যবিয়ে অনেক বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ স্বাস্থ্য খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। করোনা শুরুর পর গত এক বছরে স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা আগের চেয়ে বেড়েছে এ কথা স্বীকার করতেই হবে। তবে এখনো অনেকটা পথ বাকি। সুচিন্তিত পরিকল্পনা মাফিক এগুলো সেই সংকটও কাটিয়ে উঠা সম্ভব।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়