ওয়ারী থেকে উদ্ধার : মারা গেল সেই নবজাতকটি

আগের সংবাদ

বিদ্রোহের ভারেই নৌকাডুবি

পরের সংবাদ

তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ বেড়েছে, ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য : সংবিধান ও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক > গবেষণার ফল প্রকাশ

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : তামাক কোম্পানির অব্যাহত হস্তক্ষেপে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) আর্টিক্যাল ৫.৩-এর নির্দেশনাবলি বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি হয়নি। ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক বাংলাদেশ-২০২১’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তামাক কোম্পানির অংশগ্রহণ, তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক (সিএসআর) কর্মসূচি, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে তামাক কোম্পানির অপ্রয়োজনীয় যোগাযোগ এবং সহযোগিতা বেড়েছে। গবেষণার তথ্য বলছে, ২০২১ সালে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৭২। ২০২০ সালে যা ছিল ৬৮। ২০১৯ সালে এই স্কোর ছিল ৭৭, ২০১৮ সালে ৭৮। গতকাল রবিবার ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক, বাংলাদেশ ২০২১’ শীর্ষক গবেষণা ফলাফল প্রকাশিত হয়। সকালে সিরডাপ মিলনায়তনে প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং এন্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা) যৌথভাবে এই গবেষণা প্রতিবেদনের ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ব্লুমবার্গ ফিল্যানথ্রপিসের স্টপ (স্টপিং টোব্যাকো অর্গানাইজেশন্স এন্ড প্রোডাক্টস) প্রকল্পের আওতায় এই গবেষণায় সার্বিক সহযোগিতা করেছে গেøাবাল সেন্টার ফর গুড গভার্নেন্স ইন টোব্যাকো কন্ট্রোল (জিজিটিসি), থাইল্যান্ডের থামাসাত ইউনিভার্সিটি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন প্রজ্ঞার তামাক নিয়ন্ত্রণবিষয়ক কর্মসূচি প্রধান হাসান শাহরিয়ার। প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন টিভি টুডের এডিটর ইন চিফ মনজুরুল আহসান বুলবুল। বক্তব্য রাখেন জিজিটিসির হেড অব গেøাবাল রিসার্চ এন্ড এডভোকেসির ড. মেরি আসুন্তা, ভাইটাল স্ট্রাটেজিসর বাংলাদেশ কান্ট্রি এডভাইজার শফিকুল ইসলাম, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডসের (সিটিএফকে) লিড পলিসি এডভাইজার মোস্তাফিজুর রহমান, গেøাবাল হেলথ এডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার ডা. সৈয়দ মাহফুজুর হক, দি ইউনিয়নের টেকনিক্যাল এডভাইজার সৈয়দ মুহবুবুল আলম, প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের,

আত্মার কনভেনর মর্তুজা হায়দার লিটন প্রমুখ। আত্মার কো-কনভেনর নাদিরা কিরণ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, কোভিডের চেয়ে তামাকের কারণে বাংলাদেশে অনেক বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। অথচ তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকার কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আমাদের সংবিধানে জনস্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়ে অন্যতম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ এফসিটিসি স্বাক্ষরকারী দেশ। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছেন। আদালতের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তও আছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ বেড়েছে। সরকারি সংস্থাগুলো এফসিটিসি এবং প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে ধারণ করছে কিনা সেটাই মৌলিক প্রশ্ন। অর্থমন্ত্রীকে এটি স্পষ্ট করতে হবে, রাজস্ব নাকি জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেয়া হবে। দুই নৌকায় পা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, হস্তক্ষেপ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই নাজুক। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ, সেটি কেন? তিনি তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ, বিএটিবির শেয়ার প্রত্যাহার এবং তামাকের ২৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক পুনর্বহাল এবং তামাক ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে আরো বেশি জোর দিয়ে প্রচার করার দাবি জানান।
গবেষণায় কূটনৈতিক মাধ্যম ব্যবহার করে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ এবং প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার বিষয়টি উঠে এসেছে। জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল (জেটিআই) কোম্পানির পক্ষে অর্থমন্ত্রীকে লেখা জাপানি রাষ্ট্রদূতের চিঠিতে বলা হয়েছে, জেটিআইর ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো তামাক নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ নেয়া হলে তা বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ জাপানি বিনিয়োগের (এফডিআই) পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে প্রতিবেদনে উঠে আসা জনস্বাস্থ্যবিরোধী আরেকটি ঘটনার সূচনা করোনা মহামারির শুরুর দিকে। ২০২০-এর এপ্রিলে লকডাউন চলাকালীন সরকারি আদেশের মাধ্যমে দুটি বহুজাতিক তামাক কোম্পানির ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) এবং জেটিআইকে লকডাউনের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি প্রদান করে শিল্প মন্ত্রণালয়। কোম্পানিগুলো যাতে নির্বিঘেœ সিগারেট উৎপাদন, বিপণন ও তামাক পাতা ক্রয় করতে পারে, সেজন্য সব বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দেয়া হয়। তামাক কোম্পানিকে দেয়া এই বিশেষ অনুমতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তুলে নেয়ার অনুরোধ করা হলে শিল্প মন্ত্রণালয় তা নাকচ করে দেয়। এশিয়ান টোব্যাকো লিমিটেড নামে একটি তামাক কোম্পানিকে ঈশ্বরদী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। ফলে কর অবকাশসহ বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করবে তামাক কোম্পানিটি। এছাড়া বিড়ির ওপর কর কমানোর দাবি সমর্থন করে ১০ জন সংসদ সদস্য অর্থমন্ত্রী বরাবর আধা সরকারি পত্র পাঠান।
গবেষণায় ২০২০ সালে করোনা মহামারি চলাকালে তামাক কোম্পানিগুলোকে যেভাবে বিভিন্ন কথিত সিএসআর কর্মসূচি নিয়ে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে, ইতোপূর্বে সেভাবে কখনো দেখা যায়নি। করোনা অতিমারীর সুযোগে দাতব্য কাজের নামে যেমন আগ্রাসিভাবে ব্র্যান্ড ইমেজ বাড়িয়েছে অন্যদিকে সুরক্ষা সরঞ্জাম বিতরণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রভাবশালী সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সান্নিধ্যে এসে ভবিষ্যৎ হস্তক্ষেপের পথ সুগম করেছে তামাক কোম্পানিগুলো। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকেও তামাক কোম্পানিগুলোকে পুরস্কৃত করতে দেখা গেছে।
গবেষণার সুপারিশে তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধসহ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে এফসিটিসির সঙ্গে আরো বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ করার প্রতি জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সিগারেটকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দিতে ১৯৫৬ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন, একটি সহজ তামাককর ও মূল্য নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন, তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার/বিনিয়োগ প্রত্যাহার, তামাক কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ বা আলোচনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩-এর আলোকে আচরণবিধি চূড়ান্তকরণ এবং তামাক কোম্পানিকে সব ধরনের পুরস্কার দেয়া বন্ধসহ সব সুবিধা প্রত্যাহার ও তামাক ব্যবসায় নতুন বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়