চকবাজারে প্লাস্টিক গোডাউনে আগুন

আগের সংবাদ

তথ্যপ্রযুক্তি সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি : বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর ফ্রিল্যান্সার দেশ

পরের সংবাদ

ব্যাংক কর্মকর্তারাও জড়িত : নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে লেনদেন ৬০ কোটি টাকা

প্রকাশিত: নভেম্বর ১১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। সরকারি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তাসহ প্রশ্নফাঁস চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা। একটি পরীক্ষায় ডিবি পুলিশের সদস্যরা ছদ্মবেশ ধারণ করে তাদের গ্রেপ্তার করেন।
প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্যরা হলেন- জনতা ব্যাংকের গুলশান শাখার অফিসার শামসুল হক শ্যামল (৩৪), রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলন (৩০), পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলন (৩৮) ও রাইসুল ইসলাম স্বপন (৩৬) এবং এই চক্রের হোতা আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির আইসিটি টেকনিশিয়ান মোক্তারুজ্জামান রয়েল (২৬)।
পুলিশ জানায়, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করে এ চক্রটি দুই শতাধিক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে ৬০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। চক্রটি এর আগেও অনুষ্ঠিত হওয়া চারটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করেছে বলেও তথ্যপ্রামাণ পাওয়া গেছে। সরকারি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা প্রত্যক্ষভাবে এ চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। প্রশ্নফাঁস চক্রের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ব্যাংক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানাতে গতকাল বুধবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে ডিএমপি গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুষ্ঠিত পাঁচটি ব্যাংকের ১ হাজার ৫১১টি ‘অফিসার ক্যাশ’ শূন্য পদের নিয়োগ পরীক্ষা বিকালে অনুষ্ঠিত হয় গত ৬ নভেম্বর। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক ১৮৩টি, জনতা ব্যাংক ৫১৬টি, অগ্রণী ব্যাংক ৫০০টি, রূপালী ব্যাংক পাঁচটি এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাতটি পদ রয়েছে। বিকাল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে এমসিকিউ পদ্ধতিতে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র তৈরি ও পুরো পরীক্ষা সম্পাদনের দায়িত্বে ছিল আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি।
তিনি আরো জানান, গত ৬-১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিশেষ অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগ। ডিবির প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য। জড়িত সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রশ্নপত্র প্রণয়নসহ পরীক্ষা আয়োজনে দায়িত্বপ্রাপ্ত আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির আইসিটি বিভাগ থেকে প্রশ্নফাঁস হয়েছে।
এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, গত ৫ নভেম্বর রাতে পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হওয়ার গোপন তথ্য পেয়ে পরের দিন ৬ নভেম্বর ডিবির টিম ছদ্মবেশে পরীক্ষার্থী সেজে প্রশ্নপত্রসহ উত্তর পাওয়ার জন্য চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রশ্ন ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের সদস্য রাইসুল ইসলাম স্বপনকে অগ্রিম টাকা পরিশোধ করা হলে পরীক্ষার্থীকে বুঝে নিয়ে যায়। এরপর পরীক্ষার উত্তরপত্রসহ স্বপনকে হাতেনাতে আটক করা হয়। গত ৬ নভেম্বর পরীক্ষায় আসা প্রশ্নের সঙ্গে সকালে পাওয়া প্রশ্ন ও উত্তর হুবহু মিলে গেলে আটক স্বপনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে শ্রীনগর থেকে রূপালী ব্যাংকের সাভার শাখার সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জানে আলম মিলনের তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর দক্ষিণ বাড্ডা থেকে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র সরবরাহকারী শামসুল হক শ্যামলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ডিবির সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জিজ্ঞাসাবাদে শ্যামল প্রশ্নপত্রসহ উত্তরপত্র ফাঁস করার কথা স্বীকার করেছে। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে চক্রের মূলহোতা মোক্তারুজ্জামান রয়েলকে বাড্ডার আলিফনগর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। মোক্তারুজ্জামান আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে আইসিটি টেকনিশিয়ান (হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার) হিসেবে কর্মরত আছেন। পরে গ্রেপ্তার আসামি, মোবাইল ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর লালবাগ থেকে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
হাফিজ আক্তার বলেন, পরীক্ষার আগে চক্রের সদস্যরা রাজধানীর বাড্ডা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, রূপনগর, মিরপুর, মাতুয়াইল, শেওড়াপাড়া, শেরেবাংলা নগর ও পল্লবী এলাকায় বুথ বসায়। যেখানে পরীক্ষার ৫-৬ ঘণ্টা আগে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের ফাঁস করা প্রশ্ন ও উত্তরপত্র মুখস্থ করানো হয়। চক্রের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক বুথে ২০-৩০ জন পরীক্ষার্থীকে এই পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করিয়ে কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে মোক্তারুজ্জামান ও শ্যামল জানায়, এর আগে আরো তিনটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁস করেছে। শ্যামল জানায়, তারা পরীক্ষার ৫-৬ ঘণ্টা আগেই বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে প্রায় দুই হাজার পরীক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর সরবরাহ করেছে। প্রত্যেক পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে ৫-১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে তারা। এমসিকিউ পরীক্ষার আগে ২০ শতাংশ, লিখিত পরীক্ষার আগে আরো ২০ শতাংশ ও নিয়োগ পাওয়ার পর বাকি ৬০ শতাংশ টাকা পরিশোধের শর্তে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে চুক্তি করে ডেকে নেয়া হতো।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা এ পর্যন্ত ১১টি বুথে এই চক্রের ২৫-৩০ জনের নাম ও প্রায় ২০০ জন পরীক্ষার্থীর নাম পেয়েছি। মোক্তারুজ্জামান রয়েল প্রশ্নফাঁসের হোতা। মোক্তারের কাছ থেকে প্রশ্ন নিয়ে শামসুল হক শ্যামল বিভিন্ন বুথে সরবরাহ করে। জানে আলম মিলন বিভিন্ন পরীক্ষার্থী সংগ্রহ ও বুথ নিয়ন্ত্রণ করে। পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করায়। অর্থের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র দিয়ে থাকে। মোস্তাফিজুর রহমান মিলন পরীক্ষার্থী ও বুথ নিয়ন্ত্রণ করে। পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করায়। স্বপন পরীক্ষার্থী। সেও প্রশ্ন-উত্তরপত্র সংগ্রহ এবং বুথ নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থের মাধ্যমে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন-উত্তর দিয়ে থাকে। এ পর্যন্ত এই চক্রের শনাক্ত সদস্য সংখ্যা ২৫-৩০ জন।
এক প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, এই প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে আহছানউল্লাসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই চক্রে আরো যারা জড়িত তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। অভিযোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করেছিল প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, কিন্তু আপনাদের অভিযানে প্রমাণিত হচ্ছে যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। এক্ষেত্রে এই নিয়োগ পরীক্ষাসহ বিগত তিনটি পরীক্ষার নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিলের সুপারিশ গোয়েন্দা পুলিশ করবে কিনা- জানতে চাইলে হাফিজ আক্তার বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্য জানিয়েছি।
তদন্ত করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক : ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় সমন্বিত পাঁচ ব্যাংকের অফিসার (ক্যাশ) নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস বিষয়ে তদন্ত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বারবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের ভিত্তিতে আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিকে ব্যাখ্যা তলব করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী রবিবার তাদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা পাওয়ার পরই উল্লেখিত পরীক্ষা বাতিল হবে কিনা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হুমায়ুন কবির গতকাল বুধবার ভোরের কাগজকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া গুরুতর অপরাধ। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে তদন্ত করছে। তিনি বলেন, প্রশ্ন ফাঁস বা এ বিষয়ে আমরা আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটির কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছি। আগামী ১৪ নভেম্বর রবিবারের মধ্যে তাদের মতামত জানতে চেয়েছি। যেহেতু কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতামতও নিতে হবে। এসব কৈফিয়ত পাওয়ার পরই বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়