১০ সরকারি ব্যাংকে নতুন ২০ ডিএমডি

আগের সংবাদ

মাসসেরার দৌড়ে সাকিব

পরের সংবাদ

সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও ইতিহাসের দায়

প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একটি অসাম্প্রদায়িক আর সহিষ্ণু জাতি হিসেবে বাঙালির যে সুনাম, তার সাক্ষী খোদ ইতিহাস। ইতিহাসের পাতার পরতে পরতে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে গোটা ভারতের সিংহভাগ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দাবানলে পুড়লেও ঠিক সেই সময় এই পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশ ঠাঁয় দাঁড়িয়েছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির হিসেবে। তবে কেন আজ এই ব্যত্যয়? প্রশ্ন জাগে, সুদূর অতীত ইতিহাসের এই অনন্য নজির থেকে সরে কবে থেকে বাংলাদেশ আজকের এই সহিংস অবস্থানে এসে ঠেকল? এই বিষবাষ্প কি বাঙালির জনমনের গভীরে প্রোথিত কোনো সুপ্ত সাম্প্রদায়িক উনুন থেকে উদ্গীরিত হয়েছে? নাকি এটি সাম্প্রতিক ইতিহাসের হাতে গড়া কোনো ক্ষতেরই ক্ষতিপূরণ? কিংবা বিস্তৃত পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের অংশীদারিত্বের অনিবার্য পরিণতি?
দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বয়ে যাওয়া সাম্প্রতিক এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মতো ঘটনা বাংলাদেশে বিরল হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন নয়। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এই অঞ্চলের মানুষগুলোর পারস্পরিক অংশীদারিত্বের মাত্রা অনেক বেশি, যা বিশ্বের অন্য কোথাও এমনটা দেখা যায় না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসান এবং স্বাধীনতা অর্জনের পরও এই অঞ্চলের দেশগুলো তাদের সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক আর ধর্মীয় অনুভূতি তাড়িত অবেগের কারণে একে অপরের সঙ্গে বেশ জোরালোভাবে জড়িত। তাই এক দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় কিংবা নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রভাবে সৃষ্ট ঘটনা অন্য সব দেশে অনভিপ্রেত ফলাফলের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের উত্তরাধিকার আর ধর্মের ভিত্তিতে তৎকালীন ভারতবর্ষের ভাঙন এই সত্যকে আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করছে।
ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড এন্ড রুলস’ নীতি এই অঞ্চলের সুপ্ত আর অস্পষ্ট হয়ে থাকা ধর্মীয় বিভেদ রেখাকে আরো চওড়া করেছে। এটা এমন না যে এই অঞ্চলে কোনো ধর্মীয় বিভেদ ছিল না। বিভেদ ঠিকই ছিল সঙ্গে বিবাদও বটে, তবে তা বিষাক্ত বিষবৃক্ষে রূপ নেয়নি, যা নিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শাসনকালীন সময়ে। বস্তুগত সুবিধাকে ধর্মীয় পরিচয় আর আনুগত্যের বিনিময় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ব্রিটিশরাই দিনে দিনে সাম্প্রদায়িক সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করে, যা পূর্ণতা পায় ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের বিভক্তিতে। এটা অনেকখানি সত্য যে, ২০০ বছর ধরে তিলে তিলে তৈরি করা তৎকালীন হিন্দু-মুসলিম মারমুখী রাজনৈতিক অবস্থান আর তৎসৃষ্ট জটিলতা ভারতবর্ষের বিভক্তিকে অনিবার্য করে তুলেছিল। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে সে বিভক্তি আজো এ অঞ্চলের মানুষগুলোর মনোজগতে প্রভাব ফেলে যাচ্ছে। যার ফলে এক দেশের অনাকাক্সিক্ষত অবস্থার সৃষ্টি অন্য দেশে অনভিপ্রেত অনুরণনের কারণ হয়। আজকের বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই সহিংস সাম্প্রদায়িক ঝড় দক্ষিণ এশিয়ার অনেক অনাকাক্সিক্ষত অঞ্চলিক উন্নয়নেরই অবিচ্ছিন্ন অংশ। এটা এমন নয় যে, এই সহিংস সাম্প্রদায়িক ঘটনায় বাংলাদেশ ও এখানকার মানুষের কোনো দায় নেই, সম্পূর্ণ ঘটনাই আঞ্চলিক প্রভাব সৃষ্ট। দায় অবশ্যই রয়েছে। তবে এটাও সত্য যে, এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বাংলাদেশের শিকড়ের গভীরে জৈবিকভাবে প্রোথিত নয়। ভারতের খুব কাছাকাছি এবং একই ইতিহাস আর সংস্কৃতির অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও এখানে জাতপাত, ছুৎমার্গের মতো বিভেদমূলক আচারের বালাই নেই, সেটা হিন্দুদের মধ্যে হোক আর মুসলমানদের মধ্যে হোক। তবে কেন এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার বারবার সূত্রপাত হয়? রাজনীতি-অভ্যন্তরীণ আর আঞ্চলিক উভয়ই। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান আর ৫০ বছর ধরে গড়ে ওঠা সম্পর্কের গভীরতা আর প্রগাঢ়তা বিবেচনায় ভারত আমাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। পার্শ্ববর্তী বিশাল দেশ হিসেবে সেই সঙ্গে এই দেশের সঙ্গে অনেক নৈকট্যঘটিত বন্ধন সূত্রের দরুন ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক আর আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন এই দেশেও প্রভাব ফেলে। সেই সূত্রে গত কয়েক বছর ভারতের গণতান্ত্রিক পশ্চাৎপসারণ এবং মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদপুষ্ট জাতীয়তাবাদের উত্থান এই অঞ্চলের জনমতে বিশাল প্রভাব ফেলেছে। ভারত কর্তৃক গৃহীত মুসলিম বিদ্বেষী নাগরিক আইন সংশোধন বিল ও আসামে বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম বিদ্বেষী নাগরিকপুঞ্জি আইন তারই দুটো উদাহরণ। বিজেপি মদতপুষ্ট এসব বিভেদমূলক নীতি শুধু যে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মতের পরিবর্তন করছে তা নয়, সেই সঙ্গে প্রভাব ফেলছে অন্য পার্শ¦বর্তী দেশের জনমনের ওপর, বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে, যা শেষপর্যন্ত এসব দেশে ছড়িয়ে থাকা মৌলবাদী আর উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তির মতকে শক্তিশালী করছে। এটাই আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের বিভক্তি কতটা অমোঘ আর অনিবার্য ছিল। এটা এমন নয় যে, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক আর নীতিগত অবয়ব পরিচ্ছন্ন হলেই বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতার মূলোৎপাটন হয়ে যাবে। এই আঞ্চলিক অংশীদারিত্ব আর অবিচ্ছিন্নতা যেমন সত্য তার চেয়ে বড় সত্য সভ্যতা। আজকের বাংলাদেশ নিজের উন্নয়ন এবং বিকাশের তাগিদেই হাজার বছরের মহিমান্বিত সভ্যতার আলোকে আলোকিত হোক। জেগে উঠুক সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না- ‘আমরা হিন্দু মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বড় সত্য আমরা বাঙালি’।

আরাফাত চৌধুরী : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়