ডেঙ্গুতে ৯১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত সাড়ে ২৩ হাজার

আগের সংবাদ

তৃণমূলে সংঘাত থামছেই না : সংঘর্ষে জড়িতদের তালিকা করছে আ.লীগ, অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে এক মাসে নিহত ৮, নির্বাচনী সংঘর্ষে ৩৮ নিহত

পরের সংবাদ

ডুবে প্রমাণ করতে হলো সে মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল

প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১, ২০২১ , ১২:৪২ পূর্বাহ্ণ

দৌলতদিয়া টু পাটুরিয়া নদীপথে আমানত শাহ ফেরি। ঘাটে এসেই ডুবে গেল। একাকী ডোবেনি। সঙ্গে নিয়েছে ৩৩টি যান। ৪০ বছরের বেশি বয়স ফেরির। মেয়াদোত্তীর্ণও বটে। উপর থেকে ফেরিকে যোগ্য মনে হলেও ভেতরে তার ক্ষয় ছিল সুনিশ্চিত। কিছুদিন আগেই ফেরিটি ডকইয়ার্ড থেকে ফেরত এসেছে। আর কত? তারপরও চলাচলে সেটাকে রাখা হয়েছিল সক্রিয়। সক্রিয় রেখেছে কর্তৃপক্ষ। ফেরির বয়স, সক্ষমতা, ফিটনেস এসব বুঝতে চাননি। বোঝার দরকার মনে করেননি। কিংবা মনে করেছেন অথচ গুরুত্ব দেননি। নদীপথে তো আর সবাই চলাচল করেন না। আকাশপথ হলে না কথা ছিল। আর তাছাড়া যতদিন মেরামতের দোহাই দিয়ে বাজেট রেখে টুপাইস কামানো যায়। অতীতে নানাবিধ দুর্নীতির ঘটনায় দেখা গেছে মেরামত, নিলাম ইত্যাদি বিষয়ে অনিয়ম। কাজেই মেরামত বিষয়টি টাকা কামাইয়ের সুযোগ কারো কারো জীবনে। আবার সরকারি জিনিস হলে তো কথাই নেই। ডুবলে ডুবুক। কার কী, কে দেখবে, কী হবে। কারোর কিছুই না। কেউ নেই দেখার। কেউ নেই জবাবদিহিতা নেয়ার। সরকারের জিনিস, সরকারি টাকায় কেনা। যেন সরকার টাকা পয়দা করে ফেরি কেনে, ফেরি মেরামত করে। জনগণের টাকাই যে সরকারের টাকা হয়, দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্টদের আচার-আচরণে, অবয়বে এবং কথায় তা দৃশ্যমান হয় না।
যাই হোক। মিডিয়ায় আমানত শাহ ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখা গেল। রীতিমতো লোমহর্ষক ও ভীতিকর অভিজ্ঞতা। যাত্রী ও উপস্থিত লোকজন দেখলেন ফেরি ডুবে যেতে। মনে হচ্ছিল টাইটানিকের মতো আরো একটি চলচ্চিত্র দেখছি। কেউ দেখাচ্ছেন। কিন্তু সম্বিৎ ফিরলে বুঝলাম, টাইটানিক নিয়ে নির্মিত সিনেমাই আমরা দেখেছি। কিন্তু আমানত শাহ ফেরি ডুবে যাওয়াটা কোনো সিনেমা নয়, বরং সত্য ঘটনাই দেখছি। ফলে চলচ্চিত্রের আবহ নয়, উল্টো মনের ভেতর আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল। প্রশ্ন উদয় হলো, বহুদিন বহুবার নদী পার হওয়া এমন ফেরি দিয়ে নিশ্চিন্তে আর কখনো নদী পার হতে মন চাইবে তো? কে জানে। জানা গেল, এত বড় ফেরি এই প্রথম ডুবে গেল। এমনিতেই নদীপথে চলাচলে ইদানীং মানুষের ভয় বেড়েছে। তার কারণ দুর্ঘটনা। অদক্ষ চালক, ত্রæটিপূর্ণ নৌযান, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, ফলো-আপ, মনিটরিংয়ের অভাব ইত্যাদি অনেক কারণে নৌপথে দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। অনেকটা সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন নদীপথের দুর্ঘটনা বাড়ছে। একটা সময়ে সড়কের দুর্ঘটনা থেকে জীবন বাঁচাতে যাত্রীরা নদীপথকেই অপেক্ষাকৃত শ্রেয় ও স্বস্তি মনে করতেন। এখন নদীপথই ভয়ংকর ও আতঙ্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। যমুনা সেতু দিয়ে সড়কপথে তাই অনেক যাত্রী দক্ষিণাঞ্চলে যেতে নিরাপদ বোধ করেন।
আমানত শাহ ফেরিকে ডুবে প্রমাণ করতে হলো সে মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। মেয়াদোত্তীর্ণ ফেরি কী করে সহজে, নির্বিঘেœ চলাচল করে সেই প্রশ্নটাও আমানত শাহ তুলে ধরল রীতিমতো ডুবে গিয়ে। সাধারণত আমরা দেখি যে, ভ্রাম্যমাণ আদালত মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার, ওষুধের জন্য বিক্রেতাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা জরিমানা হিসেবে আদায় করে থাকে, থাকছে। কিন্তু নদীপথে মেয়াদোত্তীর্ণ ফেরি চলাচল রোধে কোনো ভ্রাম্যমাণ আদালত ও জরিমানা বা শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে কিনা জানা নেই। থাকলেও অন্যান্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের মতো চোখে পড়েনি। নিশ্চয়ই নৌপরিবহন দপ্তরের মধ্যে ফেরি, লঞ্চ দেখভাল করার দায়িত্বপ্রাপ্তরা রয়েছেন এবং এরা কতটা সততা ও গুরুত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন, করে থাকেন- তাও দেখার লোক আছে। জনগণের টাকায় বেতনভুক্ত এসব দায়িত্বপ্রাপ্তের সততা নিষ্ঠা থাকলে অন্তত ৫০টি ফেরির মধ্যে ২০টি ফেরি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে অবাধে চলাচল করতে পারত না বলে অনেকেই মনে করেন। কেন মেয়াদোত্তীর্ণ ফেরি যান ও যাত্রী নিয়ে চলাচল করল- এই প্রশ্নের জবাব কে দেবেন তা নির্ধারণ না হলে প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে না। নিশ্চয়ই নৌপরিবহন অধিদপ্তরের বিভিন্ন স্তরের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই জবাব দিতে হবে। তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। জবাবদিহিতা না মিললে দুর্ঘটনা রোধে কোনো পদক্ষেপও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। লোক দেখানো কর্মতৎপরতা হয়ে রবে। যাত্রীদের জীবনের ঝুঁকি বাড়বে। আমানত শাহ যদি মাঝ নদীতে ডুবে যেত তাহলে অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা ঘটত। বিষয়টি রীতিমতো হত্যার শামিল হতো। এতে মেয়াদোত্তীর্ণ ফেরি চলাচলের অনুমতি প্রদানকারীদের হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত বা দায়ী করা ছাড়া কোনো উপায় থাকত না। যে কোনো হত্যার মতোই ভয়ংকর হত্যা হলো ডুবিয়ে মারা। আর এখন যেভাবে পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, হোন্ডা ডুবে গেছে তারও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে আমানত শাহ চলাচলে অনুমতিকারীদের।
নৌপরিবহন সেক্টরে দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্বের অবহেলা, উদাসীনতা কিংবা অনিয়ম কঠোর হস্তে সরকারকে দমন করতে হবে। দুর্ঘটনার পর নয়, দুর্ঘটনার পূর্বেই দায়িত্বপ্রাপ্তদের চৌকস দক্ষতা, সততার প্রমাণ দিতে হতো যেন কোনোরকম দুর্ঘটনা না ঘটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া উদ্ধার কাজের কোনো কৃতিত্ব আছে বলে আমি মনে করি না। উদ্ধার ও ত্রাণ কাজে সফলতার চেয়ে দুর্ঘটনা যেন না ঘটে সেই সফলতা অর্জন জরুরি এবং শ্রেয়। তাছাড়া তদন্ত যিনি বা যারা করেন তারা যদি সৎ ও বিচক্ষণ না হন, তাহলে ফেরি ডোবার চেয়েও তা হয় ভয়ংকর। কেননা তারাই আগামীতে বড় দুর্ঘটনার পথ পরিষ্কার করে রাখেন প্রকৃত অপরাধীকে মুক্ত করার অভিসন্ধিতে। দায়ভার কাউকে নিতে না দেয়ার প্রচেষ্টা কখনোই জনগণের কল্যাণে যায়নি, যায় না। অনেকেই মনে করেন, দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়বদ্ধতা থাকে না অনেকটা রাজনৈতিক পরিচয়ে। একজন নৌপরিবহনমন্ত্রী যখন শ্রমিক সংগঠন চালান, তখন তিনি জনগণ নয়, সংগঠনের ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। পরিবহন কর্তা বনে যান। প্রমাণিত যে, ছাড় পাওয়া বা পার পাওয়া ব্যক্তিরাই পরবর্তীতে বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তদন্ত প্রতিবেদন ও তদন্ত প্রক্রিয়া সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ না হলে শাহ আমানতের চেয়েও বড় কিছু ডুবে যেতে পারে। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
ভেবে অবাক হই যে, প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের প্রতিটি কর্মচারীকে দায়িত্বে শতভাগ নিষ্ঠা, সৎ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ থাকার কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়ার পরও কেন দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ দায়িত্ব পালনে অবহেলা, উদাসীনতা কিংবা অনিয়ম করার ধৃষ্টতা দেখান! নতুবা কী করে মেয়াদোত্তীর্ণ শাহ আমানত ফেরি যান ও যাত্রী নিয়ে চলাচল করে? আমি আশা করি সরকারপ্রধান সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে সেই জবাব তলব করবেন। এটা তো ঠিক যে, পদ্মা সেতুর সাফল্যের পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ শাহ আমানত ফেরি চলাচলে ডুবে যাওয়ার ঘটনা মানায় না, যায় না। গোটা দেশ যখন উপরের দিকে তাকিয়ে, তখন একটা শ্রেণি নিচের দিকে দৃষ্টি টেনে আনার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে, এ কেমন কথা! তারা কারা, চিহ্নিত হওয়া দরকার। কিছু লোকের কারণে সরকার বিব্রত না হোক, সেটাই কাম্য।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়