ডেঙ্গুতে ৯১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত সাড়ে ২৩ হাজার

আগের সংবাদ

তৃণমূলে সংঘাত থামছেই না : সংঘর্ষে জড়িতদের তালিকা করছে আ.লীগ, অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে এক মাসে নিহত ৮, নির্বাচনী সংঘর্ষে ৩৮ নিহত

পরের সংবাদ

কাজীর হাট-পাটুরিয়া রেল-সড়ক সেতু ও জাতীয় স্বার্থ

প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১, ২০২১ , ১২:৪২ পূর্বাহ্ণ

সে অনেক দিনের কথা। ১৯৫৪ সাল। যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক নির্বাচন। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী পাবনাতে নির্বাচনী সফরে এলে পাবনা ও উত্তরবঙ্গের মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে তাদের কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হয়। স্থানীয় যুক্তফ্রন্টের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক জনসভার বিশাল মঞ্চে দাঁড়িয়ে পূর্বাহ্নে বক্তৃতা দেন শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। ওই নেতাদের কেউ আজ বেঁচে নেই, এটি দেশের দুর্ভাগ্য।
যা হোক, সূচনা বক্তব্যে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী যে দাবিগুলো তুলে ধরেছিলেন তার মধ্যে প্রধানতম দাবি ছিল নগরবাড়ী-আরিচা রেল ও সড়ক সেতু। জাতীয় নেতৃবৃন্দ প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন, অগ্রাধিকারভিত্তিতে নগরবাড়ী-আরিচা সেতু নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হবে। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট সরকার ওই সেতু নির্মাণের কাজে হাতই দিতে পারেনি প্রকৌশলীদের দিয়ে সেতুর সম্ভাব্যতা ও তদীয় উভয় পাড়ের স্থান নির্ধারণের। তবে এ দাবি পরিত্যক্ত হয়নি কখনো- আজো না। এরপর জিয়া যখন রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছিলেন এবং তার প্রচারে পাবনা এসেছিলেন, তখনো এই দাবি তার সামনে তুলে ধরা হয়েছিল সুধী সমাবেশ থেকে। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছিলেন, কিন্তু সমীক্ষা পর্যন্ত করাননি তিনি। এর পরবর্তী যিনি এলেন তিনিও সামরিক শাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি তো ক্লান্তিহীনভাবে সারাদেশে হেলিকপ্টারে চড়ে বেড়াতেন আর হেলিকপ্টারে চড়েই একেক শুক্রবারে একেক জেলায় প্রধান মসজিদের কাছাকাছি গিয়ে মাথায় একটা সাদা গোল টুপি পরে জুমার নামাজ পড়তেন। কার্যত যা করতেন তা হলো ক্ষমতা দীর্ঘায়িতকরণ। বহুবার তিনি পাবনা এসেছেন কঠোর নিরাপত্তায়। তিনি জনসভা, সুধী সমাবেশ ও সার্কিট হাউস, স্টেডিয়ামের একটি ক্ষুদ্র অংশে বা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের হলঘরে ও গণজমায়েতে ভাষণ দিয়েছেন। তখনো তিনি কাজির হাট-পাটুরিয়া সেতু নির্মাণের আশ্বাস পাবনার মানুষকে প্রকাশ্যে দেন।
কিন্তু মানুষের মূল দাবিটি ছিল নগরবাড়ী-আরিচা ঘাট সেতুটি স্থাপন। সে অনুযায়ী এরশাদ আমলেই নানা পর্যবেক্ষণ-নিরীক্ষা প্রভৃতি চালাতে হয়। দেখা গেল যমুনা নগরবাড়ী ঘাট ভাঙনের কবলে পড়েছে। একইভাবে আরিচা ঘাটেও ভাঙনের শুরু হয়। উভয় তীরই প্রতি বছর ভাঙতে থাকে- গ্রামকে গ্রাম যায় নগরবাড়ী ঘাটকে ঘিরে গড়ে ওঠা অসংখ্য হোটেল, রেস্তোরাঁ ও যাত্রী শেড।
চালু হয়েছিল ষাটের দশকের গোড়ার দিকে বা তারও কিছু আগে নগরবাড়ী-আরিচা ফেরি সার্ভিস। ফলে পাবনায় বাস-ট্রাক পরিবহন মালিকরাই শুধু নয়, রাজশাহী, নাটোর প্রভৃতি জেলা থেকেই যাত্রী পরিবহন শুরু করে ঢাকামুখী আবার ঢাকা থেকে শুরু করে শেষ ফিরতি গন্তব্যমুখী।
এর আগে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ। এটি পাকিস্তান হওয়ার পরবর্তী সময়ের কথা। তখন রাজশাহী, ঈশ্বরদী, দিনাজপুর, রংপুর এমনকি যশোর, খুলনা থেকেও ট্রেনযোগে এসে সিরাজগঞ্জ ঘাট থেকে স্টিমারে যমুনা পার হয়ে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে গিয়ে ট্রেনে ঢাকার ফুলবাড়ী স্টেশনে নামতে হতো। পাবনা থেকে এভাবে ঢাকা যেতে ২৪-২৬ ঘণ্টা, রাজশাহী থেকে ২৭-২৮ ঘণ্টা, খুলনা থেকে প্রায় ৩০ ঘণ্টা সময় লেগে যেত। এ কারণেই সব মহল থেকে নগরবাড়ী-আরিচা ঘাটে সেতু নির্মাণের দাবি সর্বসম্মতিক্রমে উঠেছিল।
নগরবাড়ী-আরিচা (ফেরি সার্ভিস চালু হলো তখন) বিশাল যমুনা বড় বড় ফেরিতে পার হয়ে ঢাকার পথে আরো দু-তিনটা ছোট ঘাট নদী পার হয়ে যেতে হতো। তবুও ট্রেনে ঢাকা যাতায়াতের সময় ও অর্থব্যয় বহুলাংশে কমে এলো। তবে সমস্যা হতো অন্যত্র। স্রোতে নদীর অভ্যন্তরে গ্রীষ্মকালে ছোটখাটো চর-ডুবোচর সৃষ্টির কারণে বর্ষাকালের চেয়ে ফেরিগুলো নদী পার হতে অনেক বেশি সময় লাগত। তবুও ট্রেনে যাতায়াতের জন্য যে দীর্ঘ সময় ও বিপুল অর্থব্যয় করতে হতো- নগরবাড়ী হয়ে ঢাকার পথে সময় ও অর্থব্যয় অনেক কম হতো। কিন্তু সমস্যা দেখা দিত অন্যত্র।
ফেরিগুলো সময়মতো নদী পার হতে না পারায় গ্রীষ্ম ও শীতকালে যাত্রীদের উভয় পাড়ে নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষকে রোদে পুড়ে, জলে ভিজে অপেক্ষা করতে হতো। বিশুদ্ধ খাবার জল, টয়লেট না থাকায় যাত্রীদের বিশেষ করে মহিলা যাত্রীদের মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হতো। সরকার বা পরিবহন মালিক কেউই এ দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল না দেয়ায় এ কষ্ট বরাবর যাত্রীদের বহন করতে হতো এবং ওই আলগা খাবার খেতেও বাধ্য হতো। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ত। ইতোমধ্যে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার ব্যবহার করে ইঞ্জিনিয়ারদের কাছ থেকে টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জ এলাকার সংযোগ সাধনের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গে জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য সেখানে তখন যমুনা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
এরশাদকে শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে হলো। এলেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি এরশাদ নির্ধারিত স্থানেই যমুনা সেতু নির্মাণকাজ শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে যমুনা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করে সেতুটির নামকরণ করেন বঙ্গবন্ধু বহুমুখী যমুনা সেতু। বঙ্গবন্ধু বহুমুখী যমুনা সেতু আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হওয়ার পর সমগ্র উত্তরবঙ্গ বিপুলভাবে উপকৃত হয়। ওই সেতু দিয়ে উত্তরে পাঁচবিবি থেকে দক্ষিণে খুলনা পর্যন্ত পণ্য ও যাত্রীবাহী হাজার হাজার ট্রাক চলাচল শুরু করে। দাবি ওঠে সেতুর ওপর দিয়ে রেলপথ বসাতে হবে। সরকারও তা চাইল। বসল রেলপথ কিন্তু সিঙ্গেল লাইন। দুটি কারণে এই রেললাইন কার্যত সেবা দিতে পারল না। এক. সিঙ্গেল লাইনে ট্রেনটিকে দূরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ফলে অপেক্ষমাণ ট্রেনটি যাত্রী ও পণ্যের গন্তব্যে পৌঁছাতে অস্বাভাবিক সময় লাগত। দুই. এই রেললাইনে রেল চলাচলের ফলে সেতুটির ভারবহন ক্ষমতা ব্যাহত হতে থাকে।
শুধু রেলের জন্য নয়, প্রতিদিন জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটছে। তার ফলে বাস, ট্রাক, মিনিবাস, কাভার্ডভ্যানসহ সব ধরনের যানবাহনের সংখ্যাও প্রতিদিন বৃদ্ধি পেতে থাকায় সেতুটির সর্বোচ্চ বহন ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় কোনো কোনো স্থানে ফাটল দেখা দিতে শুরু করে। সব ধরনের পরিবহন চলাচল মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মুখে পড়ে। অথচ সেতুটির মেয়াদ ১০০ বছর বলে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছিল। অবশেষে জোড়াতালি দিয়ে ফাটলগুলো বন্ধ করা হলেও ঝুঁকি দিন দিনই বাড়ছে।
অপরদিকে নগরবাড়ী-আরিচা সেতু নির্মাণ সিরাজগঞ্জ-টাঙ্গাইল সেতু নির্মিত হওয়ায় একদম ফাঁকা হয়ে পড়ে। কারণ নদী পারাপারের জন্য বড় বড় ফেরি প্রত্যাহার করে অপরাপর নদীতে নিয়ে যাওয়া হয়। নগরবাড়ী-আরিচা ঘাট দুটির অপমৃত্যু ঘটে। দোকানপাট-হোটেল, রেস্তোরাঁ, মিষ্টান্ন ও ফলের দোকানগুলো- যা ওই ঘাট দুটিকে কেন্দ্র করে রীতিমতো সরগম থাকত তা বন্ধ হয়ে গেল যাত্রীর অভাবে। দুটি ঘাটই বিরান এলাকায় পরিণত হলো।
কালক্রমে দেখা গেল, বঙ্গবন্ধু বহুমুখী যমুনা সেতু চালু হওয়ায় উত্তর-দক্ষিণবঙ্গজুড়ে যে বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল- তা ক্রমবর্ধমান যানবাহনের ভার ২৪ ঘণ্টা সময় লাগত। এখন তার দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ সময় লাগায় সেতুর উভয় পাড়ে প্রায়ই বিশাল যানজটের সৃষ্টি হয়। যমুনা সেতু দিয়ে মোকাবিলা করা অসম্ভব হয়ে পড়ায় নতুন করে নগরবাড়ী-আরিচা সংযুক্ত করে যমুনা সেতুর অনুরূপ তবে রেলওয়ের সেতু নির্মাণের দাবি জোরদার হয়ে ওঠে।
নতুন করে জরিপ শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। শুরুও হয়। জরিপ কাজ চলল দফায় দফায়। অপরদিকে তীব্র ভাঙনের ফলে নগরবাড়ী ও আরিচা ঘাট নদীতে তলিয়ে গেলে নতুন করে কাজীর হাটে স্থানান্তরিত হয় নগরবাড়ী ঘাট এবং পাটুরিয়ায় স্থানান্তরিত হয় আরিচা ঘাট। সিঙ্গেল লাইন হওয়ায় সরাসরি হতে পারছে না নতুন রেলপথটি। তাই পশ্চিম দিকে পাবনা-ঢাকা ডাবল লাইন এবং পূর্ব দিকে পাবনা-পুষ্পপাড়া, আতাইকুলা-মাধপুর-বনগ্রাম-কাশীনাথপুর-নগরবাড়ী-কাজীর হাট পর্যন্ত ডাবল রেললাইন করে প্রস্তাবিত দ্বিতীয় যমুনা সেতু অর্থাৎ কাজীর হাট-পাটুরিয়া সেতু নির্মিত হলে জাতীয়ভাবে লাভজনক যাতায়াতের নেটওয়ার্ক তৈরি হবে। বাস-ট্রেন প্রভৃতির জ¦ালানি খরচ বর্তমানের চেয়ে অর্ধেকে নেমে আসবে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ব্যয় এবং বাস-ট্রাক প্রভৃতির ভাড়াও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।
নির্মীয়মাণ পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সমাপ্তির পথে। জনসংখ্যা-যানবাহন-অর্থনৈতিক কার্যকলাপ দক্ষিণাঞ্চলেও বৃদ্ধি পেতে পেতে যাতে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী যমুনা সেতুর মতো সংকটে না পড়তে হয় তাই কালবিলম্ব না করে কাজীর হাট-পাটুরিয়া সেতু জাতীয় স্বার্থে নির্মাণ শুরু করা হোক। দূরদর্শী পরিকল্পনা ছাড়া দেশ যে এগোতে পারে না- তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত।

রণেশ মৈত্র : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়