টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সফল পাঁচ অধিনায়ক : তাইফ রহমান রাফি

আগের সংবাদ

সড়কে নেই ‘ডিজিটাল’ ছোঁয়া

পরের সংবাদ

অন্তর্জালে অপকর্ম রুখবে কে : ফেসবুক-গুগলের সঙ্গে চুক্তি হয়নি আজো > ঝুলে আছে তথ্য সুরক্ষা আইন > গতি কমিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রাশেদ আলী : তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এর অপব্যবহারও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ওয়েবসাইট কিংবা বিভিন্ন এপ্লিকেশনের ব্যবহার করে ঘটানো হচ্ছে নানা অপরাধ। গুজব-বিদ্বেষ-উগ্রবাদ ছড়িয়ে অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে সমাজে। অথচ এসব নিয়ন্ত্রণে তেমন ভূমিকাই রাখতে পারছে না সরকারের কোনো সংস্থা। গত সেপ্টেম্বরে খোদ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকেই (বিটিআরসি) এ বিষয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে দেখা গেছে। এবারের দুর্গাপূজায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, গুগলের মতো জনপ্রিয় সেবাগুলো কি এ দেশে নিয়ন্ত্রণহীনই থেকে যাবে? নাকি লাগাম টানা যাবে ইন্টারনেট (অন্তর্জাল) জগতের এই পাগলা ঘোড়ার।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ প্রকৌশলী ইশতিয়াক আহমেদ জানান, ইন্টারনেট মাধ্যমের অপব্যবহার গোটা বিশ্বের কাছেই বড় চ্যালেঞ্জ। তবুও সরকারের দায়িত্ব এর নিয়ন্ত্রণ করা। এ জাতীয় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন, ত্বরিত ও কৌশলী ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হয়। পাশাপাশি প্রয়োজন হয় যুগোপযোগী আইন। দেশে এখনো সেগুলো গড়ে ওঠেনি। এছাড়া ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, গুগলের মতো বহুল ব্যবহারিত সেবা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরকারের চুক্তি থাকা ও দেশে তাদের নিজস্ব অফিস ও সার্ভার বাধ্যতামূলক করার বিষয়টিও বাস্তবায়ন করা যায়নি। এখন শুধু কোনো গুজব বা অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সরকার ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করে। অথচ ওই পোস্টটি সরিয়ে ফেলার দ্রুত কোনো সমাধান সরকারের হাতে নেই। ফেসবুক বা ইউটিউব কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানোর পরও তারা এতে খুব একটা সাড়া দেয় না।
এই তথ্যপ্রযুক্তিবিদ বলেন, অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ জাতীয় পোস্টদাতাকে শনাক্ত করতে পারলেও দেখা যায়, সেটি দেশের বাইরে থেকে করা হয়েছে। আর হাজার হাজার মানুষ বুঝে, অথবা না বুঝে সেটি শেয়ার করেছে। তখন একটা জটিল অবস্থা তৈরি হয়। তাই দ্রুত এসব নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ দরকার।
কমিউনিটি গাইড লাইন : বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানায় দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে গুগল, আমাজন, টুইটারের মতো বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। এদের একাধিক

সামাজিক মাধ্যম, ভিডিও স্ট্রিমিং সাইট ও সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজার (এসইও) রয়েছে। এ দেশে ইন্টারনেটভিত্তিক বেশিরভাগ অপরাধের পেছনেই ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপসহ কয়েকটি বহুল প্রচলিত মাধ্যম ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু ওইসব প্রতিষ্ঠানের কমিউনিটি গাইডলাইন বাংলাদেশের জন্য করা হয়নি। সরকারের সঙ্গে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো চুক্তিও নেই। এদেশের জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মূল্যবোধ- এসব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই তাদের। এদেশের জন্য ক্ষতিকর অনেক কন্টেন্টই তাদের কাছে দোষের কিছু নয়। যে কারণে সরকার যদি কোনো কন্টেন্ট সরাতে অনুরোধ করে, তবে আগে তারা কমিউনিটি গাইডলাইনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে। গাইডলাইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে ওই কন্টেন্ট সরানো হয় না। গত ৬ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার জানান, ১ বছরে বিটিআরসি ফেসবুকের ১৮ হাজার ৮৩৬টি লিংক বন্ধের অনুরোধ জানিয়েছিল। কিন্তু ফেসবুক মাত্র ৪ হাজার ৮৮৮টি লিংক বন্ধ করেছে। ইউটিউবের ৪৩১ লিংক বন্ধের বিপরীতে করেছে ৬২টি।
এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানান, ফেসবুককে কিছু বললেই তারা তাদের নিজস্ব কমিউনিটি গাইডলাইনের কথা বলে। ইউরোপ-আমেরিকা স্ট্যান্ডার্ডের গাইডলাইন ধরিয়ে দেয়। আমরা চেষ্টা করছি আমাদের দেশের উপযুক্ত একটি গাইডলাইন এ দেশের জন্য কার্যকর করতে। তিনি বলেন, ফেসবুক আমাদের দেশে কখনোই অফিস বা সার্ভার স্থাপন করতে আগ্রহী ছিল না, এখনো নয়। আমাদের সঙ্গে চুক্তিও করতে চায় না তারা। এজন্য আইন দরকার। আইসিটি বিভাগ সেটি করছে। আইনটি হলে আমরা তাদের সে অনুযায়ী চলতে বাধ্য করব। নইলে বলব, এ দেশে তোমাদের ব্যবসা বন্ধ।
ভিপিএন দিয়ে চলে সব : এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৬ আগস্ট দেশের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে পাবজি, ফ্রি ফায়ার, টিকটক, বিগোলাইভ, লাইকিসহ সব ধরনের ক্ষতিকর ওয়েব ও অ্যাপস তিন মাসের জন্য বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকম (ডট) ওই লিংকগুলো বন্ধ করে। কিন্তু এরপরও ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) দিয়ে সেগুলোর বেশিরভাগই চলছে বলে জানা গেছে। এর আগে প্রায় ২৫ হাজার পর্নো সাইটের লিংক দেশে বন্ধ করা হলেও ভিন্ন নামে, ভিন্ন লিংকে সেগুলো আবারো চালু হয়ে যায়।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, সাইবার ওয়ার্ল্ড উন্মুক্ত বিষয়। আমরা যখনই এ ধরনের সাইট চালুর কথা জানতে পারি, তখনই সেটি বন্ধ করি। আগে কোনো ওয়েবসাইট লিংক বন্ধ করতে হলে ইন্টারনেট গেইটওয়ে, ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল অপারেটরদের নির্দেশনা দিতে হতো। এখন ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকম নিজেই সেটা করতে পারে। তিনি বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ বিটিআরসির হাতে নেই। তবে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি আমরা। এতে অপরাধীদের খুঁজে পেতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করতে পারব।
ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে পারে না কেউ : ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টকে কেন্দ্র করে দেশে এ পর্যন্ত বড় ধরনের বেশ কয়েকটি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলোর শিকার হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এর মধ্যে কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, কুমিল্লার মুরাদনগর উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ২০১৯ সালে পদ্মা সেতুর জন্য শিশুর মাথা প্রয়োজন- এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে ছেলে ধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয় রানু নামে এক মহিলাসহ কয়েকজনকে। তবে কোনো ঘটনায়ই আগে থেকে ব্যবস্থা নিতে পারেনি সরকারি কোনো সংস্থা।
পার্শ্ববতী দেশ ভারতে এরকম গুজব ঠেকাতে হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষকে বেশ চাপে ফেলা হয় ২০১৮ সালে। সে দেশে কোনো ম্যাসেজ এক সঙ্গে ৫টির বেশি নম্বরে ফরোয়ার্ড করা যায় না। তবে বাংলাদেশে হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার ও ফেসবুকে কর্তৃপক্ষের বেঁধে দেয়া সংখ্যা অনুযায়ীই শেয়ার বা ফরোয়ার্ড করা যায়। এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো চাপ তৈরি করা যায়নি তাদের ওপর।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ইনোভেশন এইটিএইটের প্রধান নির্বাহী জুবায়ের কবির জানান, কয়েকটি উপায়ে এ ধরনের পোস্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোধ করা যায়। সাধারণত ফেসবুক নিউজ ফিডে আর ইনবক্সের মাধ্যমে এসব পোস্ট ভাইরাল হয়। যারা পোস্ট শেয়ার করেন, তারা হয়ত ম্যানুয়ালি ১০ হাজার মানুষের কাছে বার্তাটি পাঠাতে পারছেন। এতে সময় লাগছে। আর সরকারের কোনো সংস্থা যদি বিষয়টি ধরতে পেরে এর কাউন্টার একটি সচেতনামূলক পোস্ট দ্রুত ছড়িয়ে দিতে পারে তবে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। এখানে ডিজিটাল মার্কেটিং বা পোস্ট বুস্ট করাও যেতে পারে। এতে এক ঘণ্টার মধ্যেই লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। একই সঙ্গে গুজব, বিদ্বেষ বা প্রতিহিংসামূলক পোস্টগুলোর বিরুদ্ধে অনেক মানুষকে একসঙ্গে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ বা রিপোর্ট করতে হবে। তখন সেটি বন্ধে তারা দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। এছাড়া মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে ও সেটি গণমাধ্যমে জানাতে হবে। এসব কাজের জন্য প্রতিনিয়ত অনেক বেশি সাইবার পেট্রোলিং জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
নিয়ন্ত্রণ আইন হবে কবে : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর প্রতি নিয়ন্ত্রণ আরোপে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ একটি আইনের খসড়া করেছে। তবে সেটি কবে চূড়ান্ত হবে তা জানা যায়নি। জানা গেছে, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, তুরস্কে এ ধরনের আইন আছে। তাদের আইনের ধারাগুলো পর্যালোচনা করে খসড়া চূড়ান্ত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনুস আলী বলেন, আরো আগেই উদ্যোগ নেয়া দরকার ছিল। এটি হলে দেশের জন্য ভালো হবে। ফেসবুক, টুইটার, গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে অফিস ও সার্ভার চালু হলে তাদের কার্যক্রমকে আইনের আওতায় আনা যাবে এবং তাদের কাছে থাকা আমাদের ডাটা (তথ্য) নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। অস্ট্রেলিয়াতে গুগলের একটি ঘটনার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, আইনের কারণে সে দেশে গণমাধ্যমগুলোর সঙ্গে লভ্যাংশ বিনিময় করতে হয়েছে গুগলকে। গণমাধ্যমের নিউজ যেগুলো গুগল অপটিমাইজ করে দেখাত সেগুলোর লভ্যাংশ গণমাধ্যমকে দেয়া হতো না। গুগল প্রথমে এ নিয়ে বিরোধিতা করে একদিন সেবাও বন্ধ রেখেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারের কড়াকড়িতে মানতে বাধ্য হয়। এ দেশেও তেমনটি করতে হবে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো আইন মানবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গুগল তো ভারত, অস্ট্রেলিয়ায় মানছে। চীনের কঠোর শর্ত মেনেও ফেসবুক সেখানে ব্যবসা করতে চায়। তারা যদি বুঝতে পারে, বাংলাদেশ একটি বড় বাজার, তাহলে এখানেও মানবে।
এসব বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, আমরা এ দেশের মানুষের তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি আইন তৈরির কাজ করছি। ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্ট নামে ওই আইনটি কার্যকর হলে শুধু ফেসবুক-টুইটার নয়, সব ক্ষেত্রে তথ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে। তিনি বলেন, এখন আমাদের দেশের নাগরিকদের অনেক তথ্যই থাকে বিদেশের সার্ভারে। যেমন : এইএসবিসি বা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক আমাদের নাগরিকদের তথ্য বিদেশে রাখে। আইনটি হলে তাদের দেশে সার্ভার ও অফিস স্থাপন করতে হবে। ফলে জবাবদিহিতার আওতায় আসবে তারা। একইভাবে কেউ ফেসবুক, ইউটিউবসহ ব্যবহার করে অপরাধ করতে চাইলেও দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে। কারণ, আইনে তাদেরও এদেশে অফিস ও সার্ভার স্থাপনের বাধ্যবাধকতা রাখা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়