প্রণোদনা ঋণের জন্য ঘুষ লাগে ২৯ শতাংশ ব্যবসায়ীর

আগের সংবাদ

অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ছে : করোনার প্রকোপ কমার পর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও বিষণ্নতার বড় আঘাত আসছে

পরের সংবাদ

সাক্ষাৎকার : শ ম রেজাউল করিম >> বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে কারা কীভাবে লাভবান- রেকর্ডে আসা দরকার

প্রকাশিত: আগস্ট ৩০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৩০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মুহাম্মদ রুহুল আমিন : স্কুল জীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে হাতেখড়ি শ ম রেজাউল করিমের। পিরোজপুরের দৌলতপুর কলেজ ছাত্রসংসদের ভিপি ও সরকারি কৃষি কলেজ ছাত্রসংসদের জিএস ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেছেন খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সহসভাপতির। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গ্রেপ্তার হয়েছেন একাধিকবার। ছিলেন আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক। এর আগে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। তিনি পিরোজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য। ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী। ছিলেন আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক। ১/১১ পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা ষড়যন্ত্রমূলক সব মামলার আইনজীবী তিনি। জেল হত্যা মামলায় জাতীয় চার নেতার পরিবারের পক্ষের আইনজীবীর দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। ছিলেন আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ ও প্রথম আলোর রিপোর্টার। ২০১৯ সালে তৃতীয় মেয়াদে আ. লীগ সরকার গঠন করলে প্রথমে তিনি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি সচিবালয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাসহ নানা বিষয়ে ভোরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
এক প্রশ্নে জবাবে শ ম রেজাউল করিম বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঘটে দেশীয় ও বিদেশি ষড়যন্ত্রে। কারণ পাকিস্তান বিভাজিত হয়ে যাচ্ছে এটা সে সময়ে পাকিস্তানের মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভালোভাবে নেননি। ভারত ও রাশিয়া সফল হচ্ছে। ফলে যিনি (বঙ্গবন্ধু)-এর নেতৃত্বে ছিলেন, প্রতিশোধ নিয়ে তাকে কীভাবে শিক্ষা দেয়া যায়, সেটাই ছিল মার্কিনিদের টার্গেট। তিনি বলেন, পাকিস্তানে ইসলামি সংস্কৃতির খুব প্রভাব ছিল না। কিছু মিডিলিস্ট কান্ট্রি মনে করত পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র। ভারতের সহযোগিতা ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই তারা মনে করতেন, এটা ইসলামি রাষ্ট্র নয়। এজন্যই তারা বাংলাদেশকে মেনে নেয়নি। সৌদি আরবসহ কিছু ইসলামিক দেশ ও

চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরের দিন কিছু রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছিল। এতে প্রতীয়মান, তারা অপেক্ষায় ছিল বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর্যন্ত। এটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে- মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ ও পাকিস্তানকে খুশি করতে খন্দকার মোশতাক রেডিওতে সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা দেয়ায়। এছাড়া পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির আহ্বায়ক গোলাম আজম পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে দেশে ফিরে আসে। ক্ষমতাশালীরা তাকে টিকিয়ে রাখে। ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ নামক একটি ধর্মীয় সংগঠন করে মাওলানা আব্দুর রহিমকে প্রধান করা হয়। তখন থেকেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু হলো। শাহ আজিজ, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মাওলানা মান্নান, আবদুল আলীম, খান এ সবুরকে রাজনীতিতে আনা হয়। খান এ সবুরের কবর দেয়া হয় সংসদ ভবনের সামনে। বিদেশি মেহমানদের স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে লেখা হতো শুভেচ্ছা স্বাগতম, সেটার পরিবর্তে লেখা হলো আহলান-সাহলান। বাংলাদেশ বেতারের নাম পরিবর্ত করে বলা হলো রেডিও বাংলাদেশ। ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। অর্থাৎ পাকিস্তান স্টাইলে সবকিছু করা হলো। পাকিস্তান, আমেরিকা ও চীন বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলো আর রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটল। বাংলাদেশটাকে কার্যক্রমে পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত করা হলো।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তা ছিল পাকিস্তানি। জিয়াউর রহমান নিজেও পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ছিলেন। ’৭২ সাল থেকে খুনিরা তার সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। সর্বশেষ ’৭৫ সালের ২০ মার্চ জিয়ার সঙ্গে ফারুক ও রশীদ দেখা করে নেতৃত্ব দিতে বলেন। জিয়া তাদের বলেন, ‘আমাকে নেতৃত্বে নিও না, তোমরা এগিয়ে যাও। কারণ তারা বঙ্গবন্ধু সরকারকে উচ্ছেদ করবে। অথচ আর্মি রুলসে শপথে বলা হয়- ‘আমি আমার জীবনের বিনিময় হলেও সংবিধান, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করব’। জিয়াউর রহমান সেই শপথ ভেঙে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা ও সরকার পরিবর্তনে অধিনস্তদের হুকুম দিলেন। ষড়যন্ত্রে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে সেনা কর্মকর্তারা জিয়াকে বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট মার্ডার হয়েছে’। তার জবাব ছিল ‘সো হোয়াট’।
শ ম রেজাউল বলেন, ১৬ আগস্ট জিয়াউর রহমান ক্যান্টনমেন্টে ব্রিফ করে বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই, যে যেখানে আছ, দায়িত্ব পালন করো। অথচ ব্রিফিং করার কথা ছিল সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহর। তাকে ব্রিফ করতে দিলেন না। এরপর জিয়া বঙ্গভবন ও রেডিও স্টেশনে গিয়ে মোশতাককে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনে সহায়তার আশ্বাস দেন। অথচ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি না থাকলে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অথবা স্পিকার আবদুল মালেক উকিল দায়িত্ব পালন করবেন। তাদের উপেক্ষা করে বাণিজ্যমন্ত্রী মোশতাককে রাষ্ট্রপতির পদে বসানো হলো। এতে আরো স্পষ্ট হলো জিয়া এই হত্যাকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারি। এরপর সাত দিনের মধ্যে শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান থেকে সরিয়ে জিয়া নিজেই সেনা প্রধান হলেন। এরপর বিচারপতি সায়েমকে পিস্তলের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিলেন। অথচ আইনে তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারেন না। আবার হ্যাঁ/না ভোট দিয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করলেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যাতে বিচার না হয়, সেজন্য মোশতাককে দিয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে পার্লামেন্টে অনুমোদন দিলেন। ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল জিয়া নিজেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে এটা আইনে রূপ দিলেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ হলো। খুনিদের ১২টি রাষ্ট্রে হাইকমিশনের চাকরি দিলেন, পদোন্নতি দিলেন। নির্বিঘেœ দেশ ছাড়ার সুযোগ দিলেন।
সাবেক এই ছাত্রনেতা বলেন, জিয়ার পক্ষে মেজর জেনারেল নুরুল ইসলাম (শিশু) বিভিন্ন দেশে খুনিদের ডলার দিয়ে আসতেন। এরপর খুনিরা দেশে আসলেও তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। উল্টো খুনি শাহরিয়ার রশীদকে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি (প্রগশ), আর ফারুক রশীদকে ফ্রিডম পার্টি গঠনের সুযোগ দেয়া হয়। জিয়া এই দল দুইটাকে বৈধতা দেন। সেই ধারাবাহিকতায় এরশাদ ও খালেদা জিয়াও খুনিদের প্রশ্রয় দিলেন। পার্লামেন্টে এমপি ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার সুযোগ দিলেন।
সুপ্রিম কোর্টের এই সিনিয়র আইনজীবী বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এখনো অসম্পূর্ণ। এই ঘটনায় বিচার হবে তিন শ্রেণির মানুষের। প্রথমত; যারা সরাসরি গুলি চালিয়েছে। দ্বিতীয়ত, শুরু থেকে যারা ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিল এবং তৃতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তায় যাদের দায়িত্ব ছিল। কারণ তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। পর্দার আড়ালের ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার হয়নি। দুই খুনি রশীদ আর ফারুক গ্রানাডা টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে বলেছিল, ‘জিয়াউর রহমান তাদের এগিয়ে যেতে বলেছেন’। এছাড়া রশীদের স্ত্রীর ভাষ্য ‘জিয়া তাদের বাসায় ঘুর ঘুর করতেন এবং নিজেকে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান হওয়ার স্বপ্নের কথা বলতেন। এতেই স্পষ্ট জিয়াউর রহমান জড়িত। তিনি আরো বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কার্যালয় থেকে যেসব তথ্য ওয়াশিংটন ডিসিতে পাঠানো হয়েছিল, সেখানে বলা হয়েছিল, ‘১৯৭৩ সালে মেজর ফারুক অস্ত্র কিনতে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন, বলেছিলেন জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটির হয়ে আমরা অস্ত্র কিনতে এসেছি’। অথচ তারা তো সেনাবাহিনীর কেউ না। তাদের যাওয়ারও কথা না। অস্ত্র কিনলে সরকার কিনবে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী অথবা সেনাপ্রধান যাবেন।
সরকারের এই মন্ত্রী বলেন, আইনে বলা হয়েছে কোনো ঘটনার দ্বারা যিনি লাভবান হবেন, ধরে নেয়া হবে তার সম্পৃক্ততা আছে। জিয়াউর রহমান, খন্দকার মোশতাক ও বিচারপতি সায়েম এই ঘটনায় জড়িত। সে সময় বঙ্গবন্ধুকে নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা ছিলেন তারাও অভিযুক্ত হবেন। সেই তালিকায় তৎকালীন সেনাপ্রধানসহ অন্যরাও আসবেন। কারণ আইনে বলাই আছে, কারো গাফিলতির কারণে যদি কোনো ঘটনা ঘটে, তার দায় তাকে নিতে হবে। এর বাইরে ট্রায়াল কোর্টে যে চারজনকে খালাস দেয়া হয়েছিল। সেটার বিরুদ্ধেও কেন আপিল করা হয়নি, খতিয়ে দেখা দরকার। তাই বলা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডটা স্বাধীনতার অভ্যুদয়ে যারা হেরে গিয়েছিল, তাদের প্রতিশোধ নেয়ার একটি ঘটনা। বিদেশিদের ভূমিকা কী ছিল, সেটাও শ্বেতপত্র আকারে আসতে পারে। এখানে দুটি পার্ট হতে পারে, প্রথমত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ এর ৩ (খ) ধারা অনুযায়ী আরো তদন্ত করে একটা সম্পূরক চার্জশিট করা। যারা মারা গেছে, তাদের হয়তো বিচার হবে না কিন্তু রেকর্ডে থাকতে পারে, এরা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। দ্বিতীয়ত তদন্ত কমিশন গঠন করা। যে কমিশন তদন্ত করে একটা রিপোর্ট আনবে, সেই রিপোর্টটাকে শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করা হবে। অনাদিকালের ভবিষ্যতের জন্য এটা থাকবে, বঙ্গবন্ধু হত্যায় কার কী ভূমিকা ছিল, ইতিহাসের এই ঘৃণিত অধ্যায় কে কীভাবে লাভবান হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরিপূর্ণ তদন্ত শেষ করা দরকার। খুনিদের পরিপূর্ণ বিচার করা দরকার। এটাকে ইতিহাসের মাইলফলক হিসেবে রেকর্ডিংয়ে আসা দরকার।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়