ওবায়দুল কাদের : ২১ আগস্ট মামলার আপিল শুনানি শুরু শিগগিরই

আগের সংবাদ

মহামারিতে মেগা প্রকল্পে স্থবিরতা

পরের সংবাদ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ‘কপাট’ আপাতত খুলছে না : টানা ৭৫ সপ্তাহ স্কুল বন্ধের রেকর্ড বাংলাদেশের

প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য : সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরের খরচার হাওড়ের পাশে থাকা সিরাজপুর বাগগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা লাভলি দাস অনেকটা ক্ষোভের স্বরেই বললেন, অতিমারি করোনায় শিশুদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। যারা প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে বর্ণ পরিচয় শিখেছিল তারা গত দেড়বছরে বেমালুম ভুলে গেছে। এ ছাড়া স্কুল বন্ধ থাকায় হাওড় এলাকায় বহু শিশু স্কুল ছেড়ে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে। আবার হাওড়ের কোথাও কোথাও কম বয়সি মেয়ে শিক্ষার্থীদের বিয়েও হয়ে গেছে। যেদিনই স্কুল খুলে দেয়া হোক না কেন সেদিন থেকে তাদের ফিরিয়ে আনা কষ্টকর হবে।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার খামতিওর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা বিভা বড়ালের মতে, সরকারের নির্দেশে আমরা বাচ্চাদের ‘ওয়ার্কশিট’ দিচ্ছি। নিয়ম হচ্ছে শিশুরা ওয়ার্কশিটে প্রশ্নের উত্তর লিখে জমা দেবে। কিন্তু ওয়ার্কশিটগুলো দেখে আমরা বুঝতে পারি বাড়ির বড়রা উত্তরপত্রে লিখে দিয়েছেন। আবার যখন আমরা শিক্ষার্থীদের বাড়ি গিয়ে তাদের কাছে কোনো প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই, তখন দেখি ওরা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না। অথচ ওয়ার্কশিটে লিখে দিচ্ছে। এতে বোঝা যাাচ্ছে, বাড়িতে পড়াশুনা হচ্ছে না। তবে সচেতন অভিভাবকের সন্তানদের ক্ষেত্রে চিত্রটা একটু ভিন্ন। তারা টুকটাক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে।
শুধু এই দুজনই নয়, অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকার মতে, দেড় বছর ধরে স্কুলে না-যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে স্কুল খোলার বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানিয়েছেন সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। কিন্তু কবে খোলা হচ্ছে সে বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে খুলবে তা এখনই চট করে বলে দেয়া সম্ভব নয়। শিক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, শুধু স্কুল খুললেই তো চলবে না। পড়াশুনা ভুলে যাওয়া শিক্ষার্থীদের কীভাবে ফের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়, সেটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

এদিকে, করোনা পরিস্থিতির বাড়বাড়ন্তের মধ্যেই দেশে সবকিছু খুলে দেয়া হয়েছে। এরফলে চারদিকে রব উঠেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খুলে দেয়া হবে। কিন্তু কবে খুলে দেয়া হবে তার কোনো দিনক্ষণ এখনো ঠিক করা হয়নি। বর্তমানে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। এই বন্ধ আরো বাড়িয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। যদিও সেপ্টেম্বরের শুরুর দিন থেকেই উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষা শুরু করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও জানিয়েছে, আগামী অক্টোবর থেকে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হল খুলে দেয়া হবে। সবমিলিয়ে পরিপূর্ণভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কপাট আপাতত খুলছে না। তবে শিক্ষকদের প্রতিদিন স্কুলে যেতে নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা প্রশাসন। এরফলে স্কুল-কলেজের অফিস খোলা থাকছে।
তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখা গেছে, গত বছরের মার্চে দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যে বন্ধ করা হয়েছে, আজ পর্যন্ত সেগুলো খোলার নাম নেই। এরইমধ্যে পৃথিবীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘতম ছুটির তালিকায় বাংলাদেশ রেকর্ড গড়েছে। ৭৫ সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। বাংলাদেশের পরেই আছে মিয়ানমার। ইউনিসেফের হিসাব অনুযায়ী মহামারিতে লম্বা সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাকপ্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত বাংলাদেশে চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মহামারিকালে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশুনা চালিয়ে গেছে। সরকারও এটা নিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে। বাস্তবে ভার্চুয়াল শিক্ষা সামনাসামনি ক্লাসরুম শিক্ষার কোনো উপযুক্ত বিকল্প নয়। স্কুল তো শিক্ষার্থীদের জন্য শুধু অ্যাকাডেমিক শিক্ষার আঁধার নয়, আরো অনেক কিছু। লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা সেখানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক ও ভাবোদ্দীপক মিথস্ক্রিয়ার দক্ষতা অর্জন করে। এ ছাড়া অনলাইন শিক্ষা আর্থসামাজিক বৈষম্যের ক্ষেত্র আরো বাড়িয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিশুদের খাবার সরবরাহ করে যে পুষ্টি চাহিদা পূরণ করত, স্কুল বন্ধ থাকায় তাদের মনের খোরাকের সঙ্গে সঙ্গে দেহের খোরাকও বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু তাই না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও সহায়ক কর্মচারীরাও কর্মহীন হয়ে পড়ে এক নতুন সামাজিক সমস্যার জন্ম দিয়েছে।
ঠিক এই প্রসঙ্গটি টেনে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পশ্চিম ছাতনাই বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মজিবুর রহমান সরকার ভোরের কাগজকে বলেন, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয়স্তরের শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে গরিব শিক্ষার্থীদের অনেকেই গত দেড় বছরে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। দেখছি, অনেকে বর্ণপরিচয় পর্যন্ত ভুলে গিয়েছে। প্রাথমিক শেষ করেই তারা মাধ্যমিক স্কুলে আসে। বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী সাপ্তাহিক বারের নাম পর্যন্ত ভুলে গেছে। এক ক্লাস না পড়িয়েই উপরের ক্লাসে প্রমোশন দেয়ায় এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এবারও তাই হবে। কিন্তু দেড় বছর ধরে অনলাইনে ক্লাস করানো হয়েছে-প্রশ্নের জবাবে তিনি তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটা উদাহরণ টেনে বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে ৪২৭ জন শিক্ষার্থী পড়াশুনা করে। স্কুলের শিক্ষকদের মাধ্যমে ৪২৭ জনের ওপরেই একটি জরিপ চালিয়ে দেখি মাত্র ১৮ জনের স্মার্ট ফোন আছে। যেখানে স্মার্ট ফোনই নেই সেখানে অনলাইনে ক্লাসের সফলতা আশা করা যায় কীভাবে?
দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্ব ও আচরণে কিরূপ বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, এ থেকে উত্তরণের পথ জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। বিজ্ঞজনরা মতামত দিচ্ছেন স্কুল খুলে দেয়ার ব্যাপারে। আমরাও তো জানি, দীর্ঘ দেড় বছর ধরে বাচ্চা-কাচ্চারা বাড়িতে আছে। নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। পড়াশুনা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। খেলাধুলা নিয়ে মত্ত। তারপর অনলাইনেও আমাদের কিছু ডিস্টার্ব হচ্ছে। অনেক বাজে গেমস-টেমস বাচ্চারা খেলছে। বাল্যবিয়ের প্রবণতাটা কিছুটা বাড়ছে। এগুলো মিলিয়ে আমরা চাচ্ছি, যত দ্রুত সম্ভব আমরা স্কুল খুলে দেব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুব দ্রুত স্কুলগুলো খুলে দেয়ার কথা বলেছেন। পরিস্থিতিটা একটু স্বাভাবিক হলে আমরা খুলে দেব। স্কুল খোলার সব প্রস্তুতি আমাদের আছে। সেজন্য স্কুলগুলো প্রস্তুত রাখা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, যে কোনো সময় স্কুল খুললে যেন আমরা আমাদের কাজকর্ম করতে পারি। স্কুল খোলার পরে আমরা কী করব না করব, এই পরিস্থিতির আগেও আমাদের শিক্ষকরা স্কুলে গেছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যা কিছু লাগে, পড়ালেখার পরিবেশ যেন থাকে; সেটা আমরা দেখছি। শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার কথা ভেবে তাদের আলাদা আলাদাভাবে শ্রেণিকক্ষে ফেরানোর পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে জাকির হোসেন বলেন, থ্রি, ফোর, ফাইভ দুইদিন খুলব। ওয়ান-টু একদিন একদিন করে খুলব। এভাবে আমরা করতে চাচ্ছি। আমাদের কারিকুলাম অনুযায়ী শর্ট সিলেবাসেও আমরা একটা চিন্তাভাবনা করছি।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ রহমত উল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, করোনাকালে অনেক বাচ্চার মা-বাবাদের মাসিক আয় কমে তিন থেকে চার হাজার টাকায় ঠেকেছে। ওই সব বাড়ির পড়ুয়াদের অনলাইন ক্লাস তো দূরের কথা, ১০০-১৫০ টাকা বেতন দিয়ে পাড়ার কোনো গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ার মতো আর্থিক সামর্থ্যও নেই। তাদের অনেকেই পিছিয়ে পড়ছে ভীষণভাবে। যথাদ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া অত্যন্ত জরুরি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সরাসরি ক্লাসের কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সরাসরি ক্লাস না থাকায় শিশু শিক্ষার্থীরা ভুলতে বসেছে বর্ণপরিচয়। কিশোর শিক্ষার্থীদের মনোযোগ নেই পাঠ্যবইয়ে। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে পা না রেখেই প্রমোশন পেয়ে গেছে উপরের ক্লাসে। তাদের শিক্ষায় রয়ে গেছে ব্যাপক ঘাটতি। বিশেষ করে গ্রামের শিক্ষার্থীরা এই ঘাটতিতে চরমভাবে নিমজ্জিত! বাস্তবে একাধিক বছরের তথা ক্লাসের লেখাপড়ায় ঘাটতি নিয়ে আবারো উপরের ক্লাসে গেলে তারা পড়ে যাবে মহাসংকটে। তাই দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে এখনই নিতে হবে সেই ঘাটতি পূরণের পদক্ষেপ জানিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের বিভক্ত করতে হবে সবল, দুর্বল ও অতি দুর্বল এই তিনটি ভাগে। প্রয়োজন অনুসারে নিয়মিত ক্লাসের পাশাপাশি অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে তাদের পড়াতে হবে পূর্ববর্তী ক্লাসের বই। প্রয়োজনে যথাযথ প্রণোদনা দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করাতে হবে শিক্ষকদের দ্বারা।
সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার কথা আবারো জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, সংক্রমণের হার আরেকটু নিচে নামলেই খুব শিগগির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে। তিনি খোলার সুনির্দিষ্ট তারিখ না জানিয়ে বলেন, ধাপে ধাপে খুলব। কারণ আমাদের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা পৃথিবীর যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি। কারণ এ অসুখে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়