ওবায়দুল কাদের : ২১ আগস্ট মামলার আপিল শুনানি শুরু শিগগিরই

আগের সংবাদ

মহামারিতে মেগা প্রকল্পে স্থবিরতা

পরের সংবাদ

কীটনাশক ক্রয়ে সিন্ডিকেট বৈরী

প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** ভয়াবহরূপে ডেঙ্গু ** রাজধানীতে বেড়েছে মশার ঘনত্ব ** মশা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব নেই ওষুধে, অভিযানে নজর **
রুমানা জামান : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনে জোর দিচ্ছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু মশা মারার প্রধান হাতিয়ার কার্যকরী কীটনাশক প্রয়োগে একেবারেই নজর নেই সিটি করপোরেশনের। এতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের সব তৎপরতা বিফলে যাচ্ছে। মশা কমছে না, বাড়ছে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা। একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের চক্রান্তের কারণে কীটনাশক দ্রুত আনা সম্ভব হয়নি। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের পাশাপাশি মশার ওষুধ প্রয়োগের ওপর কতটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে? জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, ডেঙ্গুর লার্ভা মারার ওষুধ আমাদের কাছে নেই। অথচ বিদেশের সব জায়গায় এ ওষুধ পাওয়া যায়। কারণ কীটতত্ত্ব বিভাগের আইনকানুন মেনে ওষুধ আমদানি করা একটি দীর্ঘসূত্রতার ব্যাপার।
মেয়র আতিক বলেন, এক ধরনের সিন্ডিকেট বিষয়টিকে এমন জটিল করে রেখেছে, যাতে কয়েলের ব্যবসা বন্ধ না হয়। বাসাবাড়ির ছাদে, বারান্দার জমা পানিতে যে ওষুধ ছিটিয়ে দিলেই লার্ভা ধ্বংস হবে, সেই ওষুধ আনা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তিনি বলেন, ‘ওভার দ্য কাউন্টারে’ এ ধরনের লার্ভা মারার ওষুধ যত দ্রুত মানুষ ফার্মেসি থেকে কিনে নিজেরা প্রয়োগ করতে পারবে, তত দ্রুত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। এর জন্য যত ধরনের জটিলতা রয়েছে, তা দূর করার চেষ্টা করছি। আমি কৃষি মন্ত্রণালয়ে বলেছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছাড়পত্রের ব্যবস্থা করতে।
তিনি আরো বলেন, আগে একটা কোম্পানির কীটনাশক আমদানির অনুমতি ছিল। এখন তা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। বেসরকারি কোম্পানি যদি সেই কীটনাশক এনে আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করতে চায়, আমরা স্বাগত জানাই। তাদের মাধ্যমে এসব ওষুধ এনে সেগুলো দোকানে দোকানে বিক্রির ব্যবস্থা করব।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ‘প্ল্যান্ট প্রটেকশন উইং’ কীটনাশকের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে কাজ করে। কোনো প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরে থেকে কীটনাশক এনে দেশে ব্যাবসা করতে চাইলে প্রথমে ছাড়পত্রের জন্য এখানে লিখিত আবেদন করে। আবেদনের

পর প্রথমে এই উইং থেকে আবেদন ও ওষুধের নমুনা জমা দিয়ে রাখতে বলা হয়। নির্দিষ্ট কোম্পানিকে তারা সময়মতো ডাকবে। এরপর গুরুত্বের ওপর ভিত্তি করে পর্যায়ক্রমে আবেদনগুলো ‘সাবপিট্যাক’ মিটিংয়ে উঠানো হয়। আলোচনা করে স্যাম্পল ঘেঁটে পরের মিটিংয়ে ওষুধটি ব্যবহার উপযোগী হবে কিনা, তা পরীক্ষা করতে ল্যাবে পাঠানোর প্রস্তাব দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ‘কেমিক্যাল কম্পোজিশনের’ মাধ্যমে একটি ভাগ প্ল্যান প্রটেকশন উইংয়ের নিজেদের ল্যাব এবং অন্য ভাগটি রোগতত্ত্ব গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়। এ দুটি রিপোর্ট আসার পর তা পরবর্তী ‘সাবপিট্যাক’ মিটিংয়ে দেয়া হয় এবং যাচাইবাছাই করে রেজিস্ট্রেশনের ছাড়পত্র দেয়া হয়। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ৮ থেকে ১১ মাস সময় লেগে যায়। উইংয়ের কয়েকজন কীটতত্ত্ববিদ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়াগুলো দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখেন। সূত্র জানায়, এসব কাজ দ্রুত করতে গেলে কোম্পানির মালিকদের গুনতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। সিটি করপোরেশন থেকে ডেঙ্গু নিধনের ওষুধ আনতেও এই প্ল্যান প্রটেকশন উইংয়ে ঘুরতে হচ্ছে প্রায় সাত মাস ধরে।
ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশাসহ অন্যান্য মশা নিধনে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর না করে ইন্ট্রিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট (সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা) করা হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় তিনি বলেন, আমরা কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নয়, ইন্ট্রিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট করতে যাচ্ছি। দেশবাপী এটার জন্য কাজ চলছে।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, কীটনাশক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের খুবই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। মশা দমনের জন্য আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মশারা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। তাই পুরনো ও একই ধরনের কীটনাশক বাদ দিয়ে নতুন ও কার্যকরী কীটনাশক (লার্ভিসাইড ও এডাল্টিসাইড) যোগ করতে হবে। কীটনাশক বাছাই করার আগে তা প্রথমে ল্যাবরেটরিতে যথাযথ টেস্ট (টক্সিসিটি বায়োঅ্যাসে) করতে হবে। মশার লার্ভা দমনে (লার্ভিসাইডিং) বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ লার্ভিসাইডিং করতে হবে এবং সঠিক, নিরাপদ ও কার্যকরী লার্ভিসাইড ব্যবহার করতে হবে। বিভিন্ন দেশে সফলতার সঙ্গে ব্যবহৃত লার্ভিসাইড বিটিআই তথা বেসিলাস থুরেনজেনিসিস (পাউডার), স্পাইনোসাদ, গ্রোথ রেগুলেটরস আমাদের দেশেও পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ঢাকার মশা মারতে প্রতি বছরই বরাদ্দ বাড়ে। কিন্তু মশা কমে না। দুই সিটিতে বছরে বরাদ্দ প্রায় ২০০ কোটি টাকা। বরাদ্দ বাড়ার পরও এবার ডেঙ্গুর যে ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে, তাতে প্রশ্ন উঠেছে মশা মারার বরাদ্দ কার পকেটে যায়? ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন তাদের চলতি বাজেটে বরাদ্দ রেখেছে ৭২ কোটি টাকা। অন্যদিকে এ বছর বাজেট এখনো পাস না হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে মশা মারতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন, দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহমেদ।
এমন অবস্থায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জরিপে দেখা গেছে, নগরের প্রায় প্রতিটি এলাকায়ই মশার ঘনত্ব ভয়াবহভাবে বেড়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বাসাবো, গোরান, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, এলিফ্যান্ট রোড, আর কে মিশন রোড ও টিকাটুলী এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব ভয়াবহ। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মগবাজার ও নিউ ইস্কাটন এলাকায় এ মশার ঘনত্ব ব্যাপক। শুধু ডিএনসিসির মেরুল বাড্ডা ও আফতাবনগর এবং ডিএসসিসির বংশাল এলাকায় এডিস মশার অস্তিত্ব পায়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জরিপ চালানো ৯৮টি ওয়ার্ডের দুটি ছাড়া সবগুলোতেই এ মশার উদ্বেগজনক উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা না গেলেও সিটি কপোরেশনের পক্ষ থেকে নিয়মিত মশা মারার ওষুধ ছিটানো হয়েছে। এবার তেমনটি করা হচ্ছে না। কিছু জায়গায় ওষুধ ছিটানো হলেও নগরবাসীর অভিযোগ সিটি করপোরেশনের দেয়া ওষুধে কোনো কাজ হচ্ছে না। সচেতন হওয়ার জন্য মন্ত্রী-মেয়রদের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না নগরবাসী। এ পরিস্থিতিতে বাড়ছে এডিস মশার দৌরাত্ম্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রকাশিত জরিপেও এডিস মশার ঘনত্বের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
সিটি করপোরেশনের ফগার মেশিনে ওষুধ নাকি শুধুই ধোঁয়া দেয়া হচ্ছে। সন্দেহ রয়েছে মশানিধনে বাজারে বিক্রি উপকরণ নিয়েও। মশা মারার নানা ধরনের কয়েল, জীবাণুনাশক স্প্রে, ওডোমস বাজারে থাকলেও তা কোনো উপকারে আসছে না। এছাড়া বাজারে নিমপাতা-তুলসী পাতাসহ অনেক নামের কয়েল রয়েছে, যেগুলোর সরকারি অনুমোদন নেই। এর আগে লিমিট লিকুইড ইনসেক্টিসাইড, লোভালিউরন নামের মশা মারার ওষুধটি এখন আর ব্যবহার করছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভেজাল ওষুধ সরবরাহ, ট্রায়াল শেষ না হতেই ওষুধ ক্রয় এবং পানি মিশিয়ে ব্যবহারের ফলে এসব ওষুধ কার্যকারিতা হারাচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে গত বছরের মার্চের পরে মশক নিয়ন্ত্রণের নতুন কার্যকর কোনো ওষুধ আমদানি করতে পারেনি দুই সিটি কপোরেশন। এছাড়া গত বছর ডেঙ্গু অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকায় নিয়মিত ওষুধ ছিটানোসহ মশা নিয়ন্ত্রণে যাবতীয় কাজে গাফিলতি ছিল। ওষুধের কার্যকারিতার বিষয়েও ছিল না নজরদারি।
জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এবার কীটনাশকে কম গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ ডেঙ্গু বাসাবাড়ির ছাদ, বারান্দাসহ স্বচ্ছ পানিতে জন্মায়। এক্ষেত্রে পানি ঢেলে ফেলে দিলেই হয়। তাই এখানে কীটনাশকের চেয়ে সচেতনতা জরুরি। তিনি আরো বলেন, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত কীটনাশক রয়েছে। মেলাথিয়ন এলাকাভিত্তিক প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে আমরা চাইছি ‘ওভার দ্য কাউন্টার’ সহজলভ্য করা যায় কিনা। এক্ষেত্রে ‘গ্যানুল ফরমেটের’ কিছু কীটনাশক ফার্মেসিতে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে দুই সিটি করপোরেশন থেকে বলা হচ্ছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ একটি সামষ্টিক প্রক্রিয়া। কারণ এডিস মশার বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ বাসাবাড়ির ভেতরেও থাকে, যেখানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের প্রবেশগম্যতা নেই। তাই এর বিস্তাররোধ নাগরিকদের সচেতনতার ওপরও নির্ভরশীল। কিন্তু সচেতন করে তোলার প্রচেষ্টা চালানোর পরও এক্ষেত্রে নগরবাসীর মধ্যে তেমন সচেতনতা দেখা দেয়নি। ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রতি শনিবার ১০ মিনিটের জন্য বাসাবাড়ি ও আশপাশ নিজ উদ্যোগে পরিষ্কার করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু নগরবাসী তা আমলে নেননি।
ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ বলেন, জানুয়ারি থেকে মোবাইল কোর্ট, মাইকিং, লিফলেট বিতরণ করেছি। আগে বাসাবাড়ি পরিচ্ছন্ন করার জন্য একটা নামমাত্র ফি ধরা হয়েছিল। পরে সেটা ফ্রি করা হয়েছে। তারপরও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এত বড় একটা শহরে মানুষ সচেতন না হলে কাজটা করা কঠিন হয়ে পড়ে। মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত অংশ না নেয়ায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়