মির্জা ফখরুল : জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার মানুষ বিশ্বাস করে না

আগের সংবাদ

বিলুপ্তির পথে সোনাগাজীর ঐতিহ্য ‘পানের বরজ’

পরের সংবাদ

নতি স্বীকারের উপায় নেই

প্রকাশিত: আগস্ট ২০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

স্বীকার করতেই হবে আজ কিংবা আগামীতে মেহনতিরাই জিতবে। তবে তাদের সঙ্গে থাকার প্রয়োজন হবে বিপ্লবীদের, যারা শ্রেণিচ্যুত হয়ে কাজ করবে বিপ্লবের স্বার্থে, মেহনতিদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। শ্রেণিচ্যুত সার্বক্ষণিক বিপ্লবীরা কোন ধরনের মানুষ হবে তার একটা রেখাবয়ব পাওয়া যায় মার্কসের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ছোট্ট তালিকাটিতে, খেলাচ্ছলে একদা যেটি তিনি লিখেছিলেন তার মেয়ে লরার হাতখাতাতে; তার মৃত্যুর অনেক পরে, ১৯৬০-এর দশকে যে-খাতার সন্ধান পাওয়া গেছে। মার্কস লিখেছেন তার প্রিয় গুণ হচ্ছে সরলতা। মানুষের মধ্যে তিনি যে গুণটি দেখতে চান তা হলো শক্তি। সুখ বলতে বোঝেন লড়াইকে। সবচেয়ে কঠিন দুঃখ থাকে নতি স্বীকারে। তার পছন্দের কাজ হলো বই পড়া। ঘৃণা করেন যে দোষকে সেটা হলো তোষামোদ করা। তার প্রিয় নীতি হচ্ছে সব কিছুকে প্রশ্ন করা। প্রিয় ব্যক্তিত্ব স্পার্টাকাস ও কেপলার। দেখা যাচ্ছে মার্কসের সব পছন্দই তাৎপর্যপূর্ণ। হঠাৎ করে তাকালে মনে হতে পারে তালিকাটি বুঝি-বা সাজানো। কিন্তু সাজানো তো নয়; প্রকাশের জন্য লেখেননি, প্রকাশ পেয়েছে তার মৃত্যুর ৭০ বছর পরে। পুঁজির মতো অমন জটিল ও কঠিন বই যিনি লিখেছেন, তথ্য উদ্ঘাটনে ও তত্ত্ব গঠনে লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন তার আগের সব অর্থনীতিবিদকে, যিনি হেগেলের আধিপত্যের কালে ওই দার্শনিক গুরুর দর্শনকে একেবারে উল্টে মাথার ওপরে দাঁড়িয়ে থাকার দুর্দশা থেকে অব্যাহতি দিয়ে পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে দিলেন, সেকালের বস্তুবাদীশ্রেষ্ঠ ফয়েরবাখের বস্তুবাদকে যিনি মানলেন কিন্তু তার যান্ত্রিকতাকে প্রত্যাখ্যান করে সেটির বস্তুবাদিতার সঙ্গে যুক্ত করে দিলেন হেগেলের দ্ব›দ্ববাদকে, সামাজিক বিজ্ঞানের জগতে যার বৈপ্লবিক কাজ জীববিজ্ঞানের জগতে ডারউইনের কাজের সঙ্গে তুলনীয়; তিনি বলছেন তার সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে সরলতা। আসলেই তিনি অত্যন্ত সরল, সরল বিপ্লবী। ঝরনার মতো স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন। জাত বিপ্লবী যেহেতু তাই তার জন্য সুখ অন্যকিছুতে নেই, রয়েছে যুদ্ধে। সবচেয়ে কঠিন দুঃখ নতি স্বীকারে। তার প্রিয় ব্যক্তিত্বের ভেতরে যে দুজন ছিলেন তারা উভয়েই বিপ্লবী- স্পার্টাকাসের বিপ্লব ছিল দাসপ্রথার বিরুদ্ধে, কেপলারের বিপ্লব জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে। কিন্তু স্পার্টাকাসই প্রথমে আসেন, কেপলার দ্বিতীয় হন। মার্কসের দৃষ্টিতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপ্লব চাই, কিন্তু তার চেয়েও জরুরি প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লব। এ কথা সব বিপ্লবীর জন্যই সত্য। মার্কস তার মেয়েকে জানিয়েছেন তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় নাম দুটি হচ্ছে লারা ও জেনী। লারা ও জেনী তার দুই মেয়ের নাম, জেনী তার স্ত্রীর নামও। বোঝা যায় কেমন কোমল ছিলেন অত্যন্ত কঠোর বলে পরিচিত এই মানুষটি। বিপ্লবীরা কোমল হন, কোমল হন বলেই বিপ্লবী হতে পারেন, কোমল না হলে বিপ্লবী হওয়া যায় না। মানবিক বলে বড়াই করা লোকদের চেয়ে তারা অনেক অনেক বেশি মানবিক। মেয়ের হাতখাতাতে মার্কস এও লিখেছেন যে মানুষের সঙ্গে জড়িত সব কিছুকেই তিনি আপন মনে করেন। পুঁজিবাদকে এই মানুষটি তাড়াতে চেয়েছেন, কারণ পুঁজিবাদ মানুষের শত্রæ। অতি নিকৃষ্ট শত্রæ।
পুঁজিবাদীরা জ্ঞানের যথার্থ চর্চাকে উৎসাহ দেয় না, কারণ প্রথমত পণ্য হিসেবে জ্ঞানের ভালো বাজার নেই, দ্বিতীয়ত তারা জানে জ্ঞান মানুষের চোখ খুলে দেয়, চোখ খুলে গেলে আশঙ্কা থাকে বিপ্লবী হয়ে যাবার। কোনো যুগেই কিন্তু জ্ঞান ছাড়া বিপ্লব ঘটেনি, পুঁজিবাদের বর্তমান স্তরে তো জ্ঞান না থাকলে চলবেই না; কিন্তু বিপ্লবী জ্ঞান কেবল অর্জনের ব্যাপার নয়, ব্যাপার প্রয়োগেরও এবং বিপ্লবী জ্ঞান সর্বদাই প্রশ্ন করে, প্রশ্ন করতে করতে এগোয়। আমাদের দেশে বিপ্লব না ঘটার পেছনে জ্ঞানানুশীলনের ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা যে একটি বড় কারণ তাতে সন্দেহ কী।
পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধটা চলছে তাতে পুঁজিবাদ জিতবে না, মানুষই জিতবে। কবে জিতবে, কীভাবে জিতবে সেটা অনেকটাই নির্ভর করছে মানুষের বিপ্লবী তৎপরতার ওপর। সব মানুষের ভেতরেই বিপ্লবী সম্ভাবনা থাকে, তাকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব যারা অগ্রসর চিন্তার হৃদয়বান মানুষ তাদের। বিপ্লবী চেতনাকে জাগিয়ে তোলার কাজে মিডিয়াকে ভুললে চলবে না। মার্কস-এঙ্গেলস ও লেনিনের যুগে শুধু ছাপাখানার ওপরই নির্ভর করতে হতো। একালে ইলেকট্রনিক মিডিয়া এসেছে। এই মিডিয়া মানুষের সঙ্গে নানাভাবে শত্রæতা করে চলেছে। বিপ্লবের জন্য একেও ব্যবহার করা চাই। কিন্তু এক্ষেত্রে এমন আত্মসন্তোষের কোনো অবকাশ নেই যে স্ট্যাস্টাস দিলেই বৈপ্লবিক কর্তব্য পালন করা হয়ে গেল। ফেসবুকের কথোপকথন ছায়ার সঙ্গে যোগাযোগই থাকে, যদি না সে ডাক দেয় মানবিকভাবে মিলিত হবার। সেই মানবিক মিলন সামাজিকভাবেই ঘটবে, সমাজের নানা প্রাঙ্গণে। দেশে এবং সারা বিশ্বে।
জিতবে মানুষই। পুঁজিবাদের পতন অবশ্যম্ভাবী, কর্তব্যটা হচ্ছে সেই পতনকে ত্বরান্বিত করা। এক্ষেত্রে রণনীতি স্থির করা আছে, রণকৌশলের ক্ষেত্রেই চাই উদ্ভাবন। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামেই রয়েছে আশা, ভরসা এবং সুখ; সেই সুখ যার কথা মার্কস লিখে গেছেন তার মেয়ের হাতখাতাতে। এই সংগ্রামে বিপ্লবীদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক। আমরা আওয়াজ শুনি বামপন্থিদের ঐক্য চাই। সত্যিকারের প্রয়োজনটা কিন্তু বামপন্থিদের ঐক্য নয়, বিপ্লবীদের ঐক্য। কারণ বামপন্থি মাত্রেই যে বিপ্লবী এটা মোটেই সত্য নয়। বামপন্থিরা বিভিন্ন কিসিমের হয়ে থাকে, তারা তো এমনকি লেজুড়ও হয় বুর্জোয়াদের এবং দেখা যাচ্ছে যে আমাদের দেশের বামপন্থিদের অনেকেই আজকাল ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি তুলতেও ভয় পায়, অথচ কে না জানে যে এমনকি বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যও ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে একেবারে প্রথম শর্ত। বামপন্থিদের নয়, আসলে ঐক্য প্রয়োজন সমাজবিপ্লবীদের, যাদের প্রধান পরিচয় এটা যে তারা পুঁজিবাদের পতন চায় এবং সেই লক্ষ্যে সংগ্রাম করে। বামপন্থিরা ডানে ও বামে ঝুঁকতে পারে, ঝোঁকেও; কেউ হয় হঠকারী, কেউ সাজে উদারনৈতিক; বিপ্লবীদের জন্য কিন্তু সব রকমের বিচ্যুতিই নিষিদ্ধ। তাদের লক্ষ্য সুস্পষ্টরূপে চিহ্নিত। বিপ্লবী আন্দোলনে প্রাণবন্ততা অত্যাবশ্যক, কিন্তু সেটি থাকবে সুশৃঙ্খল, দুপাড়ের ভেতর নদীর স্বতঃস্ফূর্ত প্রবহমানতার মতো। এই যুদ্ধে আর যাই থাকুক নতি স্বীকারের কোনো জায়গা নেই।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়