মির্জা ফখরুল : জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার মানুষ বিশ্বাস করে না

আগের সংবাদ

বিলুপ্তির পথে সোনাগাজীর ঐতিহ্য ‘পানের বরজ’

পরের সংবাদ

জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না

প্রকাশিত: আগস্ট ২০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক না বলায় আমাকে বিএনপি সরকারের আমলে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। ২০০১ সালে আমি তখন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছিলাম। একই বছর তথাকথিত বিপ্লব দিবস উপলক্ষে ৭ নভেম্বর শিশু একাডেমির অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বিশেষ অতিথি ছিলেন মন্ত্রী সেলিমা রহমান। সভাপতি ছিলেন জিয়া শিশু কিশোর সংগঠনের তৎকালীন সভাপতি সিরাজুল ইসলাম সেলিম। স্বাগত বক্তব্যে আমি বলেছিলাম, জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন। আমার বক্তব্যের মাঝখানে বিশিষ্ট ছড়াকার ও সাংবাদিক আবু সালেহ দর্শকের আসন ছেড়ে উঠে এসে আমাকে বললেন, বলুন, ‘জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক।’ আমি তার কথা অস্বীকার করায় তিনি খুব ক্ষেপে গিয়েছিলেন। আমি পাশ থেকে শুনতে পেলাম, সেলিমা রহমান বেগম জিয়াকে বলছেন, আন উইলিং হর্স নিয়ে আপনি শিশু একাডেমি চালাতে পারবেন না। এর দেড় মাস পর আমার চুক্তি বাতিল করে আমাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তখনো আমার চাকরির মেয়াদ কয়েক মাস বাকি ছিল।
আমার পক্ষে চাকরি রক্ষার জন্য মিথ্যা কথা বলা সম্ভব ছিল না। কেননা পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘সত্য অস্বীকারকারীদের জন্য অবশ্যই কঠিন আজাব অপেক্ষা করছে।’ (সুরা : তওবা, আয়াত : ৯০)।
জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করছে বিএনপির সমর্থকরা। আমার মতে, জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক দূরের কথা মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন না। জিয়াসহ দেশের কতিপয় মুক্তিযোদ্ধার আদর্শচ্যুতির কারণ জানতে চাইলে আমার এক শিক্ষক বলেছিলেন, যোদ্ধা তিন প্রকার : আক্রমণকারী যোদ্ধা, আত্মরক্ষাকারী যোদ্ধা ও মাতৃভূমি রক্ষাকারী যোদ্ধা। শেষোক্ত যোদ্ধারাই হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণকারী যোদ্ধা ও আত্মরক্ষাকারী যোদ্ধাদের যুদ্ধ শেষ হলেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ শেষ হয় না। দেশকে শত্রæমুক্ত করার পরও মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ করতে হয় দেশের ভেতর লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে, ঘুষখোর, সমাজবিরোধী, দুর্নীতিবাজসহ সব ধরনের অপশক্তির বিরুদ্ধে। তাই সব যোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা নয়। যদিও আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আত্মরক্ষাকারী মুক্তিযোদ্ধারাও অংশগ্রহণ করেছিল।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ও জেলে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে আত্মরক্ষাকারী কথিত মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলায়। এরপর থেকে তারা আর কখনো পূর্বের ন্যায় ‘জয় বাংলা’ বলে না, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে না। পাকিস্তানি কায়দায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলে। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়। তারা মুক্তিযোদ্ধা হলে পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী, চার নেতার হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করত না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীরা কখনো বীর মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে না। আমরা জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযোদ্ধা বলে জানি। তাকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ‘বীর উত্তম’ খেতাব দেয়া হয়েছে। তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তার পাকিস্তানি কমান্ডার কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে পাকিস্তান নৌবাহিনীর জাহাজ ‘সোয়াত’ থেকে অস্ত্র খালাস করতে যাচ্ছিলেন। এই অস্ত্র আনা হয়েছিল বাংলার মানুষকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে জিয়াকে জানানো হলো, অস্ত্র খালাস করতে গেলে তাকে হত্যা করা হবে। তাকে আরো জানানো হয়, ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরীহ বাঙালিদের গুলি করে হত্যা করতে শুরু করেছে। জিয়া গতি পরিবর্তন করে শহরে ফিরে এসে কর্নেল জানজুয়াকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জিয়া যুদ্ধ করেছিলেন প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য, আত্মরক্ষার জন্য। দেশের মুক্তি বা স্বাধীনতার জন্য নয়। তিনি আত্মরক্ষাকারী যোদ্ধা ছিলেন। স্বাধীনতার চিন্তা তার মাথায় কখনো আসেনি। সে চিন্তা তার মাথায় থাকলে তিনি কখনো জাহাজ থেকে বাংলার মানুষকে হত্যার উদ্দেশ্যে আনা অস্ত্র খালাস করতে যেতেন না। জিয়া নির্বোধ ছিলেন না। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন চৌকস অফিসার ছিলেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে পাঞ্জাবের খেম খারান এলাকায় বীরত্ব প্রদর্শন করে খেতাব পেয়েছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গতিবিধি তিনি লক্ষ্য করেননি তা হতে পারে না।
আমার স্যারের কথা অনুযায়ী জিয়া কখনো মাতৃভূমির স্বাধীনতা বা দেশবাসীর মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেননি। তিনি যুদ্ধ করেছিলেন নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য। তাকে যোদ্ধা বলা যায়, মুক্তিযোদ্ধা কখনো নয়। পরবর্তীকালে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর তিনি কখনো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রিয় সেøাগান ‘জয় বাংলা’ এবং ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলেননি। এমনকি তিনি বঙ্গবন্ধু ও জেলে জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের রক্ষা করার জন্য ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই ‘ইনডেমনিটি আইন’ বা ‘দায়মুক্তি আইন’ পাস করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা হলে জাতির জনকের হত্যাকারীদের রক্ষা করার জন্য ‘দায়মুক্তি আইন’ পাস করতেন না। ১৯৮০ সালে লন্ডনে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার ব্যাপারে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা বাংলাদেশে আসতে চাইলে জিয়া তাদের ভিসা দেননি। জিয়া এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটিও বাতিল করেন। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম কর্তৃক বাংলাদেশের নির্যাতিত মা-বোনদের ‘গনিমতের মাল’ আখ্যা দেয়া সত্ত্বেও জিয়া তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে সসম্মানে দেশে নিয়ে আসেন। জিয়া মুক্তিযোদ্ধা হলে সংবিধান থেকে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ বাতিল করতেন না, দেশে মদ-জুয়ার অনুমতি দিতেন না। জিয়াউর রহমান যে কত বড় গণবিরোধী এবং বিধ্বংসী ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার উক্তিতে, ‘রাজনীতিকে আমি রাজনীতিবিদদের জন্য দুঃসহ করে তুলব।’ জিয়া মুক্তিযোদ্ধা হলে দেশকে নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্যে রাজনীতিবিদদের চরিত্র হননের নীতি গ্রহণ করতেন না। ভাগ্যের পরিহাস, আজ তারই নীতি বুমেরাং হয়েছে তার প্রতিষ্ঠিত দলের সদস্যদের জন্য। জিয়া মুক্তিযোদ্ধা হলে স্কুল-কলেজের পাঠ্য-পুস্তক থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাদ দিতেন না। ইতিহাস বিকৃত করতেন না। জিয়া মুক্তিযোদ্ধা হলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের স্থানে তাদের কলঙ্কিত চিহ্ন মুছে ফেলবার উদ্দেশ্যে শিশু পার্ক স্থাপন করতেন না। দেশবাসীর বিজয় গৌরব নষ্ট করতেন না।
উল্লেখ্য যে, আব্রাহাম লিঙ্কন, মাহাত্মা গান্ধী, জন এফ কেনেডি, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, বেনজির ভুট্টো, বন্দর নায়ককেও সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করেছিল। হত্যাকারীদের রক্ষা করার জন্য সেসব দেশে কোনো ‘দায়মুক্তি আইন’ হয়নি এবং সেসব দেশের সংবিধানও পরিবর্তন করা হয়নি।
জিয়াউর রহমানই একমাত্র ব্যক্তি যিনি কোনো সভ্য দেশে সর্বপ্রথম বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করেন এবং বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করেন। অপরাধীদের বিচার না করে জিয়া আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা অপরাধীদের বিচার করে আল্লাহর নির্দেশ পালন করেছেন এবং দেশ ও জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘কেউ কোনো অপরাধ করলে তার দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে, অন্য কেউ সে জন্য দায়ী হবে না।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৬৪)। আল্লাহর নির্দেশ অমোঘ, অলঙ্ঘনীয়। মরণোত্তর হলেও প্রত্যেক অপরাধীর বিচার করা জাতীয় কর্তব্য।

শাহ্জাহান কিবরিয়া : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়