অক্সিজেন ঘাটতি নিয়ে রওশন এরশাদ আইসিইউতে

আগের সংবাদ

এবার লক্ষ্য কূটনৈতিক জয় : তালেবানের ওপর বাড়ছে আন্তর্জাতিক চাপ >> চ্যালেঞ্জের মুখে ভারত

পরের সংবাদ

১৫ আগস্ট শুধু হত্যাকাণ্ডই নয় স্বাধীনতার স্তম্ভে আঘাত

প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রাচীন ভারতবর্ষ তথা বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হলো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত প্রণব মুখার্জি তার সর্বশেষ বাংলাদেশ সফরে এসে বক্তৃতার এক পর্যায় এমন একটি বিষয় উল্লেখ করেছিলেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা আরোহণের উপায় হিসেবে কিংবা সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল জনগণের ভ্রান্ত উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কখনো কখনো এসব দেশে হত্যাকাণ্ডকে বেছে নেয়া হয়েছে। পরিবারে সদস্য, নিকট আত্মীয়, রাজনৈতিক কুচক্রী মহল, ছদ্মবেশী ঘাতক, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র প্রভৃতি বিষয় এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল বলে ইতিহাসে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে ওইসব হত্যাকাণ্ড থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ও তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু একা নয়, সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, যা ইতিহাসে বিরল। ভোর রাতে ঘুমন্ত মানুষদের জাগিয়ে তুলে বাড়ির সবাইকে হত্যা করা হয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ড শুধু কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নয়; এর ভেতরে লুকিয়ে ছিল আরো বড় ক্ষোভের জ¦ালা। সেটি হলো এই ৩২ নম্বর বাড়িতে বসেই শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাতে পাকিস্তান ভেঙে পূর্ব পাকিস্তানের নিষ্পেষিত মানুষের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই কষ্ট, সেই ক্ষোভ পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকরা ও পূর্ব পাকিস্তানে তাদের দোসররা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। অর্থাৎ এই হত্যাকারীরা শুধু যে শেখ মুজিবুর রহমানের শত্রæ ছিল তা নয়; স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের শত্রæ ছিল। এই ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শেষ করতে চায়নি; এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্তম্ভকে ভেঙে ফেলে স্বাধীনতার মূল চেতনাকে ধূলিসাৎ করতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কিছু দিন পর তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো তার এক বক্তৃতায় বলেছিল- ভেরি সুন বাংলাদেশ উইল বি আওয়ার ফেডারেশন। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের পরে পাকিস্তানি দোসরদের যে অংশটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছিল তারা সুপরিকল্পিতভাবে পাঠ্যবইসহ সব জায়গা থেকে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ, জয় বাংলা ইত্যাদি মুছে ফেলার পাশাপাশি আবহমান বাঙালি সংস্কৃতিতে সমূলে আঘাত করতে শুরু করেছিল। এমনকি ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল স্পিরিটকে বিনষ্ট করে এসব সামরিক জান্তারা এদেশে স্বৈরশাসন কায়েম করেছিল। এ কারণে অনেক জ্ঞানী-গুণীজন কখনো কখনো বলে থাকেন যে, ১৯৭৫ সালের পরে বাংলাদেশে যাদের জন্ম হয়েছে, তারা স্বৈরশাসকদের তৈরি করা বিকৃত ইতিহাসের জাঁতাকলে দেশের প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং এরা যে বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে পারিবারিকভাবে কিছু ছেলেমেয়ে দেশপ্রেমিক পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও আদর্শ জানতে পেরেছিল এবং তা ধারণ ও লালন করতে সক্ষম হয়েছে বলে আজ আবার মূল ধারার ইতিহাস চর্চার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও স্বাধীনতাবিরোধী, ক্ষমতালিপ্সু সেই গোষ্ঠীচক্র এখনো সমাজে সোচ্চার রয়েছে এবং সুযোগ পেলেই তারা আবার পূর্বের ন্যায় বর্বরতার মাধ্যমে মূল ধারার রাজনৈতিক গতিশীলতাকে সংকটে ফেলে দিতে পারে। তাই এদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতবার্ষিকীতে আমাদের মহান নেতার বিদেহী আত্মার প্রতি শান্তি কামনার পাশাপাশি আমাদের প্রত্যয় হওয়া উচিত, আর যেন বাংলাদেশের মাটিতে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড না হয় এবং বেদনার নীল দংশনে বাঙালি জাতিকে আর যেন জর্জরিত হতে না হয়। পার্থিব জগতের একজন মানুষের জীবনের লক্ষ্য সাধারণত কি হয়? ভালো আয়-রোজগার বা ভালো একটি চাকরি, ভালো একটি বাড়ি, সুখী দাম্পত্য জীবন, কিছু ধন-সম্পদ সঞ্চয় করা। আর এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের লক্ষ্য কি ছিল? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনের লক্ষ্য ছিল অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা। একজন মানুষের ব্যক্তি জীবনের লক্ষ্য যদি হয় সমগ্র মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন, সমগ্র মানুষের ন্যায্যতা আদায় করা, সমগ্র মানুষের মুখে হাসি ফুটানো একে কি আপনি বিশ্ব মানবতার আদর্শ বলবেন না? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৫ বছরের সংগ্রামী জীবনের প্রতিটি ধাপে শৈশব, কৈশোর, যৌবন- এমনকি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার রেখে যাওয়া কৃতকর্ম থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। তিনি সর্বদাই ছিলেন মানবতার পক্ষে। মনে রাখা দরকার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের লক্ষ্য (বঙ্গবন্ধুর ভাষায় জীবনের সাধ) পূরণ হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কিন্তু তিনি জীবনের স্বপ্ন পূরণ করে যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমনি এমনি আসেননি, তাকে সময়ের প্রয়োজনে, মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে এদেশের রাজনীতিতে আসতে বাধ্য করা হয়েছিল। কী দরকার ছিল, নিজ পরিবারের ওপর এত বড় মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটার পরও আবার এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেয়া। তিনি অন্য ১০ জনের মতো পারতেন ছেলেমেয়েদের বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করে নিজেও শেষ জীবনাটা সুখেই কাটিয়ে দিতে। কিন্তু সেটা তিনি করেননি। কেন করেননি? এখানেও তিনি বাবার মতোই নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে মানুষের কথা ভেবেছেন। বাবার রেখে যাওয়া অপূর্ণ স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়নের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে এদেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয়েছে। আজ তিনি বাবার সেই স্বপ্ন পূরণে সক্ষমতার নিদর্শন দেখিয়ে যাচ্ছেন। বিদেশিদের কাছে তলাবিহীন ঝুড়ির সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, তারই একটি সংক্ষিপ্ত নমুনা তুলে ধরছি। ১৯৭২-৭৩ সালে এদেশের বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি, যা ২০২০-২১ সালে ৫,৬৮,০০০ কোটি হয়েছে, দরিদ্রতার হার ১৯৭৩-৭৪ সালে ছিল ৮২.৯ শতাংশ, যা ২০১৯ সালে ২০.৫ শতাংশ হয়েছে, ১৯৭১ সালে এদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর, যা ২০১৯ সালে ৭২.৬ হয়েছে, ১৯৮০ সালে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫.২৬ শতাংশ, যা ২০২০ সালে এসে ১১.৬৯ শতাংশ হয়েছে, ১৯৭৫-৯০ সালে গড়ে জিডিপি গ্রোথ রেট ছিল ৩.২ শতাংশ, যা ২০১০-১৯ সালে গড়ে ৬.৮ শতাংশ হয়েছে, ১৯৭২ সালে এ দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ৯৪.৩৮ মার্কিন ডলার, যা ২০১৯ সালে বেড়ে হয়েছে ১৮৫৫.৭৩ মার্কিন ডলার। একজন মানুষ যে কোনো রাজনৈতিক দলকে অপছন্দ করতেই পারে কিন্তু সে সুস্থ চিন্তার মানুষ হলে কোনো শাসন ব্যবস্থার বিদ্যমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন সূচকগুলোকে অস্বীকার করতে পারে না। কাজ করতে গেলে ভুল হয়, যারা কাজ করে না তাদের ভুলও হয় না। আসুন শোকাহত বেদনা নিয়ে আর একবার শপথ করি, আমরা সবাই অপরাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করব এবং এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সমুজ্জ্বল রাখতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করব।
বিজন হালদার : শিক্ষক ও গবেষক।
Email: [email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়