অক্সিজেন ঘাটতি নিয়ে রওশন এরশাদ আইসিইউতে

আগের সংবাদ

এবার লক্ষ্য কূটনৈতিক জয় : তালেবানের ওপর বাড়ছে আন্তর্জাতিক চাপ >> চ্যালেঞ্জের মুখে ভারত

পরের সংবাদ

আফগানিস্তানে তালেবানি শাসন আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতির জন্য হুমকি

প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলে শেষ পর্যন্ত তালেবানদের খুব বেগ পেতে হলো না। ১৫ আগস্ট তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কব্জায় নিতে সক্ষম হয়েছে তালেবান বাহিনী। বিভিন্ন প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নিতে কিছু শক্তি ও রক্তক্ষয় হলেও কাবুল দখল হয়েছে বিনা প্রতিরোধে। প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ‘রক্তপাত এড়ানো’র কথা বলে কার্যত পালিয়েছেন। তার বাহিনীর যে তালেবানদের গতি রোধের ক্ষমতা ছিল না- সেটা বুঝতে পেরে তিনি পালিয়ে বেঁচেছেন। যাবার সময় চার গাড়ি এবং হলিকপ্টার ভর্তি করে টাকা নিয়ে গেছেন বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আফগান জনগণের কথা নয়, শাসনকালে আশরাফ গনি যে নিজের আখের গোছানোর কথাই বেশি ভেবেছেন, তা এখন স্পষ্ট হচ্ছে। তবে এসব তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার কিনা তা বুঝতে আরো সময় লাগবে। আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে, তালেবানদের ক্ষমতা দখলের কারণে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে তা নিয়ে চলছে এখন নানা ধরনের আলোচনা, বিশ্লেষণ।
তবে কাবুলে যে ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে, মানুষ ভয়ে, আতঙ্কে দেশ থেকে পালাতে বিমানবন্দরে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, বিমান থেকে পড়ে তিনজনের মৃত্যুর দুঃখজনক খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসেছে। প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে কতজনকে এমন অসহায় মৃত্যুবরণ করতে হবে কে জানে!
মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে আফগানিস্তানে তালেবানি শাসন আবার ফিরে আসছে! তবে সেটা যে সেপ্টেম্বর মাসে শেষ মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের আগেই ঘটবে তা হয়তো কেউ ভাবেনি। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও হয়তো এমনটা ভাবেননি। আমেরিকা যে গত ২০ বছর ধরে এত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করল আফগানিস্তানে গণতন্ত্র ও মানবিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, কত মার্কিন সেনাকে জীবন দিতে হলো, তার সবই আসলে পানিতে গেল। আফগানিস্তানে আমেরিকার কোনো অর্জন নেই, সবই বিসর্জন। তাদের সাহায্য নিয়ে আফগান সরকার যেমন তার জনভিত্তি সবল করতে পারেনি, তেমনি আফগান সরকারি সৈন্যবাহিনীও আমেরিকার আধুনিক সমরাস্ত্র সাহায্য নিয়েও তালেবানদের সঙ্গে গেরিলা কিংবা সম্মুখযুদ্ধে পেরে ওঠার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। উল্টো দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে লড়াই করার নৈতিক মনোবল হারিয়েছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আমেরিকাকে আফগানিস্তানে বড় পরাজয় মানতে হলো। মোটামুটিভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আফগানিস্তানে আবার তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হলেও দেশটি শান্তিপূর্ণ পথে চলবে কিনা সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। তালেবানের অতীত নিষ্ঠুরতার রেকর্ড মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। কাবুলের কিংবা শহরাঞ্চলে ক্ষমতা পাওয়া মানেই পুরো দেশের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ পাওয়া নয়। আফগানিস্তানের ভূ-প্রকৃতি যেমন এক রকম নয়, তেমনি সেটা বহু জাতি-উপজাতি-গোত্রের সমন্বয়ে গঠিত একটি দেশ। আফগানিস্তানে কেন্দ্রীয় শাসন কোনো সময় প্রাতিষ্ঠানিক একটি শক্ত ভিত্তি পায়নি। বিভিন্ন জাতি-উপজাতি ও গোত্র এক ধরনের স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে এসেছে। সেখানে তালেবানরা শুধু শরিয়া আইনের ঐক্যসূত্রে পুরো দেশটিতে তাদের শাসন সংহত করতে পারবে কিনা, দেখার বিষয় সেটাও। আগের ৬ বছরের শাসনকালে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক গোষ্ঠী তালেবানরা কঠোর বিধিনিষেধ আর যে জবরদস্তির শাসন শুরু করেছিল, বিরোধী মতাদর্শে বিশ্বাসীদের প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, শিয়াসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, নারী শিক্ষা বন্ধ, বামিয়ানের অমূল্য প্রাচীন পাথুরে বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসসহ সভ্যতা, শিল্পসংস্কৃতির ঐতিহ্য গুঁড়িয়ে যেভাবে তাণ্ডব চালিয়েছিল, সে ভীতিকর অবস্থার কথা এখনো শান্তি ও প্রগতিকামী বিশ্ববাসীর স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। তালেবানরা নারী শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রবেশের অধিকারে বিশ্বাস করে না। বলা হয়ে থাকে তালেবানরা বর্বরতা ও পশ্চাৎপদ চিন্তায় বিশ্বাসী। আধুনিকতা তথা সভ্যতা পরিপন্থি এই শক্তি এখনকার বিশ্ববাস্তবতায় শাসকের ভূমিকায় নেমে কীভাবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জায়গা করে নিতে পারে, দেখার বিষয় সেটাও। তবে প্রাথমিক যে খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু নেই। তারা অনেকটা আগের ধারায়ই চলছে। বিদেশি গণমাধ্যমে নারীদের যেসব সাক্ষাৎকার প্রকাশ পাচ্ছে তা থেকে তালেবানদের পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল হওয়ায় ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে আফগানিস্তানের গুরুত্ব অনেক। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাবক দেশগুলো যেমন আমেরিকাসহ ইউরোপীয় দেশগুলো, চীন, রাশিয়া, জাপান এবং ভারত তালেবান সরকারের প্রশ্নে কী অবস্থান গ্রহণ করে তা একটি বড় বিষয়। বাইরের কোনো বড় রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনো বিশেষ মত-পথের কোনো সরকারই ক্ষমতা নির্বিঘœ করতে পারে না। নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে এখন দেশে দেশে সম্পর্ক নির্ধারিত হয় না। এখন সম্পর্ক নির্ধারণের মাপকাঠি অর্থনৈতিক, অন্যান্য স্বার্থ ও সুবিধা। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে বর্তমান বিশ্ব বড় ধরনের আতঙ্ক ও সংকটে আছে। অথচ তালেবানরা জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের জনক বলে মনে করা হয়। ফলে তালেবানদের ক্ষমতার পথ একেবারে নিষ্কণ্টক নয়।
আফগানিস্তানের এক বৃহৎ প্রতিবেশী এবং বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক সুপারপাওয়ার চীনের সঙ্গে বোঝাপড়ার নীতি নিয়েছে তালেবানরা। আবার চীনও তালেবানদের সঙ্গে চলার নীতি নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। চীন আফগানিস্তানের ওপর ভর করে আঞ্চলিক আধিপত্য তৈরির সুযোগ কাজে লাগাতে চায়। গত মাসে একটি বড় তালেবান প্রতিনিধি দল চীন সফর করে চীনা নেতৃত্বের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের আশ্বস্ত করে এসেছে যে, আফগান ভূখণ্ডকে তারা বাইরের কোনো দেশের সন্ত্রাসী বা জঙ্গিগোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে দেবে না। রাশিয়ার সঙ্গেও তালেবান প্রতিনিধিরা কথা বলেছেন। ভারতও তালেবানদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বা করার চেষ্টা করছে বলে শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ ক্ষমতা দখলের আগেই তালেবানরা এটা প্রমাণ করতে পেরেছে যে, তারা আসছে এবং তারা অপ্রতিরোধ্য। তবে বাইরে বাইরে যে যেমন ভাবই দেখাক না কন, ভেতরে ভেতরে তালেবানদের নিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে দুশ্চিন্তা এবং অস্বস্তি আছে। কারণ হয়তো ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু উদ্বেগ আছে ঠিকই। চীনের এবং ভারতের বড় বিনিয়োগ আছে আফগানিস্তানে। আফগানিস্তানের বড় বন্ধু পাকিস্তান। পাকিস্তানের সঙ্গে চীন এবং ভারতের সম্পর্ক বিপরীত মাত্রার। চীন পাকিস্তানের চিরসখা। ভারত চিরবৈরী। চীন নিজ দেশের নিরাপত্তার জন্য ইসলামি জঙ্গিবাদকে হুমকি বলে মনে করে। চীন ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী নিয়ে একেবারে ভীতিমুক্ত নয়। উইঘুর মুসলিমরা চীনের গলার কাঁটা। আফগান সেখানে জঙ্গিগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা দেয় কিনা তা নিয়ে চীনের স্বাভাবিক দোলাচল আছে। আবার তালেবানের মদদে কাশ্মিরে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ভীত ভারত। সব মিলিয়ে ২০ বছর পর আফগানিস্তান আবার তালেবানের দখলে যাওয়ায় তার প্রতিক্রিয়া শুধু আফগান ভূখণ্ডের মধ্যেই সীমিত থাকছে না। তা প্রতিবেশী দেশগুলো ছাড়াও আরো অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেও প্রভাবিত করবে। ভারতের জন্য বড় সমস্যা হতে পারে ভেবে পাকিস্তান বগল বাজালেও তালেবানি শাসন পাকিস্তানের ভেতরেও অস্থিরতা বাড়াতে পারে।
আফগানিস্তান তালেবানের দখলে যাওয়ায় বাংলাদেশে দুধরনের প্রতিক্রিয়া আছে। কেউ কেউ নতুন করে দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আশঙ্কায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আবার কেউবা উল্লসিত, উজ্জীবিত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা আফগানিস্তানে ক্ষমতা বদল নিয়ে ভাবনায় পড়েছেন। এত দ্রুত আফগানিস্তান তালেবানদের দখলে যাবে সেটা অনেকের ধারণার বাইরে ছিল। এ ঘটনায় দেশীয় জঙ্গিরা উৎসাহিত হতে পারে। এর আগে আফগান ফেরতরাই দেশে জঙ্গি সংগঠন গঠন করে দেশে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছিল। বিভিন্ন নামে সংগঠন গড়ে দেশজুড়ে কয়েকটি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়ে তারা তাদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে। সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা, আদালতে হামলা, বিচারক হত্যাসহ দেশের কয়েকটি জায়গায় শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার হুমকি দিয়েছিল। মুক্তচিন্তার অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিদের হত্যা করে আতঙ্ক ছড়াতে সক্ষম হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের জঙ্গিবাদবিরোধী কঠোর অবস্থান এবং জঙ্গিবিরোধী কয়েকটি সফল অভিযানের ফলে এখন জঙ্গিরা দুর্বল হলেও তাদের তৎপরতা বন্ধ হয়নি। এখন আফগান তালেবানদের সঙ্গে বাংলাদেশি উগ্রবাদীদের নতুন করে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে না। নিষিদ্ধ ঘোষিত এক জঙ্গি সংগঠনের ১০ সদস্য এর মধ্যেই আফগানিস্তানে গেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। পুলিশের তৎপরতায় আরো কয়েকজনের যাওয়া সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যেও তালেবানের খাতায় নাম লেখানোর আশঙ্কা রয়েছে। তালেবান উত্থান ও প্রভাব নিয়ে আতঙ্কের পরিপ্রেক্ষিতে একজন তালেবান নেতা দৈনিক প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশের কোনো দল বা সংগঠনের সঙ্গে তালেবানের কোনো সম্পর্ক নেই। আফগানিস্তানের বাইরে তাদের কোনো এজেন্ডা নেই। আফগানিস্তানের বাইরে তাদের কোনো গোষ্ঠী বা অনুসারী না থাকার যে কথা বলা হচ্ছে তা কতটুকু সত্য বা বিশ্বাসযোগ্য তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে সময়রের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তালেবানদের ভাবনা-চিন্তা ও কর্ম পদ্ধতিতে সত্যি কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা লক্ষ করার বিষয় সেটাই। তালেবানদের ব্যাপারে আরব ও মুসলিম দেশগুলোর অবস্থান অভিন্ন নয়। কারো ওপরে বোঝা না হওয়ার কথা তালেবান নেতা বললেও আফগানিস্তান তালেবানি শাসনে কারো শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতির জন্য হুমকি হয়ে ওঠে কিনা সে পরীক্ষা তাদের দিতে হবে।
বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়