বিজিএমইএ : সব স্থলবন্দর দিয়ে ইয়ার্ন আমদানির সুযোগ দাবি

আগের সংবাদ

করের আওতায় আসছেন ব্যাংকের কার্ডধারীরা!

পরের সংবাদ

সিরিজ বোমা হামলার এই দিনে

প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বেলা ১১ থেকে ১১টা ৩০ মিনিটের মধ্যে মুন্সীগঞ্জ ছাড়া বাকি সব (৬৩ জেলা) জেলার ৩০০টি জায়গায় ৫ শতাধিক বোমার আওয়াজে সাধারণ মানুষ হতচকিত হয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। চারদিক থেকে বোমা হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। কোথাও কোথাও মানুষ আহত হওয়ার খবরও শোনা যাচ্ছিল। দুজনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে বেশ কিছুটা পরে। কিন্তু কারা করল এমন বোমাবাজি, কেন করল- এর উত্তর তাৎক্ষণিকভাবে অনেকেরই জানা ছিল না। এর উত্তর পেতে কিছুটা সময় লেগেছে। তবে সেই সময় দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ও তাদের বোমা হামলার কথা মানুষের অজানা ছিল না। জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ তথা জেএমবি একটি উগ্রবাদী সংগঠনের বেশ দুর্দান্ত প্রতাপ দেশব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিল। শায়খ আব্দুর রহমান এবং সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই তখন গোটা দেশেই যে ধর্মীয় উগ্রবাদের আড়ালে বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উপাসনালয় আক্রমণ, বোমাবাজি এবং বাংলাদেশকে একটি তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করার হুঙ্কার দিয়ে যাচ্ছিল সেটি গণমাধ্যমের কল্যাণে দেশবাসী এমনকি আন্তর্জাতিক মহলেও বেশ আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। তখন ক্ষমতায় ছিল চারদলীয় জোট সরকার। জোট সরকারের অন্যতম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামের নেতা এবং মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাই’ বলে কেউ নেই, ওটি মিডিয়ার সৃষ্টি। বুঝাই যাচ্ছিল জামায়াত এদের আগে থেকেই পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে আসছে। এমনকি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলা, কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টায় বোমা পুঁতে রাখা, নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলা, সিপিবির জনসভায় বোমা হামলা, রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা হামলাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আকস্মিকভাবে গুপ্ত সংগঠনের আদলে কে বা কারা বোমা হামলা করে পালিয়ে যাচ্ছিল সেটি অনেকের কাছেই তখন অজানা ও অস্পষ্ট ছিল। কারণ এ ধরনের গুপ্ত হামলার কথা তখন সরকার কিংবা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অনুমান করতে পারেনি, পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত তাদের হাতে ছিল বলে মনে হয় না। বরং সেই সময়ের এসব হামলায় আহত, নিহত ও পণ্ড হওয়া অনুষ্ঠান সম্পর্কে নানাজনের নানা ধরনের অনুমানভিত্তিক অভিযোগ ছিল। কেউ কেউ সরকারি দল কিংবা কোনো কোনো ব্যক্তির দিকে অভিযোগের আঙুল উঁচিয়ে ধরতেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্র রাজনীতির ভেতরে তখন জেএমবি সংগঠনের নাম উচ্চারিত হলেও তারা গুপ্ত সংগঠনের মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে বা তেমন ক্যাডার বাহিনী তাদের এসব বোমাবাজির সঙ্গে জড়িত হয়েছে সেটির ধারণা করতেই অনেকে পারছিল না। কিন্তু ২০০১ সালের পর জেএমবি আর গোপনে থাকেনি। তারা অনেকটাই প্রকাশ্যে হুমকি-ধমকি এবং অসাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে তাদের ‘জিহাদের’ কথা উচ্চারণ করতে থাকে। দেশে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিজয়ী জোটের নেতাকর্মীরা দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, ভোটার এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আক্রমণ, হত্যা, নির্যাতন, দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার ভয়ভীতি প্রদর্শন, বাংলাদেশকে আওয়ামী মুক্ত, ভারতীয় প্রভাবমুক্ত এবং ধর্মীয় ভাবাদর্শের রাষ্ট্রে পরিণত করার আস্ফালন দেখানো হচ্ছিল। অনেক জায়গাতেই নারী ধর্ষণ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা, বাউলদের আখড়া, সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ, থিয়েটার তথা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বহুলাংশেই বাধাগ্রস্ত এমনকি নিষিদ্ধও হতে থাকে। এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী এস এম কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার, মমতাজউদ্দিন, অধ্যক্ষ গোপালকৃষ্ণ মহুরি, সাংবাদিক নেতা হুমায়ুন কবীর বালুসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। এর ফলে বোঝা যাচ্ছিল যে চারদলীয় জোট সরকারের অন্যতম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নানা ধরনের গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গি গোষ্ঠী বাংলাদেশে বেশ আগে থেকেই গোপনে বেশ সক্রিয় ছিল। এগুলোতে ছাত্রশিবিরের কোনো কোনো নেতা নেতৃত্বও দিয়েছিল। তাছাড়া আশি ও নব্বইয়ের দশকে আফগানফেরত বেশ কিছু সশস্ত্র জঙ্গিবাদী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাংলাদেশে মাঝে মধ্যে ‘আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ সেøাগান উচ্চারণ করত। এদের ভিন্ন ভিন্ন নাম থাকলেও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের নিকটবর্তী বা দূরবর্তী সম্পর্ক কতটা সেটি অনেকেই খতিয়ে দেখেনি। কেউ কেউ হয়তো বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে অনুসন্ধান করে পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপাত। কিন্তু বৃহত্তর সমাজে এ ধরনের গুপ্ত তৎপরতার বিষয়ে রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল না। সে কারণেই ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের জঙ্গিবাদী নানা গুপ্ত ঘটনার বহিঃপ্রকাশ নিয়েও সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরিষ্কার কোনো ধারণা গড়ে উঠতে দেখা যায় না। অনেকেই একে অপরকে অভিযুক্ত করে বক্তৃতা-বিবৃতি করতেন। এর ফলে আড়ালে থেকে যেত গোপনে বেড়ে ওঠা নানা জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা। সেটি ২০০১ সালের নির্বাচনের পর চারদলীয় জোট সরকার গঠিত হলে গোপন থাকেনি, প্রকাশ্যে বের হয়ে আসে। জোট সরকারের প্রধান দল বিএনপি জামায়াতের ওপর নির্ভরশীল থাকায় জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিকাশে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। জামায়াত জেএমবিকে অস্বীকার করার মাধ্যমে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দানের বিষয়টি বোধগম্য হয়ে ওঠে। এই শক্তি ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সারাদেশেই তাদের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে সক্ষম হয়। সেই সক্ষমতার ওপর ভর করেই ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবি একসঙ্গে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা চালায়। এটিই স্বদম্ভে তাদের আত্মপ্রকাশ ঘটানোর ঘটনা। পাঁচ শতাধিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তারা ৩ শতাধিক জায়গায়। এতে ঘটনাস্থলে দুজনের মৃত্যু ও শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। তাদের কেউই তাৎক্ষণিকভাবে ধরা পড়েনি।
১৭ আগস্টের এই বোমা বিস্ফোরণের পর তাদের বোমাবাজির ঘটনা থেমে থাকেনি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক আক্রমণ সংগঠিত হতে থাকে। এ সময়ে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় আদালতপাড়া। ৩ অক্টোবর চাঁদপুর, ল²ীপুর ও চট্টগ্রামের জেলা আদালতে আইনজীবী ও বিচারকদের লক্ষ্য করে এজলাসে বোমা নিক্ষেপ করে। ১৯ অক্টোবর সিলেটের দ্রুত বিচার আদালতে বিচারক বিপ্লব গোস্বামীকে হত্যা করতে বোমা হামলা চালায়। শুধু আদালতেই নয়, বিচারকদের বাসভবনও জঙ্গিদের নজরদারিতে চলে আসে। ১৫ নভেম্বর ঝালকাঠির অফিসার্স পাড়ায় জাজেস কোয়ার্টারের সামনে বিচারকদের বহনকারী মাইক্রোবাসে বোমা হামলা চালায়। এতে নির্মমভাবে নিহত হন বিচারক সোহেল আহমেদ চৌধুরী এবং জগন্নাথ বাড়ৈই। এ ঘটনায় সারাদেশে যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তা জোট সরকারের প্রতি মানুষের অনাস্থাকে বাড়িয়ে দেয়। শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, দেশের বাইরেও বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের তাণ্ডব নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়। কোনো কোনো বিদেশি সংস্থা বাংলাদেশকে একটি জঙ্গিবাদী তালেবানি রাষ্ট্রের পথে হাঁটার অবস্থানে দেখতে পায়। বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে যাচ্ছে এমন মন্তব্যও পৃথিবীর কোনো কোনো দেশ থেকে করা হতে থাকে। সরকার দেশের অভ্যন্তরের জনমতের চাপে নয় বরং বিদেশি রাষ্ট্র সংস্থাগুলোর তির্যক মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য হয়। জঙ্গিদের এসব বোমা হামলার মামলা তখন দায়ের ও গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সেই সময় মোট ১৬১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। দেশে ও বিদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় সরকার বাধ্য হয় চিহ্নিত জঙ্গি নেতাদের আস্তানা খুঁজে বের করতে এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে। উল্লেখযোগ্য জঙ্গি নেতারা ছিল শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ আরো অনেকে। তাদের দ্রুত বিচার আইনে আদালত মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে, সেটি কার্যকরও হয়। কিন্তু জেএমবি ছাড়াও আরো কিছু ভিন্ন নামে জঙ্গিরা তখন বিভক্ত হয়ে সমাজের বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে পড়ে। সেটি রোধে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। সরকারের মেয়াদও তখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে চারদলীয় জোটের মধ্যে আস্থা ছিল যে, তারা আবার যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে। সে কারণেই পরবর্তী নির্বাচনকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ধরে রাখার জন্য সংবিধান পরিবর্তন করে প্রধান বিচারপতিদের বয়স দুই বছর বাড়ানো, নির্বাচন কমিশনকে নিজেদের ইচ্ছামতো ঢেলে সাজানো, ভুয়া ভোটার তালিকা প্রণয়ন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সদস্যদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়। কিন্তু দেশব্যাপী ওই সরকারের এসব উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ তৈরি হওয়ায় একদিকে মহাজোট গঠিত হয়, অন্যদিকে চারদলীয় জোট সরকারের সব অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য গণআন্দোলন শুরু হয়। আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাদেশ তখন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি গভীর পর্যবেক্ষণে ছিল। তাছাড়া জঙ্গিবাদের যেই উত্থান সরকারের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে দেশব্যাপী ঘটেছিল, তার ফলে শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংকটই বৃদ্ধি পাবে না, ভূরাজনৈতিকভাবেও এ অঞ্চলে একটি অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হবে, যার নজির জোট সরকারের আমলে কয়েক ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়া, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে এখানকার গোপন সংগঠন ও সরকারের কোনো কোনো মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে জঙ্গিবাদকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ তখন ভয়ানক এক ভূরাজনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হতে যাচ্ছিল, ২০০৯ সালের পর জঙ্গিদের কৌশল পরিবর্তীত হলেও তাদের কর্মকাণ্ড নতুনভাবে এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে বেড়েই চলছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার শুরু থেকেই জিরো টলারেন্সের যেই নীতি অনুসরণ করেছিল তার ফলে জঙ্গিরা বড় ধরনের চাপে পড়েছিল। হলি আর্টিজান ঘটনার পর সরকার দৃঢ়ভাবে এদের মোকাবিলা করে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ মর্যাদাপূর্ণ সমর্থন লাভ করে। এখন আমাদের প্রয়োজন হচ্ছে নিজেদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য জঙ্গিবাদী এই উগ্রপন্থার মতাদর্শের হাত থেকে আমাদের তরুণদের মুক্ত রাখা, দেশকে বাঁচিয়ে রাখা।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়