বিজিএমইএ : সব স্থলবন্দর দিয়ে ইয়ার্ন আমদানির সুযোগ দাবি

আগের সংবাদ

করের আওতায় আসছেন ব্যাংকের কার্ডধারীরা!

পরের সংবাদ

কেন পরীমনিকে নিয়ে লিখছি

প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম পরীমনিকে নিয়ে। লিখেছিলাম পরীমনিকে উদ্দেশ করে যেন তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখেন। রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে সবার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা। পরীমনি একজন সংস্কৃতিকর্মী এবং সর্বোপরি বাংলাদেশেরই একজন নাগরিক। নিশ্চয়ই রাষ্ট্র তার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করবে। কিন্তু পরীমনির সম্মান, মর্যাদা রক্ষা করা হয়নি বলে ধারণা। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ছিল, মদ, মাদক সেবন, ক্লাবে যাওয়া, কারোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা ও তাদের কাছ থেকে উপহারসামগ্রী গ্রহণ করা ইত্যাদি। কতটা অসহনীয় অভিযোগ তা পরিমাপ ও প্রমাণিত হওয়ার আগেই অপরাধীর অপবাদ তাকে নিতে হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারো কারো মুখে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় পরীমনির অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগও বারবার উচ্চারিত হয়েছে। ফেসবুকে প্রশ্ন রেখেছিলাম, ক’টা নৈতিক সম্পর্ক সমাজে আছে সেই হিসাব কারোর জানা আছে কিনা। যেসব পুরুষ অনৈতিক সম্পর্ক ফেরি করে বেড়ায় তাদের কথা কিন্তু কেউ বলেন না। তাদের দিকে আঙুল তুলে কেউ দেখায় না। যখন জানলাম, যেসব ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীর সঙ্গে তার সখ্য ছিল কিংবা তার বাসায় যাতায়াত করতেন তাদের নাম প্রকাশ করা হবে না। কারণ তারা প্রভাব-প্রতাপে সমাজে মর্যাদার লেবাসে থাকেন। সামাজিক লজ্জায় ভীতু হয়ে আছেন, তখন বিব্রত ও হতাশ হলাম। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে চরম লজ্জিত হলাম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে যেন সেসব পুরুষকে অভয় দেয়া হলো। অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দেয় হলো। এ যেন সাধারণ ক্ষমা! হতভম্ব হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিয়েছিলাম এই ভেবে যে, নারীর সম্মান রক্ষা করার চিন্তা কারোরই হলো না, পুরুষের সম্মান ঠিকই রক্ষা করা হলো। যারা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী পুরুষ। এই রাষ্ট্র কী তবে কেবল পুরুষেরই? অথচ পরীমনি বাংলাদেশের একজন নারী সংস্কৃতিকর্মী, চলচ্চিত্রের আবেদনময়ী একজন নায়িকা। যিনি ৩০টির মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন বলে শুনেছি। গিয়াসউদ্দিন সেলিম, তৌকীর আহমদ, কাজী হায়াত, চয়নিকা চৌধুরীর মতো স্বনামখ্যাত নির্মাতার ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন এবং তার হাতে রয়েছে আরো ক’টি ছবি। একজন শিল্পী হিসেবেও তার সম্মান, মর্যাদা বিন্দুমাত্র রক্ষা করা হয়নি। রক্ষা করার কথা ভাবা হয়নি। উপরন্তু পুরুষতন্ত্রের নৃশংসতা দেখানো হলো। রাষ্ট্র তো নারী-পুরুষ উভয়েরই। আইনও সবার জন্য প্রযোজ্য, নাকি? আর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই প্রোপাগান্ডায় পরীমনি অপরাধী হয়ে গেলেন!
আইনের ঊর্ধ্বে তো কেউ নন। যিনি বা যারা তদন্ত করছেন, তারাও নন। অনেকের মনে সংশয় জেগেছে, আইনের ব্যবহার সঠিকভাবে হচ্ছে তো। নিজ বাসা থেকে পরীমনিকে যেভাবে তুলে আনা হলো, তাতে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছিল, জঙ্গি আস্তানায় হামলা চলছে কিনা। জঙ্গি ধরার চেষ্টা চলছে কিনা। কিংবা নাশকতামূলক ভয়াবহ কোনো দুর্ঘটনা থেকে দেশকে রক্ষার চেষ্টা চলছে কিনা। সঙ্গে কী সাংঘাতিক মিডিয়া ট্রায়াল। মদ, মাদক রাখার দায়ে একজন অল্পবয়সি সুশ্রী নারী চলচ্চিত্র শিল্পীকে যেভাবে এবং যতজন টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলেন আদালতে তাতে রাষ্ট্রের বিবেক নিয়ে সংশয় দেখা দিল নতুন করে। কিছুদিন আগে প্রথম আলোর একজন সিনিয়র নারী সাংবাদিককেও একই কায়দায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আদালতে। সেইদিনও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলাম। যা হোক পরীমনির ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে একজন প্রশ্ন করলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়ন ইত্যাদি ইস্যু থাকতে, সেসব নিয়ে অনেক কিছুই লেখার থাকতে, পরীমনিকে নিয়ে কেন লেখা?
প্রশ্নটা আমার কাছে পুরুষশাসিত লেগেছে। যেন এই অল্পবয়সি নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখা মানে বড় অপরাধ করে ফেলা। কিংবা তাকে নিয়ে লেখা মোটেও উচিত নয়। এ ধরনের মনমানসিকতার ব্যক্তিদের জন্য করুণা হয়। এদের বোধশক্তি নিয়েও সংশয় আছে। তিনি তার জ্ঞান দিয়ে বুঝলেন না যে, এ তো শুধু নিছক একজন পরীমনির ঘটনা নয়, এ হলো রাষ্ট্রে নারীর অবস্থানের একটা খণ্ডচিত্র মাত্র। নারীর প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও নারীর সাংবিধানিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হওয়ার নির্মম গল্প। অর্থ ও প্রভাব দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্র কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, তারই আশঙ্কার গল্প। এই অবস্থার শিকার তার পরিবারের কোনো নারী সদস্যও কখনো হতে পারেন। নারীকে বাদ দিয়ে পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজ কী চলেছে নাকি চলবে? নিশ্চয়ই না। চলেনি কখনো। মানবসভ্যতা তার বড় সাক্ষী। পরীমনির ঘটনার মাঝে রাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠানের অসঙ্গতির ইঙ্গিত রয়ে যায় বলে অনেকে মনে করেন। পুরুষতন্ত্রের আঘাতের চিহ্ন আছে, যা উন্নয়ন ধারার সঙ্গে যায় না। মানায় না। মানবমর্যাদা সুরক্ষিত হয় না।
আমি পরীমনিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তাকে হেনস্তা করার আগে তার অভিনীত কোনো ছবিও দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তাকে হেনস্তা করার পর তার ক’টি ছবি দেখেছি। অভিভূত, মুগ্ধ হয়েছি তার অভিনয় দেখে। আমার জানা নেই, বর্তমান চলচ্চিত্র অঙ্গনে এত সুশ্রী ও আবেদনময়ী কোনো নায়িকা আছেন কিনা। তবে বছর চারেক আগে শিশু-কিশোরীদের মুখে পরীমনি ড্রেসের গল্প শুনতাম। পরীমনির ড্রেস তাদের চাই এমন আবদার তারা তাদের বাবা-মায়ের কাছে করত। তখন নামটার সঙ্গে পরিচিত হওয়া। যতদূর জেনেছি পরীমনি মফস্বল থেকে আসা এক অসচ্ছল পরিবারের মেয়ে। পিতৃ-মাতৃহীন। নিন্দুকেরা সেটাও বাঁকা চোখে দেখলেন। খুঁজতে শুরু করলেন ধনী হওয়ার রহস্য। অথচ এই সমাজে গরিব কোনো পুরুষ অঢেল ধনসম্পদের মালিক হলে তার রহস্য কেউ সহজে উন্মোচন করেন না। খোঁজেন না। তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন না। বরং তার গলায় মালা পরিয়ে দেন। মান্য করেন। বর্তমানে দেশে যত ধনাঢ্য ব্যক্তি, পরিবার আছেন তাদের ইতিহাস নাড়লে পাওয়া যাবে আর্থিক ক্ষুদ্র পরিসর থেকে কীভাবে তারা বৃহত্তর পরিসরে পৌঁছেছেন।
বিচারের আগেই পরীমনির বিচারকার্য যেন সম্পন্ন করা হয়েছে। পরীমনিকে নিয়ে এতটাই টানাহেঁচড়া হয়েছে যে, মনে হয়েছে রাষ্ট্রের সব শৃঙ্খলা একমাত্র পরীমনির জন্য বিপন্ন হতে চলেছে। যেন পরীমনির বাসা থেকে ট্রাকভর্তি মাদক উদ্ধার করা হয়েছে এবং এখান থেকেই দেশের আনাচে-কানাচে মদ আর মাদক সরবরাহ করা হচ্ছে। আশ্চর্য হতে হয়, এমন ভাবসাব দেখে কর্তৃপক্ষের। তখন পরীমনির পেছনে কোনো প্রতিহিংসাপরায়ণ খলনায়কের গন্ধ মেলে। অনেকের ধারণা বোট ক্লাবের ঘটনার রেশ পরীমনির এই বিপর্যয়।
আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই যে, আইনের প্রয়োগ যেন সঠিক পথে এগোয়। বিচার হওয়ার আগেই কাউকে অপরাধী বলা যায় কিনা, তার সম্মান ক্ষুণ্ন করার অধিকার কেউ রাখেন কিনা প্রশ্নগুলো মহামান্য আদালতের কাছে রাখতে চাইছি। ’৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা নারীর সতীত্ব, সম্মান লণ্ডভণ্ড করেছে। পরবর্তীতে ৯০ দশকে স্বাধীন বাংলাদেশে নারীর প্রতি মৌলবাদীদের সহিংসতা শুরু হয়েছিল ফতোয়ার লেবাসে। আজ পর্যন্ত নারীরা সুরক্ষিত হতে পারেনি। অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর অবদান স্বীকৃত হলেও নারীর মর্যাদা পুরুষের ন্যায় স্বীকৃত হতে পারেনি। হয়নি নিশ্চিত নারীর সামাজিক নিরাপত্তা। প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন কন্যাশিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক নারী। এমন একটি অবস্থায় পরীমনির ঘটনা নারীর প্রতি আরো এক ধরনের প্রতিহিংসা, সহিংসতার অবতারণা, যা নারী সমাজকে ঝুঁকিতে ঠেলে দিচ্ছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের কাছে অল্পবয়সি নারীরা যাতে অরক্ষিত হয়ে না পড়ে তার নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। পরিশেষে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলব, পরীমনিকে সম্মানের সঙ্গে মুক্তি দেয়া হোক এবং তার অভিভাবকত্ব রাষ্ট্র নিক যেন পরীমনি তার শিল্পীসত্তা দিয়ে দেশের জন্য সম্মান বয়ে নিয়ে আসতে পারে। আর চলচ্চিত্র জগৎ সমৃদ্ধ হতে পারে। আসুন, তার শিল্পীসত্তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়