খুলনায় মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর : সম্প্রীতি পরিষদ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রতিবাদ

আগের সংবাদ

হার্ড ইমিউনিটি কতটা সম্ভব : নতুন নতুন ধরন নিয়ে শঙ্কা >> টিকার সুফল কিছুটা হলেও মিলবে : আশা বিশেষজ্ঞদের

পরের সংবাদ

তাৎক্ষণিক তৎপরতা এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী

প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনার কবলে সবাই। করোনা মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ যথা তৎপরতায় বাংলাদেশও। স্ব-স্ব দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির সম্ভাব্য সব সামর্থ্য নিয়োগ নিবেদন করে করোনা মোকাবিলায় গৃহীত সব পদক্ষেপ সাফল্যমণ্ডিত হচ্ছে, করোনার গজেন্দ্রগামিতার কারণে এ কথা বলা যাবে না। তা যদি হতো তাহলে করোনাকে এত বিশাল ক্ষতির বানের পাহাড় গড়তে দেয়া হতো না, এতদিনে তাকে রানআউট করে রীতিমতো সাজঘরে পাঠিয়ে দেয়া যেত। একেকটা ওভার শেষে করোনাকে আরো শক্ত ব্যাটিংয়ে দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে করোনা আনপ্রেডিকটেবল প্যানডেমিক হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছে। অন্তত বাংলাদেশে তাকে প্রতিরোধ ও মোকাবিলার নামে, তার প্রভাবক ভূমিকা (মানবমৃত্যু ও সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি, দারিদ্র্যসীমার অধোগতি, আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি, জীবন-জীবিকার টানাপড়েন ইত্যাদি) নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সফলতা ব্যর্থতার সমীকরণ কষলে তা বোঝা যায়।
করোনা মহামারি মোকাবিলার মতো বিপর্যয়ের সামনাসামনি হয়েছিল বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং স্বাধীনতা লাভের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্বাসন পুনর্গঠনকালে। সে সময়কার পরিবেশ পরিস্থিতিতে সমকালীন নেতৃত্ব যাদের প্রজ্ঞা ও প্রত্যুৎপন্নমতিতে পরিচালিত তাৎক্ষণিক তৎপরতায় সফলতা লাভ করেছিলেন আজ করোনা মোকাবিলার এই তাৎপর্যপূর্ণ পর্যায়ে তাদের কথা বেশি করে মনে পড়ে। আজ যাদের অভাব বড্ড বেশি অনুভূত হয় তাদের অন্যতম হলেন রাষ্ট্রপতি, মানবাধিকারের প্রবক্তা ও বুদ্ধিজীবী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (১৯২১-১৯৮৭), যিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ (১৯৪০), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ ও আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভের পর ইংল্যান্ডের লিংকন্স ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। খ্যাতনামা ছাত্রনেতা হিসেবে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (১৯৪০), নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক (১৯৪০) ও নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের ব্রিটিশ শাখার সভাপতি (১৯৪৬) নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন এবং ভারত বিভাগের পর ঢাকায় এসে ১৯৪৮ সালে ঢাকা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায়ে যোগ দেন। ১৯৬০ সালে আবু সাঈদ চৌধুরী পূর্বপাকিস্তানের এডভোকেট জেনারেল এবং ১৯৬১ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। তিনি পাকিস্তানের সাংবিধানিক কমিশনের সদস্য (১৯৬০-৬১) এবং বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের (১৯৬৩-৬৮) চেয়ারম্যান ছিলেন।
বিচারপতি চৌধুরী ১৯৬৯-এর ২০ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদানের জন্য জেনেভায় গমন করেন। বিদেশি বেতারে ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাক-বাহিনীর গণহত্যার সংবাদ শুনে জেনেভা থেকে লন্ডন আসেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ঢাকা থেকে ব্রিটিশ হাইকমিশন অফিস কর্তৃক সেখানে প্রেরিত টেলেক্স পড়ে জানতে পারেন বাংলাদেশে পাকবাহিনীর নিষ্ঠুর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিস্তারিত তথ্য। তার ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ (১৯৯০) গ্রন্থে বিচারপতি চৌধুরী অত্যন্ত পরিতাপ ও বেদনার বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন, ‘পাক সেনারা ২৫ মার্চের রাতে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায় তখন ছাত্র-শিক্ষকদের নিশ্চয়ই তাদের উপাচার্যের কথা মনে পড়েছিল’ অর্থাৎ সে রাতে তাদের উপাচার্য দেশে থাকলে তারা এভাবে নির্যাতনের শিকার হতে পারতেন না। বিচারপতি চৌধুরী এহেন অমানবিক পরিস্থিতিতে মর্মযাতনা থেকেই তাৎক্ষণিকভাবে উপাচার্যের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে পাকিস্তান সরকারের নিকট পদত্যাগপত্র প্রেরণ করেন। প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ অবলম্বন করেন। বিচারপতি চৌধুরী লন্ডনে ‘দ্য কাউন্সিল ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউকে’ গঠন করেন ২৪ এপ্রিল ১৯৭১ এবং মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত নিযুক্ত হন। লন্ডনের নটিংহিল গেটে বাংলাদেশ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন, যার ট্রাস্টি ছিলেন মি. ওয়ার অন ওয়ার্থের প্রেসিডেন্ট ডোনালড চেসওয়ার্থ, তৎকালীন ব্রিটিস হাউস অব কমনসের সদস্য এবং মন্ত্রী জন থমসন স্টোন হাউস (১৯২৫-১৯৮৮) এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সে সময় জনৈক সুবিদ আলী ছদ্মনামে বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি শিল্পোদ্যোক্তা, ইসলাম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জহুরুল ইসলামের (১৯২৮-১৯৯৫) আর্থিক সহায়তায় লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭১ সালের ২৭ আগস্ট, শুক্রবার। (দ্রষ্টব্য, ডেইলি স্টার পত্রিকার ২০০৮ সালের স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত সাবেক সচিব ও কূটনীতিক মহিউদ্দীন আহমেদের স্মৃতিচারণ)। বিচারপতি চৌধুরী ১ আগস্ট ১৯৭১ থেকে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত লন্ডনে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
স্বাধীনতার পর বিচারপতি চৌধুরী ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৩ সালের ১০ এপ্রিল পুনরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ওই বছর ২৪ ডিসেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘে সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যের অবসান এবং তাদের নিরাপত্তা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তিন বছর মেয়াদি এ পদে তিনি পরপর তিন বার নির্বাচিত হন। ১৯৮৫-১৯৮৬-তে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান।
জনাব এইচ টি ইমাম বিরচিত ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫’ (২০১৩) গ্রন্থে দেখা যায় বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালীন সরকারপ্রধান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫) নেতৃত্বে ও চিন্তা পরিকল্পনায় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, অর্থনীতি, আইন বিচার, সংসদ ও নির্বাহী বিভাগ (প্রশাসন) পুনর্গঠন পুনর্বাসনে তাৎক্ষণিক তৎপরতায় অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। প্রজ্ঞা ও মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় আইন, আদেশ, বিধিবিধান জারিতে আইনি দক্ষতা-দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পরের দিনই ১১ জানুয়ারি জারি করা হয় রাষ্ট্রপতির সাময়িক সংবিধান আদেশ-১৯৭২। তার একদিন পর ১৩ জানুয়ারি কৃষিজমির খাজনা ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বকেয়া ও সুদসমেত মওকুফ ঘোষণা করা হয়। ২৫ জানুয়ারি ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত জমির সেস মওকুফ করা হয় এবং পাট রপ্তানির ওপর প্রথম শুল্কারোপ করা হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি চলতি বছরের লবণ শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। আমরা আরো লক্ষ করি ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর গণপরিষদে দেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগে ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দ্য বাংলাদেশ (কম্পট্রলার এন্ড অডিটর জেনারেল) অর্ডার, ১৯৭২ (১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ১৫) জারি হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার, ২২ মে ১৯৭২ তারিখে জারিকৃত দ্য বাংলাদেশ (অ্যাডাপটেশন অব একজিসটিং লজ) অর্ডার ১৯৭২ (১৯৭২ সালের প্রেসিডেন্টস অর্ডার নং ৪৮) এ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত তদানীন্তন পাকিস্তান তথা পূর্ব পাকিস্তানে যেসব আইন বলবত ছিল তাকে বাংলাদেশে অ্যাডাপ্ট করা হয়। তার দুদিন পর ২৪ মে ১৯৭২ তারিখে জারি করা হয় দ্য ফাইন্যান্স (১৯৭১-৭২) অর্ডার ১৯৭২ (১৯৭২ সালের প্রেসিডেন্টস অর্ডার নং ৫২)। এখানে রাজস্ব আহরণ বিষয়ে বিদ্যমান যাবতীয় পদক্ষেপকে সংশোধন সংযোজন বলবতকরণের বিধান দেয়া হয়। পুরনো আইনগুলোকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে স্বাধীন দেশে সময়োপযোগী সংশোধন সংযোজন পরিমার্জনের ধীমান প্রয়াস সেখানে ছিল। স্বল্প সময়ে এতগুলো আইনের সংস্কার, সংশোধন, প্রমার্জন, বলবতকরণ সব বিষয়ে আমরা তদানীন্তন শিশু রাষ্ট্র ও সরকারের তাৎক্ষণিক তৎপরতারই পরিচয় পাই।
উদার গণতন্ত্রী, মানবতাবাদী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি গভীর আস্থাশীল বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিচারপতি চৌধুরী খ্যাতি অর্জন করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত সংগঠনে তার অবদান স্মরণীয়। বিশ্বভারতীর তৎকালীন আচার্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী (১৯১৭-১৯৮৪) বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে শান্তিনিকেতনের সেরা ডিগ্রি বা পদক ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেন ১৯৭২ সালে। বিচারপতি চৌধুরীই ছিলেন প্রথম বাংলাদেশি যিনি ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি প্রাপ্ত হন। দেশিকদের মধ্যে যিনি উত্তম তিনি দেশিকোত্তম। দেশগত প্রাণ-দেশপ্রেমে সেরা ব্যক্তি। নিঃসন্দেহে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন সেই বিরল ব্যক্তিত্ব। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও তাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ল’ ডিগ্রি প্রদান করে। তাঁর রচিত ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ (১৯৯০) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত একটি মূল্যবান গ্রন্থ।
ন্যায় নীতিনির্ভরতার সপক্ষে, সর্বজনীন মানবাধিকার ও মানবিক মূল্যবোধের পক্ষে বিচারপতি চৌধুরীর কণ্ঠ ছিল সোচ্চার, বলিষ্ঠ ও স্পষ্ট ছিল উচ্চারণ। এটি তিনি উত্তরাধিকারী সূত্রে লাভ করেছিলেন। তার পিতা আবদুল হামিদ চৌধুরী শুধু জমিদার ছিলেন না তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কাউন্সিলের স্পিকার ছিলেন। আবদুল হামিদ চৌধুরীকে ব্রিটিশ সরকার খানবাহাদুর উপাধি দিয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি এই উপাধি পরিত্যাগ করেছিলেন ব্রিটিশ রাজের অত্যাচারের প্রতিবাদে।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : কলাম লেখক, সাবেক সচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান- এনবিআর।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়