গণপরিবহন চালু, স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে শঙ্কা : লঞ্চ, বাস ও ট্রেনের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু

আগের সংবাদ

স্বাস্থ্যবিধি হটিয়ে খুলল সবই

পরের সংবাদ

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অপ্রতুলতা : করোনায় বাড়ছে ভিক্ষাবৃত্তি

প্রকাশিত: আগস্ট ১১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এন রায় রাজা : রহিমা বেগম। রান্নাবান্না, ঘরদোর মোছা, বাসন মাজার কাজ করতেন তিন চারটি বাসায়। স্বামী ছিলেন দিনমজুর। করোনা মহামারির কারণে বেশ কয়েক মাস আগে রহিমাকে বাসার কাজে যেতে নিষেধ করেছেন মালিকরা। এখন কাছ থেকে ছাঁটাই। বলেছেন, করোনা চলে গেলে এসো। ব্যাস, রহিমার রোজগার বন্ধ। করোনা কবে চলে যাবে তাও জানেন না তিনি।
আর তার স্বামী নুরু মিয়া রামপুরা বাজারে কোদাল ঝুড়ি নিয়ে প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে অপেক্ষা করেন ঠিকা কাজের জন্য। কিন্তু করোনাকালে তাও মিলে না। এখনো কাজের সন্ধানে প্রতিদিন কয়েক জনের সঙ্গে রামপুরা মার্কেটের সামনে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলেও কাজের ডাক আসে না। অথচ বাসায় দুটি বাচ্চা, বৃদ্ধা মা ও তালাকপ্রাপ্ত মেয়ে। তার ওপরে বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল সব মিলিয়ে প্রায় ১০-১২ হাজার টাকা খরচ। সময়মতো ভাড়া না দিতে পারায় মালিক প্রায়ই ঘর ছাড়ার হুমকি দিচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে করোনার কারণে তার ছন্দবদ্ধ জীবন তছনছ হয়ে গেছে। অগত্যা দুই বাচ্চা নিয়ে মসজিদের সামনে বা রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছেন রহিমা। অনেক সময় তার স্বামীকেও সন্ধ্যের দিকে মাথায় গামছা ঢেকে মসজিদের সামনে হাত পাততে দেখা যায়। তাদের মতে, বাচ্চাকাচ্চাসহ না খেয়ে মরার চেয়ে ভিক্ষা করা ভালো। কোনো সরকারি বা বেসরকারি সহায়তা এক মুষ্ঠি চালও কেউ দেয়নি, তাই ভিক্ষে না করে উপায় কি? এসব কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন তারা।
শুধু রহিমা বা তার স্বামী নন, করোনাকালে বাসাবাড়ির কাজ বা অন্য ছোটখাটো কাজ, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীসহ কাজ হারিয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। ধারদেনায় জর্জরিত হয়ে আর পেটে ক্ষিধের জ¦ালায় অবশেষে গত বছরখানেক ধরে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে হাজারো মানুষ। যাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, প্রায় দেড় বছরজুড়ে করোনার প্রভাবে শহর থেকে গ্রামে এখন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ২১ শতাংশ থেকে বেকারের সংখ্যা বর্তমানে তা প্রায় ৪২ শতাংশ।
এ বিষয়ে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের সভাপতি অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, করোনাকালে প্রচুর মানুষ কাজ হারিয়েছে। বাসা বাড়িতে যারা কাজ করত করোনায় তাদের সে কাজটিও নেই। আবার তারা যে সরকারি সেফটি নেট প্রোগ্রামের আওতায় ঢুকবে তাও হবে না। কারণ, তাদের নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। এরা অনেকেই রাস্তাঘাটে থাকে।
তিনি বলেন, তবে এরা যেখানে থাকে সেখান থেকে এদের তালিকা করে স্থানীয় কাউন্সিলর বা মেম্বার-চেয়ারম্যানরা উদ্যোগী হয়ে সহায়তা করতে পারেন। তাই সমাজের যারা বিত্তবান বা সমাজকর্মী তারা মিলে এদের একত্রিত করে সহায়তা দিতে পারেন। তাছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে এদের জন্য আলাদা ডাটা বেইজ করে সহায়তা করা প্রয়োজন। তিনি এদের জন্য মন্ত্রণালয়কে আলাদা করে তালিকা তৈরি করার কথা বলেন। তা না হলে করোনাকালে এরা না খেয়ে মারা যেতে পারে বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো মনে করে, দেশে যে হারে দরিদ্র মানুষ এবং কর্মহীনের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে সরকার যদি তাদের ন্যূনতম খাদ্য, অর্থ সহায়তা বা স্বাস্থ্যসেবা না দেয় তাহলে সমাজে নানা ধরনের দুর্বৃত্তায়ন ঘটবে। অরাজকতার সৃষ্টি হবে। মানবাধিকারকর্মীদের অভিযোগ, সরকারের সেফটি নেট প্রোগ্রামে প্রায়শ স্বজন পোষণ ও রাজনীতিকরণ হচ্ছে। এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বার অথবা মেয়ররা সরকারি অর্থ যেভাবে নয়ছয় করছেন, ইতোমধ্যে তার প্রচুর নমুনা রয়েছে মন্তব্য করে তারও নিন্দা জানিয়েছেন তারা।
মানবাধিকারনেত্রী খুশী কবির মনে করেন, করোনা মহামারির অভিঘাতে সারা বিশ্বের অর্থনীতি তছনছ হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে এর প্রভার অনেক বেশি। দিনের পর দিন লকডাউন, দোকানপাট, বাসসহ ছোট গাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ফুটপাতে ছোটখাটো ব্যবসা, ভ্যানে করে পসরা সাজিয়ে বেচাকেনা, সবকিছু বন্ধ থাকায় মানুষের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে পড়েছে। এমনকি বেসরকারি স্কুল, কেজি স্কুলের শিক্ষকরাও শুনেছি ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করছে, কেউ কেউ রিকশা চালিয়ে সন্তানদের মুখে দুমুঠো অন্ন দেয়ার চেষ্টা করছে। এদের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে খাদ্য বা আর্থিক সহায়তা দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু অধিকাংশ দরিদ্র কর্মহীন মানুষ তা পায়নি, বিধায় ভিক্ষাবৃত্তির মতো লজ্জাস্কর কাজে নামতে তারা বাধ্য হচ্ছে। এর চেয়ে খারাপ কাজও হয়তো করতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে। এদের ডাটা বেইজ করে সরকারের সেফটি নেট প্রোগ্রামের আওতায় আনার আহ্বান জানান তিনি। এ বিষয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নূরুজ্জামান আহমেদ বলেন, দেশে এখন প্রকৃত কত মানুষ ভিক্ষাবৃত্তি করছেন, এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এ নিয়ে কোনো জরিপও হয়নি। তবে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে তিনি জানান, বাংলাদেশে এখন আড়াই লাখের মতো ভিক্ষুক রয়েছেন, যা মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ। তবে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) হিসাবমতে, দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। তবে করোনার পরে ভিক্ষুকের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ ছাড়িয়েছে। যার একটা বড় অংশ রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে বর্তমানে ভিক্ষা করে জীবন নির্বাহ করছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, করোনার কারণে দরিদ্রের হার বেড়েছে। তবে সরকারের সেফটি নেট প্রোগ্রামের আওতা আমরা বাড়িয়েছি, প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন। এটা যাতে প্রকৃত দরিদ্র মানুষ পান সেজন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি (চেয়ারম্যান, মেম্বার, মেয়র) এদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহর গ্রামে ভিক্ষা বৃত্তি যে বেড়েছে তা তিনি স্বীকার করেন।
সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, পুরো রাজধানীজুড়েই অসংখ্য অসহায়, শিশু, নারী, বয়স্ক পুরুষ রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করছে। হেঁটে বা গাড়িতে করে চলাচলরত কাউকে দেখলেই সাহায্য চাইছেন তারা। অনেকেই দ্বারে দ্বারে গিয়ে হাত পাতছেন। এ সময় অনেক নারীর সঙ্গে থাকছে শিশু সন্তানরাও। মায়ের সঙ্গে তারাও করুণ চাউনি নিয়ে তাকিয়ে কিছু পাওয়ার আশায় হাত বাড়াচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়