নির্ধারণ হবে আশুরার তারিখ : জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভা বসছে আজ

আগের সংবাদ

সংক্রমণ ঠেকানোর কৌশল কী

পরের সংবাদ

ব্যাঙের ছাতা যখন মূল ছাতাকে ঢেকে ফেলে

প্রকাশিত: আগস্ট ১০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ক’দিন আগে গণমাধ্যমে খবর এবং নানা ধরনের প্রতিবেদন আকারে আওয়ামী লীগের নামে প্রায় ৩০০ অননুমোদিত সংগঠনের দৌরাত্ম্যের কথা ছাপা হয়েছিল, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নানা ধরনের আলোচনা হয়েছিল, সামাজিক গণমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় লক্ষ করা গেছে। দেশে এমনিতেই করোনা মহামারি গ্রাম পর্যন্ত গ্রাস করে ফেলেছে। তাতে মানুষের মধ্যে আগে যে করোনা নিয়ে অবহেলা চরম আকারে ছিল এখন মোটামুটি ভীতি ও আতঙ্ক অনেকটাই বিরাজ করছে। রোগী নিয়ে তাই অনেকেই শহরগুলোতে চিকিৎসার সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছে। ঢাকা শহরে বেশিরভাগ হাসপাতালে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার রোগীদের এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে বেড পাওয়ার নিরন্তর চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবও ব্যাপকভাবে ঘটছে। হাসপাতালে শত শত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী, বিশেষত শিশু এখন বেডের সংকটের মধ্যেও চিকিৎসা নেয়ার এবং পাওয়ার চেষ্টা চলছে। এমন দুঃসহ সময় আমাদের জাতীয় জীবনে আর কখনো নিকট অতীতে এসেছে বলে মনে পড়ে না। দীর্ঘ দেড় বছর করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে অনেকই নিঃস্ব, ক্লান্ত এবং আর্থিকভাবে সঙ্গতি হারিয়ে ফেলেছে। সরকার করোনা মোকাবিলায় একদিকে বারবার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করছে অন্যদিকে টিকা সংগ্রহে কূটনৈতিক নানা দৌড়ঝাঁপ দিয়ে মোটামুটি টিকা প্রদানের একটি স্বস্তির জায়গা সৃষ্টি করতে পেরেছে। তবে দেশে করোনা সংক্রমণ, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব, অর্থনৈতিক সংকট এবং ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থানের অভাব বৃহত্তর সমাজ জীবনে যে ধরনের অস্থিরতা তৈরি করেছে তার ফলে মানুষের মধ্যে মানসিক যন্ত্রণা এবং নির্লিপ্ততা তৈরি করেছে তাও এই সময়ে এক ধরনের বন্ধ্যত্বতার মধ্য দিয়ে সময় পার করার বেশি কিছু ভাবা যায় না।
তেমন সময়ে যখন রাজনৈতিক দল হিসেবে বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা অত্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মেই করা হতো। সেটি কিন্তু গত দেড় বছরে খুব বেশি একটা লক্ষ করা যায়নি। অধিকন্তু সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ টানা ১৩ বছর দেশের রাজনীতিতে প্রধান দল হিসেবে দেখা গেলেও তৃণমূল এবং মাঠপর্যায়ে দলের কর্মকাণ্ডে আগের মতো সক্রিয়তা লক্ষ করা যাচ্ছে না। তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠন স্থানীয় নেতাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় চলছে। কর্মী ও সমর্থকরাও এসব নেতার গণ্ডির আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এমনকি উপজেলা, জেলা পর্যায়েও দল আছে, দলের অনেক নেতার নামও শোনা যায় কিন্তু আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না। দলের অভ্যন্তরে নেতাদের গ্রুপিং ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। গ্রুপিংয়ের সঙ্গে যারা সক্রিয় থাকছে তাদের গ্রুপ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল কিংবা সাইডে রেখে যদি কিছু করতে পারে তাহলে তাতে একপক্ষ খুশি হলেও, অন্যপক্ষ বিরোধী অবস্থান নিতে বাধ্য হচ্ছে। বস্তুত বেশিরভাগ উপজেলা, জেলায় মন্ত্রী, এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র এমনকি দলের কোনো স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় ব্যক্তি দলের নামে যার যার প্রভাব ও বলয় সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। এই বলয়ের ভেতরে অন্যের প্রবেশ দুরূহ। সে কারণেই গ্রাম থেকে জেলার কোথাও আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতি স্বাভাবিক গতিতে পরিচালিত হচ্ছে না। দিবস পালনের ক্ষেত্রেও নেতায় নেতায় বিভক্তি ও বিরোধের ফলে কোথাও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই- এমনটি যে কেউ দাবি করে থাকেন। সর্বত্রই যিনি আগে থেকেই আছেন কিংবা এরই মধ্যে পদ-পদবি ও প্রভাব বৃদ্ধি করে নিজের অবস্থান দাঁড় করাতে পেরেছেন তার বাইরে গিয়ে কেউ কোথাও কিছু করতে পারছেন না, করতে দেয়াও হচ্ছে না। সবার মধ্যেই পদ, ক্ষমতা ও প্রভাব হারানোর আতঙ্ক কাজ করছে। তাই অন্যকে মাঠে রাজনীতি করার তেমন একটা সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। এটি দীর্ঘদিন থেকেই চলে আসছে। এর ফলে আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলের তৃণমূল থেকে ওপরের দিক পর্যন্ত নতুন কর্মী, সংগঠক বেড়ে উঠতে পারছে না। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দলের অভ্যন্তরে বিরাজমান পরিস্থিতি ও বন্ধ্যত্ব সম্পর্কে অবগত নন- এমনটি ভাবার কারণ নেই। কিন্তু দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দলের অভ্যন্তরের এ বিষয়গুলো নিরসন করা, দলে গতিময়তা সৃষ্টি করা, দলে সৎ, ত্যাগী, যোগ্য, প্রতিশ্রæতিশীলদের আগমন ও স্থান করে দেয়ার পথটি বাধামুক্ত করার তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে পারছেন না। সমস্যার জট কোথায় পাকিয়ে আছে তা আমাদের চাইতে দলের নেতাদের বেশি জানার কথা। কিন্তু তাদের বক্তব্যে বা কর্মে সেসব জট খুলে দেয়ার তেমন কোনো উদ্যোগ মাঠে দেখা যাচ্ছে না। ফলে শেখ হাসিনা দেশ চালাচ্ছেন কিন্তু দল দেশ পরিচালনায় শেখ হাসিনার নির্দেশ, উদ্যোগ এবং প্রত্যাশা পূরণে তেমন কোনো কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে দেখাতে পারছে না। বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে কোনো কোনো অঙ্গসংগঠন কোথাও কোথাও ধান কাটা, স্বাস্থ্যসেবা দেয়া, অভাবীজনে খাদ্য দিয়ে সাহায্য করার উদ্যোগ নিলেও দেশব্যাপী দলের ও অঙ্গসংগঠনের যেভাবে মাঠে সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা ছিল সেটি ঘটতে দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে দলের অভ্যন্তরে ব্যক্তিত্বের স্বার্থ ও অবস্থানগত দ্ব›দ্ব প্রকট থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া যাচ্ছে না, নিতে দেয়াও হয় না। এর ফলে আওয়ামী লীগ এখন জাতীয় এই দুর্যোগময় মুহূর্তে যেভাবে ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল সেটি ঘটতে দেখা যাচ্ছে না। মূল সংগঠন এবং অঙ্গসংগঠনের মধ্যে যখন এ ধরনের অন্তর্দ্ব›দ্ব চরম আকারে বিরাজ করে তখন ব্যাঙের ছাতার মতো লীগ নামকে ব্যবহার করে যে কেউ এলাকায় নব্য আওয়ামী লীগার পরিচয়ে নিজের অবস্থান জানান দিতে চেষ্টা করে। নতুন এসব ব্যানার এখানে-সেখানে টানানো থাকলেও এগুলোর কোনো কার্যকারিতা কোথাও দেখা যায় না। কিন্তু এলাকায় কেউ নতুন নামে পরিচিত হওয়ার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে থাকে। স্থানীয় আঞ্চলিক কিংবা জাতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন কোনো কোনো ব্যক্তির আশীর্বাদ থাকলে তো কথাই নেই। নানা সমীকরণ এসব ভুঁইফোড় কিংবা ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা নাম সর্বস্ব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের থেকে থাকে। এদের অনেকেই নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকে। অনেকেই এর মধ্যে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। তাদের প্রভাব অর্থবিত্তের কারণেই সমাজের ওপর পড়তে শুরু করেছে। এরা আবার নিজেদের স্বার্থেই একটি গোষ্ঠী, ক্যাডার, মাস্তান বাহিনী লালনপালন করছে। সমাজের বখাটে, লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়া কিংবা শক্তি-সামর্থ্যে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পারে এমন সব তরুণই এসব ব্যাঙের ছাতার নিচে আশ্রয় নিচ্ছে। এরা সমাজের অভ্যন্তরে নিজেদের দাপট, প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে নিজেদের আর্থিক চাহিদা পূরণ করে থাকে।
গ্রামে-গঞ্জে সরকারের নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প, নির্মাণকাজ, যোগাযোগ, যাতায়াত, পরিবহন ও প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়তি অর্থ আদায়ের সঙ্গে এরা নানাভাবে যুক্ত হয়ে যায়। গ্রামের অনেক তরুণ জীবনের সাফল্যের পথ হিসেবে এসব ব্যাঙের ছাতার বাহকের পেছনে অবস্থান নেয়। এরাই এসব ভুঁইফোড় ব্যাঙের ছাতার সংগঠনে স্থানীয় নেতাকর্মী হয়ে ওঠে। এ ধরনের একটি অশুভ শক্তির নিয়ন্ত্রণ গ্রাম থেকে জেলা এমনকি তারও ওপরের বিভাগীয় শহর ও রাজধানীর ওয়ার্ড বা ওপরের স্তরের দিকে বিস্তারিত হচ্ছে। এর নেটওয়ার্কের বাইরে গিয়ে কেউ কথা বলতে কিংবা মাথা তুলতে সাহস পায় না। দৃশ্যত সবাই আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে, ঘন ঘন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম এবং তার কন্যা শেখ হাসিনার আনুগত্য প্রকাশ করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতির ইতিহাস তাদের খুব একটা জানা নেই, পড়াশোনারও আগ্রহ নেই। বাংলাদেশের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ মতাদর্শের দ্ব›েদ্ব আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী, জনগণের পাশে নিয়ে যাওয়া, জনগণকে এর সঙ্গে যুক্ত করার আন্তরিক কোনো প্রয়াস খুব একটা দেখা যায় না। সে কারণেই রাষ্ট্র পরিচালনায় শেখ হাসিনা গত ১৩ বছরে যেসব সাফল্য অর্জন করেছেন তা সাধারণ জনগণের মধ্যে জানা ও স্বীকৃত থাকলেও এসব ভুঁইফোড় ব্যাঙের ছাতার সংগঠনের নেতাকর্মীরা ক্যাশ করার পরিবর্তে বিরূপ মনোভাব তৈরিতে অনেকটা ভূমিকা রেখে চলছে। মূলত এসব ভুঁইফোড় ব্যাঙের ছাতা সংগঠনগুলো চারদিক থেকে আওয়ামী লীগ নামক সংগঠনকে ঘিরে ফেলেছে, ঢেকে দিয়েছে দলের প্রকৃত মিনারটি। যে কারণে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চলছে এখন একটি ভুঁইফোড় ব্যাঙের ছাতাদের ছড়াছড়ি, যা মোটেও শুধু আওয়ামী লীগ দলের জন্যই নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এক অনাকাক্সিক্ষত শঙ্কার তৈরি করছে। কারণ ’৭৫-পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদর্শের বিপর্যয় ঘটানো হয়েছে, সংগঠন ভেঙে তছনছ করে দেয়া হয়েছে, প্রকৃত রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতিকে কঠিন করে দেয়া হয়েছে। ফলে দেশে আদর্শহীন ভুঁইফোড় নানা সংগঠনের জন্ম হলেও সমাজের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, ভারত বিদ্বেষ, সুবিধাবাদ, অশিক্ষা, দুর্বৃত্তপনা, ভোগবাদিতা, মিথ্যাচার, প্রতারণা ইত্যাদি নানা অপশক্তির যে বিস্তার ঘটেছে তার বিরুদ্ধে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের যে রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক নেতৃত্ব অত্যাবশ্যকীয় সেটি এই দৃশ্যমান ভুঁইফোড় সুবিধাবাদী ব্যাঙের ছাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অপশক্তির কারণে দেশ ভবিষ্যতে গভীর এক সংকটে পড়তে পারে। আশা করি আওয়ামী লীগের নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্ব বিষয়গুলোকে গভীরভাবে অনুধাবন করবেন।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়