চাঁদাবাজির মামলা ৪ দিনের রিমান্ডে দর্জি মনির

আগের সংবাদ

বন্যার পদধ্বনি : পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে

পরের সংবাদ

সাক্ষাৎকার : পংকজ ভট্টাচার্য >> বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার কিছু হবে না, তোরা সাবধানে থাকিস

প্রকাশিত: আগস্ট ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য। ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, স্বৈরাচার আইয়ুব-ইয়াহিয়াবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পালন করেছেন মুখ্য ভূমিকা। ছাত্র ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। ১৯৬৭ সালে আইয়ুব সরকার তার বিরুদ্ধে ‘স্বাধীন বাংলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দিয়ে তাকে কারাবন্দি করে। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক ধারার রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী, কৃতি ফুটবলার ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে ছিলেন সক্রিয়। একাত্তরে গেরিলা বাহিনীকে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক।
পঁচাত্তরের ১৩ জুলাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয় তার। তৎকালীন বুলগেরিয়ান রাষ্ট্রদূত বায়েজিদের এক সর্তকবার্তা পৌঁছে দিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন তিনি। শোকের মাস আগস্ট উপলক্ষে সম্প্রতি টেলিফোনে ভোরের কাগজকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বর্তমানে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি, প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ যেন ফিরে যান ছেচল্লিশ বছর আগে। খুলে বসেন রাজনৈতিক ইতিহাসের খেরোখাতা। বললেন, ১১ জুলাই ৮৭ বছর বয়সি রাষ্ট্রদূত বায়েজিত আমাকে গুরুতর সংবাদ জানালেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে সেনাবাহিনীর

মধ্যস্তরের অফিসারদের একাংশ একটা রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। পরদিন ১২ জুলাই আমি এ ব্যাপারে মুজিব ভাইকে অবহিত করতে ছুটে যাই। মুজিব ভাই খবরটা শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। বললেন, আমি কিছু না দিতে পারি স্বাধীনতা তো দিয়েছি। আমার বুকে অস্ত্র তাক করতে ওদের কী হাত কাঁপবে না!
তিনি বলেন, সারা জীবন জেল খেটেছি। আমাকে কিছু করতে চাইলে আমি নিজেই ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে চাদরটা কাঁধে দিয়ে আমার প্রিয় জনতার মধ্যে চলে যাব। আবার মানুষকে নিয়ে লড়াই-সংগ্রাম গড়ে তুলব। সেদিন বঙ্গবন্ধু নিজেই খুনিদের নাম বলেছিলেন নিজের অগোচরে। মেজর ডালিম, রশিদ ও ফারুকদের বিষয়টি তুলে ধরে বললেন, ওরা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে বলেই সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত। ওরা আবারো সেনাবাহিনীতে চাকরি ফিরে পেতে চায়, যা সেনানিয়মে সম্ভব নয়। তাই ব্যাংকের লোন নিয়ে ব্যবসা করতে তাদের বলেছি। ওরা তো এখন লোন পেয়ে ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর দৌড়ঝাঁপ করছে। আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না। কিছু হবে না। তোরা সাবধানে থাকিস। মণিদা, পীর হাবিবকে সাবধানে থাকতে বলিস।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম গায়েবানা জানাজা পড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন পংকজ ভট্টাচার্য। ৪ নভেম্বর প্রথমে ‘কাঁদো কাঁদো দেশবাসী’ শিরোনামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল নিয়ে ৩২ নম্বরের দিকে যান তারা। ভয়ঙ্কর ওই সময়ে পুলিশের বাধা ছিল পায়ে পায়ে। ৩২ নম্বর চত্বরের আগেই পুলিশের বাধা পেয়ে সেখানেই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। বক্তৃতা দেন মহিউদ্দিন আহমেদ। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন খালেদ মোশারফের মা। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বঙ্গবন্ধুর ১৭ জন মন্ত্রীর বৈঠককালে উপস্থিত হয়ে গায়েবানা জানাজায় অংশ নেয়ার অনুরোধ জানান। যদিও নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে একমাত্র মহিউদ্দিন আহমেদ ছাড়া আর কেউ সেখানে উপস্থিত হননি।
পংকজ ভট্টাচার্য বলেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তখন জেলে। যারা বাইরে ছিলেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সাজেদা চৌধুরী, দপ্তর সম্পাদক আনোয়ার চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগাযোগ করি। প্রথম প্রতিবাদ বামরাই করেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রথম মিছিল বের হয়। কিশোরগঞ্জে মিছিল করে। ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শোক মিছিল করি। গায়েবানা জানাজা করি। সবার সামনে ছিলাম আমি। পরদিন ইত্তেফাক ওই ছবিটি প্রকাশ করে আমার মাথায় লালবৃত্ত এঁকে। ডিসেম্বরে আমাকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। আমি ছয় মাস ভারতে ছিলাম। পরে দেশে ফিরে আসি। ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগসহ বামদলগুলো মিলে আবার লড়াই সংগ্রাম শুরু করি। কিন্তু আমাদের দাঁড়াতে দাঁড়াতে তিন-চার বছর লেগে যায়। এর আগেই কুখ্যাত ইনডেমিনিটি আইন করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয় খুনি চক্র।
১৪ আগস্ট অনেক রাত পর্যন্ত শেখ মণির বাসায় ছিলেন তিনি। কীভাবে যুবশক্তিকে কাজে লাগানো যায় এ বিষয়ে শেখ মণির একটি সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন। পরদিন এ ব্যাপারে একটি বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল তার। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সংবাদে হতবিহ্বল জাতির মতোই শোকে মূহ্যমান হন তিনি। মুজিব হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ সৃষ্টির মধ্যেই লুকিয়ে আছে মুজিব হত্যাকাণ্ডের বীজ। মুজিবনগর সরকারের দুটি দিক। একটি তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পক্ষের অন্যটি মোশতাকের কনফেডারেশনের পক্ষের। বঙ্গবন্ধু নিজেও তা জানতেন। ষড়যন্ত্র তখন থেকেই শুরু। তাজউদ্দীন দুই বছরের মাথায় মন্ত্রিত্ব হারালেন আর মোশতাক, তাহের ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী সবাই বহাল তবিয়তে আগস্ট পর্যন্ত থেকে গেল। এই গ্রুপটি প্রভাববলয় বাড়াতে থাকে বঙ্গবন্ধুর উদারতার ছায়াতলে। আমাদের ভাবি (বঙ্গমাতা) পানের কৌটা নিয়ে ডাইনিংরুমে খন্দকার মোশতাককে পান বানিয়ে খাইয়েছেন। মোশতাক ভালো অভিনয় জানত। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাতের সময়, মোশতাক বঙ্গবন্ধুকে বলে আপনার জীবদ্দশায় কিছু করব না। কথা রেখেছিল মোশতাক। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর দেহ লুটিয়ে পড়ার পরে সে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। বিদেশি ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, চীন, আমেরিকা, পশ্চিমা কিছু দেশ বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, স্বীকৃতি দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর।
পংকজ ভট্টাচার্য বলেন, বামপন্থি কিছু নেতা বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধিতা করেছিল। হক-তোয়াহা-সিরাজ সিকদার ও নকশালরা রাজশাহী অঞ্চলে থানা দখল করেছিল। মুসলিম বাংলার লিফলেট বিতরণ করেছে। ভাসানীর ‘হক কথা’ ভারত ও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রচারণায় তুঙ্গে ছিল। মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল। জাসদের কর্মীরা হত্যাকাণ্ডের দিন রাজপথে চারদিকে স্তব্ধ, ভয়ার্ত পরিবেশে ‘রুশ-ভারতের দালাল ধর’ স্লোগানে মিছিল করছিল। অন্যদিকে মোশতাকের ভাগনে ন্যাপ নেতা কাজী আব্দুল বারী মুখের ওপর মোশতাককে প্রত্যাখ্যান করেন। মোজাফফর আহমদ মোশতাককে সমর্থন দেননি। সিপিবি নেতারা কেউ মোশতাকের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেননি।
শ্বেতপত্র প্রকাশ কেন জরুরি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে হত্যা করতে চেয়েছে। বিচার যথেষ্ট নয়, ষড়যন্ত্রে কারা মদত দিয়েছে, কারা পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশকে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিল, তদন্ত করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার। অবশ্য আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কিছুটা ইঙ্গিত আমরা পেয়েছি খুনিদের বয়ানে। দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচনে শ্বেতপত্র প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়