হেফাজতের সহিংসতা : এজাহারনামীয় এক আসামি গ্রেপ্তার

আগের সংবাদ

বোল্টের সিংহাসনে বসলেন জ্যাকবস

পরের সংবাদ

সুবর্ণজয়ন্তী : ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’

প্রকাশিত: আগস্ট ১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বৈশ্বিক মহামারির মধ্য দিয়ে আমরা অতিক্রম করছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। এ বছরটিতে বাঙালির রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোরও স্বতন্ত্র সুবর্ণজয়ন্তী আমরা অনাড়ম্বর হলেও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। কোভিড পরিস্থিতির জন্য আড়ম্বরপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা কিংবা উদযাপনের মাধ্যমে এ স্মরণ অনুষ্ঠানগুলো আমরা লাখো-কোটি মানুষের সম্পৃক্ততায় প্রকট করতে পারছি না সত্য, কিন্তু আমাদের স্মৃতিসত্তায় উদ্ভাসিত ঘটনাবলি, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন আমাদের আবেগ মথিত ঘটনাবলি, যুদ্ধকালীন অবস্থায় বাঙালিদের পাশে দাঁড়ানো বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের মানবিক মূল্যবোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করা ঘটনাবলিকে আমরা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। তবে গুরুত্ব বিবেচনায় ছোটখাটো ঘটনাবলি হারিয়ে যায় ঠিকই! কতটাই বা আমরা মনে রাখতে পারি?
আজ ১ আগস্ট রবিবার। ১৯৭১ সালের ১ আগস্টও ছিল রবিবার। ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে শুরু হওয়া নিরস্ত্র অসহায় সাধারণ বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ, অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের ৫ মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে ততদিনে। নিজ মাতৃভূমিতে টিকতে না পেরে প্রাণের ভয়ে ৫ মাসেই ১ কোটি মানুষ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। এই বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর ভরণপোষণ ভারত সরকারের জন্য ছিল বাড়তি এক চাপ। শরণার্থীদের মানবেতর জীবনযাপনের চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরাসহ বিপন্ন ও বিপদগ্রস্ত শরণার্থীদের সব বিপদে পাশে থাকার মানবিক বার্তা নিয়ে একদল সংগীত ও যন্ত্রসংগীত শিল্পী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৎপর হয়েছিলেন। ভারতের পণ্ডিত রবিশংকরের পরামর্শে সমগ্র আয়োজনটি সফল করে তুলেছিলেন জর্জ হ্যারিসন। রবিশংকর বাংলাদেশের গণহত্যা ও সাধারণ মানুষের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের বিভিন্ন তথ্য জর্জ হ্যারিসনের কাছে পাঠিয়ে কনসার্টের বিষয়ে তার সমর্থন চেয়েছিলেন। এ সম্পর্কে হ্যারিসন তার ‘আই মি মাইন’ বইয়ে লিখেছিলেন : ‘বিষয়টি কী আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করলাম। আমার মনে হলো, কাজটার ব্যাপারে আমার বোধহয় তাকে সাহায্য করা উচিত। এভাবে জড়িয়ে গেলাম। পরে যা ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ হয়ে ওঠে। তারপর কনসার্ট করলাম আমরা। দুটি অনুষ্ঠান করেছিলাম। প্রথম অনুষ্ঠানের সব টিকেট বিক্রি হয়ে গেলে দ্বিতীয় কনসার্টটি করেছিলাম। কপালই বলতে হবে, সবকিছু ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছিল।’ পণ্ডিত রবিশংকরের প্রস্তাবে জর্জ হ্যারিসন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শুরু করেন। শিল্পী সংগ্রহ ও সমন্বয়সহ প্রায় ৩ মাসের প্রস্তুতি-প্রচারণার পর অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কোয়ারে ৪০ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট রবিবার দুপুর ২.৩০টা ও সন্ধ্যা ৮টায় এ কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়। এ থেকে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪১৮ মার্কিন ডলার আয় হয়। পরবর্তী সময়ে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানটি রেকর্ড এবং তথ্যচিত্র হিসেবে সমাদৃত হয়েছিল। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’র বিভিন্ন আয় থেকে ইউনিসেফের মাধ্যমে আড়াই লাখ মার্কিন ডলার ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য পাঠানো হয়। সেদিন দুটি পরিবেশনারই শুরুতে পণ্ডিত রবিশংকর ও ওস্তাদ আলী আকবর খান যন্ত্রসংগীত পরিবেশন করেছিলেন। তাদের দুজনকেই তবলায় সহযোগিতা করেছিলেন ওস্তাদ আল্লা রাখা খান। তাদের এই পরিবেশনার নাম ছিল ‘বাংলা ধুন’। তারপর জর্জ হ্যারিসনের ৮টি অনবদ্য সংগীতসহ তার প্রথিতযশা সংগীতবান্ধবরা একে একে নিজ নজ পরিবেশনাগুলো উপস্থাপন করেছিলেন। এই কনসার্টে কেবল শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না, উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মানবিক দুর্দশাগ্রস্ততা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকেও সচেতন করা। একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অন্যদিকে পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর তাণ্ডবে রক্তাক্ত ও বিপর্যস্ত বাংলাদেশ। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলাসহ সাহসিকতার সঙ্গে মৃত্যুকে আলিঙ্গনের দৃশ্য ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তেমনি এক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনও কম দুঃসাহসিক ছিল না। এই সাহসী উদ্যোগের জন্য জর্জ হ্যারিসন এবং পণ্ডিত রবিশংকর হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অকৃত্রিম বন্ধু।
এ কথা ঠিক যে, কোভিড মহামারি যদি আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে এতটা বিপর্যস্ত না করত, প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে যদি দীর্ঘতর না হতো তবে আজকের ১ আগস্টের এই দিনটির চেহারাই হতো অন্য রকম! শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের আগ্রহ-উচ্ছ¡াসে জাঁকজমক ও আড়ম্বরপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতায় সমগ্র দেশ মাতোয়ারা হয়ে উঠত! কেননা, আজ ইতিহাস প্রসিদ্ধ ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানটির ৫০ বছর- অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বর্ষে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’রও সুবর্ণজয়ন্তী! পণ্ডিত রবিশংকর, জর্জ হ্যারিসন, উস্তাদ আলী আকবর খান, আল্লা রাখা খান, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রিস্টন, রিঙ্গো স্টার, লিয়ন রাসেলের মতো মেধাবী ও মানবিক মুখগুলো সরাসরি আমাদের সামনে নেই। কিন্তু অসহায়, ছিন্নমূল, নিরন্ন ও বিপন্ন উদ্বাস্তু বাঙালিদের প্রতি এসব বরেণ্য মানুষের ভালোবাসার দৃষ্টান্ত অনন্ত নক্ষত্রের মতো বাংলাদেশের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অমানুষিক অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেতে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল ১ কোটি মানুষ। শরণার্থী শিবিরে খাদ্য ও মানবিক সহায়তার জন্য পণ্ডিত রবিশংকরের পরামর্শে জর্জ হ্যারিসন নিউইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন গার্ডেন স্কোয়ারে আয়োজন করেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’।
এই কনসার্ট উদ্বাস্তু বাঙালি শরণার্থীদের ‘মানবিক সহায়তার’ জন্য হলেও বৈশ্বিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরির ক্ষেত্রে ‘রাজনৈতিকভাবে’ও তা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সে সময়ে ‘বাংলাদেশ’ বলে কোনো রাষ্ট্রের কথাই জানত না অনেকে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সচেতন মানুষের চিত্রপটে যুদ্ধরত বাংলাদেশ যেন একটি ভৌগোলিক অবয়ব নিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। এর পেছনেও ছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’র অনন্য ভূমিকা। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন পশ্চিম পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে আর সেই অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে গণহত্যায় বাঙালি নিধনে তখন জর্জ হ্যারিসনের ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ বিশ্ববাসীর মানসচক্ষুকে বাংলাদেশের দিকে তাকানোর প্রেরণা সঞ্চার করেছিল, উদ্বুদ্ধ করেছিল। অসহায় ও বিপন্ন বাঙালি শরণার্থীদের পাশে সাহস ও মানবিক ঔদার্য নিয়ে দাঁড়ানোর জন্য স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বর্ষে সেসব মানুষের মহৎ প্রয়াসের কাছে আমাদের অবনত-মস্তক শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের মধ্যে জর্জ হ্যারিসন অন্যতম। তার জন্ম যুক্তরাজ্যের লিভারপুলে ১৯৪৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রতিভাসম্পন্ন জনপ্রিয় গায়ক এবং গিটার বাদক। এছাড়াও তার কর্মযজ্ঞের বিশাল ব্যাপ্তির মধ্যে ছিল সংগীত পরিচালনা, রেকর্ড প্রযোজনা এবং চলচ্চিত্র প্রযোজনা। বিশ্বখ্যাত সমকালীন ব্যান্ড সংগীত দল ‘বিটলস’-র অন্যতম চার পুরোধার তিনিও একজন হিসেবে বিখ্যাত। পপ সংগীতের জনপ্রিয় এই শিল্পীর সঙ্গে ভারতবর্ষের সংস্কার ও সংস্কৃতির অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল। অন্তরঙ্গ সখ্য গড়ে উঠেছিল ভারতীয় সংগীত ও যোগসাধনার একাধিক খ্যাতিমান ঋষির সঙ্গেও। তাই পণ্ডিত রবিশংকরের উৎসাহে ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন বিপন্ন শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু জর্জ হ্যারিসন ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে মৃত্যুবরণ করেন। হলিউডের ফরএভার সিমেট্রিতে দাহ শেষে তার দেহভস্ম ভারতের কাশির নিকট গঙ্গা ও যমুনা নদীতে ছড়িয়ে দিয়ে নিকটতাত্মীয়রা হিন্দুরীতিতে ভারতেই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকার অন্যান্য বিদেশি বন্ধুদের মতো পণ্ডিত রবিশংকর এবং জর্জ হ্যারিসনকে ২০১১ সালে মরণোত্তর সম্মানা প্রদান করে।
১ আগস্ট আমাদেরকে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশে’র কথা মনে করিয়ে দেয়ার পাশাপাশি এও মনে করিয়ে দেয়, তার মাত্র ৫ বছরের মাথায় এই আগস্টেই ঘটেছিল বাঙালি জাতির এক মহাবিপর্যয়! আমাদের মাথার ওপর ভেঙে পড়েছিল ৭ আসমানের পাথরসম বোঝা! অন্তহীন শোকের বোঝা! জাতীয় জীবনের অনেক আনন্দ, উদযাপনের অনেক বিষয় সেই শোকের স্রোতে কোথায় ভেসে যায় আমরা টেরও পাই না! শুধু অনুভব করি মধ্য শ্রাবণের ঘনঘোর বরষার বিষাদিত নিনাদে ক্যালেন্ডারের পাতায় আসে আগস্ট মাস। প্রতি বছর শোকের আগস্ট আসে বাঙালির মথিতচিত্তের আবেগে আপ্লুত হয়ে। প্রকৃতি আগস্টকে এমন শোকগ্রস্ত ও জর্জরিত করেনি, বেদনায়ও করেনি আচ্ছন্ন। কিন্তু আগস্ট এলে আমরা শোক ও বেদনায় জর্জরিত হই। আগস্ট বেদনাপ্লুত হয়ে উঠেছিল বিপথগামী কিছু সেনা অফিসারের কর্মকাণ্ডে, শোকগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল ক্ষমতালোভী নরপিশাচ ও হায়েনারূপী কিছু রাজনীতিকের জঘন্য কৃতকর্মে! আগস্টের বেদনার স্রোতধারা তাই নিরন্তর বয়ে চলে বাঙালির মরমে মরমে। কেননা, এই আগস্টেই সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আগস্ট সাধারণ শোককে ছাপিয়ে আমাদের গভীরভাবে শোকাতুর করে তোলে। বর্ষ গণনার ইতিহাসের কোনো এক সময় আগস্ট নাকি বছরের প্রথম মাস হিসেবে বিবেচিত হতো- আগস্ট থেকেই বছরের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ আগস্ট থেকেই অন্যান্য মাসের দিকে এগিয়ে যাওয়া। আমরাও আগস্ট থেকে, আগস্টের বেদনাবিধুর মর্মযাতনা বুকের মধ্যে গোপন করে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়েই তৎপর থাকি। আমরা সত্যিই এগিয়ে যাই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বহন করে চলি অন্তহীন শোকের ফল্গুধারার স্রোত!
আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়