শিরীন আখতার কর্মহীন মানুষের খাদ্যের দায়িত্ব সরকারের

আগের সংবাদ

ফ্রান্সের নারী নির্মাতার হাতেই এবার ‘স্বর্ণপাম’

পরের সংবাদ

সতর্ক থাকি, ঈদের আনন্দ যেন বেদনার স্রোতে ভেসে না যায়

প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কুরবানির ঈদ আসন্ন। ঈদের সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতির পাশাপাশি আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা রকমের আবেগ জড়িত। তাই সব সময়ই ঈদকে সামনে রেখে নগরবাসী মানুষের গ্রামে যাওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিনের চর্চায় নাড়ির টানে এরূপ বাড়ি ফেরা আমাদের সংস্কৃতিরও অনুষঙ্গ হয়ে পড়েছে। নগরবাসী বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে এই চর্চা বংশ পরম্পরায় চালু আছে। একে উপেক্ষারও উপায় নেই। শত বাধা-বিপত্তি এবং প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ঈদ উপলক্ষে মানুুষকে গ্রামে যেতে হয়। কারণ গ্রামের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এতটাই নিবিড় এবং গভীর যে, তা বর্ণনা এবং ব্যাখ্যার অতীত। আবার মানুষের এই আসা-যাওয়ার মধ্যে আবেগের পাশাপাশি অর্থনৈতিক চাঞ্চল্যও আছে। অর্থাৎ ঈদকেন্দ্রিক মানুষের চলাচলের মধ্যে অর্থনীতির সক্রিয়তার বিষয়টিও নানাভাবে জড়িয়ে আছে।
কিন্তু মানুষের গ্রামে যাওয়া-আসা কিংবা যে কোনো চলাচল আর আগের মতো নির্বিঘœ নয়- পদে পদে শঙ্কা, আশঙ্কা! করোনার দাপটের কাছে আমরা দিশাহারা! তাই সব চলাচলে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। সবাই এ বিষয়টি জানেন, বুঝেনও। কিন্তু তারপরও অধিকাংশ মানুষের মধ্যে সতর্কতা অবলম্বনের কোনো লক্ষণ দেখ যায় না। অনেকের মধ্যেই ‘যা হওয়ার তাই হবে’ কিংবা ‘করোনা হলে হবে, তাই বলে বাড়ি যাব না’ অথবা ‘করোনার ভয়ে ঢাকায় বসে থাকলে চলবে’ ইত্যাদি নানা রকমের কথা বলে এবং পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বাইরে বেরোনোর অভিযানে নেমে পড়েন! গত ঈদেও আমরা দেখেছি ফেরিতে ওঠার জন্য মানুষের প্রাণান্ত চেষ্টা, স্বাস্থ্যবিধির নাজেহাল অবস্থা! তখন মনে হয়েছে মানুষকে ঢাকায় আটকে না রেখে বরং বাড়ি যেতে দেয়াই ভালো। মানুষ বাড়ি যাক এবং বাড়ি থেকে ফিরেও আসুক। আমরা চাই সবার আসা-যাওয়াটা যেন নির্বিঘœ হয়, যেন পরিপূর্ণরূপে আনন্দের হয়। আমরা চাই সতর্কভাবে মানুষের আসা-যাাওয়া এবং ঈদের আনন্দ উদযাপন শেষ হোক। এও চাই যে, অসতর্কতার কোনো ফাঁক-ফোকর দিয়ে আমরা যেন আমাদের একদিনের আনন্দটাকে দীর্ঘদিনের বেদনার ভারে ন্যুব্জ করে না ফেলি। সুতরাং আনন্দ হোক সতর্কতার সঙ্গে- অতি সতর্কতার সঙ্গে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও সেই কবে থেকে নির্দিষ্ট কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। কিন্তু তা কার্যকর হচ্ছে না। আমরা যদি আমাদের এই চলাচলের সময় অন্তত একটি মাস্ক ভালোভাবে ব্যবহার করি তাহলে করোনার প্রকোপ থেকে নিজেকে যেমন মুক্ত রাখতে পারব তেমনি এর সংক্রমণ থেকে অপরকেও সুরক্ষা দিতে পারব। এই সুবিধাটি যখন স্বল্পমূল্যের মাত্র একটি মাস্ক থেকেই পাওয়া সম্ভব তখনো আমরা মাস্ক ব্যবহারে চরম উদাসীন থাকি, নানা রকমের অজুহাত দেখিয়ে প্রকৃতপক্ষে নিজেকেই ফাঁকি দিয়ে চলি! গত প্রায় দেড় বছরে ১৭ হাজার ৫শর মতো মানুষের করুণ মৃত্যুও মাস্ক ব্যবহারে আমাদের সচেতন করতে পারল না, এটাই আক্ষেপের বিষয়।
আসন্ন ঈদের অর্থনৈতিক পরিধি অনেক ব্যাপক এবং বহুমুখী। কুরবানির পশু লালনপালনকারী ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বড় বড় ব্যবসায়ীদের লগ্নিকৃত টাকা লাভসহ ফিরে পাওয়ার জন্য একাধিক গোষ্ঠী আছে। পশু প্রাপ্তি নিশ্চিত হওয়ার দাবিদার একটি বৃহৎ গোষ্ঠীর মানুষ আছেন। আর কুরবানি-পরবর্তী চামড়া ক্রয়-বিক্রয় ও বাজারজাতকরণ চক্রের সঙ্গেও যুক্ত আছে আরো বহু শ্রেণির ফড়িয়া, দালাল, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী! সুতরাং আসন্ন কুরবানির ঈদ কেবল নামাজ আদায়ের অনুষ্ঠান নয়- এর সঙ্গে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে আছে বিশাল ও বহুমুখী এক অর্থনৈতিক প্রবাহ। লাখ লাখ কোটি টাকার অর্থনীতি সঞ্চারিত হয় কুরবানির ঈদ উপলক্ষে। রাষ্ট্রেও অর্থনৈতিক গতিশীলতা সৃিষ্ট হয়। মানুষের স্বাভাবিক চলাচলে স্থবিরতা দেখা দিলে বুঝতে হবে অর্থনীতির চাকাও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
মূলত এই ঈদের সঙ্গে অর্থনীতির চাকা সক্রিয় ও গতিশীল থাকার বিষয়টি গভীরভাবে যুক্ত। তাই বিগত দুই সপ্তাহ কঠিন লকডাউন শেষে আসন্ন ঈদ সামনে রেখে মানুষের আবেগ ও অনুভূতিকে গুরুত্ব দিয়ে একদিকে যেমন লকডাউন শিথিল করা হয়েছে অন্যদিকে বিশাল অর্থনৈতিক প্রবাহকে সক্রিয় রাখার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই শিথিল পরিবেশের মধ্যে আমাদের ঈদ কতটুকু আনন্দময় কিংবা কতটুকু আতঙ্কগ্রস্ত হবে তা নির্ভর করছে আমাদের চলাচল-স্বভাব ও অন্যান্য কর্মাকণ্ডে সাবধানতা অবলম্বনের ওপর। বিগত ঈদের মতো যদি আমাদের অসতর্ক চলাচল অব্যাহত থাকে তবে আসন্ন ঈদ-আনন্দ যে নির্ভেজাল হবে না তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। রমজানের ঈদে মানুষের হুজুগে চলাফেরার কারণেই বর্তমান সংক্রমণ ও মৃত্যু হারের সঙ্গে আমাদের এক রকমের যুদ্ধ করতে হচ্ছে! উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধির সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আসন্ন কুরবানির ঈদ আমাদের মনে আশঙ্কা ও আতঙ্কের বিস্তারকে প্রলম্বিত করছে।
ইতোমধ্যে মানুষের বাড়ি যাওয়া শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য সতর্কতার কিছুই অবলম্বন করছেন না। ফলে বাড়ি যাওয়া থেকে শুরু করে ঈদপূর্ব কুরবানির হাট-বাজার এবং ঈদ-উত্তর চামড়া ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত সর্বত্রই আমরা মানুষের স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গের যে বিচিত্র কৌশল ও নমুনা দেখতে পাব- সে মহড়াই যেন শুরু হয়ে গেছে! সরকার নানা দিক বিবেচনা করে লকডাউন শিথিল করেছে। আমাদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ সচেতনতা এবং সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই প্রথমত আত্মরক্ষা এবং পরবর্তী বিভিন্ন ধাপে পরিবার রক্ষা, গ্রাম রক্ষা এবং দেশ রক্ষায় মনোযোগী হতে হবে। অর্থাৎ লকডাউনের এই শৈথিল্যের সময় ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় আমাদের শতভাগ স্বতঃস্ফূর্ত মনোযোগ দিতে হবে। যদি তা দিতে ব্যর্থ হই তবে শেষ পর্যন্ত ঈদের আনন্দস্রোত বেদনার মহাসমুদ্রে গিয়ে পতিত হবে। সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সংক্রমণ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত করোনা যে গাণিতিক সূত্র মেনে চলে এ তারই পরিণতি, এমনই হওয়ার কথা। তখন সে বেদনার ভার বহন কিংবা ভার লাঘব করা আমাদের পক্ষে সহজ হবে না। মাস্ক পরা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উপকারী অনুষঙ্গ তা আজ প্রত্যন্ত অঞ্চলের অশিক্ষিত মানুষও জানে। কিন্তু কোনো প্রকার বিধিনিষেধ মান্য করতেই আমাদের যত রকমের খামখেয়ালিপনা! স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সব কিছু জেনেশুনেও আমরা আত্মহননের পথটিই বেছে নিই! কিন্তু কেন এই পথ বেছে নিচ্ছি? আমাদের উদাসীনতা থেকে আমরা কি একটুও বিরত থাকতে পারব না?
মনপ্রাণ ভরে ঈদের আনন্দ উপভোগ করি ক্ষতি নেই- মনে করে শুধু এই উদযাপনের সঙ্গে আমরা সবাই যদি ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি তবে আশঙ্কার বেদনাগ্রস্ত সেই মহাসমুদ্রের বৈতরণী সহজেই পার হতে পারব। আর যদি উদাসীনতায় গা ভাসিয়ে দিই তবে করোনার ভয়াবহ স্রোতধারা আমাদেরও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে মৃত্যুর মহাসমুদ্রের উপান্তে! তাই এবারের ঈদ আনন্দ হোক অতি সতর্কতায়- সতর্কতার মধ্যে, সতর্কতার সঙ্গে।
করোনার সঙ্গে আমাদের দুর্বিষহ বসবাসের প্রায় দেড় বছর হতে চলেছে। ইতোমধ্যে সংক্রমণ প্রায় ১১ লাখের কাছাকাছি পৌঁছেছে। এ লেখা পর্যন্ত মৃত্যু ১৮ হাজার ছুঁই ছুঁই করছে। মৃত্যুর চলমান পরিসংখ্যানদৃষ্টে বলা যায় আগামী অল্প ক’দিনের মধ্যেই এ সংখ্যাটিও অতিক্রম করবে। ২০২০ সালের মার্চে শুরু হওয়া করোনায় মৃত্যু সংখ্যা পর্যায়ক্রমে কেবল বেড়েই চলেছে। মাঝখানে দৈনিক মৃত্যু সংখ্যা ৩-৪-এ নেমে এলেও বর্তমানে তা ২০০ সংখ্যার ঘর অতিক্রম করেছে। টানা কয়েক দিন দুশতাধিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে। গত বছর জুলাইয়ে আমরা সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখেছিলাম। এবারো জুলাই অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে মৃত্যু ও সংক্রমণের পরিসংখ্যানে গণিতের শক্তিশালী রূপটাকেই যেন মূর্ত করে চলেছে। অথচ আমরা আমাদের সচেতন ও সংবেদনশীল আচরণের মাধ্যমে তা প্রতিহত করতে পারতাম। স্বভাবের কাছে পরাজিত আমরা ক্রমশ করোনার কাছেও পরাজয় বরণের পটভূমি তৈরি করে চলেছি! আসছে আগস্টে আমরা কী অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে চলেছি তা ঈশ্বরই জানেন! সময় থাকতে সবার কাছে আমাদের প্রত্যাশা ঈদের আনন্দ শেষেও আমরা আনন্দস্রোতেই ভাসতে চাই। একটি কথা সবারই মনে রাখা জরুরি যে, আমাদের খামখেয়ালিপূর্ণ চলাচল ও উদাসীনতায় ঈদ আনন্দ যেন মহামারির বেদনার স্রোতে ভেসে না যায়। আমরা যেন সতর্ক থাকি।
ব্যবসায় বাণিজ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ মানবজীবনের এমন কোনো অতি আবশ্যকীয় বিষয় নেই যেখানে করোনার কারণে অপূরণীয় ক্ষতি হয়নি। অসংখ্য মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়ে দরিদ্র থেকে অতি দরিদ্রের কাতারে নেমে এসেছে। শুধু দৈশিক নয় বৈশ্বিক অগ্রযাত্রাও স্তম্ভিত হয়ে আছে করোনা মহামারির আগ্রাসী দংশনে। এমতাবস্থায় আমরা চাই না স্বজন হারিয়ে আমাদের ক্ষত ও ক্ষতি আরো বৃদ্ধি পাক। আমরা চাই না মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমাদের বেদনার অকূল স্রোতে ভাসিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন আমাদের কোনো বান্ধব-আত্মীয়-স্বজন।
আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়